সেই ছোট্টবেলা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খুব শখ ছিল আমার। স্কুল কলেজে পড়ার সময় ভাবতাম ইশ! কবে যে ভার্সিটিতে পড়বো। নাকের ডগায় মোটা ফ্রেমের চশমা লাগিয়ে সেখানে জ্ঞানী জ্ঞানী রাশভারী শিক্ষকরা কত্তো কিছুই না শেখাবেন! মাথায় আগে থেকেই কিছু না থাকলে বুঝবো কি করে! তাই মোটা মোটা খটখটে বইগুলো নিয়ে ক্লাস সিক্সে পড়ুয়া আমার পাবলিক লাইব্রেরীতে দাঁত বসানোর সে কি প্রচেষ্টা!
ভাসির্টিতে ভর্তি হলাম। বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর ভার্সিটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় !
কিন্তু আমার স্বপ্নের ঠিক বিপরীতে দাঁড়িয়ে মনে হত প্রীতিলতার সামনের বিশাল পাহাড়ের বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদি! এখানে জানতে চাওয়া মানে অপরাধ! এখানে ভালো রেজাল্ট করা মানে সহপাঠীদের সাথে ভয়াবহ দূরত্ব...নোংরামো...! শিক্ষকদের চোখে তারাই ভালো যারা তোষামোদ করতে পারে, তারাই খারাপ যারা সত্যিই পড়াশোনা করতে চায়। তোষামোদের এই মহান গুণ(!) টি আমার কখনোই ছিল না।
থার্ড ইয়ারে পড়ি তখন । ভাবছি কবে যে পড়াশোনা শেষ হবে! কিছুই ভাল লাগে না। শুনলাম নাসির স্যার দেশে ফিরছেন। ওনাকে আমি দেখিনি কখনোই । কিন্তু তার নাম শুনেছি সিনিয়র আপু ভাইয়াদের মুখে। উনি জয়েন করার পর থেকে ডিপার্টমেন্টে কেমন যেন একটা পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগলো। প্রতিবছর কম্পিউটার ল্যাবের নামে মোটা অংকের একটা টাকা জমা দিতাম আমরা । কিন্তু কম্পিউটার ল্যাব বলতে আমাদের কিছু ছিল না। নাসির স্যার এসেই প্রথমে ধুম করে কম্পিউটার ল্যাব খুলে ফেললেন! নেটেও ভয়াবহ স্পীড! সেইু গতিতে আমাদের কচ্ছপ ডিপার্টমেন্টেও একটা গতি চলে এলো।
ক'দিন বাদেই শুনলাম কক্সবাজারে পিকনিক! মাত্র ৬০০ টাকায় ২ রাত ৩ দিন!!! আমাদের তো মাথা খারাপ অবস্থা!! সেইখানে নাকি আবার কালচারাল প্রোগ্রামও হবে!! বিকেলবেলা আর্টস ঝুপড়িতে চুপি চুপি নাটকের রিহার্সাল। যাতে কেউ না জানে! কক্সবাজার ট্যুর করে আসার পর ডিপার্টমেন্টের ঝিমুনি ভাবটা কেমন জানি গায়েব হয়ে গেল!
এরপরই নবীন বরণের বিশাল আয়োজন। স্যারের বানানো ডকুমেন্টারির প্রদর্শনী। বান্দরবানের আদিবাসী "খুমি" আর "চান্দের গাড়ী" নিয়ে স্যারের বানানো চমৎকার দুটো ডকুমেন্টারি দেখে আমাদের তো মাখা খারাপ হবার যোগাড়! আমাদের মাঝে উৎসাহের জোয়ার বয়ে যাচ্ছিল!
২০০৬-০৭ ব্যাচের সবাই মিলে ঠিক করলাম সিলেট যাবো। নাসির স্যারকে তো যেতেই হবে। স্যার সব ব্যবস্থা করে দিলেন। ট্রেনের একটা এক্সট্রা বগি লাগানো হল শুধু আমাদেরই জন্য! কিন্তু শেষ মূহূর্তে জানলাম, স্যার আমাদের সাথে যাচ্ছেন না। প্ল্যাটফর্মে সবাই একসাথে হলাম, ট্রেনে উঠলাম। কিন্তু সবারই মুখ শুকনো। মনে হচ্ছিল সবাইকে ধরে বেঁধে সাহারা মরুভূমিতে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। কেউ কেউ মজা করার চেষ্টা করছিল কিন্তু কেন যেন জমছিলই না। সবাই বার বার ঘুরে তাকাচ্ছি দরজার দিকে। হঠাৎ....
