somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সেই ভয়াল ২৮ শে অক্টোবর কত মায়ের চোখে পানি।

০৬ ই নভেম্বর, ২০০৯ রাত ৩:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঠিক ৩বছর আগে ২০০৬ সালের এই দিনে এ দেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক কলংকজনক অধ্যায় রচিত হয়। প্রকাশ্য দিবালোকে লগি বৈঠা দিয়ে তরতাজা যুবকদের পিটিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করার দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয় এদিন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট সেদিন জামায়াত ও শিবিরের নেতাকর্মীদের উপর পৈশাচিক হামলা চালিয়েছে ইতিহাসে তা নজিরবিহীন। লগি, বৈঠা, লাঠি, পিস্তল ও বোমা হামলা চালিয়ে যেভাবে মানুষ খুন করা হয়েছে তা মনে হলে আজও শিউরে ওঠে সভ্য সমাজের মানুষ। সাপের মতো পিটিয়ে মানুষ মেরে লাশের উপর নৃত্য উল্লাস করার মতো ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন। এ ঘটনা শুধু বাংলাদেশেই নয়, গোটা বিশ্বের বিবেকবান মানুষের হৃদয় নাড়া দিয়েছে। জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব থেকে শুরু করে সারাবিশ্বে ওঠে প্রতিবাদের ঝড়। ২৮ অক্টোবরের পৈশাচিকতার বিচার হওয়াতো দূরের কথা, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর মামলাই প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে।
ঘটনা যেভাবে শুরু
২০০৬ সালের ২৭ অক্টোবর বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া রেডিও-টিভিতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। মূলত এ ভাষণ শেষ হওয়ার পরপরই দেশব্যাপী শুরু হয় লগি বৈঠার তান্ডব। বিভিন্ন স্থানে বিএনপি-জামায়াত অফিসসহ নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি যেমন চালানো হয় পৈশাচিক হামলা, তেমনি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয় অনেক অফিস, বাড়িঘর, পুরো দেশব্যাপী চলে তান্ডবতা।
২৮ অক্টোবরে পাশবিকতা
২৮ অক্টোবর চারদলীয় জোট সরকারের ৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরীর উদ্যোগে বায়তুল মোকাররমের উত্তর সড়কে পূর্ব নির্ধারিত সমাবেশ ছিলো বিকাল ৩টায়। সকাল থেকেই সভার মঞ্চ তৈরির কাজ চলছিল। হঠাৎ করেই বেলা ১১টার দিকে আওয়ামী লীগের লগি, বৈঠা ও অস্ত্রধারীরা জামায়াতের সমাবেশ স্থলে হামলা চালায়। তাদের পৈশাচিক হামলায় মারাত্মক আহত হয় জামায়াত ও শিবিরের অসংখ্য নেতা-কর্মী। তাদের এই আক্রমণ ছিল সুপরিকল্পিত ও ভয়াবহ। এক পর্যায়ে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা পল্টনের বিভিন্ন গলিতে ঢুকে পড়ে এবং নিরীহ জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের বেধড়ক পেটাতে থাকে।
পল্টন মোড়ের পৈশাচিকতা
সেদিন পুরো পল্টনজুড়ে ছিল লগি, বৈঠা বাহিনীর তান্ডবতা। লগি-বৈঠা আর অস্ত্রধারীদের হাতে একের পর এক আহত হতে থাকে নিরস্ত্র জামায়াত ও শিবিরের নেতাকর্মীরা। তারা শিবির নেতা মুজাহিদুল ইসলামকে লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। লগি-বৈঠা দিয়ে একের পর এক আঘাত করে নির্মমভাবে হত্যা করে জামায়াত কর্মী জসিম উদ্দিনকে। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর তারা তার লাশের উপর উঠে নৃত্য-উল্লাস করতে থাকে।
টার্গেট ছিলো নেতৃবৃন্দ
