somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লিবিয়া যুদ্ধে আমি এবং আমাদের নিয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্স

২৫ শে নভেম্বর, ২০১১ রাত ৯:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অনেক দিন পর ব্লগে এলাম। এই জীবনে আর আসতে পারব কি না সন্দেহ ছিল। কিন্তু এলাম শেষ পর্যন্ত।

গত আটমাসে লিবিয়া জুড়ে যত যুদ্ধ হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধটি হয়েছে গাদ্দাফীর জন্মস্থান সিরতে। সিরতের মধ্যে যে এলাকাটিতে সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়েছে, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যে এলাকাটিতে তুমুল যুদ্ধ চলেছে এবং যে এলাকা থেকে শেষ পর্যন্ত গাদ্দাফীকে ধরা হয়েছে, তার নাম রক্বম এতনীন (এরিয়া নাম্বার টু)। আর দুর্ভাগ্যবশত আমরা ছিলাম সেই এলাকার অধিবাসী এবং যুদ্ধের শেষ পর্যন্তও আমরা হাজার হাজার মিসাইল এবং লক্ষ লক্ষ রাউন্ড গোলাগুলির মধ্যেও সেই এলাকাতেই ছিলাম। বাঁচব - এই আশা ছিল না। কিন্তু সম্ভাব্যতার সকল সূত্রকে ভুল প্রমাণ করে একমাত্র আল্লাহ্‌র অসীম অনুগ্রহে শেষ পর্যন্ত আমরা বেঁচে গেছি।

মুভির মধ্যে ওয়ার জেনরটা আমার সবচেয়ে ফেভারিট। দ্যা পিয়ানিস্ট, সেভিং প্রাইভেট রায়্যান, শিন্ডলার্স লিস্ট, হোটেল রুয়ান্ডা, ব্রাদারহুড অফ ওয়্যার সহ দেশ-বিদেশের সেরা সেরা যুদ্ধের প্রায় সবকটি মুভিই আমার দেখা। কিন্তু যে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা আমি নিজে প্রতক্ষ্য করেছি, সেটা নিঃসন্দেহে যেকোন সিনেমাকে হার মানায়। যে ঘটনাগুলো আমাদের জীবনে ঘটে গেছে, ভালো কোন ঔপন্যাসিকের হাতে পড়লে সেগুলো দিয়ে একটা কালজয়ী উপন্যাস লিখে ফেলা সম্ভব। কিংবা ভালো পরিচালকের হাতে পড়লে সেগুলো দিয়ে অস্কারজয়ী চলচ্চিত্র বানিয়ে ফেলাও অসম্ভব কিছু নয়। দুর্ভাগ্য সেরকম লেখনী বা পরিচালনা কোন রকম ক্ষমতা নিয়েই আমার জন্ম হয়নি। তাই আপাতত এই যুদ্ধে আমাদের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর সারমর্ম লিখেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে।

অবশ্য আমার ইচ্ছা আছে ভবিষ্যতে এই যুদ্ধের ঘটনাবলী নিয়ে ধারাবাহিকভাবে একটা আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস লেখার, যেখানে আমার অভিজ্ঞতা তো অবশ্যই, সেই সাথে এই যুদ্ধের মূল কারণ, যুদ্ধের জনসমর্থন, গাদ্দাফীর জনপ্রিয়তা, মিডিয়ার ভূমিকা প্রভৃতি বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ থাকবে। পড়ার অগ্রিম আমন্ত্রণ রইল।

