আমি খুব ক্ষেত টাইপের একটা মানুষ। এই হাল ফ্যাশনের যুগে হেডফোন দিয়ে মোবাইলে গান শোনার একমাত্র ফ্যাশনটি আমি গ্রহণ করে নিয়েছে নিজের মাঝে। বিশেষ করে ঢাকায় টাউন সার্ভিসগুলোতে চলাচলের সময়। এই ফ্যাশনটির কৃপায় অনেক ধরনের কুটুক্তি, হাস্যকর মন্তব্য আমাকে হর হামেসাই শুনতে হয়। তার পরেও থেমে যাইনি, চালিয়ে যাচ্ছি এবং কান জীবিত থাকা পর্যন্ত চালিয়ে যাব আশাকরি। এর প্রতেক্ষ্য কারণ ধরতে পারেন আমি গান পাগল। সারাদিন চাকরি নামক চাকরামি করতে করতে অনেক সময় দেখি নিজের স্বভাব চরিত্রের মধ্যে এক ধরনের চাকরামির ভাব চলে আসছে। বলতে পারেন গান শুনে এগুলোকে ঝেটিয়ে বিদায় করার এটা একটা বৃথা প্রয়াস। ব্যাপারটা হাস্যকর হলে হাসতে পারেন, আমার কিচ্ছু যায় আসে না। পরোক্ষ বা মূল যে কারণটা বলব এর কিছু যুক্তিযত ব্যাখা আছে আমার কাছে। আমার বন্ধু মহল এবং আমার ঘরনীর উদ্ভাবনি শক্তি থেকে প্রায়ই আমার অস্বাভাবিকতার একটা ব্যাখাটা আমাকে শুনতে হয় । মানুষের সাদা চোখে দেখা ঘটনাগুলো আমি নাকি একটু উল্টো ভাবে দেখি। যে কারনে আমাকে মাঝে মধ্যেই বির্বত পরিস্থিতীর শিকার হতে হয়। এ কাররে বন্ধুরা আমাকে আতেল, তারছিড়া, পালগা (যারা পাগল নয় কিন্তু ভালোমানুষ হয়ে পাগলামি করে আমাদের বন্ধু মহলে তাদেরকে পালগা বলা হয়। এর মানে পাগলেরও আরো একধাপ উপরে) বলে সম্বোদ্ধন করেন। আমার ঘরনীও বলে মাঝে মধ্যে খুব রেগে গেলে। আমার এই অস্বভাবিকতার পাগলামি থেকে আমাকে রক্ষা করার রক্ষা তাবিজ হলো হেডফোন এবং তার মাঝে উচ্চ শব্দে গান, যাতে বাহিরের কোন শব্দ আমার কানকে স্পর্শ না করে। ব্যাপারটার উপকারীতায় দেখিছি এই তাবিজ লাগানোর পর এই বিবর্তকর পরিস্থিতীর পরিমান আশি শতাংশ কমে গেছে। আপনার যারা আমার মত তারা চেষ্টা করে দেখতে পারেন।
আমার এই অস্বাভাবিক দৃষ্টিতে আমি প্রতিদিন টাউন সার্ভিসে আসা যাওয়ায কিছু শ্রেণীর লোক দেখি যা নিম্নরূপ
১। যাত্রী রূপি ড্রাইভারঃ যারা গাড়িতে উঠার পর থেকেই ড্রাইভারকে নির্দেশ করতে থাকবে। এই বেটা ডাইনে যা, দেখনা ডাইনে নিয়ে সব গাড়ি চলে যাচ্ছে কিংবা বায়ে যা বায়ে দিয়ে সব গাড়ি চলে যাচ্ছে। অথবা এদিকে দিয়ে আইলি কেন, ওদিক দিয়ে যেতে পারলিনা তারাতারি যাওয়া যেত। কিন্তু আজ অবধী ভেবে দেখেনি এই ডাইনে, বায়ে, এদিক ওদিকে করে কতক্ষন আগে তারা তাদের গন্তব্যে পৌছতে পারে। আমারতো মনে হয় মিনিট পাঁচেকের বেশি না। অনেকেই বলতে পারেন, তাদের ব্যাপার তারা করে আপনার সম্যসা কি? আমার সম্যসা হলো এরা এরকম শুরু করলেই আমি ভয় পেতে শুরু করি। কখন ড্রাইভার এদের কথা শুনতে গিয়ে গাড়িটাকেই না রাস্তার একেবারেই ডাইনে বা বায়ে নিয়ে যায়। একদিন ভিরু ভিরু মন নিয়ে এরকম একজন কে বলে ফেললাম “ভাই আপনি ড্রাইভার হতে খুব ভাল করতেন, কত সুন্দর গাড়ি পরিচালনা করেন”। আর যায় কোথায় গাড়ির সবাই মিলে আমাকে. . . . আর নাই বললাম।