সেদিন আওয়ামী লীগের লগি-বৈঠা বাহিনী শুধু জামায়াতের সভা পন্ড করার জন্যই পৈশাচিক হামলা চালায়নি তারা জামায়াতকেই নেতৃত্বশূন্য করতে চেয়েছিল। তারা চেয়েছিল জামায়াতের সভামঞ্চে আগুন ধরিয়ে দিতে। প্রথম দফা হামলার পর তারা ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে থাকে। আশপাশের ভবনের ছাদে উঠে বোমা ও বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্রসহ অবস্থান নেয়। সভার শেষ দিকে মাওলানা নিজামীর বক্তব্য শুরু হলে তারা তাদের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী পুনরায় হামলা চালায়। একদিকে ভবনের ছাদ থেকে বৃষ্টিরমতো বোমা বর্ষণ করতে থাকে। অপরদিকে পল্টন মোড় থেকে গুলী ছুঁড়তে ছুঁড়তে লগি বৈঠাধারীরা সমাবেশের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। জামায়াত ও শিবিরের নেতাকর্মীরা তৈরী করে মানবঢাল। এ সময় আওয়ামী অস্ত্রধারীদের ছোঁড়া গুলী মাথায় বিদ্ধ হয়ে রাজপথে লুটিয়ে পড়েন জামায়াত কর্মী হাবিবুর রহমান ও জুরাইনের জামায়াত কর্মী জসিম উদ্দিন। এ ঘটনায় জামায়াত ও শিবিরের ৬ জন নেতাকর্মী শহীদ ও সহস্রাধিক আহত হন।
হামলা ছিল একতরফা
জামায়াতে ইসলামীর উদ্যোগে বায়তুল মোকাররমের উত্তর সড়কে বিকেলে সমাবেশের জন্য সকাল থেকেই মঞ্চ তৈরির কাজ চলছিল। এ জন্য মঞ্চ তৈরির সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ছাড়াও জামায়াত ও শিবিরের কয়েকজন নেতাকর্মী কাছাকাছি অবস্থান করছিলো। এ সময় ১৪ দলের নেতাকর্মীরা জিরো পয়েন্ট এলাকায় অবস্থান করছিলো। তাই জামায়াত ও ১৪ দলের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি অবস্থানের কোন সুযোগ ছিল না। বিকেলে সমাবেশ হওয়ার কারণে সকালে মঞ্চ তৈরির সংশ্লিষ্ট লোক ছাড়া মিছিল করার মতো জামায়াত ও শিবিরের কোন নেতাকর্মী ছিলো না। হঠাৎ করেই সকাল ১১টার দিকে আওয়ামী লীগ নেতা হাজী সেলিমের নেতৃত্বে লালবাগ থানা আওয়ামী লীগ লগি-বৈঠা হাতে বিশাল মিছিল নিয়ে পল্টন মোড়ে আসে। মিছিলকারীরা ধর ধর বলে জামায়াত ও শিবিরের কর্মীদের ওপর হামলা চালায়। এ সময় জিপিও এলাকায় অবস্থানরত ১৪ দলের শত শত কর্মী লগি-বৈঠা নিয়ে তাদের সাথে যোগ দেয়। এ সময় ১৪ দলের কর্মীরা প্রকাশ্যে গুলী করা ছাড়াও লগি-বৈঠা নিয়ে জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। একের পর এক আঘাত হানতে থাকে নিরীহ জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের ওপর। মঞ্চ গুড়িয়ে দিতে এগিয়ে যেতে থাকে বায়তুল মোকাররম উত্তর সড়কের দিকে। এ হামলায় পিস্তলসহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আওয়ামী লীগ নেতা ডা. এইচবিএম ইকবাল ও তার বাহিনী নিয়ে যোগ দেয়।
সেদিন বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রচারিত ভিডিও ফুটেজ থেকে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ নেতা ডা. ইকবাল সেদিন পল্টন মোড় থেকে একটু এগিয়ে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) অফিসের সামনে তার অনুগত একদল যুবককে হাত নেড়ে সামনে যাওয়ার নির্দেশ দিচ্ছে। ডা. ইকবালকে যখন হাত নেড়ে নির্দেশ দেয়ার পরই এক যুবককে ঘেরাও করে লগি-বৈঠা বাহিনী নির্মমভাবে পিটাতে থাকে। চতুর্দিক থেকে আঘাতে আঘাতে সে পড়ে যায় রাস্তার কিনারে। সাপের মতো লগি-বৈঠা দিয়ে তাকে পিটাতে থাকে। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর তার লাশের ওপর উঠে নারকীয় উল্লাস করে লগি-বৈঠা বাহিনী। বিকল্প পথে মঞ্চ দখলের জন্য বিজয়নগর, পল্টন মসজিদের গলি দিয়ে ঢুকে পড়ে লগি-বৈঠা বাহিনী। যেখানেই দাড়িটুপি দেখেছে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তারা। শিবির নেতা মুজাহিদুল ইসলামকে তারা এ সময় পেয়ে যায় পল্টন মোড়ের কাছে। ঘিরে ধরে তাকে। লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে নরপিশাচরা। আঘাতে আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মুজাহিদ। তারপর ঐ পিশাচরা লগি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নিজেদের জিঘাংসা চরিতার্থ করে।
আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীদের মুহুর্মুহু গুলীবর্ষণ, বোমা ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের পর আহতদের সারি বেড়েই চলছিল। আহতদের প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় জামায়াতের ঢাকা মহানগরী অফিসে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। গুরুতর আহতদের নগরীর বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হয়। দফায় দফায় হামলা চলে দুপুর ২টা পর্যন্ত। এ সময় বারবার পুলিশকে অনুরোধ করা হলেও তারা রাস্তার পাশে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। অনেক পুলিশকে সেদিন বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর চত্বরের ভিতরে অবস্থান নিতে দেখা যায়।
দুপুর পৌনে ২টার দিকে ১৪ দলের লগি-বৈঠাধারী সন্ত্রাসীরা হামলা জোরদার করে পল্টন মোড় থেকে সিপিবির অফিসের সামনে চলে আসে। এ সময় তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া কয়েকজন জামায়াত ও শিবিরের নেতা-কর্মীদের ধরে নিয়ে যায়। পুলিশ কাছে দাঁড়িয়ে থাকলেও তারা কোন ভূমিকা পালন করেনি। একই সময় বিজয়নগর, পুরানা পল্টন মসজিদ গলিসহ আশপাশের এলাকা দিয়ে চোরাগোপ্তা হামলা চালাতে থাকে।
বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে বায়তুল মোকাররমের উত্তর সড়কে জামায়াতের সমাবেশ শুরু হয়। এ সময় পল্টন মোড়ের দিকে না হলেও বিজয়নগরসহ অন্যান্য এলাকায় বিক্ষিপ্তভাবে চোরাগোপ্তা হামলা চালাতে থাকে লগি-বৈঠা বাহিনী। মাওলানা নিজামীর বক্তব্য শুরু হওয়ার ৪/৫ মিনিট পর ৪টা ৪৩ মিনিটে পল্টন মোড়ে উত্তেজনা দেখা যায়। এ সময় নির্মাণাধীন র্যাং গস টাওয়ারের (বাসস ভবনের পূর্ব পাশের বিল্ডিং) ছাদ থেকে সমাবেশ লক্ষ্য করে ১০/১২টি বোমা ও প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে দফায় দফায় গুলী ছুঁড়ে ১৪ দলের সন্ত্রাসীরা। এ সময় পুলিশ নিজেদের নিরাপদ স্থানে হটিয়ে নেয়। আবার শুরু হয় ১৪ দলের মরণ কামড়ের মতো আক্রমণ। সমাবেশ ভন্ডুল করে দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে তারা। মাগরিবের আযানের পর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়ে আসে যখন বিডিআর পল্টন মোড়ে অবস্থান নেয়। এর আগে সমাবেশের কোন বক্তাই উত্তেজনাকর বক্তব্য দেননি, আক্রমণাত্মক কথাও বলেননি কেউ।
লাশ নিয়ে রাজনীতি
সেদিন আওয়ামী হায়েনারা জামায়াত কর্মী হাবিবুর রহমানকে পৈশাচিক কায়দায় হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি লাশটি টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিল গুম করার জন্য। কিন্তু পুলিশের সহায়তায় যখন লাশটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলো সেখানেও চলতে থাকে আওয়ামীলীগ নেতা হাজী সেলিম বাহিনীর লাশ দখলের খেলা। তারা নকল বাবা মা সাজিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিল লাশটি। পরবর্তীতে এ কারসাজি ধরা পড়ায় নকল বাবা মা সটকে পড়ে। এখানেই শেষ নয়। আওয়ামী লীগ হাবিবুর রহমানকে নিজেদের কর্মী দাবী করে তার লাশের ছবি ব্যবহার করে পোস্টারও ছেপেছিল। লাশ নিয়ে রাজনীতি এর চেয়ে জঘন্য নমুনা আর কী হতে পারে?
