somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রচনা: মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী

২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১১ রাত ১১:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভূমিকা: বাংলার কৃষক-মজুর-শ্রমিকের অতি আপনজন যে মানুষটি, তাঁর নাম মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। চিরকাল নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি। মজলুম মানুষের সুখে-দুঃখে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাদের কথা বলেছেন। সংগ্রাম করেছেন। তাই তিনি সবার কাছে মজলুম জননেতা।

জন্ম ও শৈশব: সিরাজগঞ্জের ধানগড়া গ্রামের এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে আবদুল হামিদ খানের জন্ম ১৮৮০ সালে। তাঁর বাবার নাম হাজি শরাফত আলী খান। মায়ের নাম মোসাম্মদ মজিরন বিবি। অল্প বয়সেই তিনি পিতৃ-মাতৃহীন হন। তাঁর এক চাচা ইব্রাহীম খান তাঁকে শৈশবে আশ্রয় দেন। তাঁর কাছে থেকেই তিনি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন।

শিক্ষাজীবন: গ্রামের পাঠশালায় পড়াশোনাকালীন ইরাক থেকে আগত এক পীর সাহেবের স্নেহদৃষ্টি লাভ করেন আবদুল হামিদ খান। সৈয়দ নাসির উদ্দীন বোগদাদি নামের এই পীর সাহেব তাঁকে পুত্রস্নেহে লালপালন করেন। এই পীর সাহেবের কাছেই তিনি আরবি, ফারসি শেখেন। পরে তিনি আবদুল হামিদ খানকে ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসায় পাঠিয়ে দেন। এ সময় তিনি দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ হন।

কর্মজীবন: মাদ্রাসার পড়া শেষ করে আবদুল হামিদ খান কর্মজীবন শুরু করেন। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি টাঙ্গাইলের কাগমারীর এক প্রাইমারি স্কুলে কিছুকাল শিক্ষকতা করেন। এখানে শিক্ষকতাকালে তিনি জমিদারের অত্যাচার, নির্যাতন দেখতে পান। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও সংগ্রাম শুরু করেন। ফলে জমিদারের বিষ-নজরে পড়ে তাঁকে কাগমারী ছাড়তে হয়।

সংগ্রামী জীবন: ২২ বছর বয়সে কংগ্রেস নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আবদুল হামিদ খান অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়। ১৭ মাস পর তিনি মুক্তি পান। এরপর ১৯২৪ সালে সিরাজগঞ্জে এক সভায় কৃষক সাধারণের ওপর জমিদারের শোষণ, নিপীড়ন ও অত্যাচারের কাহিনি তুলে ধরেন। এ সভায় ভাষণের জন্য তাঁকে নিজের জন্মভূমি ছাড়তে হয়। এবার তিনি চলে যান আসামের জলেশ্বরে।

ভাসানী উপাধি: ১৯২৪ সালে আসামের ধুবড়ি জেলার ভাসানচরে বাঙালি কৃষকদের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে আবদুল হামিদ খান এক বিশাল প্রতিবাদী সমাবেশের আয়োজন করেন। এ সমাবেশেই সাধারণ কৃষকেরা তাঁকে ভাসানচরের মওলানা তথা মওলানা ভাসানী নামে আখ্যায়িত করেন। আর তখন থেকেই তিনি হলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।

রাজনৈতিক জীবন: ভারত বিভাগের পর ১৯৪৭ সালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আসাম থেকে পূর্ববাংলায় চলে আসেন। প্রথমে তিনি পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ ও পরে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময় তিনি সাপ্তাহিক ইত্তেফাক পত্রিকা প্রতিষ্ঠা ও প্রকাশ শুরু করেন। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে তিনি আবার গ্রেপ্তার হন। ছাড়া পাওয়ার পর ১৯৫৪ সালে সাধারণ নির্বাচনে তিনি শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। যুক্তফ্রন্ট এ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়।

