somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সম্পর্ক, অথবা জীবন চক্র । (গল্প)

১৬ ই মার্চ, ২০১৫ বিকাল ৫:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শপিং মলের সামনে বাচ্চা ছেলেটি ছোটছুটি করছে । কিছু দূরেই মা দাঁড়িয়ে আছে। অন্যমনস্কভাবে ফোনে কথা বলছে । ছেলেটা একবার দৌড় দিয়ে বেলুনওয়ালার কাছে যায় আবার মায়ের কাছে আসে । সে মায়ের জামা টেনে বলতে চাচ্ছে যে সে বেলুন নিবে । কিন্ত তার দিকে মা খেয়াল করছে না । তিনি ফোনে কথা বলেই যাচ্ছেন । রাস্তার অন্য পাশ থেকে আহাদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে । সে রাস্তা পার হয়ে ছেলেটির পাশে এসে দাঁড়ায় । ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করে বেলুন নিবে কিনা । ছেলেটা বেলুনের দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে ।আহাদ তাকে কোলে তোলে বেলুন কিনে দেয় ।

ছেলেটির মা ফোনে কথা বলা শেষে তার বাচ্চাকে খুঁজতে থাকে । কিন্তু বাচ্চাকে কোথাও দেখছে না। বেলুনওয়ালার কাছে জিজ্ঞেস করতেই সে জানায়, একটা ছেলে তাকে কোলে তুলে বেলুন কিনে দেয় এরপর তাকে নিয়ে ঐদিকে চলে যায়, বেলুনওয়ালা দক্ষিণ দিকে ইশারায় দেখিয়ে দেয় । ছেলেটির মা দৌড়ে ঐদিকে যায় । কিন্তু কোথাও দেখতে পেল না । ছেলেটির মা এদিক ওদিক পাগলের মত খুঁজছে ।

আহাদ একজন ছেলেধরা । তবে সে প্রোফেসনালী এই কাজ করে না । মাঝে মাঝে করে ।তার সাথে একটি ছেলেধরা দলের যোগাযোগ আছে যারা টাকার বিনিময়ে এসব বাচ্চা নিয়ে যায় । তাদেরকে একটি বাচ্চা দিতে পারলে নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা পাওয়া যায় ।মেয়ে বাচ্চা হলে আরও বেশি পাওয়া যায়। তবে আহাদের ছেলেধরা ক্যারিয়ারে সবগুলোই ছেলে ।কারণ বাচ্চা মেয়েদেরকে দেখলে তার কাছে বেশি মায়া লাগে তাই বাচ্চা মেয়ে ধরতে গিয়েও ধরতে পারে না !এই ছেলেধরা দলটি বাচ্চাগুলো নিয়ে কি করে সেটাও আহাদ জানে না ।সে জানতেও চায় না । সে টাকা পায় তাই বাচ্চা দেয়। একটা বাচ্চা ধরে দিতে পারলে সে প্রায় ছয়মাস বিনা পরিশ্রমে খুব আরাম আয়েশ করে চলতে পারে । তাই আহাদের কাছে এর থেকে আর ভাল কাজ কি হতে পারে !

আহাদ একা মানুষ । তার আপনজন বলতে আছে শুধু কয়েকজন মহিলা যাদেরকে সে ছয় বছর বয়স থেকে দেখে আসছে ।তারা একটি সেচ্ছাসেবক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন । তারা প্রায় আঠার বছর আগে রাস্তার পাশে ক্রন্দনরত অবস্থায় আহাদকে পেয়েছিল ।কিন্ত পরে শত চেষ্টা করেও আহাদের পরিচিত কাউকে পাওয়া যায়নি । আর কেউ আহাদেরও খোঁজ করতে আসেনি । এরপর থেকে শিশু অধিকার রক্ষা নামে এই সেচ্ছাসেবক প্রতিষ্ঠানেই তার বেড়ে উঠা । এখানেই সে কাজের বিনিময়ে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান আর সামান্য প্রাথমিক শিক্ষা পেয়েছে । এখন সে এখানে থাকে না তবে মাঝে মাঝে শুধু এই কয়জন মহিলার সাথে দেখা করতে আসে ।

