১। মেমেন্টো (Memento) - নন লিনিয়ার স্ট্রাকচারের সবচেয়ে ভালো উদাহরণ ক্রিস্টোফার নোলানের ছবি মেমেন্টো। এটা শুধু নন লিনিয়ার স্ট্রাকচারে নয়, একেবারে রিভার্স ক্রনোলজিক্যাল স্ট্রাকচারে তৈরি। অর্থাত্ এর কাহিনী শেষের দিকে প্রথম দিকে এগোয়। সিনেমাটা মূলত রঙ্গিন, কিন্তু পরপর দুটো রঙ্গিন দৃশ্যের মাঝে স্বল্প ব্যাপ্তির একটা করে সাদাকালো দৃশ্য আছে। সিনেমার একেবারে শুরুতে দেখানো হয় শেষ দৃশ্যটা, তার পরে দেখানো হয় তার আগের দৃশ্যটা, তার পরে তারও আগের দৃশ্য ... এভাবে। এই রঙ্গিন দৃশ্যগুলোর মাঝে মাঝে যে সাদাকালো দৃশ্যগুলো দেখানো হয়, সেগুলো কিন্তু আবার কাহিনীর শুরু থেকে সামনের দিকে এগোতে থাকে থাকে। একেবারে শেষ দৃশ্যে এসে রঙ্গিন এবং সাদাকালো দৃশ্য মিলে এক হয়ে যায় এবং দর্শকদের দেওয়া হয় চূড়ান্ত এক চমক। ভয়াবহ জটিল এই ছবিটার মর্মোদ্ধার করার জন্য কমপক্ষে তিনবার দেখা বাধ্যতামূলক।
এই ফিল্মে শর্টটার্ম মেমরী লসে আক্রান্ত এক ব্যক্তি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তার স্ত্রীর হত্যাকারীকে খুঁজে বেড়ায়। তার শরীরে আঁকা ট্যাট্টু এবং অন্যান্য সূত্র থেকে প্রতিবার তাকে বুঝে নিতে হয় সে কে এবং তাকে এরপর কি করতে হবে। কারণ প্রতিবারই পনের-বিশ মিনিটের বেশি সময় পরপর সে তার সাম্প্রতিক স্মৃতিগুলো হারিয়ে ফেলে। সিনেমাটা শেষ থেকে শুরু করার ফলে যেই চমত্কার ব্যাপারটা ঘটেছে, সেটা হলে সিনেমার প্রতি মুহূর্তে নায়ক যতটুকু জানে, দর্শকও ঠিক ততটুকুই জানে, নায়কের কাছে যে ব্যাপারগুলো অস্পষ্ট, সেগুলো দর্শকের কাছেও অজানা। তাই দর্শক অনকেটাই নায়কের মানসিক অবস্থার কাছাকাছি যেতে পারে।
২। দ্যা প্রেস্টিজ (Prestige) - ক্রিস্টোফার নোলানের আরেকটি অসাধারণ ছবি। দুই ম্যাজিশিয়ানের প্রতিদ্বন্দিতার কাহিনী। দুই বন্ধু ম্যাজিশিয়ানের শত্রুতা শুরু হয় যখন একজনের একটু অসাবধানতা বা অজ্ঞানতার জন্য শো দেখানো অবস্থাতেই অন্যজনের স্ত্রী মারা যায়। এরপর থেকেই তারা একজন আরেকজনের শো ভুন্ডুল করে দিতে এবং অন্যজনের ম্যাজিকের গোপন কৌশল উদ্ধার করতে উঠেপড়ে লাগে।
ম্যাজিকে মানুষকে গায়েব করে দেওয়ার বা টেলিপোর্ট করার প্রসঙ্গ ধরেই মুভিতে চলে আসে বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন এবং তার প্রতিদ্বন্দী পাগলাটে বিজ্ঞানী নিকোলা টেসলার কথাও। মুভির বড় একটা অংশ জুড়ে টেসলাকে দেখানো হয়, যেখানে তিনি টেলিপোর্ট করার একটি মেশিন আবিষ্কার করেন। এই টেলিপোর্টেশন যন্ত্র ব্যবহার করতে গিয়েই মুভির মূল প্যাঁচ শুরু হয়। শুধু নন লিনিয়ার ন্যারেটিভ স্টাইলের স্ক্রীপ্টের জন্য না, অসাধারণ ডায়লগ আর চিত্রনাট্যের জন্যও এই সিনেমার কথা চিরজীবন মনে রাখা যায়। মেমেন্টোর মতো এটাও ভয়াবহ জটিল একটা সিনেমা, কমপক্ষে দুইবার না দেখলে এর কাহিনী বুঝা সম্ভব না।