১। যুদ্ধের প্রথম দিকে অর্থাত ফেব্রুয়ারি মাসে সিরতের পরিস্থিতি খুবই স্বাভাবিক ছিল। মিছিল সমাবেশ যা হতো সবই সরকারী আয়োজনে এবং গাদ্দাফীর পক্ষে। সেই সব মিছিলে অবশ্য জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই অংশ নিত। মার্চ মাসের ৪ তারিখে পুরো লিবিয়াতে ইন্টারনেট কানেকশন কেটে দেওয়া হয়। মার্চের ১৯ তারিখে ফ্রেঞ্চ-আমেরিকান-ব্রিটিশ বিমান আক্রমণ শুরু করে। প্রথম দুই সপ্তাহে সিরতেও বেশ কিছু ভয়াবহ বিমান হামলা হয়। দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টা ন্যাটোর উড়াউড়িতে কান ঝালাপালা হওয়া ছাড়া অবশ্য এতে সাধারণ মানুষের অবশ্য তেমন কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। প্রথম প্রথম ন্যাটোর বিমানের আওয়াজে ভয় লাগলেও পরে সেগুলো অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। মে-জুন-জুলাই মাসের দিকে সিরতে ন্যাটো একেবারেই উড়ত না। তখন সিরতের মানুষের পক্ষে বুঝাই সম্ভব ছিল না যে, লিবিয়ার অন্যান্য এলাকায় রকম ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে।

২। রোযার মাস থেকে সিরতের পরিস্থিতির অবনতি হতে শুরু করে। বিদ্রোহীরা মিসরাতা, জিনতান, নাফূসা মাউন্টেইন সহ বিভিন্ন এলাকার উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ফেলে এবং গুরুত্বপূর্ণ হাইওয়েগুলো দখলে নিয়ে নেয়, যার কারণে সিরতের সাথে ত্রিপলীর যোগাযোগ কঠিন হয়ে পড়ে। দোকান-পাট গুলো খালি হতে শুরু করে, পেট্রোলের অভাবে রাস্তায় ট্যাক্সি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, এমনকি, গ্যাস এবং বিদ্যুতের সংকটও শুরু হয়। রোযার মাঝামাঝি আমাদের গ্যাস শেষ হয়ে যায় এবং আমরা মাটির চুলা তৈরি করে কাঠ দিয়ে রান্না শুরু করি। শেষের দিকে অবশ্য শহরে কাঠেরও সংকট শুরু হয়। মানুষ মাজরায় গিয়ে আস্ত গাছ উপড়ে নিয়ে আসতে শুরু করে। এ সময় দুই দিন পরপর দুই-তিন ঘন্টা করে কারেন্ট দেওয়া হতো। অথচ এর আগে সারা জীবনে লিবিয়াতে মোট কত ঘন্টা বিদ্যুত ছিল না, সেটাও হাতে গুনে বলে দেওয়া যেত। গাদ্দাফী বাহিনীর দাবি ছিল বিদ্রোহীরা পাওয়ার সাপ্লাই কেটে দেওয়ার কারণে কারেন্ট নেই, কিন্তু এটা অনেকের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য ছিল না কারণ বিদ্রোহীরা ইচ্ছে করলে পানির সাপ্লাইও কেটে দিতে পারত। বরং গাদ্দাফী বাহিনী নিজেই ইচ্ছে করে কারেন্ট বন্ধ করে রাখত যেন মানুষ আল জাজিরা, আল আরাবিয়া দেখে দেশের প্রকৃত অবস্থা (অধিকাংশ এলাকা বিদ্রোহীদের দখলে) জানতে না পারে - এটা আরও অধিকতর বিশ্বাসযোগ্য ছিল।

৩। রমজান মাসের ২০ তথা আগস্টের ২০ তারিখে বিদ্রোহীরা ত্রিপলী আক্রমণ করে এবং অকল্পনীয়ভাবে প্রায় বিনা বাধায় মাত্র এক রাতের মধ্যে ত্রিপলী দখল করে ফেলে। গাদ্দাফীর তথ্যমন্ত্রী মূসা ইব্রহীম আগের দিনও বলেছিল ত্রিপলী দখল করা অসম্ভব কারণ গাদ্দাফীর অনুগত ৬৫,০০০ সৈন্য এবং সশস্ত্র সাধারণ জনগণ ত্রিপলী রক্ষা করবে। কিন্তু বাস্তবে তার কিছুই হয় নি। ত্রিপলীর গ্রীন স্কয়ার দখলের পরদিন ২২ তারিখে বিদ্রোহীরা টিভি সেন্টার এবং মোবাইল ফোন কোম্পানীগুলো দখল করে নেয়, সাথে সাথেই সবাইকে ৫০ দিনার (প্রায় ২৫০০ টাকা) করে উপহার দেয়, দীর্ঘ ছয মাস পর ইন্টারনেট উন্মুক্ত করে দেয় এবং "গাদ্দাফীকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য সবাইকে অভিনন্দ" এই জাতীয় একটা এসএমএস পাঠায়। এই এসএমএস মোবাইলে আসা মাত্রই সিরতে গাদ্দাফী বাহিনী নেটওয়ার্ক কেটে দেয়।

