আমাদের একটা আড্ডা আছে। আড্ডার মধ্যমনি আমাদেরই এক শিক্ষক। বাড়ি গেলেই, আমরা কয়েকজন বন্ধু যখন একত্র হই, চলে যাই স্যারের কাছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায় চায়ের কাপে। বলা বাহুল্য, আমাদের আলোচনা কোনদিন সরলপথে থাকেনি। আড্ডার স্বভাবমতই ঢু মেরেছে বিভিন্ন গলিতে।
স্যার একদিন বললেন, তার একহাতে সিগারেট, অন্য হাতে চায়ের কাপ, “আমার এক ছাত্রী একদিন ক্লাসে জিজ্ঞেস করেছিল, “ স্যার, আপনি কোন দল করেন?”
আমি সাধারণত রাজনীতি তুলি না ক্লাসে। কারণ অনেকে ভুল বোঝে। তাও বললাম, “আমি সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী কোন কালেই ছিলাম না। কোন নির্দিষ্টদল ক্ষমতায় আসলে আমি বিশেষ কোন সুবিধাও পাই না। আমি শুধু চাই, যে দলই আসুক ক্ষমতায়, তারা যেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাটুকু লালন করে। যেন ধর্মনিরপেক্ষ একটা দেশ উপহার দেয়। দেশের সব মানুষ যেন সমান অধিকার পায়!”
আমার কথা শুনে ছাত্রীটি বলল, “বুঝেছি স্যার, আপনি আওয়ামীলীগ!””
আমার অবস্থাটা হয়েছে অনেকটা স্যারের মতই। যখন মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক তুলেছিল ছাগুরা, তখন তাদেরকে বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলাম বলে, অনেকে আমাকে আওয়ামীলীগের দালাল বলেছিল। ধর্মনিরপেক্ষতা, ব্লগার হত্যা ইত্যাদি নিয়ে কথা বলায় অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ পর্যন্ত হয়েছিল শুনতে। মনে আছে, একজন বিখ্যাত ব্লগার আনফ্রেন্ডও করে দিয়েছিল ফেসবুক হতে।
এখন হয়েছে তার উল্টোটা।
মুক্তিযোদ্ধা কোটা আর ছাত্রলীগের বিপক্ষে লিখছি বলে, আওয়ামীবিরোধী হয়ে গেছি অনেকের কাছে। সরকারের অনেক দোষ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছি বলে অনেকে ক্ষেপে আছে আমার উপর। কেউ কেউ শিবিরের ট্যাগও লাগিয়েছে। অবস্থাটা ত্রিশঙ্কু।
এ বাবদ একটা কৌতুক মনে পড়ে গেল। শুনুন-
একজন বৃদ্ধ মৃত্যুশয্যায়। অনেক বয়স হয়েছে তার। স্ত্রী সন্তান পরিবৃত হয়েই তার মৃত্যু হচ্ছে। ঠিক মরবেন মরবেন করছেন, এমন সময় কী যেন মনে পড়ে গেল তার। সবার উদ্দেশ্যে বললেন, “শোন, আমি কার কার কাছে কত টাকা পাব বলছি, লিখে রাখো।“
একথা শুনে তার বড় ছেলে গদগদ হয়ে বলল, “দ্যাখো, দ্যাখো। বাবা কেমম সজ্ঞানে স্বর্গে যাচ্ছে!”
বৃদ্ধ যাদের কাছে টাকা পাবেন তাদের নাম বললেন। বললেন টাকার অংকটাও। সব মিলিয়ে প্রায় লাখ দুয়েক টাকা।
এরপর বৃদ্ধটি বললেন, “এবারে যারা আমার কাছে টাকা পাবে, তাদের নাম লেখ। আমার ঋণ বেশি নেই। লাখ চারেক হবে!”
তার কথা শুনে বড় ছেলে তড়িঘড়ি করে বলল, “ওরে, বাবা যে মরার সময় ভুলভাল বকছে। তাড়াতাড়ি মুখে গঙ্গাজল দে!”
