somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পুজোর ছুটিতে

১২ ই আগস্ট, ২০১১ সকাল ৯:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সেই ছোটবেলাতেই ঘোরাঘুরির দুর্দান্ত নেশা পেয়ে বসেছিল আমাকে। স্কুল পেরোনোর আগেই ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর ও আরো কয়েকটি সংগঠনের সাথে বাংলাদেশের বেশ কিছু দ্রষ্টব্য স্থান ঘোরা হয়ে গিয়েছিল। এর বেশ কয়েকটি খুব দুর্গমও ছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সেন্টমার্টিন (১৯৮৬) এবং হাতিয়ার নিঝুপ দ্বীপ (১৯৮৯)। অনেকে হয়তো ভাববেন সেন্টমার্টিন আবার দুর্গম হলো কিভাবে! ১৯৮৬ সালের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে দেখবেন অনেকেই তখন সেন্টমার্টিনে যাওয়া দূরের কথা নামই শুনেনি। বর্তমান পর্যটন ব্যবস্থার সুবিধাদি তখন কল্পনাও করা যেত না। যাতায়াতের জন্যে এখন যেখানে আধুনিক সীট্রাক বা অত্যাধুনিক ক্রুজার এর ব্যবস্থা আছে, তখন শুধুমাত্র সংকীর্ণ পরিসরের ইঞ্জিন চালিত নৌকাই ছিল সেন্টমার্টিনের একমাত্র যাতায়াত মাধ্যম।
যাই হোক ছেলেবেলার সেই ঘোরাঘুরির নেশায় আজও আমি মত্ত-দ্রবিভূত। অর্থনৈতিক কারণে যার সীমাবদ্ধতা ছিল বরাবরই। এমনকি স্কুলের গন্ডি পরিয়ে পড়ালেখার পাশাপাশি যখন টিউশনি করতাম, সারা বছর ধরে সেই টাকার সিংহভাগই জমতো ডিসেম্বর-জানুয়ারি শীতে নতুন জায়গায় ভ্রমণের জন্যে। কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেই চট্টগ্রাম ফটোগ্রাফিক সোসাইটির কতিপয় সদস্যের সঙ্গে পড়ে পেয়ে বসলো ফটোগ্রাফির নেশা। যা আমার বেড়ানোর নেশাকে দিলো ভিন্নমাত্রা। শুরু হলো স্মৃতিবন্দীর সাথে সাথে ক্যামেরার স্থির ফ্রেমে আটকানোর কাজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বছরের স্কলারশিপের টাকায় তামাকুন্ডি লেইনের জাফরের কাছ থেকে আড়াই হাজার টাকায় কেনা জেনিথ ক্যামেরাটাই আমার প্রথম ব্যক্তিগত সম্পত্তি। তখনই বুঝেছিলাম বেড়ানো ও ফটোগ্রাফি একে অন্যের পরিপূরক হয়ে যে চরম নেশা জাগিয়েছে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এর থেকে নিস্তার নেই।
ঘরের সবাই বই পড়ে। অনেকটা পারিবারিক নেশার মতোই। দাদা দিদিদের দেখতাম সুনীল সমরেশ ছাড়াও প্রত্যেক পুজোয় ভারতীয় দেশ, আনন্দমেলা বা আনন্দ বাজারের পুজো সংখ্যা পড়তো। সেসব পত্রিকায় কমিকসের পাশাপাশি “পুজোর ছুটিতে বেড়ানো’ শীর্ষক ভ্রমণ কাহিনীগুলো ছিল আমার কাছে অন্যতম আকর্ষণ। এছাড়া ভ্রমণ বিষয়ক রচনা ‘ভ্রমণ’ ও ভারতের বিভিন্ন বন জঙ্গলে জিম করবেটের শিকার কাহিনী আমার কিশোর বেলাকে ভালোই অভিভূত করে রেখেছিলো।