৪। ত্রিপলী দখলের পরপরই বিদ্রোহীরা নজর দেয় সিরত, সাবহা এবং বেনওয়ালিদের উপর। এরমধ্যে সিরত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ সিরত কোস্টাল হাইওয়ের উপর অবস্থিত। এবং ত্রিপলী বা মিসরাতার সাথে বেনগাজীর যোগাযোগের মাধ্যম হচ্ছে এই কোস্টাল হাইওয়ে। রোযার ঈদের পরপরই বিদ্রোহীরা বেনওয়ালিদ আক্রমণ করে। সেপ্টেম্বরের দুই তারিখ রাত ঠিক বারোটার সময় বিদ্রোহীরা বেনওয়ালিদ শহরের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে যায়। ঠিক যে মুহূর্তে আল জাজিরাতে এই সংক্রান্ত ব্রেকিং নিউজ পরিবেশন করে, তার পাঁচ মিনিট পরেই সমগ্র সিরতের বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। গ্যাস, ইন্টারনেট, ফোন আগেই বন্ধ ছিল। এবার কারেন্টও গেল। আমরা শুধু আল্লাহ্‌র কাছে দোয়া করছিলাম পানিটা যেন না যায়।

৫। সেপ্টেম্বরের ১০ বা ১১ তারিখে সিরতে একটা ভয়াবহ ঘটনা ঘটল। সিরতের রক্বম ওয়াহেদ (এরিয়া নাম্বার ওয়ান) নামক এলাকার অধিবাসীদের অধিকাংশই মিসরাতী ক্বাবিলার (গোত্রের) অন্তর্ভুক্ত এবং স্বভাবতই তারা গাদ্দাফীবিরোধী। কিন্তু সংখ্যালঘু হওয়ায় তারা এতোদিন নিশ্চুপ ছিল। তাদের অনেকে এমনকি মিছিলে সবুজ নিয়ে "আল্লাহ‌, মোয়াম্মার, ওয়া লিবিয়া, ওয়া বাস" অর্থাত "আল্লাহ, গাদ্দাফী অ্যান্ড লিবিয়া, অ্যান্ড দ্যাটস অল" স্লোগান পর্যন্ত দিয়েছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে অনেকেই গোপনে স্যটেলাইট ফোনের মাধ্যমে বিদ্রোহীদের সাথে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছিল। এরকম একজন ব্যক্তি ছিল আ'দ সাফরুনী। খবর পেয়ে গাদ্দাফী বাহিনী তাকে গ্রেপ্তারের জন্য যায়। ধরা খাওয়া মানেই নিশ্চিত মৃত্যু, তাই সে ধরা না দিয়ে বিদ্রোহীদের চাঁদ-তারা খচিত তিন বর্ণের পতাকা নিয়ে বেরিয়ে আসে। শুরু হয় গোলাগুলি। সাফরুনীর পুরো বাড়ি রকেট লঞ্চার দিয়ে ধ্বসিয়ে দেওয়া হয়। সে এবং তার এক ছেলে মারা যায়। গাদ্দাফীর পক্ষের মারা যায় আরও পাঁচজন।