আহাদের কোন স্বপ্ন নেই । তার তেমন কোন বন্ধুবান্ধব নেই । সে থাকে একা, ঘুরে একা ।যখন যে কাজ পায় সেই কাজ করেই জীবন চলে । আর ছেলেধরার পার্টটাইম কাজটুকু করে ।সে একজন সেইন্ট স্মোকার, মাঝে মাঝে গাঞ্জা, লাল পানীয়ও তাকে টানে। তার অবসর সময়গুলো কাটে সিডি দোকানদার কুবেরের পর্ণো মুভির সিডিতে । আর তাতে যদি কাম স্বাদ না মিটে সে চলে যায় কাঁচা মাংসের সন্ধানে রঙ্গিন দুনিয়ায় । কিন্তু ইদানীং এসব কাজ সে করছে না । তবে তার একটা যুক্তিসঙ্গত কারণও আছে তা হল, তার বাসার সামনে একটা অফিস আছে, সেখান থেকে প্রতিদিন কিছু মেয়ে আসা যাওয়া করে, সে এতদিন মেয়েগুলোর সূতোবিহীন শরীর কল্পনায় মনের মাধুরী মিশিয়ে আল্পনা আঁকলেও হঠাৎ একটা মেয়ে এসে তার সকল চিন্তা ভাবনা তছনছ করে দেয় যাকে বলা যায় লাভ এট ফার্স্ট সাইট !সে এখন মেয়েটাকে নিয়ে দিবারাত্রি স্বপ্ন দেখছে । তবে সেটা কোন নষ্ট স্বপ্ন নয় । সে স্বপ্ন দেখে মেয়েটাকে নিয়ে জীবন সংসার করার । এতগুলো বছর তার কোন স্বপ্ন ছিল না এখন সে একটা স্বপ্ন পেয়েছে, বেঁচে থাকার । সে কখনো ভাবেনি যে, একটা মেয়ের কাছেও একটা ছেলের বেঁচে থাকার এমন সুন্দর একটা স্বপ্ন লুকিয়ে থাকে যাদেরকে সে এতদিন ভাবতো একটুকরো টসটসে মাংসপিন্ডমাত্র !

কিন্তু আহাদের সমস্যা অন্য জায়গায় ।মেয়েটাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়া আর আলাদিনের চেরাগ পাওয়া তার জন্য একই কথা । কারণ সকল দৃষ্টিকোণ থেকেই আহাদ মূল্যহীন একটা অভাগা ছাড়া আর কিছুই নয় ।তবে অনেক চিন্তা ভাবনা করে সে একটা পথ বের করেছে সেটা হল পয়সাওয়ালা হওয়া । সে অনেক জায়গায় শুনেছে টাকা থাকলে বাঘের চোখও পাওয়া যায় ।তাই বছরের ছ’মাস না যেতেই সে পাঁচটা ছেলেধরার কাজ করে ফেলেছে । তবে তার গতি আরও বাড়তে পারে কারণ সে এখন স্বপ্ন দ্বারায় চালিত যুবক । তার চোখ এখন হায়েনার মতোই তাকিয়ে থাকে বাচ্চাদের দিকে । অন্যের ভালবাসা কেড়ে নিয়ে সে নিজের ভালবাসার আবাদে ব্যস্ত ।

