(সামুতে বিচিত্র পেশা সিরিজটা লিখে আমি নিজে আনন্দ পাচ্ছি, বলতে পারছি আমাদের দেশের কিছু মানুষের বিচিত্র পেশার কথা। দরিদ্র দেশ, মানুষের পেশার ভিন্নতা কিছুটা অবাক করেই দেয়। তবে লেখায় কিছুটা গ্যাপ পড়ে যাচ্ছে বলে আমি দুঃখিত, তবুও আমার চেষ্টা চলবে।)
বিচিত্র পেশার আমার আজকের সহযাত্রীর নাম আজিজুর রহমান। বাড়ী শরীয়ত পুর। আমার দেখা সব চেয়ে ভদ্র জুস বিক্রেতা আপনাদের এই ঢাকা শহরে!
আজিজের সাথে আমার দেখা হয় প্রায়ই। ওর দোকান দেখলে আমি তাকিয়ে থাকি। খুব যত্ন করে সাজিয়েছে দোকান। বিশেষ করে ফলফলাদি যেভাবে সাজিয়ে রাখে তা দেখার বিষয় হয়ে উঠে। আমি অনেকদিন ধরে আজিজুলকে চোখে রাখলেও কথা বলা হয়ে উঠে নাই। আজ ব্যাংক থেকে কাজ সেরে ফুটপাতে হাঁটতেই আজিজুলের দোকানের দেখা পাই।
কাছে যেয়ে নাম জিজ্ঞেস করতেই তার নাম বলে এর পর জমিয়ে তুলি। এক গ্লাস পেঁপের জুস খেয়ে বিদায় নেই! আজিজুল কিছুতেই আমার কাছ থেকে জুসের টাকা নিবে না, একি মুস্কিলে পড়লাম, নিবেই না কিছুতে! যাই হোক তবুও পরে বিল দিয়েই আসছি, এত সাধারন এবং সহজ মানুষ কি এই দুনিয়া হয়! একটা মানুষের সাথে কিছুক্ষন আগে পরিচয় হল আর তাকে ফ্রি খাইয়ে দিল! আমি তাকে বললাম, এটা যদি তুমি করো তা হলে তো তোমার যে কোন ব্যবসাই লস করবে! হাসি মুখে তবুও আজিজুল বলে যাচ্ছিলো, আমি আপনাকে মন থেকে বড় ভাই বলে খাওয়ালাম। আমি শুধু অবাক হচ্ছিলাম!
যাই হোক, আজিজুলের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম। প্রায় ১৮ বছর যাবত সে চাইনিজ রেষ্টুরেন্টে কাজ করেছে, বেতন শেষের দিকে পেত প্রায় ১৫ হাজার টাকা কিন্তু এই কাজে সে আর কিছুতেই মন বসাতে পারছিলো না। সকাল থেকে রাত ১২/১টা পর্যন্ত কাজ করে হাফিয়ে উঠছিলো সে। পরে সিদ্ধান্ত নিলো, এই শহরে নিজে কিছু একটা করবে। ফলে আরো কয়েকজনের সাথে কথা বলে বের করলো, এমন একটা ফলের জুসের দোকান করলে মন্দ হবে না।
তবে ব্যবসায় নেমে এখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে! এবং একবার হাসি মুখে বলেই ফেলল, মনে হচ্ছে আবার চাকুরীতেই ফিরে যেতে হবে! ফলের জুসের ব্যবসা তো মন্দ হবার কথা নয় বলতেই সে জানালো। না, মানুষ ভাল জিনিষ খেতে চায় কম। ফলের জুসের প্রতি বৃদ্ধদের আগ্রহ বেশী, যুবকরা কখনোই খেতে চায় না। এককাপ চা এবং একটা সিগারেট টান্তে যুবকরা বেশী পছন্দ করে কিন্তু সামান্য ১০ টাকার এক গ্লাস জুস পছন্দ করে না! আমি হাসি, হ্যাঁ, এটাই আমাদের এই সমাজের বাস্তবতা! আমরা বয়স না হলে কিছু নুঝি না! রোগে শোকে পড়লেই বুঝি, ভাল থাকা কত আনন্দ। অথচ সেই সময় থেকে আর ফিরে আসা যায় না!
আজিজুল জানালো। এই ব্যবসায় আসার সময় ভেবেছিলো, যদি প্রতি দিন ২০০ গ্লাস জুস বিক্রি করে তা হলেও প্রতিদিন ৪০০ টাকা আসবে। কিন্তু এই আশা দিনের পর দিন গুড়োবালি হচ্ছে। আমাকে বলল, দেখেন এমন গরম পড়ছে অথচ কাষ্টমার নেই।
আজিজুলের সাথে আরো অনেক কথা হয়েছে। ব্যবসাহিক কারবার নিয়ে আরো কথা বলেছি। আরো লোকারনে তাকে দোকান নিয়ে যাবার জন্য বলেছি। আজিজুল জানালো, যে সব জায়গাতে মানুষের ভীড় একটু বেশী, সেখানে ভ্যান থামালেই পুলিশ দিনে ২০০ টাকা চায়, এই টাকা দেয়াও কষ্টকর! (এর পর আর কিছুই আমার মুখ দিয়ে বের হচ্ছিলো না) এক জন মানুষ সারাদিন কষ্ট করে রোদ বৃষ্টিতে পুড়ে টাকা কামাই করবে, আর এক শ্রেনীর মানুষ এসে চাঁদা নিয়ে যাবে, এটা কেমন সভ্যতা! মাথায় কিছু ধরে না। আইন কানুন কোথায় থাকে জানতে ইচ্ছা হয়!
যাই হোক, আমি আজিজুলকে আরো সাহস দেই, ব্যবসা না ছেড়ে আরো কিছু দিন দেখতে বলি। একটা ভাল জায়গা খুঁজে একবার সেট হয়ে যেতে পারলে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হবে না। কারন আজিজুলের আছে সততা, পরিশ্রমের মানষিকতা এবং সব চেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, সে কোন ক্ষতিকর কিছু দিচ্ছে না (ভেজাল নিয়েও কথা হয়েছে, আজিজুল বলেছে এটা সে কিছুতেই করবে না), ফলফলাদি সব কিছু নিজ হাতে কিনে, নিজের হাতেই কাষ্টমারদের বানিয়ে দিচ্ছে। সুতারাং আর কি চাই।
আমি আজিজুলের সাফল্য কামনা করি। আজিজুলরাই এই দেশ একদিন গড়ে দিবে।
(আজিজুলকে নিয়ে ফেবু স্ট্যাটাস, এখানে )
বিচিত্র পেশাঃ ১৭ (আমার দেখা একটা শারীরিক কষ্টের পেশা)
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই এপ্রিল, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৫২