গোলমালটা বাঁধে সাফরুনীর ছেলেকে নিয়ে। সে মারা গিয়েছিল ধারণা করে তাকে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখা হয়। কিন্তু লাশ গোসল করানোর জন্য বের করতে গিয়ে দেখা গেল যে সে আসলে তখনও মরে নি। এই খবর কোন এক আশ্চর্য উপায়ে মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে। এবং মিডিয়া তার স্বভাব অনুযায়ী ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে জীবন্ত মানুষকে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখার মতো এই অমানবিক ঘটনাকে বিশ্লেষণ করে। এর ফল হিসেবে মিসরাতার বিদ্রোহী যোদ্ধারা সিরত আক্রমণের জন্য দলে দলে এসে জমা হতে থাকে।

৬। ১৩ই সেপ্টেম্বর প্রথম আমরা একটু ভিন্ন ধরনের শব্দ পেলাম। এর আগে ন্যাটো যখন অনেক দূরে কোথাও বোমা ফেলত, তখন শব্দ যতটুকু হতো না হতো, সেই তুলনায় মাটি এবং ঘরের দরজা-জানালা কেঁপে উঠত অনেক বেশি। কিন্তু এই প্রথম আমরা অনেক দূর থেকে ধুপ-ধাপ জাতীয় এক ধরনের প্রতিধ্বনির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম, কিন্তু কোন কম্পন অনুভব করছিলাম। আমাদের অনেকেরই ধারণা হল এবং মাত্র চার-পাঁচ জন লিবিয়ান স্বীকার করল এগুলো ট্যাংক, মর্টার এবং আরপিজির (রকেট প্রপেলিং গ্রেনেড) আওয়াজ। বিদ্রোহীরা চল্লিশ কিলোমিটার পর্যন্ত চলে এসেছে। সেখানে যুদ্ধ হচ্ছে। কিন্তু সিরত রেডিও এবং সাধারণ লিবিয়ানদের মুখে তাদের সেই ক্লাসিক্যাল সুর। এগুলোর লিবিয়ান সেনাবাহিনীর (গাদ্দাফী বাহিনী) অনুশীলনের আওয়াজ। বিদ্রোহীরা সিরতের কাছাকাছি আসার প্রশ্নই উঠে না। কারণ সিরতে গাদ্দাফীর ২০,০০০ সৈন্য আছে। তাছাড়া লিবিয়ার সব জনগণই তো গাদ্দাফীকে চায়। বিদ্রোহীরা মূলত তালেবান এবং কাতার ও আরব আমিরাতের সৈন্য, তারা সংখ্যায় খুবই কম। সিরতে ঢুকবে কি, মিসরাতাই তো এখন আর তাদের দখলে নেই। সিরতের দিকে যখন এগোচ্ছিল, তখন লিবিয়ান সৈন্যরা দক্ষিণ দিকের সাহারা থেকে আক্রমণ করে মিসরাতা দখল করে ফেলেছে। একদিকে মিসরাতা পর্যন্ত এবং অন্যদিকে ব্রেগা পর্যন্ত গাদ্দাফীর দখলে। আর এক সপ্তাহের মধ্যেই পুরা লিবিয়া গাদ্দাফীর দখলে চলে আসবে।

৭। ১৪ই সেপ্টেম্বর একটু শান্ত ছিল। কিন্তু ১৫ই সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার দুপুর থেকেই মর্টারের শব্দ ধীরে ধীরে জোরালো হতে থাকে। সকালে আমি, আমার খালাতো ভাই শাওন, আমাদের প্রতিবেশী ইয়াসিন এবং শাকের সমুদ্রে গিয়েছিলাম মাছ ধরার জন্য। গত কয়েকমাস ধরে বাজারে কোন মাছ নেই। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে ডিম নেই, মুরগীও নেই প্রায় সপ্তাহখানেক ধরে। মাছ অবশ্য পাই নি, কিন্তু সেখানে একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম বিদ্রোহীরা নাকি সিরতের বিশ কিলোমিটারের মধ্যে চলে এসেছে। বাসায় ফিরে এসে দেখি আমার ছোটভাই তালহা ঘরে নেই। সে বাড়িওয়ালার ভাই মোত্তালেবের সাথে খুবজা কিনতে গেছে। খুবজার দোকানটা (কুশা) সিরত শহরের একেবারে শেষ প্রান্তে। বিদ্রোহীরা ঐদিক দিয়েই আসছে। মর্টারের আওয়াজ যত জোরালো হয়ে উঠতে লাগল, তালহার জন্য আমরা তত দুশ্চিন্তা করতে লাগলাম। বিকেল চারটার দিকে তালহা যখন রাস্তার দিক থেকে কান ফাটানো শব্দ হতে লাগল, ঠিক তখনই ধুলো ছিটিয়ে প্রায় ১২০ কিমি গতিতে মোত্তালেব গাড়ি চালিয়ে এসে ব্রেক করল এবং হাঁপাতে হাঁপাতে তালহা গাড়ি থেকে নেমে এল। তারা মাত্র নেমেছে, আর সাথে সাথেই রাস্তার দিকে মর্টার শেল এসে পড়তে লাগল।

