(ইচ্ছে ছিল দুই পর্বেই সিরিজটা শেষ করবো। কিন্তু বিষয়টির পরিধির কথা চিন্তা করে, কয়েকটি পর্বে ভাগ করছি। আশা করি সাথে থাকবেন।)
প্রথম পর্বের লিংক
Click This Link
"এই সাআন সাআন সাআন... . এই মুকাদ্দার কা সিকান্দাররররর" দুই তিন জন তরুণের জটলা থেকে এই ধরণের অনেক হিন্দি ছবির নাম দিয়ে দৃস্টি আকর্ষন করা হতো নাজিমুদ্দিন রোড থেকে শুরু করে বেগম বাজার পর্যন্ত। এ রকম পকেট ছিল চকবাজার থেকে বেগম বাজার এবং মৌলবি বাজারে ঢোকার প্রবেশ পথে। সাত রওজা, চাদনি ঘাট, রহমতগঞ্জ থেকে হাজারিবাগ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এর পরিধি।
এরা স্থানীয় বেকার তরূণ। এলাকায় ছিচকে ষন্ডা বলেও কুখ্যাত। তাই পথযাত্রি বা রিক্সাযাত্রির যতই কর্ণে বিষ বহমান হোক না কেন, ভয়ে কেউ কিছু বলতো না। এরা বেশ্যার দালালদের মতই, ভিসিআরে হিন্দি ছবি দেখানোর জন্য দর্শক সংগ্রহ করতো। এবং নির্দিস্ট দর্শনীর বিনিময়ে, ভয়ংকর গলি ঘুপচি পেরিয়ে কোন একটা আধা ভাঙ্গা ঘরের হিন্দি ছবি উপভোগের জন্য নিয়ে যেতো। এরকম আড্ডাখানা ছিল প্রায় শ খানেক। যেখানে দিন রাত মিলিয়ে এক একটি শো তে ২৫ থেকে ৫০ জন দর্শক থাকতো। আর দিনে কতটা শো চলবে সেটা নির্দিস্ট ছিল না। মানুষ ভেদে ৫ থেকে ১০ টাকা করে প্রতি দর্শককে দিতে হতো। আর এভাবেই অবাঙ্গালি রাজাকার জাহাঙ্গির মোঃ আদেলের ভেঙ্গে পড়া কোমড় সিধে হতে থাকে।
কথা হচ্ছিল বাংলাদেশের চলচিত্র নিয়ে। এর মধ্যে ভিসিআরের প্রসঙ্গ আনার কারণ হলো, আমাদের চলচিত্রের (সাথে সামাজিক অবক্ষয়ের)ক্রমশ অবগতির জন্য এটি বিশাল একটি ভুমিকা রেখেছে।
আবারও ইতিহাসে চলে যাচ্ছি। গত পর্বেই লিখেছিলাম যে, ভারতের মত এত আগে না হোক, তাও জোড়াতালি দিয়ে নবাব বাড়ির কিছু তরুণদের উদ্যোগে সেই ১৯৩১ সালেই আমরা প্রথম চলচিত্রের স্বাদ নিয়ে ছিলাম। কিন্তু নবাব সলিমুল্লাহর ক্রমশ দেউলিয়াত্ব এবং পরে মৃত্যু, এবং অযোগ্য উত্তরসুরিদের কারণে বাংলাদেশি চলচিত্র মাধ্যম ধন্যাড্য পৃষ্ঠপোষকতা হারায়। এছাড়াও বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের ধনী ব্যাক্তিদের অনেকেই ১৯৪৭ সালেই বাংলাদেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যান। এই দলে অনেক জ্ঞানি গুনী ব্যাক্তিও ছিলেন বলে পুর্ব বঙ্গে শিক্ষিত ধনিদের শুন্যতা দেখা দেয়। অবশ্য কিছু শিক্ষিত মানুষ পশ্চিম বাংলা থেকে বাংলাদেশে আসলেও তাদের ট্যাকের ভার ছিল বেশ দুর্বল। ফলে রুটি রুজির ভাবনা তাদেরকে এক রকম শিল্প সাহিত্য থেকে দুরে রাখে। ( এ ব্যাপারে জহির রায়হানের কালজয়ি উপন্যাস সংসপ্তকে কিছুটা উল্লেখ করা হয়েছে।)
আগেই উল্লেখ করেছি যে, পুর্ব বঙ্গ বা বাংলাদেশের মানুষদের মধ্যে সিনেমার প্রতি উদাসীনতা থাকলেও, ভারত ও পাকিস্থানের মানুষদের মধ্যে এব্যাপার বেশ ভালো রকমেরই উৎসাহ ছিল। যেমন ধরুণ আমাদের প্রথম চলচিত্রটি ১৯৩১ সালে মুক্তি পেলেও, অবিভক্ত ভারতের বোম্বেতে সেই ৭ই জুলাই ১৮৯৬ তেই স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছয়টি নির্বাক চলচিত্রের প্রদর্শনি হয়েছিল। ১৮৯৮ সালে ভারতীয় সিনেমার অন্যতম পথিকৃত বলে খ্যাত হীরালাল সেন কোলকাতায় থিয়েটারগুলি সেলুলয়েডে বন্দি করা শুরু করেন।

