প্রথম লগ্ন :
নিহান বসে আছে ছাদের টাঙ্কির উপর পাঁ ঝুলিয়ে । পরিবেশে চলছে ঘুটঘুটে অন্ধকারের জলসা, অহেতুক কোন কারন ছাড়াই অমাবস্যা যাকে বলে ।নিহানের কাছে অমাবস্যার এই ক্রন্দন বিজড়িত ঘুটঘুটে অন্ধকারটাকেও উপহাস স্বরুপ মনে হচ্ছে ।কারন তার মনে এর থেকেও তীব্র অন্ধকার ভর করছে । আর সেই অন্ধকার শুধু পোড়া কালোই না অত্যন্ত বিভীষিকাময়ও । সে এখন পর্যন্ত তার চাহিদার সবকিছুই পেয়েছে । তার মা বাবা তার কোন শখ আহ্লাদ থেকে কখনো বঞ্চিত করেনি । কিন্তু তাদেরকে আজ নিহানের কাছে খুব যন্ত্রনাদায়ক লাগছে । আবার তাদের থেকেও সে নিজেকে আরও বেশি বিষাক্ত মনে করছে ।তাই সকল অনুকূলতার মধ্যেও সবকিছুই তার কাছে অস্বাভাবিকভাবে প্রতিকূল মনে হচ্ছে ।আজ সে তার জীবনের খুব ভয়ংকর কিছু জেনেছে । এই ‘কিছু’ এতই ভয়ংকর যে তা না জানলেই অনেক ভাল হত । কিন্তু হঠাৎ করে কিছু পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করে এই ‘কিছু’ জানিয়ে দিয়েছে ।
দ্বিতীয় লগ্ন :
সেদিন ছিল নববর্ষের রাত ।নিহানের আব্বা তাকে একটা কাজে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়েছিল । নিহান গ্রামের বাড়ি থেকে শহরে ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় আড়াইটা বেজে যায় । নববর্ষ উদযাপনে ক্লান্ত শহর তখন প্রায় ঝিমিয়ে পড়েছে । নিহানের বাসা বাসস্ট্যান্ড থেকে দশ মিনিট হাঁটার রাস্তা । তাই সে বাসার দিকে হাঁটতে শুরু করে । কিছুদূর যাওয়ার পর রাস্তার পাশে ডাস্টবিনের দিকে চোখ যেতেই নিহান থমকে দাঁড়ায় । বড় ডাস্টবিনটার আশেপাশে আরও এক ডাস্টবিন পরিমান ময়লা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে । সেখানে নিহান দেখতে পায় প্রায় অচেতন এক মহিলা পড়ে আছে । সে আরও কাছে গিয়ে দেখতে লাগলো । মহিলাটা অর্ধনগ্ন, তখনো শরীর থেকে ব্লিডিং হচ্ছে, চেহারা শরীরে খামচির অনেক ক্ষত ।নিহানের বুঝতে কষ্ট হলো না মহিলাটা কোন এক হায়েনা দলের খপ্পরে পড়েছিল । মহিলাটার গলা দিয়ে তখনো গরগর আওয়াজ বের হচ্ছে । মনে হচ্ছে যেন এই মুহূর্তে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবে । নিহান ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা বের করে মহিলার মুখে দিতে লাগলো । মহিলার গলা দিয়ে পানিটা পৌঁছে যাচ্ছে হৃদপিন্ডে ।হেডলাইটের আলো পড়ায় নিহান পেঁছনে তাকিয়ে দেখে রাতে টহলরত পুলিশের গাড়ী এসে হাজির । কিছু বুঝে উঠার আগেই তাকে আর মহিলাটিকে উঠিয়ে নিয়ে যায় । মহিলাকে হসপিটালে পাঠিয়ে নিহানকে নিয়ে ভরে লকাপে । প্রাথমিক কিছু উত্তম মধ্যম অলরেড়ি শুরু হয়েছে নিহানের উপর ।