ভালোবাসা শব্দ হলে তুমি তার অনুভব ________________________
লেকের বাতসে কাঠগোলাপেরা উড়ে বেড়াচ্ছে। জলেরা কেমন থইথই করছে, বাতাসের ধাক্কায় ছলকে এসে পড়ছে হৃদপিন্ডের অভ্যন্তরে। খুব শান্তির, খুব শান্তির অনুভূতি ইমু। জানাতো ছিলোই যে তোমার কাছাকাছি পাশপাশি থাকাটা অনেক বিস্ময় মিশ্রিত হবে। তবে তা কতোটা সেটাতো আর মাপযোগ সম্ভব নয়, তোমার পাশে এসেই শুধুমাত্র অনুভব করা সম্ভব। এই যে তোমার হাত ধরে পাশাপাশি হাঁটছি, তোমার শরীরের কম্পন অনুভব করছি, এ এক স্বর্গীয় অনুভূতি ইমু! তুমিও কি কিছু অনুভব করছোনা!
সেদিনের কথা মনে পড়ছে। চা বাগানের সরু রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তোমাকে ফোন করেছিলাম। কেউ একজন তোমার সেল নাম্বারটা আমাকে দিয়েছিলো। ফোন পেয়ে তুমি আমার পরিচয় জানতে চাইলে আমি হেঁয়ালি শুরু করেছিলাম, তুমি কিছুটা বিরক্ত হয়ে আর ফোন না করার কথা জানিয়ে লাইনটা কেটে দিয়েছিলে। সেদিন আসলে সেই হেঁয়ালিপনা করা ছাড়া আমার আর উপাই ছিলোনা। আর কিভাবে তোমার নাম্বারটা পেয়েছিলাম সেটাও তোমাকে জানানো আমার সম্ভব ছিলোনা। তোমাকে ফোন করবার পেছনে তখন হয়তো আমার কোন সুনিদ্দিষ্ট উদ্দেশ্যও ছিলোনা। অনেকের মতো আমিও এমনিতেই একটি মেয়ের নাম্বারে ফোন করেছিলাম। হয়তো অনেক ভাবনাই মনের মাঝে ছিলো, কিন্তু সেসব তখনো দানা বাঁধতে শুরু করেনি বা তার তেমন কোন প্রকাশ ছিলোনা। এভাবে তোমাকে তিন চার দিন ফোন করায় তুমি খুবই বিরক্ত হচ্ছিলে, তবুও আমার সাথে কথা বলছিলে। আমার সাথে কথা বলবার আগ্রহটা তোমার থেকে প্রকাশ পাচ্ছিলো। যদিও কথায় কথায় তোমার বিরক্তিটা যথেষ্ট তারপরও তুমি হুটকরেই লাইনটা কেটে দিতেনা, এটা আমার খুবই ভালো লাগতো। আমরা একে অন্যের সম্পর্কে কিছুকিছু করে জানতে থাকলাম। আমাদের সম্ভবত আমার আগ্রহের মাত্রা বাড়তে থাকলো আরও। বেশ কিছুদিন কথার পরে একদিন হঠাৎই আমাকে খুব অনুরোধ করেছিলে আর কোনদিন ফোন না করতে। শুনে কিছুটাতো কষ্ট পেলামই তবে আমি অভদ্র ছিলামনা কোনদিন, তোমাকে কথা দিয়েছিলাম, আর কখনোই ফোন করবোনা তোমাকে। অবশ্য তোমাকে এও বলে রেখেছিলাম, তোমার কন্ঠ শুনবার অপেক্ষায় থাকবো। যদি কখনো তোমার মনে হয় যে আমি তোমার সময় নষ্ট করিনি তবে ফোন করো। প্রতিক্ষায় থাকবো।
এর পরদিন থেকেই চা বাগানের সৌন্দর্য্য কেমন ম্লান হতে থাকলো আমার কাছে। বাগানগুলোকে কেমন বিশ্রিটাইপের জঙ্গল মনে হতে লাগলো আমার কাছে। বাতাসে অক্সিজেন কমে আসতে থাকলো, আমার নিঃস্বাস নিতে বড়ই কষ্ট হতে লাগলো। জল খাবার যেন স্বাদহীন, কন্টকময়, গলা দিয়ে নামতে চায়না। আহ্, কি সমস্যায় পড়ে গেলাম বলোতো। অন্যের সাথে কথা বলার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছিলাম। এমনিতেই আমি চুপচাপ, আরও চুপচাপ হয়ে পড়ছিলাম।
সে সময়টায় খুব লক্ষ্য করেছিলাম, বাতাসেরও কন্ঠস্বর আছে। ওরা কথা বলে, ঠিক তোমার মতো করেই। সারাক্ষণ, কানের কাছাকাছি, মাথার ভেতর, বুকের ভেতর।