ব্যবসা প্রশাসনের স্নাতক পরীক্ষা শেষে ফাইন আর্টসে পড়ুয়া কিছু বন্ধু-বান্ধব জুটে গেলো যারা ব্যক্তিগতভাবে আমাকে ছবি আঁকার কলাকৌশলসহ বেশ কিছু একাডেমিক রিসোর্সের সন্ধান দিয়েছিলো। বিভিন্ন শিল্পীর ও ভাস্কর্যের জীবনী পড়তে শুরু করলাম, সাথে রবীন্দ্রনাথ, বিষ্ণু দে বিশেষ করে জীবনানন্দ দাশ। যেসব কাহিনী খুব করে মনে ধরতো, নোট খাতায় টুকতাম তার সারসংক্ষেপ অবশ্য নিজের মতো করেই। মাঝে মাঝে নিজস্ব কিছু ঘটনার আলোকপাত থাকতো তাতে। হঠাৎ একদিন ঝোঁকের বশেই দৈনিক আজকের পত্রিকায় লিখে ফেললাম জলজ্যান্ত একটি মৌলিক গদ্য। এরপর আজাদীর সানজিদা আপা ও সিদ্দিক ভাইয়ের অনুপ্রেরণা গদ্য লেখার নতুন এই নেশাকে স্থায়ী ভাব দিতে বসেছিলো। কিন্তু একথা সত্য যে আমার সব নেশাই বাড়াবাড়ি পর্যায় থেকে মাথায় বাড়ি খেয়ে সময়ের সাথে সাথে স্তিমিত হয়েছে। দারিদ্র্যতা তার অন্যতম কারণ। কেবল ভ্রমণের নেশাটুকু এর মাঝেও রয়ে গেছে, মনে হয় আমৃত্যু তাকে ছাড়ানো যাবে না। সম্প্রতি সানন্দা পত্রিকায় পুজোর ছুটিতে গ্যাংটক শীর্ষক একটি ভ্রমণ কাহিনী পড়ে আমার মাথা খারাপ অবস্থা। দিনরাত জল্পনা কল্পনা ও ধ্যানজ্ঞান হয়ে গেল কিভাবে গ্যাংটক পৌঁছানো যায়! ছুটি ছাটার জটিলতা তো আছেই, সাথে আর্থিক সীমাবদ্ধতা। গ্রুপে গেলে কিছুটা সাশ্রয় হয় তাই বন্ধু-বান্ধবদের সাথে যোগাযোগ করলাম। কিন্তু পাসপোর্ট ভিসার বিশেষত: ভারতীয় দূতাবাসের সাম্প্রতিক জারিকৃত জটিল নিয়ম কানুনের কারণে কেউ রাজি হলো না। দুর ছাই, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম এই পুজোর ছুটিতেই...। মনের ভেতর রবীন্দ্রনাথ গাইছে “যদি তোর ডাক শুনে...”
আমার কাজিন রিংকুদাকে বলাই ছিল আমি আসছি। গ্যাংটক যাওয়ার সম্ভাব্য সব পথের হদিস যাতে করে রাখে। কলকাতায় পৌঁছে জানলাম আমার দূর সম্পর্কের আরেক কাজিন যিশু গ্যাংটকেরই একটি হোটেলে চাকরি করে। বেশ-বেশ, মনে মনে সস্তায় থাকার বন্দোবস্তের এক অলীক স্বপ্নে বিভোর হলাম। মুহূর্তে মেজাজটা বেশ ফুরফুরে হয়ে গেল।
ট্রেনের টিকেটের জন্যে অনেক দৌঁড়ঝাপ করেও কোন লাভ হলো না। কেননা ইন্ডিয়ানদের ভ্রমণ প্রীতিও বড্ড মারাত্মক। ছুটি পাওয়া গেলেই কেউ একা, কেউ দোকা, কেউ বা পরিবারসুদ্ধ ঘটিবাটি সহকারে বেড়াতে চলে যায়। আর এ-তো পুজোর লম্বা ছুটি! ট্রেনের টিকেট মহার্ঘ্য বস্তুতো হবেই। অবশেষে শিলিগুড়িগামী ছোট বাসের দু’খানা সিট পাওয়া গেল কষ্টেসৃষ্টে। কলোনীর মোড় থেকে রাত আটটায় বাস। তাই ভর সন্ধ্যাতেই রাতের খাবারের পাঠ চুকাতে হলো। পৌনে আটটা থেকে বাস কাউন্টারে এসে বসে আছি। আটটা, সাড়ে আটটা, ন’টা বাজলো, কিরে বাবা বাসের কোনো দেখা নাই কেনো!! গিয়ে ধরলাম স্থানীয় প্রতিনিধিদের। এরই মধ্যে অপেক্ষমান আরও কয়েকজন যাত্রী চড়াও হয়েছে তাদের উপর। কথাকাটাকাটি ও হৈ চৈ এর মধ্যে যতটুকু শুনলাম তার সারমর্ম হচ্ছে বাস ঠিক সময়তেই এক্সপ্লেনেড থেকে ছেড়েছে, কিন্তু পুজোর আগে একবারে শেষ মুহূর্তের কেনাটার জন্যে শহরের প্রতিটি অলিগলি ও রাজপথ এতই যানজটে রুদ্ধ যে পারছে না আমাদের সিডিউল বাস। রাত ন’টা চল্লিশের দিকে বাস এলে অর্ধক্লান্ত আমরা বাসের পেটে চটজলদি ঢুকে পড়লাম। শুরু হলো গ্যাংটক যাত্রা।
