পাঁচটার সময় একটা ফোন এসে শুধু জানাল সুমনের বাসায় আয়। কিন্তু ফোনের ভাষায় অন্যকিছু ছিল। গিয়ে সুমনের বাসায় ঢুকব অমনি আরেক ফোন এসে জানিয়ে গেল কবি সুমন প্রবাহন আর নেই। মনে হল, কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের দিকে যাচ্ছি। মাথাটা ফাঁকা হয়ে গেল। উপরে ওঠা সম্ভব হল না, স্থির দাঁড়িয়ে রইলাম।
এক ধাক্কায় চোখের সামনে রঙিন, সাদাকালো বিস্তর নেগেটিভ ভেসে এল। মনে পরে, জহুরুল হক হলের ছাদে মদ খেয়ে পড়ে থাকা; বারান্দায় ডুকরে কেঁদে ওঠা, লঞ্চের ছাদে চিৎকার করে গাওয়া-যদি মরি কোন দিন নদীর উজানে/আমারে ভাসায়ে দিও ভাটিয়ালি গানে।একসময় সকাল-সন্ধ্যা কাটত একত্রে। মাঝখানে লম্বা বিরতি; দিন আগে একত্রে তিন দিন বাস। বহুদিনের জমানো, না পড়া কবিতাগুলো পড়া হল। মনে হল জীবন মৃত্যুর দ্বৈত স্বত্তা তাড়া করছে অনুক্ষণ তাকে। এর মধ্যেই লিখে ফেলল একটি গল্প। আসলে সে গল্প লেখে নি। এঁকেছে নিজের নীল পোর্টেট। মজা করে বললাম, এই গল্প কিন্তু তুই ছাপবি না, তোর মরার পর আমরা ছাপবো। কে জানত এই মহেন্দ্রক্ষণ এত তাড়াতাড়িই!
প্রাণশক্তি উছলে পড়া টগবগে এক কবি হঠাৎ বছর তিনেক আগে থেকে মন বৈকল্যের অভিযোগে গাদা গাদা পিলে নিথর। ডাক্তারের নির্দেশে দরজাবন্দি কবিতা। মধ্যে একদিন দেখা হলে, অস্ফুট আর্তনাদ একটু বের হল আবার কাজ করবার। বলেছিল,ইচ্ছে হয় কোদাল হাতে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ি।
জীবন্ত লাশ হয়ে আমাদের বিচরণ। রোবট আর মানুষের ফারাক অতি সামান্য। মাথায় ঘুরপাক খায় সংসারের জটিল অংক। কি করে বুঝবো, কবিতা লেখাও একটি কাজ। যদি নাও তুমি নিষ্কাম কর্ম হিসেবে? কাব্যের ঘোরকে বুঝিয়ে দেবে মুখ, চোখ, হাত, পা দিয়ে-এর কোন পণ্য মূল্য নাই। লিখেছিল ও, বাড়িতে ছোট্ট একটি রেইনট্রি গাছ আছে আমার, ওর গোড়ায় এক সময় কাদা আর জল দিয়েছিলাম, আমার অর্জন বলতে ও টুকুই। সত্যিই তাই!
জমা হয়েছিল বেশকিছু কবিতা। যদিও দুই মলাটে একক হয়ে কারো হাতে পৌঁছায়নি। পাণ্ডুলিপিটা সারাক্ষণ আগলে রাখত। পেলব ছোঁয়ায় ভরিয়ে দিত যেন নাড়িছেঁড়া সন্তান। ওর ভাষায় "যে মরে মরুক, আমি ঠিকই বেঁচে থাকব
কবিতায়,মানুষের ভালবাসায়"।
মা মারা যাবার পর দুটো কথা বলবে এমন আদম সন্তান ছিল না সমাজে। কোথায় না আশ্রয় খুঁজেছে সে? নিয়মমত সবাই সযতনে এড়িয়ে গেছে তাকে; সে আজিজ মার্কেট, ছবির হাট, মধুর ক্যান্টিন কিংবা হোক ঘর। ঘটনায় অংশগ্রহণ ছিল আমার-আমাদের। পাড়ার একটি কুকুর তার জন্য এগিয়ে এলেও মালিক যে ওই আদম সন্তানেরই জাত। অসহ্য মাথাব্যথায় দেয়ালে মাথা ঠোকাত, ঘুমুতে পারত না সারারাত। আমরা কী করে বুঝব কত কষ্টে ওকে লিখতে হয়েছিল,"ঈশ্বরের অসীম একাকিত্বও আমার একাকিত্বের কাছে একা।" এমনি করেই তৈরি হয়েছিল তার চলে যাবার দশা।
সুমন আসলে মরেনি। জীবন-মরণের সীমা সে আগেই পেরিয়ে গিয়েছিল। মেঘের দেশে ছিল তার বাস, ছিল মেঘের সঙ্গে নিয়মিত আলাপ। যদিও চাইছিল না, কিন্তু আমরা তাকে বাধ্য করেছি দেহান্তর করাতে। জবাবদিহিতার জন্য আমরা যেন তৈরি থাকি। মুখ নীলাভ হয়ে আছে, যেন সকলের পাপ শুষে নিয়ে মুক্তি দিয়ে গেছে আমাদের; আর ধ্যানমগ্ন চোখ ইঙ্গিত করেছ নিচুতার উর্ধ্বে ওঠার। ভুল লিখেছিলি সিগারেটে এক কাঠিতে আগুন ধরে ক'জনার?এক নয় বন্ধু, তিন পুড়িয়ে চার নম্বর কাঠিতে যে আগুন লেগেছে তা চির অগ্নিময়।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে আগস্ট, ২০০৮ বিকাল ৪:৪৯