তার কোন কথাই শুনছে না । কোন কিছু বলতে গেলেই এলোপাতাড়ি চড় থাপ্পড় পড়ছে ।পুলিশ কর্তা মহিলাটিকে শনাক্ত করতে পারে । প্রভাবশালী ব্যবসায়ী মতিন আহমেদের স্ত্রী । মতিন আহমেদকে ফোন দিয়ে জানায় পুলিশ কর্তা । মতিন আহমেদ জানে কারা এই কর্মকান্ড ঘটাতে পারে । তবুও তার অনুমতি ছাড়া নিহানকে ছাড়তে কড়া নিষেধ করে দেন ।মতিন সাহেবের স্ত্রীও কোমায় চলে গেছেন ।তাই সত্যি বের করাটা আরও অস্পষ্ট হয়ে যায় ।মতিন দম্পতি সন্তানহীন দম্পতি । মতিন সাহেবের স্ত্রীর সমস্যা । তিনি কখনো সন্তান ধারন করতে পারবেন না । আর মতিন সাহেবেরও বাম পা প্যারালাইজড হয়ে আছে একবছর হয় । স্ক্র্যাচে ভর দিয়ে হাঁটেন । এখনো চিকিৎসা চলছে ।
এইদিকে দিশেহারা নিহানের মা বাবা থানায় এসে পুলিশের কাছে আকুতি মিনতি শুরু করে দিয়েছে । কিন্তু কোন ফল হলো না । পুলিশের কাছেও নিহানকে নির্দোষই মনে হচ্ছে কিন্তু মতিন সাহেব না বললে তাকে ছাড়া যাবে না ।নিহানের মা বাবা ছুটে মতিন সাহেবের কাছে । মতিন সাহেব হসপিটালে ডক্টরস চেম্বারে বসে আছেন । নিহানের বাবা মা সেখানে গিয়ে তাকে অনেক ভাবে বোঝায় যে তাদের ছেলে নির্দোষ । কিন্তু মতিন সাহেব কনফার্ম হওয়া ছাড়া নিহানকে ছাড়ছে না ।তখন ডাঃ গোপাল চেম্বারে প্রবেশ করে মতিন সাহেবকে জানান রিপোর্ট তো বলছে একাদিক ব্যক্তির আলামত । মতিন সাহেব ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেন স্পটে আটক করা ছেলেটি কি জড়িত ? ডাক্তার বলেন সেটা জানতে হলে তো তাকেও টেষ্ট করতে হবে ।নিহানের টেষ্ট নেওয়া হয় । তার কোন আলামত পাওয়া যায়নি ডাক্তার জানালেন । মতিন সাহেব ক্ষমা চেয়ে নিহানদের বিদায় দিলেন ।
মতিন সাহেব এখন পুরোপুরি নিশ্চিত কারা এই কান্ড ঘটিয়েছে ।মতিন সাহেবের স্ত্রী ছোট বেলা থেকেই একটু মর্ডান । তার ছেলেবন্ধু অনেক । মেয়েবন্ধু বলতে গেলে তেমন একটা নেই ।এইসব ছেলে বন্ধুদের সাথেই সে উদর ফুর্তি করে বেড়িয়েছে । বিয়ের পর একটু শান্ত ছিল । কিন্তু মতিন সাহেব প্যারালাইসড হওয়ার পর আবার ওইসব ছেলে বন্ধুদের সাথে আড্ডাবাজিতে মেতে উঠা শুরু করে । সেই রেস ধরেই থার্টিফার্ষ্ট নাইট উদযাপনে বেরিয়ে পড়ে তার স্ত্রী । আর ঔসব নষ্ট বন্ধুরাই তার উপর এমন নির্মম অত্যাচার চালিয়েছে । তার স্ত্রীর শরীরে এ্যালকোহল সেবনের আলামতও পাওয়া যায় । মতিন সাহেব তাদের নামে নারী নির্যাতন কেইস ঢুকে দেন । পুলিশ খুঁজতে শুরু করে দিয়েছে কিন্তু ওরা আগেই পালিয়ে গেছে ।