৩। ফলোয়িং (Following) - এটাও ক্রিস্টোফার নোলানের। এবং এটা হচ্ছে তার প্রথম ছবি। অত্যন্ত স্বল্প বাজেটে নিম্ন মানের ক্যামেরা এবং লাইটিং ব্যবহার করে, সাদাকালোতে তৈরি এবং বন্ধু-বান্ধবদেরকে দিয়ে কাজের ফাঁকে ফাঁকে ছুটির দিনগুলোতে অভিনয় করানো এই মুভিটা একটু কম পরিচিত হলেও যারা দেখেছেন শুধু তারাই বলতে পারবেন এটা কত দারুণ একটা ছবি।
এক লেখক উদ্দেশ্যহীন ভাবে রাস্তায় অপরিচিত লোকজনকে অনুসরণ করত। এরকম করতে গিয়েই একদিন সে আরেকজনের হাতে ধরা খায়, যে নিজেও অনেকটা এই চরিত্রেরই অধিকালৱরী। এরপর তারা দুইজনে মিলে অপরিচিত লোকজনের ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র উল্টাপাল্টা করে রেখে আসতে শুরু করে। এভাবে একদিন এক মহিলার বাসায় ঢুকার পর থেকেই শুরু হয় জটিলতা। জটিল এই মুভিটায় একই সাথে পাশাপাশির তিন ধরনের টাইমলাইনে কাহিনী এগুতে থাকে। সিনেমার শেষে গিয়ে তিন কাহিনী একসাথে এসে মিলে যায়।
৪। পাল্প ফিকশন (Pulp Fiction) - কুয়েন্টিন টারান্টিনোর মাস্টারপীস এটি। এই পরিচালকের বেশিরভাগ সিনেমাই বিভিন্ন চ্যাপ্টারে বা সেগমেন্টে ভাগ করা থাকে। এটা হচ্ছে সেই ধারার মৌলিক ছবি। মূল ঘটনাটি কয়েকটি সেগমেন্টে ভাগ করে দেখানো হয়।
প্রথমে যে হোটেল ডাকাতির দৃশ্যটি দেখানো হয়, সেটা আসলে শেষ দৃশ্যেরই একটা অংশ। পরের সেগমেন্টগুলোতে ঐ হোটেল ডাকাতির আগের এবং তার সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন ঘটনা দেখানো হয়। একেবারে শেষ সেগমেন্টে এসে হোটেল ডাকাতির দৃশ্যটার বাকি অংশ দেখিয়ে সিনেমাটা শেষ করা হয়। টারান্টিনোর অন্যান্য ছবি যেমন রিজারভয়ার ডগস এবং ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডসেও এরকম চ্যাপ্টারভিত্তিক দৃশ্য দেখানো হয়, যদিও সেগুলো ঠিক নন লিনিয়ার না।
৫। ৫০০ ডে'স অফ সামার (500 Days Of Summer)
চমত্কার একটি রোমান্টিক কমেডি এটি। ডায়লগগুলো বেশ সুন্দর। দুই প্রেমিক-প্রেমিকার প্রেমের ৫০০টি দিনের মধ্যে বিভিন্ন দিনের ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্নভাবে দেখানোর মধ্যদিয়ে তাদের সম্পর্কের নানা দিক তুলে ধরা হয়।
৬। অ্যাটোনমেন্ট (Atonement)
খুব সুন্দর একটি রোমান্টিক ড্রামা। সামান্য একটু ভুল বুঝাবুঝির কারণে কয়েকজন মানুষের জীবনে কতবড় ওলট-পালট ঘটে যেতে পারে, তারই চমত্কার উদাহরণ এই ছবিটি।
৭। দ্যা ইংলিশ পেশেন্ট (The English Patient)
বেস্ট পিকচার সহ মোট আট বিভাগে অস্কারজয়ী এ ছবিতেও নন লিনিয়ার ন্যারেটিভ স্ট্রাকচার ব্যবহার করা হয়েছে। এই মুভিকে অবশ্য একটা কাহিনী না বলে অনেকগুলো কাহিনীর সমষ্টি বলা যায়।
৮। সিটি অফ গড (City Of God)
অপেশাদার অভিনেতাদের অভিনয়ও কত অসাধারণ হতে পারে তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ এই ছবিটি। মুভিটা দেখার সময় মনেই হয় না কোন সিনেমা দেখছি, মনে হয় এগুলো বস্তব ঘটনা, গোপন ক্যামেরা দিয়ে ভিডিও করা হয়েছে - অভিনয়, মেকিং সবকিছু বাস্তবের এতো কাছাকাছি!
