somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আছে ভাবের তালা যেই ঘরেঃ লালনমেলা ভ্রমণবৃত্তান্ত

১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ৮:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রাক-যাত্রা পর্বঃ
লালন মেলায় যাওয়ার তাল করছি বেশ বহুদিন হল, কিন্তু কেন যেন বার বারই এইবার যাই - ওইবার যাই করে নানা ব্যাস্ততায় আর যাওয়া হয়ে ওঠে না।

নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি, অখণ্ড অবসর। ক্লাসের পেছনের বেঞ্চিতে ঝিমানো আর হলে বসে বন্ধু বান্ধবের সাথে গ্যাজানো ছাড়া হাতে তেমন বিশেষ কোন কাজ নেই। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম যেভাবেই হোক, এইবার যাবই। সফর সঙ্গি হিসেবে পাওয়া গেল সদা বন্ধু শাদ আশরাফকে। আমরা দুই রত্ন সাভার ডেইরী গেইটে গাভীর খাঁটি দুধের চা চাখতে চাখতে সাঁইজির বারামখানার ছবি কল্পচক্ষুতে দেখা শুরু করে দিলাম :-D

যাত্রা প্রস্তুতি পর্বঃ

অক্টোবর মাস চলে আসতেই খোঁজ খবর নেওয়া শুরু করলাম। কোথায় - কিভাবে যেতে হয় এ ব্যাপারে কুষ্টিয়ার বন্ধু বান্ধবদের খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বিভিন্ন ধরনের তথ্য উদ্ধার করা হল।
পূর্বে দেশের বিভিন্ন জায়গায় খাপছাড়ার মত একাধিকবার ঘুরে বেড়ালেও কুষ্টিয়ায় এটা আমার প্রথম যাত্রা।
ঢাকা থেকে কুষ্টিয়া যাওয়ার সিস্টেম দুইটা। একটা হানিফ / লালন প্রভৃতি পরিবহনের সরাসরি বাস, ভাড়া ৩৫০ - ৪০০ টাকা।
আরেকটা প্রথমে পাটুরিয়া - দৌলতদিয়া ঘাট, এরপর ঘাট পার হয়ে কুষ্টিয়া। এই প্রক্রিয়ায় খরচ ১৭০ - ২০০ টাকা।লালনমেলার সময় দৌলতদিয়া ঘাট থেকে সরাসরি লালনের আখড়া পর্যন্ত বাস পাওয়া যায়, অন্য সময় কুষ্টিয়া থেকে অটোবাইক বা নসিমনে ছেঁউড়িয়া আখড়ায় আসতে হয়। দিনহীন নির্যাতিত ছাত্রসমাজের গর্বিত সদস্য হিসেবে আমি কোন রাস্তা নিয়েছিলাম তা বলাই বাহুল্য B-|

যাত্রা পর্বঃ

শুরুতেই বিঘ্ন। যাকে সাথে নিয়ে পুরো প্ল্যান প্রোগ্রাম সেই শাদ আশরাফ মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পরায় যাওয়া একরকম অনিশ্চিত হয়ে গেল। পরে সিদ্ধান্ত নিলাম একাই যাব। যেদিন রওনা দেব তার আগের রাতে পাওয়া গেল আর দুই বন্ধু মারুফ আর জাকির কে। ওদের কাছে জানতে পারলাম বড় ভাইদের একটা গ্রুপও নাকি যাবে, সবাই একসাথে যাব। ব্যাপার মন্দ না। বড় ভাইরা সাথে গেলে মানিব্যাগের ওপর চাপটা একটু কম যায় :-v
সকালে ওঠে খবর পেলাম বড় ভাইরা আমাদের রেখেই চলে গেছে।

অতঃপর নানা আলাপ আলোচনার পর সন্ধ্যা ছয়টায় নবীনগর থেকে পাটুরিয়াগামী বাসের ছাদে চাপলাম আমরা তিনজন সাথে মানিকগঞ্জ গামী আরও দুইজন। পূর্বে ট্রেনের ছাদে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থাকলেও বাসের ছাদে এই প্রথম। পদ্মা থেকে উড়ে আসা ফুরফুরে বাতাসে ভ্রমণ শুরু থেকেই উপভোগ করা শুরু করলাম।