নিজেকে মাঝেমাঝে ঠিক মৃত্যুশয্যায় থাকা বৃদ্ধটির মত মনে হয়।
২
কোটা সংস্কারের জন্য নাকি একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। গতকাল তারা রিপোর্টও দিয়েছে। তাদের মতে, দেশে আর কোন কোটা থাকবে না মুক্তিযোদ্ধা কোটা ছাড়া। রিপোর্ট যে এমন হবে, আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। কোটায় নয়, মেধায় যে নিয়োগ দেয়া উচিত, এটা তারা বুঝলেন এতোদিনে। এটা বুঝতে বুদ্ধিজীবী পর্যায়ের একটা কমিটির লেগে গেল এতোদিন।
কোটার যে দরকার নেই, সাধারণ মানুষ তো সেটা বহুদিন থেকেই বলছে। নতুন করে গবেষণা করার কী দরকার ছিল? আর মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের সুপারিশ করার মত মেরুদন্ড যে তাদের নেই, তা জানতাম। নিজে থেকে এসে তা বলারই বা দরকার কী?
এ বাবদেও একটা কৌতুক আছে স্টকে। শুনুন-
“গভীর রাত। কদম আলী নতুন বিয়ে করেছেন। বৌ তাকে বিছানায় ডাকছে। বৌয়ের কাছে যাওয়ার আগে, তিনি ডন বৈঠক দিয়ে নিজেকে ফিট করে নিচ্ছিলেন।
এমন সময় দরজায় টোকা। ঠিক এ সময়েই কাউকে আসতে হবে?
কদম আলী দরজা খুলে দেখেন একজন মাতাল হাতে বোতল নিয়ে টলছে। মাতালটা বলল, “আপনি কি কদম আলী?”
কদম আলী যথেষ্ট বিরক্ত, বললেন, “হ্যাঁ। কেন বলুম তো?”
মাতালটি বলল, “আপনি কী পত্রিকায় ফ্লাট বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন?”
“হ্যাঁ!”
মাতালটি জড়ানো গলায় বলল, “আমি বলতে এসেছি যে, আমার পক্ষে আপনার ফ্লাটটা কেনা সম্ভব নয়!””
এবারে তুলনাটা করে নিন।
৩
কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল, কোটাটা যেন সহনীয় পর্যায়ে থাকে। নারী, মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধী, জেলা, উপজাতী- সব মিলিয়ে কোটা যেন ২০% অতিক্রম না করে।
কিন্তু কমিটি তুলে দিল পুরোটাই। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় তারা হাত দেয়নি, এর সপক্ষে তাদের যুক্তি হলো, আদালতের ভার্ডিক্ট এর অবমাননা করা হবে এতে। যুক্তিটা পুরোটাই খোড়া। তারা শুধু একটা সুপারিশ করেছে, এটাই চুড়ান্ত নয়। কোন সুপারিশ আদালত অবমাননা করতে পারে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। আদাতলের রায় তো বাংলা ভাষা নিয়েও আছে। বলা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় সকল কাজে বাংলা ব্যবহার করতে হবে। কৈ, হয় না তো সেটা মানা। স্কুল কলেজের প্রশংসাপত্র পর্যন্ত ইদানিং ইংরেজিতে দেয়া হয়, বড় বড় অফিস আদালতের কথা বাদই দিলাম। ভাষার বেলায় তো সরাসরি আদালত অবমাননা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে টু শব্দ পর্যন্ত নেই। আর কোটার বেলা সামান্য একটা সুপারিশেই, আদালত অবমাননা হয়ে যায়?
কোটার সিংহভাগই হলো, মুক্তিযোদ্ধা কোটা। সেটাতেই যদি হাত দেয়া না হয়, তাহলে কোটা সংস্কার হলো কতটুকু? নাতিপুতির ব্যাপারেও তারা কোন সিদ্ধান্ত দেয়নি। উপজাতি আর প্রতিবন্ধী কোটা নিয়েও কোন কথা নেই। আন্দোলন তো হয়েছিল, কোটা সংস্কারের। কোটা তুলে দেয়ার কথা তো আর হয়নি। কোটা তুললেও যে কোটা তুলে দেয়া উচিত ছিল, তা তো আছে অক্ষত। প্রতিবন্ধীদের চেয়েও কি মুক্তিযোদ্ধার ছেলেমেয়ে নাতিনাতনিদের কোটা সুবিধা বেশি প্রয়োজন?
কমিটির সিদ্ধান্তে যে আন্দোলনকারীদের দাবি মানা হয়নি, তা স্পষ্ট। যা চাওয়া হলো, পাওয়া গেল তাত উল্টোটা। অবশ্য তারা চাটাচাটিতে এক্সপার্ট হলে তাদের কাছ থেকে এর চেয়ে ভাল আর আশা করাই বা যায় কীকরে?
এ বাবদেও কৌতুক জানি একটা। পুরোটা হয়ত মিলবে না, কিন্তু কৌতুকটা ভাল। সেটাই বা শুনতে আপত্তি কীসের?
এক তরুণ সার্কাসে কাজ করতে আগ্রহী। ম্যানেজার তাকে বাঘের খাঁচার কাছে নিয়ে গেল।
সে দেখল, একটা মেয়ে বাঘের খাঁচায় ঢুকে বসে আছে। আর বাঘটা চাটছে মেয়েটার পা।
মাস্টার বললেন, “কি, এরকম কাজ করার সাহস আছে?”
ছেলেটা বলল, “পারবো না মানে? আপনি বাঘটাকে খাঁচা থেকে বের করুন। তারপর দেখুন, আমি ওর কাজটা করতে পারি কিনা!””
এবারেও তুলনা করার দায়িত্বটা আপনাদের হাতেই তুলে দিলাম।
৪
রাজামশাই তার রাজ্যের জন্য একজন মন্ত্রী খুঁজছেন। অনেক খুঁজে দুজন পণ্ডিতকে ডেকে বেছে নেয়া হলো যাদের মধ্য থেকে একজন মন্ত্রীর পদমর্যাদা পাবেন। রাজা এখন তাদের মধ্যে প্রথম জনকে জিজ্ঞাসাব্দ করছেন।
রাজাঃ মন্ত্রী হতে চাও, তোমার যোগ্যতা কী?
১ম জনঃ হুজুর, আমি সুদূর চীন থেকে কঠোর সাধনা করে শিক্ষা নিয়ে এসেছি। এই দেখুন প্রমাণপত্র।
রাজাঃ বেশ। আমাদের রাজ্যের কাজ করতে পারবে তুমি?
১ম জনঃ অবশ্যই হুজুর।
রাজাঃ কিন্তু আমার যে মনে হচ্ছে তুমি সফল হবে না।
১ম জনঃ একবার সুযোগ দিয়েই দেখুন, হুজুর। ঠিক পারবো।
এবারে ২য় জনকে ডাকা হলো।
রাজাঃ মন্ত্রী হতে চাও, তোমার যোগ্যতা কী?
২য় জনঃ আমি মূর্খ মানুষ, হুজুর। আপনার গোলাম।
রাজাঃ তাহলে কী করে রাজকার্য করবে তুমি?
২য় জনঃ তাই তো, আমি কী করে এ কাজ করবো!
রাজাঃ তবে চেষ্টা করলে তুমি পারতে পারো
২য় জনঃ ঠিক বলেছেন, হুজুর। চেষ্টা করলে আমি পারতে পারি।
রাজাঃ আমার তাও সন্দেহ হচ্ছে, তুমি পারবে না। তুমি ঠিক উপযুক্ত নও
২য় জনঃ আমারও সন্দেহ হচ্ছে আমি পারবো না। আমি ঠিক উপযুক্ত নই।
জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রাজা ২য় জনকেই মন্ত্রী হসেবে নিয়োগ দিলেন।
**
সাহেব কহেন, “চমৎকার! সে চমৎকার!”
মোসাহেব বলে, “চমৎকার সে হতেই হবে যে!
হুজুরের মতে অমত কার?”
-কাজী নজরুল ইসলাম
শুরু করেছিলাম লেখাটা আমার ত্রিশঙ্কু অবস্থা দিয়ে। সমাপ্তিটাও নাহয় সেকথার জের টেনেই বলি। ২য় জন যেমন করে মন্ত্রীত্ব নিল, তেমন করে লিখতে পারতাম যদি, লতা-পাতা হতো যদি হতো লেখার বিষয়, কিংবা হতে পারতাম যদি মোসাহেব, তাহলে আমাকে এ অবস্থায় পড়তে হত না। আওয়ামী আর আওয়ামীবিরোধী, দুদলই মাথায় করে রাখত। যেহেতু তারা তোষামোদকারী চায়, সমালোচক নয়।
তবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থেকে আওয়ামীলীগ ট্যাগ কিংবা কোটা ও ছাত্রলীগের বিপক্ষে থেকে আওয়ামীবিরোধী ট্যাগ- এদের কোনটাতেই আপত্তি নেই আমার।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই আগস্ট, ২০১৮ বিকাল ৫:২০