তালহার মুখ থেকে যা শুনতে পেলাম তা হচ্ছে, তারা যখন কুশায় খুবজার জন্য লাইন ধরে দাঁড়িয়ে ছিল, তখন প্রথমে একজন লোক এসে খবর দিল যে বিদ্রোহীরা ২৩ কি.মি. পর্যন্ত চলে এসেছে। তার পাঁচ মিনিট পরেই আরেকজন এসে বলল বিদ্রোহীরা ১৭ কি.মি. পর্যন্ত এসে গেছে, সবাই যেন তাড়াতাড়ি বাসায় চলে যায়। লোকজন তার কথা বিশ্বাস না করে তাকে ধমকে ভাগিয়ে দিল। কারণ সবাই গাড়ির রেডিওতে সিরত রেডিও শুনছিল। সেখানে বলা হচ্ছিল, পঞ্চাশ কি.মি. দূরে যুদ্ধ হচ্ছে, স্বেচ্ছাসেবীরা যেন তাদের গাড়ি এবং অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে যায়। গাড়িতে বেশি পেট্রোল না থাকলেও সমস্যা নেই, ত্রিশ কি.মি. দূরের একটি ফিলিং স্টেশনে ফ্রি পেট্রোল দেওয়া হচ্ছে। দ্বিতীয় লোকটা চলে যেতে না যেতেই হঠাত কান ফাটানো শব্দ হতে থাকে এবং গাদ্দাফীর সৈন্যরা শহরের বাইরের দিকে ফিরে এসে কুশার সামনের গোল চত্বরে মেশিনগান এবং মিসাইল ফিট করে পজিশন নিয়ে ফায়ার করতে শুরু করে। সাথে সাথে সবাই দিগ্বিবিক শূণ্য হয়ে পালাতে শুরু করে। তালহা জোরে চিতকার করে কথা বলছিল কিন্তু আমরা সেটাও ঠিকমতো শুনতে পারছিলাম না। কারণ ততক্ষনে আমাদের সামনের গলিতে পজিশন নিয়ে গাদ্দাফী বাহিনী রাস্তার দিকে মেশিনগানের ফায়ার করা শুরু করে দিয়েছে। অর্থাত বিদ্রোহীরা শহরে ঢুকে পড়ছে।

