হ্যাঁ শুভ্রই তো, ক্লাস সিক্স থেকে ক্লাস এইট পর্যন্ত ক্লাসের সেকেন্ড বয় ছিল।
শুভ্র আপন মনে বলল, মেয়েটা এমন একটা বোরকা পরেছে শুধু মুখ কেন, চোখ দু’টাও দেখার উপায় নাই। নাক পর্যন্ত ঢাকা, শুধুমাত্র চোখ দু’টা খোলা আছে তারওপর আবার সানগ্লাস। মানুষ এখনো এত পর্দা মানে? মেয়েটা খুব গোঁড়া নাকি? নাকি একেবারে ধর্মান্ধ? নাকি কেউ দেখলে তার রুপ ক্ষয় হয়ে যাবে?
উর্মী একটা চাপা নিঃশ্বাস মোচন করল, উঃ এতদিন সবার কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছি, আমার জীবনে তখন একটার পর একটা অঘটন ঘটেই যাচ্ছিল, তারপর সবচেয়ে কলংকিত ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার পর থেকে সেই যে বোরকা পরেছি তারপর আর কারো সামনে বোরকার ভেতর থেকে মুখ বের করিনি। শুধু তাই নয় আমি নিজেকে আড়াল করার জন্য অ্যাফিডেভিড করে নিজের নাম চেঞ্জ করেছি। সব সময় নিজেকে খুব কাছের বান্ধবীরা ছাড়া অন্য কারো কাছে পরিচয় দিইনি কিন্তু আজ বোধ হয় আর শেষ রক্ষা হলো না।
উর্মী নিজেকে সামলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল, নিজের মনের কাছে সান্ত্বনা খুঁজে বের করার চেষ্টা করল, আমি তো বোরকা পরে আছি আমার শুধুমাত্র চোখ দু’টা দেখতে পাবে, শুধু মাত্র চোখ দেখে কি সাত/আট বছর আগের কোন মেয়েকে কেউ চিনতে পারবে? না, না, তা পারবে না কিন্তু আমার কণ্ঠস্বর? আমি আমার কণ্ঠস্বর লুকাবো কি করে?
উর্মী আবারো নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, যাক এখানে তো অনেকেই আসে ঘটনাক্রমে এই যে শুভ্রর সঙ্গে আমার দেখা হলো আর তো কোনদিন দেখা নাও হতে পারে। কয়েকমিনিট কোনভাবে কাটিয়ে দিতে পারলেই হয়।
উর্মী মুখ ফিরিয়ে নিল।
উর্মী সব সময় যে রকম বোরকা পরে থাকে তাতে কেউ তাকে চিনে ফেলার কথা নয়। শুভ্রও উর্মীকে চিনতে পারেনি।
উর্মী রিসিপশনিস্টকে সালাম দিয়ে তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা দিল।
রিসিপশনিস্ট জিজ্ঞেস করল, আপনি আফসানা বেগম উর্মী?
জি।
কম্পিউটার সেকশনে নতুন জয়েন করবেন?
জি।
আপনি বসুন প্লিজ।
দু’বার জি বলতে শুনেই যেন শুভ্র চমকে উঠল তার কাছে উর্মীর কণ্ঠস্বরখুব পরিচিত মনে হলো। সে মনে করার চেষ্টা করল, এই কণ্ঠস্বরতার কাছে খুব পরিচিত, যেন তার অনেক কাছের।
রিসিপশনিস্ট শুভ্রকে জিজ্ঞেস করল, আপনি?
জি আমিও জয়েন করতে এসেছি।
কম্পিউটার সেকশনে?
জি।
উর্মীর বুকটা আবার ধক্ করে উঠল। তারমানে কিছুক্ষণ না একই সেকশনে অনেকদিন কাজ করতে হবে? শুভ্র কোনকিছু জানে না তো। ওরা ধামইরহাট থেকে চলে যাবার অনেক পরের সেই ঘটনা? পত্র-পত্রিকায় আমার নামে লেখালেখি এসব?
রিসিপশনিস্ট শুভ্রর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, দেখি আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা?
শুভ্র তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা দিল।
রিসিপশনিস্ট অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা দেখে বলল, একই পদে?
