somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভেজা গোলাপ

২৮ শে জুলাই, ২০১৬ রাত ১০:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



সবকিছুই ঠিক ছিল সেদিন মাঝবিকেল পর্যন্ত। কিন্তু শেষ বিকেলের সূর্যটা যখন পশ্চিমের আকাশে অন্তিম লজ্জায় লাল হল, বদলে যেতে শুরু করলো সবকিছু।
আমি তখন শান্ত একটা মফস্বল শহরের ইট বিছানো রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম। কমলা রঙের ইট- সোজা সোজা লম্বা সারি বেঁধে বিছানো- শাড়ির পাড়ের নকশার মত। আমি দাদীর পুরোনো শাড়ির পাড়ের মত রাস্তাটাকে দেখছিলাম হাঁটতে হাঁটতে।
একসময় টের পাই তারা জীবন্ত। ডোরাকাটা ভয়ংকর সুন্দরী সাপের মত তারা দীর্ঘ শীতের শেষে আড়মোড়া ভাংতে শুরু করেছে। একবার ডানদিকে, একবার বামদিকে। কখনো বা মোচড় খাচ্ছে। আমি অবাক চোখে দেখতে থাকলাম জড় বস্তুর এই অসাধারন প্রাণলীলা...
একসময় আমি নিজেকে আবিষ্কার করি বেশ কিছুক্ষন আগে পার হয়ে আসা একটা যায়গায়- কেন যেন আবার পাড় হচ্ছি ওই যায়গাটা। আমি রাস্তার পাশের বকুল গাছটার দিকে তাকাই। গাছের প্রতিটি ডালে খেলা করছে শান্ত সাগরের স্নিগ্ধ কিছু ঢেউ। গাছের ডাল, পাতা সব একসাথে মিলে মিশে একেকার হয়ে গেল আমার চোখের ঠিক সামনেই। আমি দাঁড়াই। দাঁড়িয়ে সুর্যের দিকে তাকাই। লাল- কমলা রঙের উজ্জ্বল একটা বস্তু আকাশে সেঁটে আছে। তার আকৃতি পরিবর্তিত হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। আমি আবারও মুগ্ধ হলাম চিরচেনা সূর্যের চির অচেনা এই নৃত্যে। বৃত্ত, উপবৃত্ত, মোবিয়াস স্ট্রিপ- কত রুপে যে আজ দেখলাম সূর্যকে। অনেক দিন পর তাকে ডাকলাম- "কেমন আছো তুমি, মামা?" মামা কোন উত্তর দিল না।
সবকিছু কেন যেন কুঁকড়ে যাচ্ছে আজকে। সব বস্তু, আজীবন সোজা চলতে দেখা সময়- সবাই আজ পেঁচিয়ে যাচ্ছে, পথ ঘুরে বেঁকে যাচ্ছে, জট পাকিয়ে পেঁচিয়ে যাচ্ছে একটা আরেকটার সংগে। আমি রাস্তা পার হয়ে মাঠের উপরে আসলাম। সদ্য যৌবন প্রাপ্ত জ্বলজ্বলে সবুজ কিছু ঘাস এখানে ঢেকে রেখেছে মাটির সকল লজ্জা। আমি হাঁটু গেড়ে বসি। ব্যস্তভাবে চড়কির মত ঘুরতে থাকা ওই যুবক যুবতিদের মাথায় আমার আঙুল ছোঁয়াই। ওরা আমার আঙুলে চুমু খেয়ে খেয়ে চলে যায়। ওহ... আমার সারা শরীর শিরশির করে ওঠে আনন্দে..... আর ভালবাসায়। আমি উবু হয়ে চুমু খাই ওদেরকে। মাটিকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকি।
আবার সময় পেঁচিয়ে যায়।
আমি দাঁড়িয়ে আছি ঘাসে ঢাকা ওই মাঠটাতে। হাঁটু গেড়ে বসার ঠিক আগ মুহুর্তে। এবার আর আমি হাঁটু গাড়ি না। আমার চোখ পড়ে লাল টকটকে একটা গোলাপের উপর। সে আর তার দুই উর্বোশী বোন- গাছের ডালে ঝুলছে। আর নিচ থেকে মা পাতা তাদেরকে সতর্ক করছে বারবার- "তাড়াতাড়ি নেমে আয় মা, মৌমিতা নইলে খেয়ে যাবে... আয় মা, নাম, ঘরে ঢোক। সন্ধ্যা হয়ে এল বলে.." আমি হাসলাম। এই বয়সে খাওয়াটা দ্বিপাক্ষিক। মা কি তা জানে না? আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের তিন বোনকে দেখছিলাম। ওরা নাচছে, দুলছে, খেলছে, ভাই পাতার গায়ে ঢলে পড়ছে। নিজেদের লাফালাফিতে ওদের কোমল পাঁপড়িগুলো দুলছে। পেঁচিয়ে যাচ্ছে একটার সাথে আরেকটা। সৌরভ ছড়াচ্ছে, ছড়াচ্ছে মনকে মাতাল করে দেয়া একটা কামনা। আহ... কি সুন্দর.... এই সৌন্দর্য তো লুকিয়ে রাখার নয়। এমন সময় ঠান্ডা বাতাস উঠলো। উঠতি কিছু বাতাস এসে ছুঁয়ে দিয়ে গেল তিন সুন্দরীকে। তারা কেঁপে উঠলো তিরতিরে শিহরণে। বোড় বোন কপট রাগ নিয়ে কোমরে বৃতি পেঁচিয়ে এগিয়ে গেল ওই বাতাসের দিকে- "এই অসভ্য, তোমরা আমাদের গায়ে হাত দিলে কেন?"