বৃহস্পতিবারের সেই বিকেল আমাদের জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ দিনগুলোর মধ্যে একটা। কান ফাটানো শব্দ করে একটার পর একটা মিসাইল এসে আশেপাশে পড়ছে। উপর দিয়ে ন্যাটো প্রচন্ড শব্দ করে উড়ছে। গাদ্দাফী বাহিনীর মেশিনগান অবিরত বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষন করে যাচ্ছে। এর মধ্যে আমরা হঠাত অনেক মানুষের মিছিলের মতো আনন্দধ্বনি শুনতে পেলাম। আমাদের বাসার উত্তরে সমুদ্রের পাড় দিয়ে নতুন একটা রাস্তা গিয়েছে যেটা সমতল থেকে বেশ উঁচু, সেই রাস্তা দিয়ে বিদ্রোহীরা এগিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে হঠাত গাদ্দাফী বাহিনীর কয়েকটা ছেলে এসে আমাদের বাসার ঠিক সামনে থেকে আড়াল নিয়ে বের হয়ে সেই রাস্তা লক্ষ করে একটা আরপিজি মারল। ধোঁয়ায় চারদিক ভরে গেল। এবং ছেলেগুলো আরপিজি মেরেই দৌড়ে পালিয়ে গেল। বিদ্রোহীরা সেই রাস্তা ধরে আর না এগিয়ে পিছু ফিরে গেল। কিন্তু সেখান থেকে শহরের উপর এলোপাথাড়ি মেশিনগানের গুলি আর মিসাইল মারতে লাগল। আমরা এবং বাড়িওয়ালারা আমাদের বাসা থেকে বের হয়ে সামনে বাড়িওয়ালার ভাই হামজা নতুন বাড়ি বানাচ্ছিল, সেখানে আশ্রয় নিলাম। বাড়িটাতে এখনও দরজা-জানালা লাগানো হয় নি, কিন্তু এর ছাদটা তুলনামূলকভাবে একটু মজবুত। তাই মিসাইল পড়লে হয়তো একটু কম ভাঙবে। এরমধ্যেই ন্যাটো হঠাত একটা বোমা মারল আমাদের বাসা থেকে এক থেকে দেড়শ মিটারের মধ্যে। মনে হল পুরো ঘর যেন ভেঙ্গে মাথার উপর পড়ছে। কিন্তু না, পুরানো প্লাস্টার খসে পড়ে ছাড়া আর কিছু ঘটল না।

এই গোলাগুলির মধ্যেই আমাদের বাড়িওয়ালা কামাল তার যাবতীয় অস্ত্রশ্ত্র, অর্থাত আট-দশটা কালাশনিকভ রাইফেল, একটা স্নাইপার রাইফেল, তিনটা রকেট লঞ্চার এগুলো বস্তায় ভরে মাটি গর্ত করে লুকিয়ে ফেলল। কামাল নিরাপত্তা বাহিনীর কিছুতে চাকরি করত। প্রায়ই সে অস্ত্র নিয়ে ব্রেগা, রাস লানুফ প্রভৃতি শহরে গাদ্দাফীর যোদ্ধাদের সহযোগিতা করতে যেত। কিন্তু আজ যখন একেবারে ঘরের সামনে যুদ্ধ চলছে, সে তখন সব অস্ত্র মাটিচাপা দিয়ে বাচ্চা কোলে নিয়ে বউয়ের পাশে বসে আছে।

সেদিন শহরের ভেতর যুদ্ধ মাত্র দুই ঘন্টা স্থয়ী হয়েছিল। সন্ধ্যার সাথে সাথেই বিদ্রোহীরা ফিরে গেল। কিন্তু রেখে গেল একটি শহরের ধ্বংসস্তুপ। জায়গায় জায়গায় আগুন জ্বলছে। আমাদের গলি থেকে বেরুলে রাস্তার উপরেই যে ফার্নিচারের দোকান, সেটায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। আগুনের গন্দে বাতাস ভারী হয়ে গেছে। আমাদের নিঃশ্বাস নিতে পর্যন্ত কষ্ট হতে থাকে। কিছুক্ষণ পরেই অবশ্য শুনলাম গাদ্দাফী বাহিনী রাস্তায় মিছিল বের করেছে। তাদের দাবি, তারা বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে "ইঁদুরগুলোকে" তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। এটা তাদের মহা বিজয়।

রাতের বেলা আমাদের প্রতিবেশী নবী স্যার এবং ইয়াসিনের আব্বা রমজান আংকেল আসল আমাদের বাসায়। ইয়াসিনের ছোট বোন খাদিজা পালি গুলি খেয়েছে। ঘরের দেয়াল ভেদ করে গুলি এসে পায়ে ঢুকেছে। ঐ মুহূর্তে হসপিটালে নেওয়া সম্ভব ছিল না, তাই রমজান আংকেল নিজেই ব্লেড দিয়ে উরুর মাংস কেটে এরপর প্লায়ার্স দিয়ে টেনে গুলিটা বের করেছেন। পরে যুদ্ধ থামার পর হসপিটালে নিয়ে গেছেন। হসপিটালে গিয়ে শুনলেন তখন পর্যন্ত দেড়শ লাশ নেওয়া হয়েছে হসপিটালে।