এর আগে ১৮৯৭ সালেই হরিশ্চন্দ্র সখারাম নামে এক ব্যাক্তি ১২ স্বর্ণ মুদ্রায় ইংল্যান্ড থেকে সিনেমার ক্যামেরা কিনে আনেন। সেটা দিয়েই তিনি বেশ কয়েকটি প্রামান্য চিত্র তৈরি করেন। এর মধ্যে ১৯০৩ সালে লর্ড কার্জনের দিল্লি দরবারের অভিষেকটি বেশ উল্লেখযোগ্য।

ভারতীয় চলচিত্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রগামি বলে যাকে ধরা হয় সেই দাদা সাহেব ফালকে যে শুধু চলচিত্র নির্মান করে সফল হয়েছেন তা নয়। বরং উপার্জিত অর্থ তিনি বিনিয়োগ করেছিলেন ভারতীয় চলচিত্র উন্নয়নের জন্য। একারণে বর্তমান বলিউড তার কাছে চির কৃতজ্ঞ। একারণেই ভারতে চলচিত্রের অস্কার নামে খ্যাত পুরস্কারটি দাদা সাহেব ফালকের নামেই পরিচিতি।

ভারতীয়রা যে শুধু ছবি পরিচালনায় ছিল এমন না। বরং, বানিজ্যিক ভিত্তিতে সারা দেশে সিনেমা ছড়িয়ে দেবার জন্য সমানভাবে তৎপর ছিল। এফ বি থানেওয়ালার গ্র্যান্ড কিনেটস্কোপ এবং জামশেদজি ফ্রামজি মদনের মদন থিয়েটারের উদ্যোগে শুধু ভারতীয় নয়, এমন কি সুদুর আমেরিকার ছবিও সারা ভারতে পরিবেশনা করতো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতই ছিল আমেরিকান চলচিত্রের সবচেয়ে বড় বিদেশি বাজার। আপনারা জেনে অবাক হবেন যে, হলিউডের বিশ্বখ্যাত পরিবেশনা সংস্থা
ইউনিভার্সাল পিকচার্স সেই ১৯১৬ সালেই ভারতে তাদের শাখা স্থাপন করে।

ফলে দেশি বিদেশি বিনোদন লাভের আকাংখায় ভারতীয় সাধারণ মানুষ আরো বেশি ছবি দেখার দিকে ঝুকে পড়লো। তাই ভারতে সিনেমা হলগুলির সংখ্যা বেড়ে গেলো। এমন কি দর্শক সংকুলানের জন্য খোলা মাঠে তাবু খাটিয়েও ছবি প্রদর্শিত হতো।

এতো গেলো ভারতের খবর। ৪৭ এ ভারত ভাগের পর পঃ পাকিস্থানিরাও বসে থাকেনি। অবিভক্ত ভারতে বোম্বের পাশাপাশি লাহোরেও ফিল্ম স্টুডিও প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন একই দেশের মানুষ হিসেবে ভারতীয় চলচিত্র দুই যায়গাতেই নির্মিত হতো।
(চলবে)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