একেবারে আচমকা দেখি, নীল জিন্স আর পাঞ্জাবী পরে নাসির স্যার ট্রেনে উঠছেন। আমরা পুরো ব্যাচ একসাথে চিৎকার দিয়ে উঠলাম। চোখের সামনে শাহরুখ খান চলে এলেও এতটা আনন্দ হত বলে মনে হয় না। খুশিতে চোখে পানি চলে এলো....।
স্যার এসে্ই জমিয়ে তুললেন...সাধের লাউ বানাইলো মোরে বৈরাগী, ঘুমায়া ছিলাম , ছিলাম ভালো, মুজিব পরদেশীর গান, আমার গায়ে যত দুঃখ সয়....আরো কত গান.....। আমরা সবাই ক্লিক ক্লিক করে ছবি তুলছি, ভিডিও করছি, নাচছি, বা একমনে কেউ বা ভাবছি....স্যার সত্যি সত্যিই এসেছেন তো! নাকি স্বপ্ন দেখছি!!!
সিলেটের পুরোটা সময় ভয়াবহ মজা হল! বাসে স্যার আমাদের একটা মজার গান শেখালেন । গানটার কলিগুলো এমন যে, "ওগো ভাবীজান, নাও বাওয়া মর্দ্দলোকের কাম....(স্যার আগেই বলে নিয়ে ছিলেন, এটা কেবল মজা করার জন্য গাওয়া...জেন্ডার সেনসিটিভ ইস্যু হিসেবে যাতে এটাকে আমরা না নিই)" আর আমরা একগাদা ছাগল মিলে এটাকে নানারকম বানিয়ে ফেললাম। কেউ গাইছিল "মন্দ লোকের কাম", আবার কেউ বা "ভদ্রলোকের কাম!" যাই হোক গাইছিলাম তো! স্যারের সাথে গাইতে পারছি এটাই জীবনের অনেক বড় পাওয়া!!!
স্যার আমাদের কাছে বড়সড় সেলিব্রিটির চেয়ে কোন অংশেই কম না!!!!স্যার এত কম সময়ে আমাদের এতো এতো জায়গা ঘুরিয়ে দেখালেন..আমাদের কারো ৩২ টা দাঁত এক মুহূর্তের জন্যেও বন্ধ হয়েছে কিনা মনে পড়ে না।
ফেরার দিন ভীষণ মন খারাপ লাগছিল...স্যার ডিপার্টমেন্টে একেবারেই রিজার্ভ একটা মানুষ। কথা বলতে গেলেও ভয় লাগে। এই কয়দিন আমাদের সবার সাথে স্যারের যে বন্ধুর মত আচরণ এ সব কিছু আর কয়েক ঘন্টা পর আজীবনের জন্য স্মৃতি হয়ে যাবে এটা ভাবতেই ভীষণ খারাপ লাগছিল!
ট্রেনে স্যার আমাদের সবাইকে নিয়ে বসলেন...আমাদের প্রায় সবার চোখই তখন ছল ছল করছে। স্যার বললেন...তোমাদের সবার অনুভূতি বলো। আমরা এক এক করে বললাম....এবারে স্যার বলতে শুরু করলেন...স্যার যে কথাগুলো বললেন তা একটা মানুষের সারা জীবনের চলার পথে পাথেয় হয়ে থাকার জন্য যথেষ্ট।
ভোরে ট্রেন চট্টগ্রামে পৌছবার পর আমরা যে যার গন্তব্যে চলে গেলাম। স্যার চলে গেলেন ডিপার্টমেন্টে। ক্লাস করাবেন বলে।
এর কিছুদিন পর চাকরি হয়ে গেল আমার । ঢাকা চলে আসার আগে স্যারের কাছে দেখা করতে গেলাম। স্যার আবারো সেই রাশভারী ব্যক্তিত্বসম্পন্ন জ্ঞানী মানুষটি...যার সামনে দাঁড়াতেও ভীষণ ভয় লাগে! খুব ভয় পাচ্ছিলাম কথাটা বলতে...আমি চাকরি পেয়েছি স্যার!!! স্যার ভীষণ খুশি হলেন। ডিটেইলস জানতে চাইলেন। বললাম। ফেরার আগে স্যারকে বললাম, 'স্যার আমি আপনাকে একটু সালাম করবো।' স্যার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। আমি স্যারের পা স্পর্শ করলাম। স্যার আমার মাথায় হাত রাখলেন। আমার মনে হচ্ছিল, আমার সামনে এখন আর কোন বিপদই মাথা তুলে দঁড়াতে পারবে না। অদ্ভূত একটা আত্মবিশ্বাস আমাকে ঘিরে ধরলো। ঠিক যেমনটা কোন পবিত্রতম স্থানে গেলে আমাদের বোধ হয়!