ফেরি পার হয়ে দৌলতদিয়া ঘাটে পৌঁছে পরলাম বিপদে। চারদিকে সুনসান নিরবতা। দূর থেকে বাস স্টেশনে কোন বাস নেই বলেই মনে হল। এগিয়ে দেখি সিরিয়ালের সব বাস শেষ, লালনমেলা উপলক্ষ্যে বিশেষ বাসের ব্যবস্থা করেছে মালিক সমিতি, সেই বাস শেষ ট্রিপের উদ্দেশ্যে ইঞ্জিন স্টার্ট করেছে। দৌড়ে বাসে উঠতে গিয়ে দেখি ভেতরে সুঁই ফালানোর জায়গা নেই। দরজার হ্যান্ডেল ধরতে গিয়েও মারুফ পাশে থাকা মই বেয়ে তরতর করে ওপরে ওঠে গেল। বাকি দুইজনও সেই পথ ধরলাম। ছাদে ওঠে দেখি আমরা তিনজন ছাড়া আর কেউ নেই। ওপরে এত জায়গা থাকতে নীচে লোকজন কেন এমন ঠাসাঠাসি করে আছে এ নিয়ে নিজেদের মাঝে একটু হাসাহাসিও হল।
বাস টানতে শুরু করা মাত্রই কারণ টের পেলাম, যেই বাতাস এতক্ষণ ফুরফুরে ছিল তা কনকনে হয়ে ওঠল। গায়ের পাতলা টিশার্ট টেনেটুনে বড় করা, হাত - পা ঘসে ঘসে গরম করার মত বিভিন্ন ব্যর্থ প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে যাত্রা চলতে থাকল।
লালনের আখড়ার সামনের রাস্তায় যখন নামলাম রাত তখন সাড়ে বার।
এরপর প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে পৌছালাম বহু প্রতিক্ষিত সাঁইজির আখড়ায়।

পর্যটন পর্বঃ

প্রথমেই লালন সাঁইজির মাজারে ঢোকার ব্যার্থ চেষ্টা চালালাম। প্রচন্ড ভিড়ে ওইদিকে ঢোকা দূর, দাঁড়ানোও দায়। তাই ভাবলাম কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেব। পাশে মেলার দিকে সরে আসলাম। এদিকে অপেক্ষাকৃত কিছুটা কম ভীড়। বিশাল স্টেজ করা হয়েছে, দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা বাউলগণ গান গাইছেন। এইখানে দাঁড়ালাম কিছুক্ষণ। কানে ভেসে এল --
"পুরুষ বলতে কুম্ভ ভারী
এক জলে হয় পুরুষ নারী,
বারিতে সৃষ্টি কারবারি,
এক ফুলে দুই রঙ ধরায়..."