এমনটাতো হবার কথাছিলোনা। তুমি অজানা এক তরুনী, কোনদিন দেখিনি, তোমাকে জানিনা ঠিকমতো, শুধু কথাবলেছি কয়েকটা দিন। ব্যাস, তাতেই আমার এমন হয়ে গেলো! আমি কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিলাম না এর উত্তর। উত্তরহীন আমি ভেতরে ভেতরে ফাঁপড়ে মরছিলাম। হয়তো সে সময়টাতে আমার একাকীত্বই এর জন্য দায়ী। আমার একজন মানুষ দরকার ছিলো, সঙ্গের জন্য। মনের কথা বলবার জন্য। হয়তো তোমার মতোই বা তোমাকেই দরকার ছিলো।
আমি বাগানে বাগানে কাজ ফেলে ঘুরে বেড়াই। মাটির চড়াই উৎরাই পেরিয়ে পেরিয়ে বহুদূর চলে যাই। ছোট ছোট টিলার মাথায় উঠে যাই। আকাশ দেখি। বৃহৎ বৃক্ষকে জড়িয়ে ধরে জীবনের স্পর্শ খুঁজি। ছড়ার জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকি। অনন্য সুন্দর সব বন্যফুলদের নিজের বলে মনে হয়না। ওরাও যেন সুবাস ছড়ায় না।
আমি ভেবেনিয়েছিলাম তুমি আবারো আমাকে ফোন করবে। কথা বলবে। বলবে, রাগ করোনা এমনিতেই ফোন দিতে না করেছিলাম তোমাকে। এই দেখ আমি নিজেই তোমাকে ফোন করে খোঁজখবর করছি। আরও অনেক কিছু বলবে। তুমি বলতেই থাকবে। আমি শুনবো আর শুনবো, কোন কথা বলবো না। কোন এক দুর্বোদ্ধ আবেগে আমার চোখ ঝাপসা হতে থাকবে। এক সুশব্দময় ব্রহ্মান্ডের ভেতরে তখন আমি। তুমি সুকন্ঠী আর আমি তার একমাত্র শ্রোতা।
কিন্তু আমার সেসব স্বপ্নকল্পনাকে ধুলোতে পরিণত করলে তুমি। ফোন করলেনা তুমি। কথা বললেনা তুমি। একমাস, দু'মাস, তিনমাস এভাবে সময় গড়াতে থাকলো। আর আমিও বাতাসের শব্দগুলোকে যেন আস্তে আস্তে হারাতে থাকলাম। আহ্, ইমু সে সময়টা কতোটা হাহাকারের ছিলো যদি তুমিতা জানতে, দেখতে! আর তা যদি হতো তবে তুমি কি তার প্রকৃত অনুভব করতে পারতে? হয়তো পারতে হয়তোবা না।
তুমি পেরেছিলে। আমার ব্যাথাগুলো বাতাসে মিশে উড়ে উড়ে তোমার কাছে পৌছে গিয়েছিলো। তুমি অনুভব করতে পেরেছিলে। মানুষের ষষ্ঠইন্দ্রিয় বলে মনে হয় কিছু আছে অথবা সপ্তম, অষ্ঠম, নবম।
এক মাঝরাতে ট্রেন মিস করে যখন লাইনের পাশে বসে নক্ষত্র রুপ আর জোছনাতরল পান করছি ঠিক তখনই একটি ফোনকল এলো আমার মোবাইলে। এমন অনেক কলইতো আসে আমার কাছে রাত বেরাতে। তবে সেটা যে তুমি করবে এমটা তখন ভাবনাতেই ছিলোনা। আমি কতোটা বিস্মিত হয়েছিলাম তা তুমি হয়তো কোনদিনই জানতে পারবেনা। সেটা সম্ভবও না। আমিই ভুলে গিয়েছিলাম যে সেটা আমার জন্মদিন ছিলো। আর তুমি কিনা একটিবার আমার কাছ থেকে শোনা দিনটার কথা ওভাবে মনে রেখে দিয়েছিলে! জন্মদিনে আমাকে তেমন কেউ উইশ করেনা। আসলে বেশিরভাগ পরিচিতরাই আমার জন্ম তারিখের কথা জানেনা। দু,চারজন জানলেও তাদের মনে রাখার কোন প্রয়োজন নেই। তমি শুভেচ্ছা জানালে।
তুমি কিনা পাক্কা ন'মাস পর আমাকে ফোন করে শুভেচ্ছা জানালে। এমন আনন্দতো আমি আর কখনোই পাইনি। বিশ্বাস করো। এমন আনন্দে সেদিন রাতের আকাশ, ষ্টেশন, রেললাইন যেন খরস্রোতা নদী হয়ে গিয়েছিলো। আমি চারিদিক শুধু জল আর জল দেখলাম। আর তার ভেতরে ক্যামন এক ছায়া ক্যামন সব আলো দেখলাম। এমন আর কোনদিন দেখিনি!