তৃতীয় লগ্ন :
ডাঃ গোপাল নিহান সম্পর্কে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মতিন সাহেবের কাছে গোপন করেছিলেন । কারন তিনি নিজেই বিষয়টা বিশ্বাস করতে পারছেন না ।এইজন্য নিহানের স্যাম্পল তিনি একাদিকবার টেষ্ট করিয়েছেন কিন্তু ফলাফল একই আসছে বারবার । ডাঃ গোপাল বিশাল ধাঁধার ভেতর পড়ে গেছেন । এইটা কিভাবে সম্ভব! কিছুদিন পর ডাঃ গোপাল নিহানকে ফোন করে আসতে বলেন ।তিনি নিহানকে জিজ্ঞেস করেন তুমি কি আগে থেকেই মতিন সাহেবের স্ত্রীকে চেনো ? নিহান বলে, না, আমি উনাকে ঔইদিন রাতেই প্রথম দেখি । ডাঃ গোপাল বলেন, আচ্ছা । তিনি একটু কাচুমাচু করতে করতে আবার জিজ্ঞেস করেন আচ্ছা তোমার মা বাবারা কি তোমার আসল মা বাবা ? এ কথা শুনে নিহানের মাথা গরম হয়ে যায় সে একটু উত্তেজিত হয়ে বলে আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে! এইসব যা তা কি বলছেন ! ডাঃ গোপাল নিহানকে একটু শান্ত করার চেষ্টা করেন, প্লিজ নিহান তুমি রাগ করো না আমি আসলে অন্যকিছু মিন করিনি । আমার এই বিষয়টা জানা একটু জরুরী, প্লিজ একটু বলো। নিহান একটু শান্ত হয়ে গরগর করে বলে, ১০০% তাঁরা আমার আসল মা বাবা । ডাঃ গোপাল বলেন, ওকে ঠিক আছে, তোমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত প্লিজ কিছু মনে করো না । নিহান প্রশ্ন করে, আপনি এইসব কেন জিজ্ঞেস করলেন সেটা তো বললেন না । ডাঃ গোপাল বললেন, নাহ, তেমন সিরিয়াস কিছু না একটু দরকার ছিল এই আরকি । নিহান আর তেমন পাত্তা না দিয়ে চলে যায় ।এমনিতেই এসব নিয়ে তাকে এই ক’দিন অনেক দকল পোহাতে হয়েছে ।নিহান চলে যওয়ার পর ডাঃ গোপাল নিজেকে মনে মনে গালি দেয় । এইসব ব্যপার জানার জন্য নিহানকে ডাকা তার মোটেও ঠিক হয়নি । ডাঃ গোপালের মাথা রহস্যে জ্যাম হয়ে যাচ্ছে ।শুধু ভাবছেন এইটা কিভাবে সম্ভব !এইটা কিভাবে সম্ভব !
ডঃ গোপাল একপ্রকার প্রতিজ্ঞাই করেছেন এই রহস্য তিনি উদ্ধার করেই ছাড়বেন । কারন এই রহস্য উদ্ধার করতে পারলে চিকিৎসা জগতে নতুন কিছুর আবিষ্কার হবে । তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন এইবার নিহানের মা বাবাকে ডাকবেন ।
- কেমন আছেন আপনারা ?
- জ্বি, ভালো আছি ।
- শুনে খুশি হলাম । আপনাদের ডেকেছি কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা জিজ্ঞেস করার জন্য । অবশ্য গুরুত্বপূর্ণটা আমার জন্য আপনাদের জন্য না ।
- ঠিক আছে বলুন ।
- কিছু মনে করবেননা তো আবার ?