পুলিশের ভূমিকা ছিল রহস্যজনক
ঘটনার শুরু থেকেই পুলিশের ভূমিকা ছিল রহস্যময়। পুলিশের উপস্থিতিতেই আওয়ামী লীগের আগ্নেয়াস্ত্র ও লগি-বৈঠাধারী সন্ত্রাসীরা জামায়াতের সমাবেশ স্থলে হামলা চালায়। এ সময় পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। অসহায় জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের শত অনুরোধেও পুলিশ কোন ভূমিকা রাখেনি। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের ভূমিকাও ছিল রহস্যজনক।
২৮ অক্টোবরের আগ থেকেই পুলিশের পক্ষ থেকে বারবার ঘোষণা করা হচ্ছিল, লগি বৈঠা, কাস্তে বা অন্য কোন অস্ত্রশস্ত্র বহন নিষিদ্ধ ও বেআইনী এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু পুলিশ এ ব্যাপারে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়নি। আওয়ামী লীগের অফিসে লগি, বৈঠা, সংরক্ষণ করা হচ্ছে বলে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল সচিত্র প্রতিবেদন প্রচার করলেও পুলিশ এ ব্যাপারে ছিল নীরব।
বাবরের রহস্যজনক আচরণ
চারদলীয় জোট গঠিত হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন কর্মসূচি কখনো একসাথে আবার কখনো আলাদা আলাদাভাবে পালিত হয়েছে। কিন্তু বিস্ফোরনোন্মুখ পরিস্থিতিতে সেদিন (২৮ অক্টোবর) আলাদা আলাদাভাবে সমাবেশ করার ব্যাপারে জামায়াতের পক্ষ থেকে প্রশ্ন তোলা হয়েছিলো কিন্তু তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, ‘‘নো প্রোবলেম, পুরো নিরাপত্তার দায়িত্ব আমার।’’ সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, লুৎফুজ্জামান বাবর সে সময় জামায়াত নেতৃবৃন্দকে জানিয়েছিলেন, আমরা দৈনিক বাংলার মোড় এলাকা নিয়ে চিন্তিত। আপনাদের লোকজন সেখানে বেশি রাখবেন। আর পল্টন মোড় এলাকা আমি দেখবো। আপনারা এ এলাকা নিয়ে চিন্তা করবেন না। অথচ ঘটনা ঘটেছে ঠিক উল্টো। দৈনিক বাংলা মোড়ে কিছুই ঘটেনি। আর পল্টন মোড়ে লগিবৈঠা বাহিনীর পৈশাচিক হামলার ঘটনা ঘটে। জামায়াত নেতৃবৃন্দকে এ ধরনের বিভ্রান্তকর তথ্য দেয়ার হেতু কি? কেন এ ধরনের মিথ্যা আশ্বাস দেয়া হয়েছিলো?