২। কান পচা রোগিঃ এরা হেডফোন ব্যবহার না করে সরাসরিই চাইনিজ মোবাইল গুলো দিয়ে গাড়িতে বসে গান শুনে। এরকম একজনকে একদিন কানের কাছে গিয়ে বললাম “কি ভাই কানে কি কোন অসুবিধা আছে”। এবার অবশ্য সামান্য হাতাহাতি হয়েছিল।
৩। বিজ্ঞাপনি লোকঃ এরা গাড়িতে উঠেই সারাদিনে সব কর্মকান্ড, পারিবারীক কথা, কোন কিছুই না লুকিয়ে অবলীয়ার আরেকজনে সাথে অন্যেকে শুনানোর জন্য বিজ্ঞাপনি পন্থায় মোবাইলে বলে যেতে থাকে। এরকম একজন কে একদিন প্রশ্ন করালাম। আপনি মনে হয় রাস্তায় থাকেন? বাসা বাড়ি নাই। লোকটা রেগে মেগে বলল কেন? বললাম গাড়িতেই সব কথা বলতেছেন তো তাই মনে হল।
৪। নীতিবানঃ বলতে পারি এদের জন্যই আমার কানে হেডফোন তাবিজ। এরা সারাদিন নিজের স্বাদ্ধ্যসিদ্ধির জন্য অন্যের পাছায় আঙুল দিতে একটুও দ্ধিধা করবেনা। কিন্তু গাড়িতে পা দেওয়ার পর থেকেই এদের মত নীতিবান আর কেউ নেই। যা শুরু হবে বাসের কন্টাকটার দিয়ে। এই বেটা বাসে এটা নেই কেন, ওটা নেই কেন, ভাড়াতো কম নেস না। আর যদি সিটিং বাসে রাস্তার মাঝখান থেকে কোন লোক উঠায় তাহলে তো এটা অন্নপাপের মত একটা পাপ হয়ে দাড়ায়। তখন বাসগুলো সিষ্টেম, এবং নীতিবোধ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে যায় যা শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক কথকথায় গিয়ে চলতেই থাকে থেমে যায় না। এবার ভেবে দেখুন তো এই বাস কন্টাকটার গুলোকে অমানুষ বানানোর জন্য আমরা কিছুটা দায়ি কিনা। একটা মানুষের সাখে যদি মানুষ সারাদির কুত্তার মত ব্যবহার করে তার মানষিকতা কি হতে পারে? বাদ দিন মানষিকতার ব্যপার ওরা ছোটলোক ওদের আবার মানষিকতা কি? নিজের বাসার একটা কুত্তা রেখে প্রতিদিন তাকে আদর না করে খেউ খেউ করবেন। কিছুদিন পর দেখুন তার আচরণ কি রমক হয়। এটাও বাদ দিলাম যে দেশে সর্বচ্চ পর্যায়ে সিষ্টেম, নীতিবোধের কোন বালাই নেই সেখানে বাসকন্টাকদের মাঝে নীতিবোধ, সিস্টেম খোজা হাস্যকর নয় কি? এতই যদি পারেন সর্বচ্চ পর্যায়ে গিয়ে সিস্টেম এবং নীতিবোধ শেখান, দেখি তো পারেন কিনা। এই রকম কিছু লোকজন একদিন একটা সিটিং বাছে রাস্তায় মাঝখান থেকে লোক উঠেছে বলে খুব চিল্লা পাল্লা শুরু কওে দিলে। কিছুক্ষন পর যে লোকটা উঠেছে সেই লোকটাও ভাড়া কম দিতে চেয়ে সেই চিল্লা পাল্লার সাথে যোগ দিল। তার অভিযোগ সে রাস্তার মাঝখান থেকে উঠেছে পুরো টাকা কেন দিবে। আরো বড় যে অভিযোগ তাহলো এই টাকা তো মালিকের পকেটে যাবে না। যাবে ওর পকেটে তাই পুরোটা পাবে না। আমি এইদিন পূর্বের কথা মনে করে নিশ্চুপ ছিলাম। কিন্তু কিছু দুর যাওয়ার পর রাস্তার মাঝখান থেকে আবার দুটো পুলিশ গাড়ি