আহাদ পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে তার ছয় নাম্বার শিকারের দিকে । বাচ্চার এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি সাথে আহাদের মাথাও ডানে বামে যাওয়া আসা করছে । হঠাৎ আহাদের চোখ একটা বাচ্চার চেহারায় আটকে যায় । সে বাচ্চাটাকে চেনে । কয়েকমাস আগে সে বাচ্চাটিকে ধরেছিল । বাচ্চাটা অনেক কিউট ছিলো । মিষ্টি মিষ্টি কথা বলেছিল তার সাথে । তাই এই বাচ্চাটাকে আহাদের মনে আছে ।কিন্তু সে এখানে কি করছে ? সে কি পালিয়েছিল ! নাহ তা তো হতেই পারে না । এতটুকুন বাচ্চা পালাবে কিভাবে ! আহাদ একটু কাছে গিয়ে দেখার চেষ্টা করে । বাচ্চাটার বুকের উপরের অংশ ঠিক আছে কিন্তু নিচের অংশ অদ্ভুত আকৃতি ধারণ করেছে । নিচের অংশে পেটটা বড় হয়ে বের হয়ে আছে, পা দু’টো শরীরের আকার থেকে অনেক ছোট এবং ডানে বায়ে বাঁকানো । তার সামনে একটা বাটি দেওয়া আছে । বাটিতে কিছু টাকা পয়সাও আছে । আহাদ বাচ্চাটার এমন অবস্থা দেখে তার বুকের বাম পাশে চিপ দিয়ে ওঠে । সে ভেবে পাচ্ছে না বাচ্চাটার এমন আকৃতি হলো কিভাবে । আহাদ আজকের শিকারের বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ভাবতে ভাবতে চলে যায় ।

প্রতিবারের মতো আজকেও সেই দুজন লোকই আসে আহাদ থেকে বাচ্চাটি নেওয়ার জন্য । আহাদ আজকে ওদেরকে প্রশ্ন করে বসে এই বাচ্চাগুলো নিয়ে তারা কি করে ? তাদের মধ্যে একজন খুব রেগে যায় প্রশ্ন শুনে । সে বলে, ওই শালারপুত তোর বাচ্চা সাপ্লাই দেওয়ার কাজ বাচ্চা সাপ্লাই দিবি । এতো কথা জানার তোর কি কাজ ? আরেকজন তাকে থামায়া বলে, আরে জানতে চাইছে জানুক না এতো রাগার কি আছে ! সে এবার তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, শোন, আমরা এই বাচ্চাগুলো নিয়ে কয়েকমাস পাতিলে ভরে রাখি । যখন তাদের শরীরের আকৃতি পরিবর্তন হয়ে যায় তখন তাদেরকে ভিক্ষায় বসায়া দেই । এই কথা বলে ওরা আহাদের দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে, এইবার খুশি ? দে তাড়াতাড়ি বাচ্চাটা দেয়, না হয় তরেও সাইজ কইরা বসায়া দিমু । আমাদের কাছে কিন্তু খুব ভাল ভাল ডাক্তার আছে তরে এমন সুন্দর করে সাইজ করবে যে তুই টেরই পাবি না... হা হা হা !আহাদ তাদের এইসব কথা শুনে বাচ্চাটাকে নিয়ে ওখান থেকে সজোরে দৌড় লাগায় । সে শুধু দৌড়াতে থাকে । পেছনেও ফিরে তাকায় না । অনেকক্ষণ দৌড়ানোর পর সে দাঁড়ায় ।পেছন ফিরে দেখে ওদেরকে আর দেখা যাচ্ছে না । সে বাচ্চাটিকে নিয়ে যে জায়গায় ধরেছিল সেখানে যায় । সে বাচ্চার মালিককে খুঁজছে । এদিক ওদিক তাকিয়ে থালা নিয়ে বসে থাকা বাচ্চাটাকেও দেখার চেষ্টা করছে । কিন্তু বাচ্চাটা এখন নেই ।