- নাহ কি মনে করবো । তবে মনে করার মত হলে অবশ্যই করবো ।
- আসলে বিষয়টা মনে করার মতই ।
- আচ্ছা ঠিক আছে বলুন । আগেতো শুনে নেই ।
- আচ্ছা, আপনারা বলুন তো নিহান কি আপনাদের আসল সন্তান ?
- কি সব যা তা বলছেন ! নিহানের বাবা রেগে উঠেন ।
- দেখুন আমি একটা ধাঁধার ভেতরে পড়ে গেছি । সেই ধাঁধা থেকে আপনারাই শুধু আমাকে উদ্ধার করতে পারেন । প্লিজ সত্যি সত্যি যদি আপনাদের সন্তান না হয়ে থাকে আমাকে বলুন । আমি কথা দিলাম আমার বাহিরে এইসব কথা আর কোথাও যাবে না ।
- কেন, আপনার কাছে এইরকম মনে হলো কেন ? একটু নরম হয়ে বলেন নিহানের বাবা ।
- আসলে বিষয়টা হচ্ছে কয়েক সপ্তাহ আগে আপনার ছেলে যে মহিলাটিকে বাঁচাতে গিয়েছিল তার ডিএনএ’র সাথে আপনার ছেলের ডিএনএ কাকতালীয়ভাবে মিলে যায় । প্রথমে আমারও বিশ্বাস হয়নি কিন্তু পরে আরো কয়েকবার টেষ্ট করার পরও একই ফলাফল আসে । তার মানে আমি বলতে চাচ্ছি নিহান মতিন সাহেবের স্ত্রীর গর্ভের সন্তান ।
ডাক্তারের এইসব কথা শুনে নিহানের বাবা মা একে অপরের দিকে তাকাতে থাকে । তারা সত্য বিষয়টা আর গোপন করতে পারে না ।
- নিহানের বাবা বলতে থাকে, আমরা সন্তান জন্মদানে অক্ষম দম্পতি । এই নিয়ে আমাদের অনেক কষ্ট হতো । চিকিৎসাও করেছি অনেক কিন্তু দশ বছরেও কোন ফল হলো না । হঠাৎ একদিন আমার এক ডাক্তার বন্ধু আমাকে ফোন করে বলে তার কাছে একটা ''অকাল গর্ভপাতে প্রাপ্ত প্রিম্যাচিওর বেবী'' আছে । চার মাস আগেই তাকে গর্ভ থেকে ত্যাগ করে ফেলা হয় । বেবীটা অপরিপক্ক । তবে এখনো প্রান আছে । হার্টবিট আছে । কিন্তু কন্ডিশান পুরোই ক্রিটিকাল ।না বাঁচার সম্ভাবনাই ৯০% । তবে তোরা যদি রাখতে চাস তাহলে আমি একটা ট্রাই দিয়ে দেখতে পারি । বেবীটাকে তিনমাস নিবিড় পরিচর্যায় রাখলে বাঁচতেও পারে ।
ডাক্তার বন্ধুর কথা শুনে আর আমার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আমি রাজি হয়ে যাই ।তিনমাস পর বেবীটা একটি ফুটফুটে পরিপক্ক বাচ্চায় রুপান্তরিত হয় । মিরাকলই বলা চলে ।আমরা বাচ্চা নিহানকে বাসায় নিয়ে আসি । এর আগে কি হয়েছিল তা আমরা আর জানি না ।
ডঃ গোপাল তাদের বিদায় করে দেন । তিনি গভীর ঘোরে চলে যান ।তাকে এর শেষ অবশ্যই দেখতে হবে ।অবশ্য তিনি নিহানের বাবার বন্ধু ডাঃ মুহিতের ফোন নাম্বার নিয়ে রাখেন ।
......
নীল রক্ত- শেষ পর্ব ( গল্প )
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জানুয়ারি, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৫১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