৯। দ্যা বাটারফ্লাই ইফেক্ট (The Butterfly Effect)
এই মুভির বাজেট যদি আরেকটু বেশি হতো, মেকিংটা যদি আরেকটু ভালো হতো এবং এর অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও যদি আরেকটু ভালো কাজ দেখাতে পারত, তা হলে এর কাহিনী এবং চিত্রনাট্য যেরকম দারুণ, এটা একটা অসাধারণ মুভি হতে পারত। প্রথম একঘন্টা তো আমি বুঝতেই পারিনি কি দেখানো হচ্ছে। সিনেমার শেষের দিকে এসে যখন বুঝলাম, একটানা দুই মিনিট স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম। এই মুভির কাহিনীর কাছাকাছি আইডিয়া নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের একটা উপন্যাস আছে - নিষাদ। উপন্যাসটাও আমার কাছে দারুণ লেগেছে।
১০। মূল হল্যান্ড ড্রাইভ (Mulholland Drive)
ব্যাতিক্রমধর্মী পরিচালক ডেভিড লিঞ্চের পরিচালনায় অদ্ভুত একটি পরাবাস্তবতার ছবি। স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলা এক তরুণী আশ্রয় নেয় সিনেমায় অভিনয় করতে ইচ্ছুক আরেক তরুণীর বাসায়। দুজনে মিলে তার পরিচয় বের করতে চেষ্টা করে, তাদের পেছনে কারা যেন তাড়া করে, এর মধ্যে তাদের দুইজনের মধ্যে অদ্ভুত এক সম্পর্ক গড়ে উঠে। কিন্তু যাকিছু ঘটছে, সেগুলো কি বাস্তব, নাকি স্বপ্ন, নাকি স্মৃতিশক্তিহীন মেয়েটির কল্পনা, বুঝা বেশ কষ্টকর হয়ে উঠে। স্বপ্ন এবং বাস্তবের মিশ্রণে তৈরি অদ্ভুত ধরনের জটিল এই মুভিটি সবার কাছে ভালো নাও লাগতে পারে, কিন্তু পরিচালকের মাথায় যে কিছু একটা আছে এটা সবাই স্বীকার করতে বাধ্য হবে।
১১। ট্রায়াঙ্গেল (Triangle)
এই মুভিটা আমার মতে খুবই আন্ডাররেটেড একটা মুভি। সম্ভবত এর কারণ হচ্ছে এই জাতীয় কাহিনীর মুভি প্রচুর আছে। কিন্তু আমার কাছে এটা খুবই দারুণ লেগেছে। বারমুডা ট্রায়্যাঙ্গেলে গিয়ে টাইম লুপে পড়ে যাওয়া কিছু মানুষের মৃত্যুর পূর্বের ঘটনাগুলো এখানে বারবার লুপের বিভিন্ন অংশের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখানো হয়, যেখানে মেয়েটা বারবার চেষ্টা করে এই লুপ থেকে বেরিয়ে আসতে। প্রতিবারই মেয়েটা একটু ভিন্ন পদ্ধতিতে বাঁচার চেষ্টা করে, কিন্তু নিয়তি তাকে প্রতিবারই লুপে আটকে ফেলে। একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত রুদ্ধশ্বাসে দেখতে হয় মুভিটা। এবং বলাই বাহুল্য মূল টুইস্টটা শেষ মুহূর্তের জন্যই রেখে দেওয়া হয়েছে।
১২। ইররিভার্সিবল (Irreversible)
মনিকা বেলুচি অভিনীত এই মুভিটাকে আমি লিস্টে রাখতে চাইনি। কারণ আমার মতে একটা একটা জঘন্য বিকৃত মানসিকতার মুভি। কিন্তু রাখতে হল এ কারণে যে এটা আক্ষরিক অর্থেই একটা ননলিনিয়ার মুভি। মেমেন্টোর মতো হাফ রিভার্স ক্রনোলজির না, এটা পুরাই রিভার্স ক্রনোলজির ছবি। সিনেমা শেষ থেকে শুরু হয়ে শুরুতে গিয়ে শেষ হয়।
এছাড়া আরও কিছু মুভি আছে, যেগুলো উপরের মুভিগুলোর মতো ব্যাপক নন লিনিয়ার না হলেও সেগুলোর কাহিনীও পুরাপুরি সরল নয়। কয়েকটা এরকম মুভি হচ্ছে -
ব্যাটম্যান বিগিনস
গডফাদার টু
দ্যা ইউজুয়্যাল সাসপেক্টস
স্লামডগ মিলিওনিয়ার
রান লোলা রান
ক্র্যাশ
দ্যা কিউরিয়াস কেইস অফ বেঞ্জামিন বাটন
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই এপ্রিল, ২০১২ বিকাল ৫:৪২