মধ্যরাত, প্রায় বারটা নাগাদ রাস্তার ধারে এক ধাবায় প্রথম স্টপেজটা দেওয়া হলো। রিংকুদা’র পছন্দ অনুযায়ী পাঠার মাংসের অর্ডার দিলাম। খিদে পেয়েছিল বেশ, তাই প্রবল আগ্রহ নিয়ে খেতে বসেও মাত্রাতিরিক্ত ঝালই বিপত্তি বাঁধালো। প্রি-টেস্ট করার উদ্দেশ্যে আমি শুধু এক টুকরো মাংস নিলাম রিংকুদা’র বাটি থেকে। যেহেতু প্রচণ্ড ঝাল তাই বেয়ারাকে বললাম ঝাল কম ওয়ালা কোনো আইটেম দিতে। সে এনে দিলো দুই পিচ রুই মাছ। চামচ দিয়ে তার একটি নিয়ে খেলাম। স্বাদ তেমন সুবিধার না দেখে বাকি মাছটা খেলাম না। কিন্তু খাওয়া শেষে বিল আনতেই চক্ষু চড়কগাছ। এ কীরে বাবা!! দু’প্লেট পাঠার মাংস এবং দু’পিচ মাছেরই দাম ধরা হয়েছে এতে অন্যান্য খাবারের সাথে। ডাকু সদার্স মাধব সিং -এর মতো চেহারার কাউন্টার ম্যানেজারকে এর কারণ জিজ্ঞেস করতে সে শীর্ণ চেহারার ওই বেয়ারা কাম ঠাকুরকে তলব করলো। বেয়ারা এসে কারণ হিসেবে যা ব্যাখ্যা করলো তাতে আক্কেল গুড়ুম অবস্থা। যেহেতু দু’টো আইটেমেই আমাদের উদ্দেশ্য করে দেওয়া এবং ওই টেবিলেই রাখা হয়েছে যেখানে আমরা অন্য খাবার খেয়ে টেবিলটাকে এঁটো করেছি-তাই এ খাওয়া অফেরতযোগ্য।
কিছুক্ষণ কথা কাটাকাটি হলেও ওই মধ্যরাতে অচেনা জায়গা বিবেচনা করে আর্থিক এই ক্ষতিটুকু স্বীকার করতে হলো। যদিও মেজাজটা বেশ দমে গিয়েছিল। ড্রাইভার কন্টাক্টরের খাওয়া শেষ হলে ফের চলতে শুরু করলো বাস।
ভোর পাঁচটায় প্রাতকৃত্য ও ব্রেকফাস্টের জন্যে আরেকবার বিরতি হলো। এর আগে দুই দু’বার এই পথ দিয়ে আমি দার্জিলিংয়ে গিয়েছি। ভোরের প্রথম আলোয় সিংহভাগ জঙ্গলে ঘেরা ফসল ক্ষেত দেখে পরিচিত মনে হলো। বাস থেকে নেমে দু’জন দু’বার চা খেলাম ভারত বিখ্যাত ব্রিটনিয়া বিস্কুট সহকারে।
পথের মধ্যে একবার চাকা পাংচার হলো, পুরনো সরকারি গাড়ি অনেকটা ধুঁকে ধুঁকে যখন শিলিগুঁড়ি বাস স্টেশনে পৌঁছল তখন বেলা ৯টা। খানিকটা খুঁজতেই গ্যাংটকগামী জিপ ছাড়ার স্টেশনটির খোঁজ মিলল। ১৩০ রুপি করে দু’খানা টিকেট কেটে জিপের সামনে ড্রাইভারের পাশের সিট দখল করলাম। আধঘণ্টার মধ্যেই জিপ কানায় কানায় পরিপূর্ণ। হাতের দেশীয় সিগারেট কড়া দুটি শেষ টান দিয়ে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসে গাড়ি ছাড়লো ড্রাইভার। কিছুটা পথ সমতল রাস্তায় চললো জিপ, তারপর নির্দিষ্ট দু’পাহাড়ের উপত্যকা হয়ে আধভাঙা পাহাড়ি রাস্তা ধরলো; ঘুরে ঘুরে ক্রমশ ওপরে ওঠা শুরু হলো। একপাশে গভীর জঙ্গলপূর্ণ খাদ ঢালু হয়ে নেমে গেছে অন্ধকারে, অন্যদিকে পাহাড়ের সুদৃঢ় পাহাড় প্রাচিল। ঘুরে ঘুরে মাঝারি গতিতে উঠছে আমাদের জিপ। মাইল তিনেক উঠতেই হঠাৎ দু’পাশের পটভূমি পাল্টে গেল। এবার উল্টোদিক থেকে সবেগে নেমে আসা খরস্রোতা পাথুরে নদী তিস্তা আমাদের সঙ্গী