থামিয়ে গাড়িতে উঠার পর আমার পাগলামি মাথাচারা দিয়ে উঠল। আমি যে লোকটা পড়ে রাস্তা থেকে উঠেছে তাকে গিয়ে বললাম। ভাইজার আপনি যে বললেন আপনি ভাড়া দিলে তা মালিকের পকেটে না গিয়ে ওর পকেটে যাবে। ওর এই পকেটে নেয়ার সুযোগটাও আপনি করে দিলেন। তাই এই বিষয়ে ও যদি অপরাধী হয় তবে আপনিও অপরাধী। আর বাকি যাত্রিদের উদ্দেশ্যে বললাম। এই লোকটা যখন বাসে উঠেলো তখন খুব চিল্লা পাল্লা করলেন এখন যে দুইজন পুলিশ উঠল সবাই নলের পেদানির ভয়ে চুপ করে রইলেন। এই হচ্ছে আপনাদের চরিত্র। এবার অবশ্য উত্তম মাধ্যমের পরিমানটা একটু বেশি খেয়ে ফেলেছিলাম। আমাকে হাসপাতল পর্যন্ত যেতে হয়েছিল। তারপর থেকেই এই হেডফোন তাবিজের উদ্ভাবন করলেন আমার ঘরনী। এখন প্রতিদিন সকাল বেলা অফিস থেকে বেড়–নার সময় ঘরনী বার বার মনে করিয়ে দেয় বাসে উঠার পর অবশ্যই কানে হেডফোন দিবে। কি করব বলুন ঘরনীর আদেশ।
এত গেলো হেডফোন তাবিজের কাহিনী এবার একটু অন্যরকম কিছু বাস কাহিনী বলি।
১। আমি তখন মাধ্যমিক পর্যায়ে। ঐ বয়সে সব ছেলেদের মাঝে সিটে বসে যাওয়ার চেয়ে বাসা গেটে ঝুলে যাওয়ার একটা প্রবনতা থাকে। আমারও ছিল। একদিন এরকম বাসে গেটে ঝুলে যাওয়ার সময় সামনে থেকে এক মহিলা তার মাথাটা জানলা দিয়ে বের করে বমি (আমার দেশীয় ভাষার যার নাম চিকির পানি) করে দিলো। যার কিছু অংশ ঢুকে গেলো আমার হা করে থাকা মুখের ভিতর আর কিছু অংশ পুড়া মুখ জুড়ে।
২। এক বিদেশ ফেরত লোক বাসে উঠে তার সদ্য ফেরত দেশের সাথে এদেশের সিস্টেম নিয়ে এত বেশি বক বক করেছিলো যে বাছের সব মানুষ বিরক্ত। মাঝখান কে এক স্কুল পড়–য়া ছেলে তাকে হঠ্যাৎ প্রশ্ন করে বসল “ ভাই ঐদেশেও কি মানুষ বাসে উঠে এত বেশি কথা বলে।
৩। এবার এক হুজুরের কাহিনী। হুজুর সাহেব খুব কষ্ট করে ঢেলে ঢুলে বাসে উঠেই বলছেন। এই শহরে এত লোক। পাশ থেকে একজন ভদ্রলোক উনাকে জিজ্ঞেস করল হুজুরের সন্তান কয়জন। হুজুর সরল মনে বলল মাহআল্লাহ ৭জন। ভদ্রলোক তড়িৎ উত্তর “ঘরে তো চিন্তা করেননি বাসে উঠে করছেন”।
৪। আবার আমার কাহিনীতে ফিরে আসি। ঢাকার ৬ নাম্বার বাসগুলো সিটিং এবং ননসিটিং চরিত্র বড় বিচিত্র। এই ওরা সিটিং এই ওরা ননসিটিং। এরকম একটি সিটিং বাসে আমি একদিন ফার্মগেট থেকে উঠে পড়লাম গন্তব্য মৌচাক নেমে রামপুরা। বাসের উঠার সাথে সাথে শুরু হলে গেলো লোকজনের চিল্লা পাল্লা। দেখলাম একমাত্র আমিই দাড়ানো। কি আর করব উঠে যখন পড়েছি তাই লোকজনের কথা শুনেও দাড়িয়ে দাড়িয়ে মৌচাক নামলাম। আরো কিছু সিটিং লোক নামল। এবার ওপর সাইড থেকে একটি রামপুড়া গামি ১০ নাম্বার বাস আসল যেটিও সিটিং। কিছুলোক উঠার পর বাস কন্টাকটার বললো সিটিং হয়ে গেছে আর লোক নেওয়া যাবে না। এক ভদ্র লোক জোর করেই উঠবে। তাকিয়ে দেখলাম উনি ৬ নাম্বার বাসের সিটিং সেই লোক যে সবচেয়ে বেশি চিল্ল পাল্লা করেছিন। আমার পাগালামির মাত্র এত বেশি বেড়ে গিয়েছিলো যে আমি উনাকে একটা চড় মেরে বলেছিলাম ভন্ডামির করার জায়গা পায়না।