স্যার মাথা থেকে হাত সরানো মাত্র আমি ছুটে বেরিয়ে গেলাম। চোখের বাঁধভাঙা জলকে এতক্ষণ কি করে সামলে রেখেছিলাম কে জানে! দীপ বার বার জিজ্ঞেস করছিলো...কি হয়েছে? স্যার বকেছে? আমি শুধু বললাম ...দীপ, আমার পক্ষে এখন সব জয় করা সম্ভব...স্যার আমার মাথায় হাত রেখেছেন..স্যারের আর্শীবাদ আমার সাথে আছে...!
স্যারের সাথে সেটাই আমার শেষ দেখা...।
সম্প্রতি শুনলাম, স্যার চলে যাচ্ছেন দেশের বাইরে। শুনে ঠিক কি বলবো, কি করবো বুঝতে পারছিলাম না....মনে হচ্ছিল মাথার ওপর থেকে বিশাল এক মহীরূহের ছায়া যেন একটু একটু করে সরে যাচ্ছে। অথচ কিছুই করার নেই!
ছোটবেলার সেই স্বপ্নটা খুব মনে পড়ে আজকাল । বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সম্পর্কে সেই ধারণাটা আমার একটুও মিথ্যে ছিল না...বরং ভীষণ রকম সত্যি...।
কিন্তু খারাপ লাগে একটা কথা ভেবে, আগামী বছর নৃবিজ্ঞান ডিপার্টমেন্টে যারা ভর্তি হবে...তারা অদ্ভূত এক শূন্যতার বোধে ভূগবে....থিওরির মত শক্ত বিষয়কে অদ্ভূত সহজতায় মাথার মাঝে গেঁথে দেবার কাজটা নাসির স্যারের মত কেউ কি পারবেন?
কেউ কি পারবেন, একটু্ও পক্ষপাতিত্ব না করে সব শিক্ষার্থীর সাথে একই আচরণ করতে, একটা কচ্ছপ গতির ডিপার্টমেন্টকে এক মূহূর্তে খরগোশে রূপান্তর করতে! স্যারের সাংস্কৃতিক সংগঠন 'অঙ্গন' পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কে মাতিয়ে রাখতো, স্যারের 'বিবর্ত পাঠচক্রে'র মত চমৎকার মুক্ত জ্ঞানচর্চার জায়গা, সবই তো শূন্য হয়ে যাবে!
আর কে পারবে শিক্ষার্থীদের মাঝে ক্যারিয়ারিস্ট হবার জায়গায় একজন সত্যিকারের ভাল মানুষ হবার স্বপ্ন বুনে দিতে!!!
স্যার......আপনাকে আমরা রয়ে যেতে বলছি না এই ঘুণ ধরা বিশ্ববিদ্যালয়ে....যারা আপনার মত গুণীর কদর কখনোই বুঝবে না...
কিন্তু আমরা আপনাকে মনে রাখবো ....আমাদের নষ্ট পৃথিবীতে আপনি বড় ভুল করে চলে এসেছিলেন...নিজের আদর্শকে আমাদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে প্রকৃত মানুষ হবার যে লক্ষ্যে আমাদের চালিত করে গেলেন....আমরা যেন সেই পথে চলতে পারি স্যার...আাপনি আমাদের ভালবেসে "ছাগল" বলতেন....দোয়া করবেন....আপনার এই ছাগলগুলো যেন একদিন সত্যিকারের মানুষ হতে পারে!
ভালো থাকবেন স্যার.....আপনার জন্য শুভকামনা....।
রাহমান নাসির স্যার...আপনাকে আমরা হারাতে চাই না....
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
৬টি মন্তব্য ৪টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?
যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।
নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন
আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত
বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন
বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!
কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন
সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে
সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে
আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন
অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?
এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন