somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সিদ্ধান্ত

১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৮ সন্ধ্যা ৭:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বিধবা হয়ে রাশদো ভেবেছিল,বাপ-ভাই দেখবে।
আরিফের লাশের সামনে রাশেদার দুই ভাই আয়াজ-রিয়াজের
বুক চাপড়ানি দেখে মহরমের মাতমজারির কথা মনে পড়ছিল অনেকের।
রাশেদার বাপ বুড়ো মানুষ।সে মেয়েদের সুরে তাল মিলিয়ে ইনিয়ে-
বিনিয়ে কাঁদছিল।তাই দেখে কাঁদতে না পারা অনেকেই ফিসফিস করছিল-এই না হলে বাপ ভাই!
আরিফের দাফন-কার্য সেরে দুই ছেলেকে নিয়ে নিজের গ্রামে ফিরছিল ইলিয়াস।মেঠো পথে হাঁটতে-হাঁটতে সে খুকখুক করে কেশে
বলল--কাল আমার সাথে রেজস্ট্রি অফিস চল তোরা।
--কেন ?
বড়ছেলে আয়াজের থমকে দাঁড়ানো কৌতুহল।
রাখাল ছেলেরা দাম-শেওলা ভরা পুকুরে লাফঝাঁপ খেলছে।
সেদিকে তাকিয়ে ইলিয়াস বলল--মরণজিয়ন গালের কথা লয়রে
বাপ,আমার জোতজমা সব তোদের দুজনের নামে লিখে দিব।
জমির আলে ঘাস খাওয়া থামিয়ে একটা গরু নাদছে,চোখ
সরিয়ে নিয়ে রিয়াজ বলল-তার আর দরকার কী,তোমার য-কিছু
আছে সব-ই তো আমরা দুই ভাই পাব।
--স্কুল-কলেজে পড়ে তোর এই বুদ্ধি ?চোখ রাঙিয়ে বলল
ইলিয়াস।তারপর থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়া দুই ছেলের মুখোমুখি
দাঁড়িয়ে বলল--রাশেদা বেওয়া হয়েছে,আমি মরলেই বাপের
সম্পত্তির ভাগ দাবি করবে সে।তাই তোদের সব লেখে দেব।
রেজস্ট্রি অফিস থেকে ফিরে ইলিয়াসের বাড়িতে যখন খানাপিনা
হৈ-হুল্লোড় চলছে,পাশের গ্রামে তার বিধবা মেয়ের ঘরে গুমরে
মরছে বাতাস।
আরিফের ছোটভাই তারিফ কলমিস্ত্রীর কাজ করে।প্রতি রাতে
সে মদ খেয়ে বাড়ি ফিরে বুক চাপড়ে কাঁদে--ওরে আমার সোনামুখো
ভাই-রে,কোথা গেলি ভাই-রে,আমাকে নিয়ে যা-রে।
আরিফের বড় ভাই শারিফ গরু-ছাগলের পাইকার।হাট থেকে ফিরে
আরিফের ঘরে ঢোকে সে।দেওয়ালে ঝোলানো আরিফের প্যান্ট-শার্ট
পরা ফটোর দিকে তাকিয়ে হাপুস নয়নে কাঁদে--ওরে আমার সাহেবসুবো ভাই-রে, তোকে ছাড়া এই ঘর মানায় না -রে!