এদিকে বেলা ১১টার পর লগিবৈঠা বাহিনীর আক্রমণ শুরু হওয়ার পর জামায়াত নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে অন্তত ১৫/২০ বার তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে ফোন করা হয়েছিলো। লগিবৈঠা বাহিনীর পৈশাচিকতার মুখে জামায়াত-শিবির নেতা-কর্মীদের অসহায়তা, পুলিশের নিষ্ক্রিয়তাসহ পুরো পরিস্থিতি তাকে বারবার অবহিত করা হয়। প্রত্যেকবারই প্রতিমন্ত্রী মৌখিক আশ্বাস দিয়েছেন। কার্যকর কোন পদক্ষেপই নেননি। যার ফলে পুরো ঘটনায় আগাগোড়াই পুলিশ ছিলো শুধুই দর্শক।
বেগম জিয়ার উদ্যোগে রক্ষা পেলো
শত শত নেতাকর্মী
সেদিন জামায়াতে ইসলামী তাদের পূর্বনির্ধারিত সমাবেশ করে বিকেলে। সমাবেশ শেষ হওয়ার পরও নারকীয় আক্রমণ চলতে থাকে অব্যাহতভাবে। একটা পর্যায়ে শত শত নেতাকর্মী অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। সন্ধ্যার পর আক্রমণের ভয়াবহতা বাড়ার আশংকায় শংকিত হয়ে ওঠেন তারা। এরপর জামায়াত নেতৃবৃন্দ বাধ্য হয়েই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পুরো বিষয়টি তাকে অবহিত করানো হয়। তখন তিনি ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগী হয়েই বিডিআরকে ঘটনাস্থলে আসার কথা বলেন। বিডিআর ঘটনাস্থলে আসার পরই পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে। সেদিন বিডিআর ঘটনাস্থলে না আসলে কী ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতো তা মনে করে এখনো অনেকেই নিজের অজান্তেই অাঁতকে ওঠেন।
লগি বৈঠা নিয়ে ঢাকা অবরোধের নির্দেশ
২০০৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর পল্টন ময়দানের মহাসমাবেশ থেকে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা তার কর্মীদের লগি, বৈঠা নিয়ে ঢাকা অবরোধের আহবান জানিয়েছিলেন। তারা এই আহবানে সাড়া দিয়েই আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের কর্মীরা লগি বৈঠা ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ২৭ অক্টোবর থেকেই ঢাকাসহ সারাদেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। ২৮ অক্টোবরের ঘটনা ছিল তার নির্দেশেরেই চূড়ান্ত ফসল। শেখ হাসিনার এধরনের নির্দেশ নতুন কিছু নয়। ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন ১টি লাশের পরিবর্তে ১০টি লাশ ফেলতে হবে। সেদিনও মুক্তাঙ্গনে আওয়ামী লীগের সভাস্থল থেকে বারবার ঘোষণা দেয়া হচ্ছিল, ‘‘জামায়াত শিবিরের উপর হামলা কর, ওদের খতম কর’’। ১৪ দলীয় জোট ও আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল জলিল, তোফায়েল আহমদ, আবদুর রাজ্জাক, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, বারবার উত্তেজনাকর বক্তব্য দিয়ে হামলার জন্য তাদের সন্ত্রাসী বাহিনীকে উৎসাহিত করছিল।
মামলা : অধিকতর তদন্তের নামে সময় ক্ষেপণ পরে প্রত্যাহার
ঘটনার পরদিন জামায়াতে ইসলামীর পল্টন থানা আমীর এ.টি.এম সিরাজুল হক বাদী হয়ে পল্টন থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলা নং-৬১(২৯/১০/০৬)। ধারা- ১৪৩/ ৩২৩/৩২৫/ ৩২৬/৩০২/ ৩০৭/ ১০৯/১১৪ দন্ডবিধি। মামলায় আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের ৪০ জন নেতার নামসহ অজ্ঞাতনামা সহস্রাধিক ব্যক্তিকে আসামী করা হয়। ২০০৭ সালের ১১ এপ্রিল আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে পলাতক আসামী হিসেবে উল্লেখ করে ৪৬ জন আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশীট দাখিল করা হয়। চার্জশীট দাখিল করেন ডিবির সাব ইন্সপেক্টর এনামুল হক। চার্জশীট দাখিলের পর ২২ এপ্রিল ২০০৭ মামলার চার্জশীট গ্রহণ করেন মহানগর হাকিম মীর আলী রেজা। চার্জশীট গ্রহণ করেই আদালত পলাতক আসামী শেখ হাসিনাসহ অন্যান্যদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করে। পরদিন ২৩ এপ্রিল তদন্ত কর্মকর্তার নাটকীয় আবেদনের প্রেক্ষিতে পরোয়ানা স্থগিত করে মামলাটি অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন মহানগর হাকিম মীর আলী রেজা। সেই থেকে অধিকতর তদন্তের নামে তিন বছর পার হয়েছে আর আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমার তারিখ বার বার পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে যা আইন আদালতের ক্ষেত্রে বিরল ঘটনা ছিল।
