somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার চোখে বঙ্গবন্ধু: চারটি কঠিন প্রশ্নের উত্তর

০৮ ই মার্চ, ২০১৩ বিকাল ৩:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বঙ্গবন্ধু কেমন মানুষ ছিলেন সেটা বিবেচনায় যাওয়ার আমার দরকার কি? বঙ্গবন্ধুকে বিচার-বিবেচনা করার মত যোগ্যতা কি আমার আছে? বঙ্গবন্ধুর নাম মুখে নেওয়ার 'অপরাধে' আমাকে আবার আওয়ামী লীগের আদমি বলে বিবেচনা করা হবে না তো? আমি তো আওয়ামী লীগ করি না, ভাল লাগে না। আমি তো হাসিনাকেও পছন্দ করি না। উনি বেশি কথা বলেন। আমি তো কোন দলই করি না। দল ছাড়া কি মানুষ হতে পারে না? কোন একটা রাজনৈতিক দলকে কি আমার সাপোর্ট করতেই হবে? এটা কি মাজহাবের মতো নাকি? মানুষ হয়ে জন্মেছি দেখে কোন একটা ধর্ম থাকতে হবে এমন কিছু? ধর্ম ছাড়াও তো মানুষ আছে। দল ছাড়াও মানুষ থাকতে পারে, আছে না অনেকে? আমি তেমনই একজন। আমি সব দলকে মাইক্রোস্কোপের নিচে রেখে পজিটিভ-নেগেটিভ আলাদা করতে পছন্দ করি। উত্তরাধুনিক যুগে একজন তরুণ কোন একটি দলকে সারা জীবন পছন্দ করার মানসিকতা ধারণ করবে কেন? কেন সে কোন রাজনৈতিক দলের বা নেতার মানসিক দাসত্ব করবে? দলের বা নেতার অপছন্দনীয় বিষয়গুলো কেন সাহস করে মুখ ফুটে বলতে পারবে না? অন্য কেউ বলতে চাইলে কেন তাকে থামিয়ে দেয়ার জন্য হাত-পা নিশপিশ করবে?

কিন্তু আমার মতো দল ছাড়া মানুষের মুখে একজন 'দলীয়' মানুষের নাম কেন? দল ছাড়া মানুষের তো ভয়ে ভয়ে থাকার কথা। তার তো কোন রাজনৈতিক মানুষের নাম মুখে আনার কথা না; পাছে যদি কোন দলের লোক বলে 'ট্যাগ' দিয়ে দেয়া হয়! কিংবা কোন মতামত কারও পক্ষে বা বিপক্ষে যাচ্ছে দেখে পছন্দের তালিকা থেকে নাম কেটে দেয়া হয়? হামলা-মামলা-কুৎসা-রটনার কথাও ভুলে যাচ্ছি কেন! দল ছাড়া মানুষের ভয়টা আমার নেই কেন? নির্বিরোধী মানুষ হিসেবে সেই ভয়টা কি থাকা উচিত না? নাহ। মানি না। দলহীন মানুষদের উচ্চারণ বরঞ্চ আরও সাহসী হওয়া উচিত। দলহীন মানুষরা যেহেতু কারও অন্ধ অনুকরণ করে না তাই তাদের সাহসী হওয়ার পথ বেশি প্রশস্ত। দলহীন মানুষরা যেহেতু কারও দাসত্ব করে না তাই তাদের চিন্তা-চেতনা-মতামত স্বচ্ছ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

তাই বঙ্গবন্ধু নিয়ে কথা বলতে আমার কোন সঙ্কোচ নেই। এই দেশের মানুষ হিসেবে তাকে মূল্যায়ন করার অধিকার আমারও আছে। ইতিহাস যতটুকু পড়েছি, জেনেছি, বুঝেছি তাতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমার কোন বিতৃষ্ণা নেই। উৎসাহের পরিমাণটাই বেশী। কিন্তু তাকে নিয়ে আমি এখানে কোন বিশদ আলোচনায় যাচ্ছি না। শুধু আমার টুকরো কয়েকটি ভাবনা সহজ কিন্তু স্পষ্ট করে তুলে ধরবো। যা অনেকের ভাবনার সাথে মিলে যাবে আবার অনেকের সাথে মিলবে না।

বঙ্গবন্ধু কি অবিসংবাদিত নেতা নাকি দলীয় নেতা?

অবশ্যই বঙ্গবন্ধু একজন অবিসংবাদিত নেতা। যারা তাকে শুধু আওয়ামী লীগের নেতা মনে করেন তারা ভুল করেন। এই ভুলের দায়ভার তাদের নিজেদের যেমন আছে তেমনি খোদ আওয়ামী লীগের উপর বর্তায়। পঁচাত্তর পরবর্তী আওয়ামী লীগ, বিশেষত ছিয়ানব্বইয়ের নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকার এর জন্য দায়ী। ছিয়ানব্বইয় থেকে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এতো বেশী মাতামাতি করেছে যে লোকজন বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল। আমার মনে আছে সেই সময়ে বিটিভিতে এতো বেশী 'বঙ্গবন্ধু চর্চা' করা হতো যে বঙ্গবন্ধুকে ব্যাঙ্গ করে 'বঙ্গবল্টু' ডাকা হতো, 'জাতির পিতা' কথাটিকে বিকৃত করে বলা হতো 'জুতার ফিতা'। এর জন্য কে দায়ী? শুধু কি বিটিভি তথা বঙ্গবন্ধু চর্চা কেন্দ্র, নাকি খোদ বঙ্গবন্ধু কন্যা? যিনি সবকিছুতে পিতার নামের স্বাক্ষর দেখতে চেয়ে পিতাকেই বিতর্কিত করে ফেলেছেন। নাকি আওয়ামী নেতা-কর্মীদের? যারা নেত্রীকে খুশ রাখতে গিয়ে হুশ হারিয়ে ফেলেন।

আওয়ামী লীগ দেশের নেতা বঙ্গবন্ধুকে বানিয়েছে শুধু তাদের দলের নেতা। লেবু বেশি চাপলে যেমন তিতা হয়ে যায় বঙ্গবন্ধুর দশা হয়েছে তেমন। আওয়ামী লীগের বর্তমান আমলেও সেই ধারা অব্যাহত আছে। গুণকীর্তনেরও যে একটা সীমাবদ্ধতা আছে এবং পরিমিতি বোধের অভাব যে বিপরীত পরিণতি ডেকে আনে সেই সহজ সত্যটা তারা বুঝতে চায় না। তাই যেখানে সেখানে বঙ্গবন্ধুর নাম নিতে নিতে মুখে ফেনা তুলে লোকজনকে বিরক্ত বানিয়ে ফেলে।

এইসব কারণে এখন যদি কেউ একজন অবিসংবাদিত নেতাকে দলের নেতা বলে তাচ্ছিল্য করতে থাকে দোষটা কি সেই দলের ঘাড়েই পরে না?

যুগ পাল্টেছে, মানুষের চিন্তাধারা বদলেছে, এখন প্রচারের ভাষাও বদলেছে, আর বঙ্গবন্ধু কোক বা পেপসি নয় যে তাকে এভাবে প্রচার করতে হবে। আজকাল কোক কম্পানিও যদি কারও কানের কাছে এসে সারাদিন 'কোক খাও' 'কোক খাও' বলে ঘ্যাঙ ঘ্যাঙ করতে থাকে তবে কোক প্রিয় পানীয় হলেও বিরক্ত হয়ে ছেড়ে দিতে পারে।

বঙ্গবন্ধু শাসক হিসাবে কেমন ছিলেন?

বঙ্গবন্ধু একজন উঁচু দরে মানুষ ছিলেন তাই বলে ফেরেশতা ছিলেন না। ঘোর আওয়ামী লীগ যারা করেন তারা বঙ্গবন্ধুকে ফেরেশতা হিসাবে প্রচার করতে পছন্দ করেন। কিন্তু একজন মানুষকে ফেরেশতার সঙ্গে তুলনা করতে হবে কেন? ফেরেশতা মানুষের চেয়ে বড় হলো কোন দিক থেকে? মানুষকে হাজারটা সমস্যা ও পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, ফেরেশতাদের কি সেই সব ঝামেলা আছে? বঙ্গবন্ধু যেমন একজন মানুষ ছিল তাই মানবীয় দোষ-ত্রুটিও তার ছিল। তাই হয়তো তাজউদ্দীন আহমেদের সঠিক মূল্যায়ন করা হয়নি, পরিবার ও দলীয় লোকদের লাগাম ছাড়া কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি, বাকশালের মতো ভয়ংকর ব্যাপার-স্যাপার মাথায় চেপে বসেছিল। কিন্তু তার আশে-পাশের লোকগুলোকে দায়ী করা ছাড়া শুধু তাকে তো দায়ী করা যাবে না! তাই বলে তো বঙ্গবন্ধুর যাবতীয় অবদানের কথা অস্বীকার করা যাবে না! একটা যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশকে পরিচালনা করা চাট্টিখানি কথা ছিল না।