আহাদ বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর বাচ্চাটার খোঁজে একজন আসে । আহাদ বাচ্চাটাকে তার হাতে তুলে দিয়ে বাসায় চলে আসে ।সে অনেক ক্লান্ত । ক্ষিধাও লেগেছে খুব কিন্তু খেতে ইচ্ছে করছে না । পেটটা কেমন যেন করছে, মনে হচ্ছে যেন বমি হবে । কিন্তু বমি হতে গিয়েও হয় না । সে গোসল করে শুয়ে পড়ে । সকালে সূর্য উঠার সাথেই উঠে যায় । সে কখনো এতো সকালে উঠেনি । সারারাত তার নির্ঘুম কেটেছে । সারারাত তার মনে এসেছে শুধু অদ্ভুত আকৃতির বাচ্চাটাকে ।বাচ্চাটির করুণভাবে তাকিয়ে থাকা দৃশ্যটি তার চোখের সামনে ভেসেছে শুধু ।কাজের মেয়েটা এসেছে । সে জিজ্ঞেস করছে, ভাইজান সকালে নাস্তা কি খাইবেন? আহাদ মেয়েটার দিকে তাকায় তারপর বলে , আমাকে এক গ্লাস পানি দাও তো । সে এক ঢোকে পানিটা খেয়ে ফেলে । এই প্রথম সে পেটে কিছু নিয়েছে । কাজের মেয়েটাকে কিছু না বলেই শার্টটা গায়ে দিয়ে বের হয়ে যায় আহাদ ।

আহাদ থানার সামনে ঘোরাঘুরি করছে । সে পুলিশকে সব কিছু বলতে চায় কিন্তু ভয় পাচ্ছে ।কারণ ছেলেধরার কাজতো সেও করেছে পুলিশ যদি তাকেও হাজতে দিয়ে দেয় । টংয়ের দোকান থেকে সিগারেট ধরায় সে, টেনশন কমানোর জন্য । লম্বা নিঃশ্বাসে ধোঁয়া নিচ্ছে, লম্বা নিঃশ্বাসে ধোঁয়া ছাড়ছে । সিগারেট শেষে পায়ের নিচে চাপা দিয়ে সে ঢুকে পড়ে থানার ভেতর ।পুলিশ কর্তাকে সবকিছু খুলে বলে । পুলিশ কর্তা সব শুনে মোবাইল নিয়ে কাকে যেন ফোন করে । মোবাইলে কথা শেষে পুলিশ কর্তা আহাদকে লকাপে নিয়ে যায় । আধাঘন্টার মতো লকাপ ভেতর থেকে শুধু ধোলাই আর চিৎকারের শব্দ শোনা গেল । এরপর লকাপ থেকে আহাদকে বের করে আনে পলিশ কর্তা । আহাদ এর কিছুই বুঝতে পারছেনা । শুধু বুঝতে পারছে তার শরীরের তীব্র ব্যথাটুকু ।পলিশ কর্তা মুখের ঘাম মুছতে মুছতে আহাদের দিকে তাকায়, তর সাহস তো কম না, তুই লুলা ভাইয়ের নামে কমপ্লেইন করতে আসচছ । লুলা ভাই বলেছে দেখে তরে ছেড়ে দিলাম না হয় ছেলেধরা মামলায় তরে আজীবন হাজতে পাঠিয়ে দিতাম, যা এখন বাড়ি যা । আহাদ ছেঁড়া শার্টটার বোতাম লাগাতে লাগাতে বেরিয়ে যায় । তার শরীর প্রচন্ড ব্যথা করছে । হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছে । কোনমতে বাসায় গিয়ে শুয়ে রইল ।

বিকালের ঘুমে আহাদ জেগে উঠে পরদিন ভোরে । তার চোখ খুলতে কষ্ট হচ্ছে । শরীরে অনেক জ্বর । সে চোখ খুলতেই দেখে একদল লোক তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ।তাদের মধ্যে দু’জনকে আহাদ চেনে । সে বাচ্চাগুলোকে এদের কাছে তুলে দিতো । লোকগুলোর মাঝে একজন বিমর্ষ চেহারার ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে । তাকে দেখলে যে কেউই ভয় পাবে । লোকটা আহাদের দিকে তাকিয়ে খুব হাস্যজ্জলভাবে বলে, স্যার, আমি লুলা ভাই, আপনার নামটা কি জানতে পারি ? আহাদ নামটা শুনে উঠে বসতে চায়, লোকটা আবার বলে, স্যার আপনার উঠার কোন প্রয়োজন নাই, আপনি রিলাক্স করেন, আমরা কিছুক্ষণ কথা বলে চলে যাব, এরপর আপনি রেস্ট ইন পিসে যাইয়েন । রেস্ট ইন পিস এর অর্থ লুলা ভাই জানে না । তার কিছু বিদেশী কাস্টমার আছে তাদের কাছ থেকে শুনে সেও মাঝে মধ্যে কিছু ইংরেজি ছেড়ে দেয় হোক সেটা কাজে কিংবা অকাজে । সে এই ইংরেজি শব্দগুলো মূলত ছাড়ে তার সাগরেদদের শোনানোর জন্য তারা যেন বুঝতে পারে সে অনেক জ্ঞানী !