হলো। মিনিট দশেক পর নদীর তীক্ষ্ন বাঁকের ওপর অদ্ভুত কারিগরি দক্ষতায় নির্মিত একটি রেস্টুরেন্টে যাত্রা বিরতি হলো। মুরগির স্ট্যু ও পাউরুটি খেলাম দু’জনে মিলে। দার্জিলিং টি তো আছেই, স্পেশাল হিসেবে কান্ট্রি টি এর নাম মেন্যু লিস্টে দেখে দু’জনে দু’কাপের অর্ডার দিলাম। প্রচুর ননীযুক্ত সে চা আসার পর তাতে প্রথম চুমুক দিলো রিংকু দা। খানিকটা মুখ বিকৃত করতেই জিজ্ঞেস করলাম- কেমন? চোখ নাচিয়ে হেসে মাথা নাড়লো ওকে। সাবধানে ফুঁ দিয়ে ননী সরিয়ে এক চুমুক দিতে বোটকা দুর্গন্ধে ষষ্ঠীর ভাত সুদ্ধ বের হয়ে আসার যোগাড় হলো। পরে জানলাম এ’ চা নির্মিত হয় গয়ালের ঘন দুধ থেকে।
ব্রেক শেষে আবারও শুরু হলো পথ চলা। উঠছি তো উঠছিই, যেন এর কোন বিরাম নেই। আমাদের দু’পাশে লম্বা লম্বা গাছের ঘন বন ক্রমশ দু’দিকের খাদে নেমে গেছে। কোন কোন জায়গায় জঙ্গলের ঘনত্ব এত বেশি যে সূর্যের আলো ঠিকমত প্রবেশ করতে পারছে না। ছায়া ছায়া অন্ধকার ভাব চারদিকে। হঠাৎ জিপের ভেতর থেকে একটি হাত সবেগে বেরিয়ে এসে ড্রাইভারের হাতের স্টিয়ারিং হুইল ধরে ফেললো। চেঁচিয়ে বললো গাড়ি থামাতে। গাড়ি থামতেই দু’জন সিকিমি যুবক জোর করে ড্রাইভারকে নামিয়ে আনলো গাড়ি হতে। ভয় পেয়ে গেলাম সবাই। বুঝি আতঙ্কবাদিদের হাতে পড়লাম! এক সিকিমি যুবকের সাথে আলাপ করতেই বেরিয়ে এলো সাংঘাতিক ঘটনাটি। ঘণ্টাখানেকের আগে ব্রেকে খাওয়াতে ড্রাইভার ঘুমিয়ে পড়েছিল চলন্ত অবস্থাতেই স্টিয়ারিং-এ হাত রেখেই। আর গাড়ি ক্রমশ বা দিকের খাদে অগ্রসর হচ্ছিলো এবং কি আশ্চর্য আমরা ড্রাইভারের পাশে বসেও তার এই ঘুমিয়ে পড়াকে টের পেলাম না, অথচ পিছনে বসেও এই যুবক দু’জন টের পেল। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসে যুবকদ্বয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতায় ছেয়ে গেল মন। তারা তখনও ড্রাইভারকে স্থানীয় ভাষায় অকথ্য গালিগালাজ সহ কখনও কোক খাওয়াচ্ছে, কখনও সিগারেট খাইয়ে পূর্ণ সচেতনতা আনার চেষ্টায় রত। শেষে চোখে মুখে জল ছিটিয়ে খানিকটা হাঁটিয়ে নিয়ে এলো জিপের ড্রাইভারকে। মিনিট পনেরর অনির্দিষ্ট ব্রেকের পর ফের রওনা হলাম আমরা। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে। গাড়ি পৌঁছল সিকিম চেকপোস্টে। শুরু হলো গাড়ি তল্লাশি ও আইডি কার্ড চেক। আমার পালা আসলে বললাম যে আইডি আনি নাই। সাথে সাথে ড্রাইভারকে গাড়ি এক পাশে রেখে আমাকে গাড়ি থেকে নেমে আসতে বললো। রিংকু দা ড্রাইভারের সাথে সংক্ষিপ্ত আলাপেই জানতে পারলো যে সিকিমে ভারতীয় ছাড়া বিনা অনুমতিতে (বিশেষ) বিদেশি পর্যটকদের প্রবেশ নিষেধ। হতাশায় মুষড়ে পড়ার অবস্থা আমার। ইন্টেলিজেন্ট অফিসারদের একজন আমাকে আমার ব্যাগেজ সুদ্ধ নিয়ে গেল তাদের অ্যানকোয়ারি অফিসে। অন্য একজন অফিসার রিংকুদাকে বললো, তুমি যেতে পার। রিংকু দা’র চেহারা দেখে বুঝতে পারলাম তার