৫। আবার নীতিবানদের গল্প এটা আমার সর্বশেষ দেখা। গন্তব্য পল্টন থেকে মীরপুর-১২। সিটিং বাস পুরোপুরি সিটিং হয়নি বলে বাসকন্টাকার শাহবাগ থেকে দুজন লোক উঠিয়ে নিলো শুরু হয়ে গেলো নীতিবানদের পুরনো কাহিনী যা শেষ পর্যন্ত জিয়া বিমান বন্দর নাম পরিবর্তন গিয়ে দুই পক্ষের দুইজন লোকের হাতাহাতি পর্যায়ে মাঝে চলছিল। এত চিল্লা পাল্লা দেখে ঐদিন আমার হেডফোন তাবিজ কোন কাজ করলনা আমি তা কান থেকে নামিয়ে এদের কথা শুনতে লাগলাম। ফ্রামগেট আসার পর তিনচারজন লোক নেমে গেলো। তারা এর মাঝেই তুমুল বেগে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের তর্ক। মিরপুর ১০ নম্বর গোলচক্কর যাওয়ার পর বাসের প্রকৃত ঘঁনাটা উন্মোচন হলো যে তাদের এই চিল্লা পাল্লার মাঝে এক ভদ্রলোককে অজ্ঞান পার্টি ধরে সব কিছু নিয়ে ফ্রামগেট নেমে গেছে। আমরা টেরও পাইনি। এবার নায়ক কিছু ইফনিভারসাটি পড়–য়া যুবক। এরা এই দুই নীতিবান ভদ্রলোক দুটিকে ধরল। আমরা যখন এতকিছু ভাবেন দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দলের কর্ণধার সেই হিসাবে এই অজ্ঞান লোকেটির দায়িত্ব আপনাদের নিতে হবে। ভদ্রলোক দুইটি আমতা আমতা করে তাদের বিভিন্ন সম্যসার দেখিয়ে এর অপরাগতা জানানো। ছেলেগুলিও ছাড়ে না । আমিও মজা পেয়ে এদের সাথে যোগ দিয়ে দিলাম। ভদ্রলোক দুটি যতই না করে আমরা কিছুতেই এদের ছাড়ি না। সর্বশেষে এরা প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বাসের সব ঘটনার জন্যে ক্ষমা চেয়ে তড়িঘড়ি কওে চলে গেলো। আমরাও কিছুক্ষন থেকে চলে আসলাম। অজ্ঞান লোকটির দায়িত্ব রইল কার কাছে জানেন, বাছের কন্টাকটার, যাদের কোন নীতিবোধ নেই সিস্টেম নেই, যাদের কে আমরা মানুষ বলে মনে করি না। আর আমার মত নীতিবানরা পালিয়ে বাঁচলাম।
এবার সর্বশেষে ঘটনাটি বলি। একদিন একটা লম্বা চুল ওলা যুবক তার সাইলিষ্ট চুলগুলো হেলিয়ে দুলিয়ে বাসে উঠে আমার সামনের সিটটায় বসল। বাস চলছিল। হঠ্যাৎ কি মরে করে ছেলেটি তার মাথা জানলা দিয়ে বাইরে বের করল। ওমনি তার মাথায় পরচুলা (আগলা) চুলগুলো বাতাসে উড়ে গিয়ে রাস্তায় দাড়ানো একটা লোকের মাথায় পড়ল। আমি কোনভাবেই সেদিন হাসি চাপিয়ে রাখতে পালাম না। আমার দেখাদেখি বাসের পিছনে দিকে যারা বসে ঘঁটনাটি দেখেছিল তারাও খুব অট্টহাসি হাসতে লাগলো। কাজটি ঠিক হয়নি জানি। কিন্তু কি করব অনেক মার খেয়েছি একদিন না হয় হাসলাম।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুলাই, ২০১০ দুপুর ১২:১৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



