আজ বুদ্ধিজীবি দিবস। এই দিবসটির সাথে খুব নিবিঢ়ভাবে জড়িত। তাই এই দিবসটি আসলে বরাবর কেমন বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। ডাকটিকেটে ডাঃ খোরশেদ আলী সরকার নামে আমার দাদার ছবি আছে, বাকী বুদ্ধিজীবিদের সাথে। (ছবির প্রথম সারির এক্কেবারে হাতের বাদিকে)
নাহ কোনদিন অহংকার হয়নি। শুধু আফসোস হয়েছে আমি এমন একজন এক মহান লোকের শুধু গল্পই শুনেছি, তার স্পর্ষ পাইনি, আজ তার জন্য কষ্ট লাগে, আর কিছুটা ভাল লাগে আমি তারই নাতনী।
আমার দাদা সেই ইংরেজ আমলে আমেরিকান সরকার থেকে ফেলোশীপ পেয়েছিলেন। দেশ দেশ করে যাননি। তিনি ইংরেজ খেদানো আন্দোলন করেছেন , তার বউকে নিয়েও।
একটু পেছনে ফিরে আসি। চার বোন দুই ভাইয়ের মধ্যে সদর আলী প্রধানের বড় ছেলেটি বেশ জেদী ছিলেন। মেট্রিক পরীক্ষার পরে তিনি তার হিন্দু দোস্তদের সাথে চরকা আন্দোলন । কংগ্রেস করতেন । এত বড় জমিদারী আর তার দেখাশোনা কোন কিছুতেই মন নেই ছেলের।খালি রবীন্দ্র, বঙ্কিম হালের শরৎ এইসব বই মুখ গুজে পড়তে থাকেন ।সদর আলী বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন। খালি রাজনীতি আর বই কিসব অবস্থা ছেলের । আবার ইংরেজী সাহিত্যও পড়া শুরু করেন । মাইকেল মধুসুদন দত্তের খুব বেশি ভক্ত ছিলেন। কঠিন কঠিন ইংরেজী সাহিত্য পড়ে তিনি মেট্রিক পাশের পর আর পড়াশুনা করতে চাইতেন না। ভাবতেন তিনি মাস্টারদের চেয়ে বেশি জানেন। তাকে কে শিখাবে ?? তিনি তাদের থেকে বেশি জানেন। ১৪/১৫ বছর বয়সে তিনি বাসা থেকে বেড়িয়ে চলে গেলেন যে সাধু হয়ে যাবেন, ধ্যান করবেন আর জগতের মায়া ছেড়ে শুধু মানব কল্যানে জীবন- যাপন করবেন। ২/ ৩ বছর তাকে খুজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তিনি ইণ্ডিয়া ভ্রমনে বেড়ুন। তিনি যাত্রাকালে বহু বিহারীদের সময় কাটান, তাদের সাথে সুখ-দুঃখের কথা বলতেন। একদিন এক ডাক্তারের কাছে অসুস্থ অবস্থায় তাকে পাওয়া যায়। সেখানে একজন দিনাজপুরের ডাক্তারের ঠিকানা পাওয়া যায় যার কাছে কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন। ইন্ডিয়ার ডাক্তারটি দিনাজপুরের ডাক্তারের কাছে টেলিগ্রাফ করেন তিনি শয্যাশায়ী হয়ে আছেন। । দিনাজপুরের ডাক্তারটি বাসায় পৌছে দিয়ে যান। কিন্তু তিনি তার ছত্রছায়ায় ডাক্তারি শিখা শুরু করেন। কিন্তু বাড়িতে তখন তাকে বিয়ে দিবে। লোকে পরামর্শ দিলেন ধরে বেন্ধে ছেলের বিয়ে দিয়ে দেন। ১৯-২০ বছরের ছেলে এত বেশি বুঝলে তো সমস্যা। সদর আলী খুজে খুজে ওইপারে পঞ্চগড়ের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের এক মেয়েকে খুজে বের করলেন, যাদের বাড়িতে শিক্ষার চল আছে।