আজকের মতো যুদ্ধ শেষ হয়েছে। গাদ্দাফী বাহিনী যতই দাবি করুক, তারা বিদ্রোহীদের তাড়িয়ে দিয়েছে, আমরা তো দেখেছি তারা তেমন কোন প্রতিরোধই করতে পারেনি। বিদ্রোহীরা এল, দেখল এবং মারল। আজ হয়তো সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় তারা চলে গেছে। কিন্তু কাল তো আবার আসবে। সিরতের তথাকথিত ২০,০০০ সৈন্যের বূহ্য ভেদ করে একবার যেহেতু তারা ঢুকতে পেরেছিল, আবারও পারবে। কিন্তু কথা হচ্ছে কতদিন এভাবে আসবে আর আক্রমণ করে চলে যাবে? এতোদিন শুধু দোয়া করতাম বিদ্রোহীরা সিরতে আসে না কেন, এসে দখল করে ফেললেই তো শেষ হয়ে যায়। কিন্তু একবেলার এই যুদ্ধ দেখে এখন মনে হচ্ছে বিদ্রোহীরা না এলেই ভালো হতো।

... চলবে ...


সিরত যুদ্ধের কিছু ছবি -

আরপিজি মারছে একজন বিদ্রোহী



হাইডলার রোড (আমাদের বাসা থাকে পৌনে এক কিমি দূরে) দখল করছে বিদ্রোহীরা



হাইডলার রোড



হাইডলার রোড



হাইডলার রোড



হাইডলার রোড



হাইডলার রোড



সিরত দখল করতে আসছে



মিসাইল মারছে



মিসাইল রেডি করছে



মিসাইল মারছে বিদ্রোহীরা


সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে নভেম্বর, ২০১১ রাত ৯:৩১
৩৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কম্বলটা যেনো উষ্ণ হায়

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৭


এখন কবিতার সময় কঠিন মুহূর্ত-
এতো কবিতা এসে ছুঁয়ে যায় যায় ভাব
তবু কবির অনুরাগ বড়- কঠিন চোখ;
কলম খাতাতে আলিঙ্গন শোকাহত-
জল শূন্য উঠন বরাবর স্মৃতির রাস্তায়
বাঁধ ভেঙ্গে হেসে ওঠে, আলোকিত সূর্য;
অথচ শীতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইউনুস সাহেবকে আরো পা্ঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চাই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪৪


আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি পুরো ১৫ মাস ধরেই ছিলো। মব করে মানুষ হত্যা, গুলি করে হত্যা, পিটিয়ে মারা, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারা, পুলিশকে দূর্বল করে রাখা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৬

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

শহীদ ওসমান বিন হাদি, ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

হ্যাঁ, সত্যিই, হাদির চিরবিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার এই মুহূর্তটিতেই তার খুনি কিন্তু হেসে যাচ্ছে ভারতে। ক্রমাগত হাসি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

'জুলাই যোদ্ধারা' কার বিপক্ষে যুদ্ধ করলো, হ্তাহতের পরিমাণ কত?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৫১



সর্বশেষ আমেরিকান ক্যু'কে অনেক ব্লগার "জুলাই বিপ্লব" ও তাতে যারা যুদ্ধ করেছে, তাদেরকে "জুলাই যোদ্ধা" ডাকছে; জুলাই যোদ্ধাদের প্রতিপক্ষ ছিলো পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, ছাত্রলীগ; জুলাই বিপ্লবে টোটেল হতাহতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?

লিখেছেন এ আর ১৫, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৩

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?


হাদিকে মারল জামাত/শিবির, খুনি নাকি ছাত্রলীগের লুংগির নীচে থাকা শিবির ক্যাডার, ডাকাতি করছিল ছেড়ে আনলো জামাতি আইনজীবি , কয়েকদিন হাদির সাথে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×