গণ-অভ্যুত্থানে মওলানা ভাসানীর ভূমিকা: মওলানা ভাসানী বুঝতে পেরেছিলেন, পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের শাসকেরা ধর্ম ও জাতীয় সংহতির নামে পূর্ববাংলার মানুষকে শোষণ করছে। তাই তাদের সঙ্গে একই রাষ্ট্রের বাঁধনে অবস্থান করা আর সম্ভব নয়। সে কারণে ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানি স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৭০ সালের নভেম্বরে পল্টন ময়দানে ভাষণ দানকালে এ কথাটিই বারবার উচ্চারণ করে জাতিকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৫৫, ১৯৫৬ ও ১৯৫৭ সালেও তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর যে অত্যাচার-নিপীড়ন চালাচ্ছে, যে বৈষম্যনীতি অনুসরণ করছে, তা চলতে থাকলে পূর্ব পাকিস্তান একদিন স্বাধীন হয়ে যাবে। তাঁর এ কথা বাস্তব সত্যে পরিণত হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধে মওলানা ভাসানীর ভূমিকা: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর থেকে দেশব্যাপী পাকিস্তানি সেনাদের হত্যাযজ্ঞ শুরু হলে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। মওলানা ভাসানীর টাঙ্গাইলের ঘরবাড়ি পাকিস্তানি সেনারা পুড়িয়ে দেয়। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য তিনি ভারতে চলে যান। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ছিলেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে মওলানা ভাসানী: ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করলে মওলানা ভাসানী স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন। স্বাধীনতার পরও কোনো পদমর্যাদা ও মোহ তাঁকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। তিনি সব সময় জনগণের পাশে থেকে বিভিন্ন জনমুখী কর্মসূচি পালন করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, ভারত কর্তৃক ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে ঢাকা থেকে রাজশাহী পর্যন্ত লংমার্চ পরিচালনা।

শিক্ষা বিস্তারে মওলানা ভাসানী: মওলানা ভাসানী নিজে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া করতে পারেননি, কিন্তু এ দেশের মানুষের জন্য শিক্ষা ও জ্ঞান-বিস্তার প্রসারে ছিল তাঁর অনেক অবদান। তিনি সন্তোষে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মহীপুরে হাজি মুহম্মদ মুহসীন কলেজ, ঢাকায় আবুজর গিফারি কলেজ ও টাঙ্গাইলে মাওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।

মওলানা ভাসানীর মৃত্যু: মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর ৯৬ বছর বয়সে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে টাঙ্গাইল জেলার সন্তোষে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়।

উপসংহার: মওলানা ভাসানীর জীবন থেকে আমরা শিক্ষা পাই প্রগাঢ় স্বদেশপ্রেম, প্রগতিশীল আদর্শ ও প্রতিবাদী চেতনার। তিনি চিরকাল শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায় বেঁচে থাকবেন এ দেশের কোটি কোটি মানুষের হূদয়ে।
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইন্টেরিম সরকারের শেষদিন : গঠিত হতে যাচ্ছে বিপ্লবী সরকার ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২২


ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়াকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্তঃদেশীয় প্রকল্পটা সফল হতে অনেক দিন লেগে গিয়েছিল। বাংলাদেশে সে তুলনায় সংশ্লিষ্ট শক্তিসমূহের সফলতা স্বল্প সময়ে অনেক ভালো। এটা বিস্ময়কর ব্যাপার, ‘রাষ্ট্র’... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিচার চাই? না ভাই, আমরা "উল্লাস" চাই

লিখেছেন মাথা পাগলা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৩৭





দীপু চন্দ্র দাস একটি পোশাক শিল্প কারখানায় চাকরি করতো। সম্প্রতি দীপু দাস তার যোগ্যতা বলে সুপার ভাইজার পদে প্রমোশন পেয়েছিলো।

জানা যায়, সুপারভাইজার পজিশনটির জন্য আরও তিনজন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

মব সন্ত্রাস, আগুন ও ব্লাসফেমি: হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:৫২


ময়মনসিংহে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মধ্যযুগীয় এই ঘটনা এই বার্তা দেয় যে, জঙ্গিরা মবতন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাসফেমি ও শরিয়া কার্যকর করে ফেলেছে। এখন তারই... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×