দুই ভাই কাঁদে আর হাত ধরাধরি করে আরিফের ঘরের
জিনিষপত্র বের করে নিজেদের ঘরে ঢোকায়।রাশেদা বারান্দায়
বসে জুগজুগ করে দেখে সব।তার মুখে কথা ফোটে না।গর্ভভারে
শরীর ভারি তার,শোকভারে বুক।
রাশেদার গর্ভে নড়াচড়া করছে আরিফের স্মৃতি,সত্তা।বিয়ের সাত বছর পর সন্তান।উচ্ছ্বসিত আরিফ আগন্তুকের ভবিষ্যত সুনিশ্চিত
করতে আরিফ ছুটেছিল মুম্বাই।সেখানেই কালব্যধি।হলুদ শরীর
নিয়ে বাড়ি ফিরছিল,কুলি চৌরাস্তায় লিভার ফেটে যায়। তার দুই
সঙগী ট্রেকার ভাড়া করে লাশ নিয়ে আসে।আরিফের শেষ সফরের
সেই দুই সঙগী এখন প্রতি সন্ধ্যায় দরজায় হাঁক পাড়ে--কই-গো
শারিফ-তারিফ,একবার বাইরে এসো।
তারিফের ঘরে বেজে চলা আরিফের টেলিভিশন থেমে যায়।
বিরক্ত মুখে কব্জিতে বাঁধা আরিফের ঘড়ির রেডিয়াম-ছটা দেখতে
-দেখতে দরজা খোলে শারিফ।হাসিমুখে বলে--সেই ট্রেকারের
ভাড়া নিবা তো,এসো ভেতরে এসো।
পাওনাদার দেখলেই বুক কাঁপে রাশেদার।তার গহনাগুলো চুড়ি
ভাঙার সময় কে খুলে নিয়েছে মনে নেই।বলে--একবার আব্বার
কাছে যাই,আমার সব দেনা তিনি শোধ করে দেবেন।
কথা বলতে গিয়ে জ্বিভে তোতলা ধরে তার।হাঁটতে গিয়ে পা টলে।
একিদন কলতলায় পড়ে গর্ভপাত হয়ে গেল তার।
হাসপাতাল থেকে তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে ইলিয়াস।
আরিফের দুই-ভাইয়ের সঙেগ তার প্রচণ্ড ঝগড়া।তারা শেষ যুক্তি
দেখিয়েছে,আরিফের কাফন-দাফনের সব খরচা আমরা করেছি,
তাই তার ভিটে মাটিতে ছুঁচ পরিমান অধিকার নেই রাশেদার।
অসুস্থ রাশেদার উপস্থিতিতে কলবল করে আয়াজ-রিয়াজের
বউ।পাওনাদারদের আসা-যাওয়ায় বাড়ি কাদা।একজন প্রস্তাব
দিয়েছে,আমাদের যে-কোন একজনের সঙগে রাশেদার নিকাহ দেন,
সব পাওনা মকুব।
ইলিয়াসের সফেদ দাড়ি নড়ে।চোখের তারায় ঝলসানি।বেওয়া হলেও
রুপসী মেয়ের দাম থাকে সংসারে।
একের পর এক প্রস্তাব আসে।বাড়ে ইলিয়াসের লোভ।বলে --
বিনা পণে বিয়ে দিলাম,বেওয়া হয়ে ফিরল খালি হাতে।এবার দেন-
মোহর নেব।সব চেয়ে যে বেশি টাকা দেবে,আমার মেয়ে তার।
সেদিন মুখ-আঁধারী বেলায় একজন প্যান্ট-শার্ট-চশমা পরা তরুন
এসে হাজির।বলল-আরিফ আমার বন্ধু ছিল।আমি তার স্ত্রীর সঙেগ
কথা বলতে চাই।
--কত টাকা পান?ইলিয়াসের হিসেবি কৌতুহল।
--আরিফের-ই কিছু পাওনা আছে আমার কাছে।আমি বোম্বায়ে
থাকি,কাল রাতে বাড়ি ফিরে শুনলাম,তাই ছুটে এসেছি।
দলিজ-ঘরে তাকে খাতির করে বসাল ইলিয়াস।বলল-তোমার নাম,মানে কী বলব রাশদোকে।
--বলবেন,পুব-পাড়ার রফি এসেছে।