লুলা ভাই আহাদকে আবার জিজ্ঞেস করে, স্যার আপনার নামটা কি জানতে পারি ? আপনি তো আমার স্টার । স্টারের নাম না জানলে কি হয় ! আহাদ তার নাম বলে ।

তো আহাদ স্যার আপনার শরীর কেমন ? শুনলাম পুলিশবাবু নাকি আপনাকে খুব ধোলাই দিসে ? কেনো শুধু শুধু আপনি আমার নামে কমপ্লেইন করতে গেলেন । শুধু শুধু কষ্ট পেলেন । আমি পুলিশবাবুকে না বললে তো আমি শেষ হয়ে যেতেন । আমার জন্য আপনি এমন একটা বিপদ থেকে ছাড়া পেলেন আর আমার কোন উপকার করবেন না তা কি হয় ! শোনেন স্যার, আমার একটা ছোট্ট উপকার করেন । আগামী এক মাসে আমাকে দশটা বাচ্চা দিবেন তারপর আপনার কাছে আর কিছু চাইবো না । এই কথা শুনে আহাদ আবার উঠতে চায়। লুলা ভাই আবার বলে,
স্যার আপনার এতো উত্তেজিত হওয়ার কোন কারণ নেই । আপনি এই কাজ নাও করতে পারেন সে ক্ষেত্রে না হয় আমরা আপনাকেই সাইজ করে আমাদের ব্যবসায়ের একটা নতুন ব্রাঞ্চ খুলে দিলাম। কি বলেন ! লুলা ভাইয়ের এই কথা শুনে সাগরেদরা সঝোরে হাসতে থাকে ।
লুলা ভাই বলে, এই তরা থাম স্যারের ডিস্টার্ব হচ্ছে তো । তো স্যার একমাস, দশটা, ওকে । আসি এখন আমরা, ঠিক আছে ? আপনি আরাম করে ঘুমান । এই চল । লুলা ভাই চলে যায় ।
লুলা ভাইয়ের কথাগুলো শুনে আহাদের জ্বর আরও বাড়তে থাকে । সে ভাবছে কি দরকার ছিল হাতে ধরে এই বিপদে পা দেওয়ার । এই পৃথিবীতে যে মানুষ নেই তা কেন ভুলে গিয়েছিলাম ? আমি তো অমানুষের মতোই বড় হয়েছি তাও কেন ভুলে গেলাম ? আমি এখন দশটা বাচ্চা কিভাবে দেব ? এইসব প্রশ্ন ভাবতে ভাবতে আহাদ আবার ঘুমিয়ে যায় ।