মনের অবস্থাও আমার মতই। অ্যানকোয়ারি ছোটখাট বয়স্ক এক অফিসার বসে তখন ব্রিটিশ দু’জন ট্যুরিস্টের পাসপোর্ট চেক করছে। এক পর্যায়ে তাদের বিদায় দিয়ে আমার সাথে আলাপ শুরু করলো। আমি সত্য কথাই বললাম। মুহূর্ত কয়েক আমার পাসপোর্ট চেক করে বললো- ‘তোমরা সমতলের লোক, সমতলই তোমাদের জন্যে ভালো হবে। ফিরে যাও’। অনেক অনুনয় বিনয়-এতে কোনো কাজ হলো না। ইতোমধ্যে আমাদের জিপ অন্যান্য যাত্রীদের নিয়ে চলে গেছে গ্যাংটকের উদ্দেশ্যে। বয়স্ক অফিসারটি তরুণ অফিসারদের নির্দেশ দিলো আমাদের যেন শিলিগুড়িগামী গাড়িতে তুলে দেয়। শুরু হলো গ্যাংটকে-গন্ডগোল। গ্যাংটক থেকে শিলিগুড়িগামী সবকটি গাড়িই ফুল লোডেড। হতভাগা আমাদের কেউ নিতে চাচ্ছে না। অনেকগুলো গাড়ি এরই মধ্যে বেরিয়ে গেছে। দাঁড়িয়ে থেকে থেকে পা ব্যথা হয়ে গেলে চেকপোস্টের বারান্দায় বসে পড়লাম।
সন্ধ্যা ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে। অন্ধকারের সাথে পাল্লা দিয়ে নামছে ঠান্ডা। শুধু টিশার্ট পরা শরীর শীতে কুকড়ে গেল। ব্যাগ খুলে জেকেট বের করে পরে নিলাম। পাহাড়ি এলাকা ঝুপ করে অন্ধকার হয়ে গেল চারদিক। আমাদেরকে শিলিগুড়ি পাঠানোর ব্যাপারটা এতক্ষণ হালকাভাবেই নিয়েছিলো বোধহয় চেকপোস্টের লোকজন। রাত বাড়া শুরু হতেই আমাদের ব্যাপার সিরিয়াস হয়ে গেল। এবার বিভিন্ন গাড়ি ড্রাইভারদের অনুরোধ করতে লাগলো আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্যে। টানা তিন ঘণ্টা অপেক্ষার পর কুলি-মজুর-কামলা শ্রেণীর লোকজনে ভর্তি একটি জিপ রাজি হলো আমাদের নিতে। তবে ভাড়া দ্বিগুণ। নিরুপায় হয়ে তাতেই চেপে বসলাম। মৃদু অন্ধকারে আমাদের দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে থাকা চেহারাগুলো দেখে আঁতকে উঠলাম। অধিকাংশই স্থানীয় ট্রিবিয়ান মুখ থেকে ভক্ভক্ করে দেশি মদের গন্ধ বেরুচ্ছে। পোশাক আশাকে স্পষ্টতই নিম্ন শ্রেণীর ছাপ। এদের পক্ষে সবকিছুই করা সম্ভব। আমরা বাঙালি বুঝতে পেরে তাদের কয়েকজন ভাঙা ভাঙা গলায় আমাদের সাথে আলাপ জুড়তে চাইলো। কিন্তু আমাদের নির্লিপ্ততা তাদের সেই উৎসাহকে বাড়তে দিলো না। যে কোন পরিস্থিতির জন্যে মনে মনে তৈরি হয়ে বসে ছিলাম। অবশেষে রাত দশটা নাগাদ শিলিগুড়ি পৌঁছলাম। অতিরিক্ত মানসিক চাপে শরীর মন এতই ক্লান্ত ছিল যে প্রথম যে হোটেল পেলাম তাতেই উঠে গেলাম বিনা দরাদরিতে। মাঝারি শ্রেণীর হোটেল তথাপি আটশো টাকা ভাড়া। বুঝলাম গলাকাটা হয়েছে আমাদের। বেলা ১২ টার পর পেটে কিছু পড়েনি তাই হোটেলের রুম সার্ভিসকে দিয়ে বাইরে থেকে রুটি-তরকারি আনিয়ে নিলাম। রিংকুদা তার মেজাজ ঠাণ্ডা করার জন্যে হুইস্কির বোতল নিয়ে বসলো। আমাকে সাধলেও নিলাম না কারণ এসিডিটির কারণে এমনিতেই চোখে অন্ধকার দেখছিলাম।
পরদিন খুব ভোরে উঠে দার্জিলিং -এর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