গনগনে উনুনের মত মুখ নিয়ে রফির সামনে দাঁড়াল রাশেদা।
বলল-টাকা নেব না,আপনি আমার মানুষটাকে ফিরিয়ে দেন।
বোম্বাই-এ খাটলে লাখপতি হওয়া যায়,এই লোভ দেখিয়ে ওকে আপনি নিয়ে গেছিলেন।
রফি নিরব।রাশেদার মর্মবেদনা উপলব্ধি করে সে।বছর খানেক হল
বিপত্নীক হয়েছে সে।দু-বছরের মেয়েকে তার নানার বাড়িতে রেখে
মুম্বাই গেছিল সে।ফিরেছে অনেক টাকা,এক বুক আশা নিয়ে।ফিরে
দেখল,মা-মরা মেয়েটি কঙ্কাল সার।ছোট শালী রঙিলা।হাইস্কুলে
পড়ে।দেখতে ভাল।কথায় ও কাজে চটপটে।সংসারী।তার দায়িত্ব
নিলে,সে নিশ্চয় মা-মরা মেযেটির দায়িত্ব নেবে।সব ওলট-পালট
হয়ে যাচ্ছে রাশেদার অভিযোগে।
দাড়িতে আঙুল চালিয়ে ইলিয়াস বলল--বাদ দে মা ওসব কথা
বাদ দে।কই বাপ দাও তো দেখি টাকাটা।
--না,নেব না টাকা,আমি মানুষটাকে চাই।ঝাঁজের গলায় বলল
রাশেদা।
--শুনুন ভাবি,আরিফকে নিয়ে গেছিলাম ঠিক-ই,কাজও ধরিয়ে
দিয়েছি।ডাক্তার দেখিয়েছি,অবহেলা করিনি।সে যখন বাড়ি ফেরার
জেদ ধরল,শেঠের কাছ থেকে দু-হাজার টাকা এনে দিয়েছি।পরে
শেঠের কাছে হিসাব মোকাবিলা করে আজ ওর পাওনা দু-হাজার
টাকা দিতে এসেছি।
রাশেদার ওসব শোনার মানসিকতা নেই,সে একনাগাড়ে বলে চলেছে
--আমার টাকা চাই না,স্বামী চাই,সংসার চাই,সন্তান চাই।
--তবে যে ওরা বলছে,আরিফের পকেটে কিছু ছিল না,ওরা খরচা করে লাশ এনেছে?ইলিয়াসের কৌতুহল।
--মিছে কথা,,আমি আরিফের টিকিট
কেটে,ট্রেনে চড়িয়ে ওদের হাতে তিন হাজার টাকা গুনে দিয়েছি।
আমার সামনে মিছে বলার সাহস ওদের হবে না।
রাশেদা চোখ পাকিয়ে বলল--আমার হবে,আমি বলব,তুমিই আমার স্বামী-সংসার-সন্তান সব কেড়ে নিয়েছো,ফেরৎ দাও।
রাশেদার চিৎকারে মাথায় আগুন জ্বলে গেল রফির।রাশেদার বাহুমূল
ধরে টান মেরে বলল--চল,আমার ঘরই তোমার সংসার হবে আজ
থেকে।
রাশেদা কাঁপছে।ইলিয়াস বলল--ওসমানপুরের সোলেমান হাজি
দশ হাজার টাকা দেনমোহর দেবে বলেছে।
--আমি বিশ হাজার দেব।কন্ঠস্বরের মত কাঁপছে রফির শরীরও।
--কেন টাকা দেবেন আপনি,বাপ আমার টাকা নিয়ে ব্যাঙ্কে জমাবে
ভাইদের নামে।ওদের সংসারে আমি কাঁটা হয়ে থাকব না,আমি
সংসার চাই...বলতে -বলতে সজল হয়ে উঠল রাশেদার চোখ।
রফির হাত ধরে মেঠো পথে হাঁটছে রাশেদা।রফির ভাঙাচোরা
আগাছা-লাঞ্ছি ত বাড়িটি তাকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে।।


সর্বশেষ এডিট : ১২ ই অক্টোবর, ২০০৮ ভোর ৬:৪১
১০টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×