এই বিরল ঘটনার মধ্যেই আরেকটি বিরল ঘটনার জন্ম দিয়েছে বর্তমান সরকার। চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর তাদের দলীয় নেতাকর্মী, সমর্থক ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে গত ৯ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব আবু সাঈদ জনস্বার্থে পল্টন থানায় দায়ের করা হত্যা মামলাটি (নং ৬১ তারিখ ২৯.১০.২০০৬) প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত জানিয়ে ঢাকা জেলা প্রশাসককে একটি পত্র দেয়। এই পত্রটি পরদিন ১০ জুলাই মহানগর পিপি আবদুল্লাহ আবুর কাছে পাঠানো হয়। তিনি তখন মামলা প্রত্যাহার সংক্রান্ত ফাইলে তা নথিভুক্ত করেন এবং একটি আবেদন তৈরি করেন। এই আবেদন পত্রটি ১২ আগস্ট আনুষ্ঠানিকতা শেষে ঢাকা মহানগর সিএমএম আদালতে দাখিল করা হয়। আদালত আবেদন ও মামলার বিষয়বস্তু পর্যালোচনা করে ১৭ আগস্ট এক আদেশে মামলাটি প্রত্যাহার করে নেয়। এই আদেশনামা মামলার তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ ঢাকা মহানগর ডিবি পুলিশের হাতে পৌঁছার পর এক সপ্তাহের মধ্যেই গত আগস্ট মাসের শেষ দিকে মামলার নথিপত্র (ডকেট) আদালতে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
আইন অনুযায়ী যেকোন হত্যা মামলা বাদীর সম্মতি ছাড়া প্রত্যাহার করার সুযোগ না থাকা সত্ত্বেও মহাজোট সরকার তাই করেছে। এ ব্যাপারে ফৌজদারী আইন বিশেষজ্ঞ সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, পল্টন হত্যা মামলার দফায় দফায় পুনঃতদন্ত দুর্ভাগ্যজনক। একটি হত্যা মামলার বার বার তদন্ত হলে সময়ের অপচয় ঘটে। সময়ক্ষেপণ করা ন্যায়বিচার পরিপন্থী। তদন্তের দীর্ঘসূত্রতার কারণে মামলার সাক্ষ্যপ্রমাণ ও আলামত বিনষ্টের মাধ্যমে আসামীদের খালাস দেয়ার প্রবণতা গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, কোন হত্যাকান্ডের মামলাই রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার করার সুযোগ নেই। যদি কোন ব্যক্তিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত করা হয়েও থাকে তদন্ত শেষে আদালতই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
৩ বছর পার হওয়ার পরও কোন বিচার না হওয়ায় শহীদ মাসুমের মা শামসুন্নাহার রুবি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, যেদিন টিভির পর্দায় দেখলাম ২৮ অক্টোবরের নৃশংস হত্যাকান্ডের মামলা প্রত্যাহার করা হচ্ছে, সেদিন আমি খুবই মর্মাহত হয়েছি। যারা এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে তারা এখন ক্ষমতায়, ক্ষমতা জোরে তারা মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। তিনি বলেন, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়, সবাইকে আইন মানতে হবে। কিন্তু বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে তাদের বিরুদ্ধের সব মামলা প্রত্যাহার করে নিচ্ছে।
২৮ অক্টোবরের পৈশাচিক ঘটনা দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে সমস্ত বিশ্ব বিবেককে আঘাত দিয়েছে। নাড়া দিয়েছে বিবেকবান সকল মানুষকে। রাজনৈতিক সমাবেশ ভন্ডুল করার জন্য প্রকাশ্য দিবালোকে এভাবে সাপের মতো পিটিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনা বিরল। যা এখনো হাজার হাজার মানুষকে কাঁদায়। এ ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। দেশ ও জাতির স্বার্থেই এ ঘটনার রহস্য উদঘাটন, দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং নেপথ্য নায়কদের খুঁজে বের করা প্রয়োজন।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×