বাতাস থোড়াই এগুলো কেয়ার করে- তাদের দল এতক্ষণে কতদূর চলে গেছে... বাকি দুই বোন খিলখিল করে হাসে। আহ... কি রিনরিনে তাদের হাসি। হাসিতে যোগ দেয় বড় বোনও। তিন গোলাপের তরল হাসিতে আমি মোহিত হই, ওদেরকে ভালবেসে ফেলি। তাকিয়ে থাকি এক দৃষ্টিতে। হারিয়ে যাই সৌন্দর্যে। গন্ধে হই মাতাল...
ওরা একসময় আমাকে খেয়াল করে। "কি গো? সেই কখন থেকে এখানে ছ্যাবলার মত দাঁড়িয়ে আছো। তোমার কি কোন কাজ বাজ নেই নাকি? নাকি এর আগে জীবনে কখনো ফুল দেখোনি?"
আমি হাসি। হেসে তাদের দিকে এগিয়ে যাই। ছোট দুই বোন মুখ চেপে হাসে, বড় বোনের ইশাড়ায় দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর আড়চোখে আমাদেরকে দেখে, ফিসফিস করে কি সব বলে আর মুখ চেপে হাসে।
আমার সামনে থাকে ওই বড় টকটকে লাল গোলাপটা। সে আমার দিকে তাকায় আর মুচকি হেসে চোখ ঘুড়িয়ে অন্যদিকে নেয়। আমি তার খুব কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসি। তার শরীরের গন্ধ নেই। আঙুল বুলাই তার নরম কোমল পাঁপড়িতে। আমি শিহড়িত হই। শিহরিত হয় ওই গোলাপও। সে চোখ বুঁজে আমার আঙুলের ছোঁয়া উপভোগ করে। আমি আরো শিহরিত হই। ইচ্ছে করে তার শরীরে প্রেমের হুল ফুঁটিয়ে দিতে, ইচ্ছে করে তার দেহের ভেতরের গহীন ওই কুঠুরির সুধা পান করতে। কিন্তু আমি তা পারি না। সেদিন খুব আফসোস হয় আমার মৌমাছি না হতে পারার জন্য। আজন্ম চিরন্তন ওই বিষাদটাকে মনে চেপে রেখে আমি গোলাপটিকে চুমু খাই। সে লাল থেকে আরো বেশী লাল হয়। আমার লোভ বাড়ে। সংগে সংগে বাড়ে হতাশাও। না পাওয়ার হতাশা, না পারার হতাশা। আমি নিজেকে থামাই। গোলাপটিকে শেষবারের মত আদর করে উঠে দাঁড়াই। সে অবাক হয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমার চোখে দেখতে পায় আমার সব বিষাদ, সব হতাশা, জীবনের সব ক্লেষ, সব অতৃপ্তি। আমি চোখ সড়াই না। তার আর্দ্র চাহুনিতে বের হতে থাকে এক অকৃত্রিম ভালবাসা। আমার মন ভিজে যায় অচেনা এক অপার্থিব রঙে। নির্জীব এই পৃথিবীতে জন্ম নেয়া একটা অপুর্নাংগ জীবনের জন্য এইটুকুই হয়ত সব- আমি নিজেকে বোঝাই।
ওদিকে লাল গোলাপের পাঁপড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ে এক বিন্দু অশ্রু....
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুলাই, ২০১৬ রাত ১১:৪৩
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×