কিন্তু দাদা শুনলেন যে মেয়ে পাঠশালায় যাইনি। বাড়িতে বউ তুলে তার সুটকেস ছুড়ে মারেন, বেড়িয়ে পড়ে শরৎ, বঙ্কিম এর বই। দাদী তার বড় ভাইয়ের কাছে সব পড়াশুনা শিখেছেন। আস্তে আস্তে খোরশেদ তার নিরিহ বউয়ের প্রেমে পড়া শুরু করেন। দাদীর হারমুনিয়াম ছিল। তিনি গান গাইতেন, কবিতা আবৃতি করতেন। তার কন্ঠস্বর অনেক মধুর ছিল। লেখালিখি করতেন। দুজনে মিলে সারাদিন বইয়ের গল্প। দাদা হোমিওপ্যাথিতে ডাক্তারী পড়া শুরু করেন।দাদীকে প্রাইভেটে ম্যাট্রিক ও ইন্টামিডিয়েট পড়ান। দাদী অনেক ভালো রেজাল্ট করেন। রায়গঞ্জে তিনি শিক্ষিকা ছিলেন। নিজের উৎসাহে তাতের কাজ শিখেন । মেশিন কিনে শাড়ি বুনা ও তার প্রশিক্ষনের জন্য মেয়েদের এক কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। দাদী টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং এ প্রথম হয়েছিলেন। এদিকে ছেলে মেয়ে সংসার পড়াশুনা আর পাগলাকে আচলে বেধে রাখা দুটাই করতেন দাদী। দাদা হোমিওপ্যাথিতে নাম জশ করেন। তিনি বেশ বিখ্যাত ডাক্তার ছিলেন।
আর চলত রাজনীতি। একজন করতেন মুসলমান (দাদী ) কংগ্রেস আর আরেকজন করতেন হিন্দু কংগ্রেস। আমাদের ইন্ডিয়ার রায়গঞ্জের বাড়িটাতে এইসবই চলত। ইংরেজরা টাকার উপঢৌকন, পরিবারের খেতাব কত লোভই দেখাল।
দাদীর হঠাৎ জরায়ুতে ক্যান্সার ধরা পড়ল। দেখতে দেখতে তিনি চলে গেলেন। দাদী খালি পাকিস্তানকে ভালবাসতেন । পাকিস্তানিরা মুসলিম ছিল দেখে দিনাজপুর আসতে চাইতেন। পাকিস্তানে আসতে চাইতেন। কিন্তু দাদা ভারত ভালবাসতেন । হিন্দু বন্ধুদের ভালবাসতেন। কিন্তু দেশভাগের সময় হিন্দুদের অত্যাচার এত বেড়ে গিয়েছিল যে বাধ্য হয়ে তিনি দিনাজপুরে চলে আসেন। দাদী মারা যাবার পর দাদা দিনাজপুরে টাউনে ভিটাবাড়ি কিনে সেটেল হলেন। সেখানেই তার ছোট্ট খাট্ট একটা ডাক্তারখানা ছিল । তাতে প্রেকটিস করতেন। তাকে সবাই ঠসা ডাক্তার নামে চিনতেন ।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কোন এক বিহারির হাতে তার ভিটেবাড়িতে তিনি নিহত হন। তিনি চার ছেলে ও জমজ মেয়ে রেখে যান। এসব তার মেজো ছেলে আমার মেঝোবাবু শওকত আলী এর বই বসত, দলিল ও ওয়ারিসে খুব সুন্দর করে পারিবারিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ আছে।
আজ বুদ্ধিজীবি দিবসে যারা বুদ্ধিজীবি দিবস আর মুক্তিযুদ্ধের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত তাদের সকল পরিবারকে শ্রদ্ধা ।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১:১৪