দশদিন পর...
আহাদ বসে আছে কুবেরের দোকানে । কুবের সাউন্ড কমিয়ে নতুন আসা পর্ণোগুলো টেস্ট করছে । আহাদ টিভির চ্যানেল পাল্টাছে শুধু । তার কিছু ভাল লাগছে না । এখনও সে একটা বাচ্চা জোগাড় করতে পারে নি । এদিকে লুলা ভাইয়ের লোকেরা প্রতিদিন ফোন করে ভয় দেখাচ্ছে ।আহাদ আসলে বাচ্চা জোগাড় করতে পারছে না যে তা নয়। এই কাজ তার কাছে হাতের ময়লা । কিন্তু সে আর বাচ্চা ধরতে চায় না । সে আর কোন বাচ্চার এমন বিমর্ষ পরিনতি চায় না । কিন্তু এই কাজ না করলে যে লুলা ভাই তাকেই থালা দিয়ে বসিয়ে দেবে । তার মাথায় এখনো কিছুই কাজ করছে না । চ্যানেল পাল্টাতে পাল্টাতে হঠাৎ একটা চ্যনেলে আহাদের চোখ আটকে যায় । খবরে বলছে, শিশু পাচারকারী লুলা ভাই এবং তার দুই সহযুগীসহ ক্রস ফায়ারে নিহত । শিশু পাচারকালে র্যাচবের সাথে বন্দুক যুদ্ধে তারা নিহত হয় । আহাদ খবরটা শুনে নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারছে না । সে আরও চ্যানেল ঘাটতে থাকে ।প্রায় সব বাংলা চ্যানেলেই খবরটা দেখাচ্ছে এবং মৃত লুলা ভাই ও তার দুই সহযুগীকেও দেখাচ্ছে । আহাদ খুশিতে কি করবে সে বুঝতে পারছে না । সে কুবেরের দিকে তাকায় । কুবের তখনো তার কাজে ব্যস্ত ওঁ... আঁ শব্দ নিয়ে । আহাদ কুবেরের গলা জড়িয়ে একটা চুমো বসিয়ে দেয় । কুবের হা হয়ে তাকায় !... এই বেটা তুই আবার ওইটা হইলি কবে !! আহাদ হাসতে থাকে আর বলে, কুবের তোকে একটা কথা বলি ? কুবের বলে, বল । তুই আর এইসব দেখিস না, এইসব খুব খারাপ, বিক্রিও করিস না । কুবের অবাক হয়ে আহাদের দিকে তাকায় । এই পোলায় কয় কি ! যে আহাদ তার এইসবের প্রথম কাস্টমার হয় সে কিনা এই কথা কয় ! কুবের ঠিক নিজের কানকে বিশ্বাস করাতে পারছে না। আহাদ আবার বলে, যাইরে দোস্ত । খুব ঘুম পাচ্ছে । আহাদ এই কথা বলে বেরিয়ে যায় । কুবের আহাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, বাইঞ্চত ! সে আবার তার কাজে মনযোগ দেয় ।

আহাদ বাসায় গিয়ে একটা ঘুম দিবে । সে গত কয়েকদিন একটুও ঘুমাতে পারেনি ।লুলা ভাই তাকে ঘুমাতে দেইনি ।অথচ সে লুলা ভাই নিজেই চিরতরে ঘুমিয়ে গেল ।ভাবতেই আহাদের বেশ ভাল লাগছে । ফুরফুরে মেজাজে সে তার শরীর বিছানায় এলিয়ে দিয়ে গভীর ঘুমে চলে যায় ।সে ঠিক কতক্ষণ ঘুমালো তা জানে না কিন্তু হঠাৎ ফোন বেজে উঠায় তার ঘুম ভেঙ্গে যায় । শিশু অধিকার রক্ষা প্রতিষ্ঠানের খালা ফোন করেছে । খালার কথা শুনে তার ঘুমের ঘোর পুরোপুরি কেটে যায় । সে খালার কথা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না । খালার ফোনটা কেটে দিলো । সে ছাদে ঝুলে থাকা ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে আছে । তার চোখের দু’পাশ গড়িয়ে পানি পড়ছে । সে তার মাকে মনে করার চেষ্টা করছে । সেই ছয় বছরের চোখ এখনো মা’কে একটু একটু মনে করতে পারে । মায়ের কোলে শুয়ে উল্টো করে মাকে দেখা । মা বড় বড় চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকতো । তাকে গল্প শুনাতো । মায়ের ডান গালের বড় তিলটা ধরে সে বার বার বলতো এইটা কি মা ? মা মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমো দিয়ে বলতেন এইটা হলো তুমি যেন আমাকে চিনতে পারো তার চিহ্ন । আমি আবার জিজ্ঞেস করতাম, তুমি আমাকে চিনবে কি করে ? মা আমার প্রশ্ন শুনে হাসতো আর বলতো তুমি আমার লহ্মীসোনা তোমাকে আমি চিনবো না তো কে চিনবে ! এইসব ভাবতে ভাবতে আহাদের শুধু কান্না পাচ্ছে ।আহাদ বিশ্বাস করতে পারছেনা যে সে তার মাকে দেখবে ।সে শার্টটা পড়ে তাড়াতাড়ি বের হতেই কাজের মেয়েটা হাজির ।সে বলল, মামা আজ কি রানমু ? বাজার করছেন ? আহাদ পকেট থেকে টাকা বের করে বললো, এই নাও তোমার পুরো মাসের টাকা । তোমাকে ছুটি দিয়ে দিলাম আর আসতে হবে না । আহাদ বেরিয়ে যায় । কাজের মেয়েটা আহাদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, মাসের দশদিনও যায়নি অথচ পুরো মাসের টাকা দিয়ে দিয়েছে ।