ধন্যবাদ রোজ, তোমাকে। আনন্দ বলো সুখ বলো বা শান্তি, এর স্বাদ আমি সেদিনই প্রগাঢ়ভাবে অনুভব কলরেছিলাম। এক মাঝরাতের শান্ত ষ্টেশন আমাকে জীবনের এক লক্ষ্য বাতলে দিয়েছিলো সেদিন।
আমি যেমনটা ভেবেছিলাম ঠিক তেমনই যেন তুমি আমাকে সেদিন বলেছিলে। দুঃখ প্রকাশ করেছিলে। কেন করেছিলে, তারতো কোন প্রয়োজন ছিলোনা!
এরপর কি নেশায় পেয়েছিলো আমাকে, আমাদেরকে। সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধা, রাত, মাঝরাত, ভোর কোন সময়টায় তোমার সাথে আমার কথা হতোনা বলোতো!। আমার প্রতি তোমার ছড়ি ঘোড়ানোটাও দিন দিন বেড়েই চলছিলো। আর আমিও তা মাথা পেতে নিতে একটুও কার্পণ্য করিনি। পৃথিবীর সেরা উপহারটাই যে তুমি আমাকে দিয়েছিলে। ভালোবাসা শব্দটার সাথে পরিচিত থাকলেও ভালোবাসার অনুভূতিটা তুমিই আমাকে দিয়েছিলে প্রথম। আমি বুঝলাম যে আমি এক স্বার্থক পুরুষ, একজন নারী আমাকে ভালোবাসে।
রোজ, পৃথিবীর কারো সাথেতো আমি তত কথা বলিনি যতটা আমি তোমার সাথে বলেছি। আসলে সেসব কি কথা ছিলো, নাকি অন্যকিছু! আমি ভাবি অন্যকিছু, কথা নয়, জাদু, মায়া, স্বর্গানুভূতি।
আমি তোমার নাম দিয়েছিলাম রোজ। আনসিন রোজ। আমার নাদেখা গোলাপ। পৃথিবীর বাগানে ফুটেই তুমি সৌরভ ছড়িয়ে দিলে। তোমার সৌরভে মোহিত হয়ে এক একাকী পুরুষ তোমার সৌন্দর্য্যের খোঁজে বেড়িয়ে পড়লো অজানার পথে। এমন রোমাঞ্চ কি আর অন্য কিছুতে সম্ভব। কেমন তুমি? তোমার কন্ঠের মাদকতাতো টের পেয়েছি। কিন্তু অনেকভাবে চেষ্টা করেও তোমার সুরত কল্পনা করতে পারিনা। পারিনি। তুমি আমার কাছে থেকে গেলে গলিত ঝোছনা, আলোর ঝরণা।
আমরা একে অপরের থেকে অনেক দূরে থাকলেও তোমাকে দেখার আশাটা খুব তাড়াতাড়ি সামনে এসে গেলো। তুমিই সুযোগ করে দিলে। আজ তোমাকে সামনে থেকে প্রথম দেখে আমার হৃদপিন্ডটা ঠিক যেন দেহ ফেটে বেড়িয়ে আসতে চাইছে! তোমার কি হচ্ছে রোজ, তোমার ক্যামন হচ্ছে রোজ, খুব জানতে মন চাইছে। এ ক্যামন অনুভূতি! তোমাকে হৃদপিন্ডের সাথে আষ্টেপিষ্টে বেঁধে ফেলতে মন চাইছে আমার!
আমরা পাশাপাশি হাঁটছি! আমি তোমার স্পর্শ নিয়ে হাঁটছি! এখনও বাতাস আর জলেরা খেলা করছে অবিরত। আমরা হাঁটছি, হাঁটতেই থাকবো, অনন্তের পথে।।
____________________________
যমুনার চোরাবালি
সময়: পহেলা অক্টোবর, বিকাল ৪:৫৪ মিনিট।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা অক্টোবর, ২০১৪ বিকাল ৫:১১