কিছুক্ষণ পর ঠেলেঠুলে লালনের মাজারের দরজা দিয়ে ঢুকে গেলাম। সে এক এলাহি কারবার। যেদিকে চোখ যায় শুধু মানুষ, মানুষ এবং মানুষ। রাস্তা দিয়ে পলিথিন, তেরপল যে যা পারে বিছিয়ে বসে বা শুয়ে পরেছে। জায়গায় জায়গায় ছোট ছোট জটলা করে গান চলছে। ভেতরে খিচুড়ি রান্না হচ্ছে, সবার মাঝে বিলানো হচ্ছে। আমরা তিনজনও প্রয়োজন হতে পারে ভেবে আনা গামছা হাতে লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম।
খিচুড়ীর চালার পাশেই দেখলাম এক সাধু বসে আছেন, সামনে বর্তমানে জীবিত মোটামুটি সব ধর্মের প্রতীক মাটিতে সার বেঁধে দাঁড় করান। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তাঁর কাছে দাঁড়াতে পারলাম না।
খিচুড়ি সদ্ব্যবহার শেষে চলে এলাম সাঁইজির মূল মাজারে৷ জুতো খুলে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে ভেতরে ঢুকলাম, খাদেম সাহেব মুখে একটা অচেনা প্রকৃতির মিষ্টি তুলে দিলেন।
এরপর পাঁচ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে ঢুকলাম দুই রুম বিশিষ্ট লালন মিউজিয়ামে। ঢুকে মনে হল পাঁচটা টাকাই জলে গেল। মিউজিয়ামের ভেতরে ঢুকতেই সামনে এক বিশাল ধাতব গামলা, ট্যাগে লিখা সাঁইজির শিস্যদের ব্যবহৃত রান্নার পাত্র। পরের রুমে আছে সাঁইজির ব্যবহৃত চৌকি ও ঘরের দরজা।
এছাড়া আছে একটা ভারি কারুকাজ করা একটি নলের হুঁকো কিন্তু গায়ে কোন ট্যাগ নেই। সাঁইজি এমন ব্যয়বহুল বিলাসী দ্রব্য ব্যবহার করেছেন তা কখনো শুনিনি।
এছাড়া মাজারের ভেতরে দেখার আর কিছু খুঁজে পেলাম না, তাই বেড়িয়ে এলাম।
মাজারের সামনেই বেশ কয়েকটা স্থায়ী দোকান, যাতে অসংখ্য একতারা। অবশ্য চতুর্দিকেই মিনি, ছোট, মাঝারি, বড়, বিশাল বড় বিভিন্ন ধরনের একতারার ছড়াছড়ি। এছাড়াও কাঠের তৈরি খড়ম (পায়ে পড়ার খড়ম। আদি এবং আসল খড়ম।) সহ বিভিন্ন জিনিসপত্র পাওয়া যায়। তবে এসব স্থায়ী ভদ্র দোকান থেকে কিছু না কেনাই মঙ্গল। কারণ মেলার ছোট অস্থায়ী ঝুপড়ি দোকানেও এগুলো সবই পাওয়া যায়, অর্ধেক দামে।
এবার স্টেজের দিকে পুনরায় অগ্রসর হলাম। স্টেজের চতুর্দিকে মোটামুটি স্টলের মত করেই গঞ্জিকা বিক্রি চলছে, পাওয়া যায় বিভিন্ন কোয়ালিটির বানিয়ে রাখা স্টিক। তবে এখানে স্টিকের চাহিদা তেমন একটা নেই, প্রয়োজন বাঁশি। যারা বাঁশি চেনেন না তারা আর নাইবা চিনলেন।
আমরাও এমন এক স্টলের দ্বারস্থ হলাম, স্টল মালিকই চট বিছিয়ে দিয়ে বসবার ব্যবস্থা করে দিলেন। ডুবে গেলাম ভাবের মূর্চ্ছনায় --

"জলে যেমন চাঁদ দেখা যায়
ধরতে গেলে কে হাতে পায়
আলক মানুষ অমনি সদাই
আছে আলকে বসে...."

সুর আর সুধার পার্থক্য কতটুকু?
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিব নারায়ণ দাস নামটাতেই কি আমাদের অ্যালার্জি?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৭


অভিমান কতোটা প্রকট হয় দেখেছিলাম শিবনারায়ণ দাসের কাছে গিয়ে।
.
গত বছরের জুন মাসের শুরুর দিকের কথা। এক সকালে হঠাৎ মনে হলো যদি জাতীয় পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাসের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতি মাসে সামু-ব্লগে ভিজিটর কত? মার্চ ২০২৪ Update

লিখেছেন জে.এস. সাব্বির, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

মার্চ ২০২৪ সালে আমাদের প্রিয় সামু ব্লগে ভিজিটর সংখ্যা কত ছিল? জানতে হলে চোখ রাখুন-

গত ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ ছিল জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে সর্বমোট ভিজিট ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×