আহাদ খুব জোরে জোরে হাঁটছে । সে জানে সে তার মাকে দেখেই চিনে ফেলবে । সেই ডানপাশের বড় তিলটা নিশ্চয় এখনো আছে । মাকে দেখেই সে চিনতে পারলো এবং জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদলো । সেই ছয় বছরের আহাদের মত । মাও কাঁদলো । এই কান্না যেন দীর্ঘ হাহাকারের শেষ ঝর্ণাধারা । মা ছেলে দু’জন ঘরে ফিরলো । দু’জনের মনে জমা হয়েছে হাজারও কথা । আহাদ মায়ের পেছন পেছন ঘরে ঢুকলো । আহাদের বুক হাহাকার করে উঠলো । এই ঘর তার খুবই চেনা । ছোট্ট আহাদ সারা ঘরজুড়ে হামাগুড়ি দিয়েছে, ছোটছুটি করেছে, মায়ের সাথে লুকালুকি খেলেছে ।একটা রুমের দরজায় গিয়ে আহাদ হঠাৎ দাঁড়িয়ে যায় । ভেতরে একটা মহিলা উষ্কখুষ্ক চুলে রুমের এপাশওপাশ হাটাহাটি করছে আর বিড়বিড় করে যেন কি কি বলে যাচ্ছে । আহাদ মাকে জিজ্ঞেস করে মহিলাটা কে? সে এমন করছে কেন ? মা বলে এ তোমার ছোট বোন । আমার নাতিটা হারিয়ে গেছে আজ একমাসের উপরে হয়ে গেছে । কতো ছটফটে ছিল নাতিটা । কিন্তু এখনো কোন খোঁজ মেলেনি । মেয়েটা আমার প্রায় পাগল হয়ে গেছে । নাতিকে খুঁজতে গিয়েই তো তোমাকে পেলাম । আফসুস করে ওখানে তোমার বর্ণনা দিতেই মহিলাটি তোমার কথা বললো ।তোমার কপালের দাগটার কথা বললো । এই দাগটা ছোটকালে রুপা দিয়ে দিয়েছিলাম তুমি যেন আর মারা না যাও । কারণ তোমার আগে আমাদের আরও দুটি সন্তান জন্মের কিছুদিনের মধ্যে মারা গিয়েছিল ।এই কথাগুলো বলতে বলতে মা তার মেয়েকে ডাকলো, এই সুমনা এদিকে দেখ নাতিকে খুঁজতে গিয়ে কাকে পেয়েছি ! এ তোর হারিয়ে যাওয়া ভাই ! আহাদ ! এদিকে তাকা দেখ কতোবড় হয়ে গেছে সে । সুমনা মাথা ঘুরিয়ে আহাদের দিকে তাকালো । আহাদ উষ্কখুষ্ক চুলের মুখটা দেখে থমকে গেল যেন কিছুক্ষণের জন্য । সুমনা তার দিকে বিবর্ণ হয়ে তাকিয়ে আছে ।

সে রাতে ঘর থেকে আহাদ আবার হারিয়ে গেল । তাকে আর কখনো পাওয়া যায়নি......
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মার্চ, ২০১৫ রাত ৯:২৯
২৪টি মন্তব্য ২৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×