Grameen Phone স্পষ্ট ভাবেই ভারত প্রেমী হয়ে উঠেছে

লিখেছেন অপলক , ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৪৯



গত কয়েক মাসে GP বহু বাংলাদেশী অভিজ্ঞ কর্মীদের ছাটায় করেছে। GP র মেইন ব্রাঞ্চে প্রায় ১১৮০জন কর্মচারী আছেন যার ভেতরে ৭১৯ জন ভারতীয়। বলা যায়, GP এখন পুরোদস্তুর ভারতীয়।

কারনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কম্বলটা যেনো উষ্ণ হায়

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৭


এখন কবিতার সময় কঠিন মুহূর্ত-
এতো কবিতা এসে ছুঁয়ে যায় যায় ভাব
তবু কবির অনুরাগ বড়- কঠিন চোখ;
কলম খাতাতে আলিঙ্গন শোকাহত-
জল শূন্য উঠন বরাবর স্মৃতির রাস্তায়
বাঁধ ভেঙ্গে হেসে ওঠে, আলোকিত সূর্য;
অথচ শীতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইউনুস সাহেবকে আরো পা্ঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চাই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪৪


আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি পুরো ১৫ মাস ধরেই ছিলো। মব করে মানুষ হত্যা, গুলি করে হত্যা, পিটিয়ে মারা, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারা, পুলিশকে দূর্বল করে রাখা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৬

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

শহীদ ওসমান বিন হাদি, ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

হ্যাঁ, সত্যিই, হাদির চিরবিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার এই মুহূর্তটিতেই তার খুনি কিন্তু হেসে যাচ্ছে ভারতে। ক্রমাগত হাসি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?

লিখেছেন এ আর ১৫, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৩

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?


হাদিকে মারল জামাত/শিবির, খুনি নাকি ছাত্রলীগের লুংগির নীচে থাকা শিবির ক্যাডার, ডাকাতি করছিল ছেড়ে আনলো জামাতি আইনজীবি , কয়েকদিন হাদির সাথে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×