বঙ্গবন্ধু কি জাতির জনক?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বলা হয় জাতির পিতা, ফাদার অফ দি ন্যাশন। কোন জাতির পিতা? বাঙালি জাতির? বাঙালি তো পশ্চিম বাংলায়ও আছে। তাদের কাছে তো বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা না। বাংলাদেশে তো অবাঙালিও আছে, তাদের জন্য কি বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা হবেন না?

সোজা কথা হল, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জনক। তার হাত ধরে বাংলাদেশের চূড়ান্ত স্বাধীনতা এসেছিল। এটা অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামে অনেক জাতীয় নেতার ভূমিকা ছিল, কিন্তু শেষ পরিণতিটা বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই হয়েছিল। যুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানে কারাবন্দী ছিলেন, তিনি নিজে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেননি- এগুলো কোন কাজের কথা না। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে- এটাই চরম সত্য। ভৌগলিক বা রাষ্ট্রীয় জাতীয়তার ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা-পুরুষ, বাংলাদেশের জাতির পিতা বা জাতির জনক।

বঙ্গবন্ধু কি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি?

আমার কাছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি তিনজন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম এবং শেখ মুজিবুর রহমান। রবীন্দ্রনাথ আমাদের মানসলোকের প্রথম সার্থক মুক্তিদাতা, বাঙালি সংস্কৃতির ভাষ্যকার। নজরুল শুধু মনের মুক্তিতে থেমে থাকেননি, তিনি পরাধীনতার শিকল ভেঙ্গে প্রকৃত মুক্তির মন্ত্র শিখিয়েছেন। শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলাকে দিয়েছেন বহু কাঙ্ক্ষিত মুক্তির অমিয় স্বাদ, শত্রু মুক্ত আকাশ-বাতাস।

আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।


পূর্বপুরুষদের সমালোচনা করার চেয়ে পূর্বপুরুষদের অবদানের কথা আমরা যেন বেশি করে স্মরণ করি; সমস্ত মানসিক দাসত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখি। এটাই প্রত্যাশা।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মার্চ, ২০১৩ বিকাল ৩:৪৭
৩০টি মন্তব্য ৩০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মানুষের জন্য নিয়ম নয়, নিয়মের জন্য মানুষ?

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৪৭



কুমিল্লা থেকে বাসযোগে (রূপান্তর পরিবহণ) ঢাকায় আসছিলাম। সাইনবোর্ড এলাকায় আসার পর ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি আটকালেন। ঘটনা কী জানতে চাইলে বললেন, আপনাদের অন্য গাড়িতে তুলে দেওয়া হবে। আপনারা নামুন।

এটা তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

একটা গাছ কাঠ হলো, কার কী তাতে আসে গেলো!

লিখেছেন নয়ন বড়ুয়া, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:০৬



ছবিঃ একটি ফেসবুক পেইজ থেকে

একটা গাছ আমাকে যতটা আগলে রাখতে চাই, ভালো রাখতে চাই, আমি ততটা সেই গাছের জন্য কিছুই করতে পারিনা...
তাকে কেউ হত্যা করতে চাইলে বাঁধাও দিতে পারিনা...
অথচ... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। কালবৈশাখী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:২৪



গত পরশু এমনটি ঘটেছিল , আজও ঘটলো । ৩৮ / ৩৯ সে, গরমে পুড়ে বিকেলে হটাৎ কালবৈশাখী রুদ্র বেশে হানা দিল । খুশি হলাম বেদম । রূপনগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন খাঁটি ব্যবসায়ী ও তার গ্রাহক ভিক্ষুকের গল্প!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৪


ভারতের রাজস্থানী ও মাড়ওয়ার সম্প্রদায়ের লোকজনকে মূলত মাড়ওয়ারি বলে আমরা জানি। এরা মূলত ভারতবর্ষের সবচাইতে সফল ব্যবসায়িক সম্প্রদায়- মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে অভ্যাসগতভাবে পরিযায়ী। বাংলাদেশ-ভারত নেপাল পাকিস্তান থেকে শুরু করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×