শুভ্র হাসল।
রিসিপশনিস্ট মৃদু হেসে বলল, সো ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম। মিঃ শুভ্র আপনিও বসুন। আমি ভাই’র সঙ্গে কথা বলি। তারপর আপনাদের বলছি।
শুভ্র বসল।
রিসিপশনিস্ট ইন্টারকমে উর্মী আর শুভ্রর পরিচয় দিয়ে তাদেরকে ভিতরে পাঠিয়ে দেওয়ার অনুমতি চাইল।
রিসিপশনিস্ট ইন্টারকম রেখে দিয়ে বলল, আপনারা একটু বসুন।
উর্মীর মুখ যেন কালো মেঘে ঢেকে গেল। সে বুকে একটা হাহাকার অনুভব করল, আজ বোধ হয় আর নিজেকে আড়াল করতে পারলাম না। শুভ্র যখন আমার সবকিছু জানবে তখন কি ভাববে? শুভ্র কি বুঝবে আমার কোন দোষ ছিল না। নাকি আমাকে প্রতারক মনে করবে? এতদিন পর আবার আমি এমন বিব্রতকর অবস্থায় পড়লাম। উঃ তুই কেন আমাকে ছেড়ে চলে গেলি মামুন? কেন এমন করলি? কেন আমাকে এত ভালবাসলি? পাগলামি করে শেষ পর্যন্ত নিজের জীবনের চেয়ে আমাকে বেশি ভালবাসলি? মামুন তুই থাকলে আমি সমস্ত কিছু ছেড়ে তোর কাছে চলে যেতাম, আমি যত অপরাধই করি না কেন তুই আমাকে ফিরিয়ে দিতিস্ না। সব কলংক মুছে দিয়ে তুই আমাকে বুকে তুলে নিতিস্।
মানুনের কথা ভাবতেই এক অর্থ পিপাসু, হৃদয়হীন অমানুষের স্মৃতি উর্মীর হৃদয়ে ভেসে উঠল, নেমকহারাম, আমার জীবন নষ্ট করলি শুধু জেল পর্যন্তই তোর শাস্তি হওয়া ঠিক হয়নি তোর ফাঁসি হওয়া উচিত ছিল।
কয়েকমিনিট পর পিয়ন এলো।
রিসিপশনিস্ট বলল, প্লিজ আপনারা ভিতরে যান।
শুভ্র চেয়ার ছেড়ে উঠল কিন্তু উর্মী উঠল না।
উর্মীকে আনমনা বসে থাকতে দেখে শুভ্র ডাকল, হ্যালো ম্যাডাম চলুন।
উর্মী নিজের কণ্ঠস্বরলুকানোর জন্য কিছু বলল না।
শুভ্র আপন মনে বলল, কি আনসোশ্যাল মেয়ে রে বাবা? কোন কথা বলল না।
একটা চেম্বারেএকজন মধ্যবয়সী ভদ্র লোক বসে ছিলেন।
দু’জনে সালাম দিয়ে ভিতরে ঢুকল।
তিনি গম্ভীরস্বরেবললেন, বস।
দু’জনে চেয়ারে বসল।
ভদ্রলোক আগে নিজের পরিচয় দিলেন, তারপর শুভ্রর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম?
শুভ্র বলল, জি স্যার আমার নাম জহিরুল ইসলাম শুভ্র।
স্যার বলবে না আমাদের এখানে কেউ কাউকে স্যার বলেনা, একজন আরেকজনকে ভাই বলে, তোমরা আমাকে জামান ভাই বলে ডাকবে।
শুভ্র মাথা নেড়ে বলল, জি ভাই।
জামান সাহেবের ইন্টারকম বেজে উঠল।
তিনি রিসিভ করে বললেন, জি ভাই।
তারপর তিনি অপর পাশের কথা শুনে বললেন, জি ভাই ঠিক আছে।
জামান সাহেব উর্মীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি তো উর্মী?
জি।
শুভ্র কিছুটা অবাক হলো তারমানে উর্মী সবার পুর্বপরিচিত।
জামান সাহেব শুভ্রকে জিজ্ঞেস করলেন, শুভ্র তো আগেও কাজ করেছ?
জি ভাই।
আচ্ছা তোমরা জয়েনিং লেটার লিখে এনেছ?
শুভ্র বলল, জি।
উর্মী তুমি?
উর্মী মাথা বাঁকিয়ে জানাল সে জয়েনিং লেটার লিখে আনেনি।
জামান সাহেব কলিং বেল টিপ দিতেই পিয়ন চলে এলো।
জামান সাহেব বললেন, আগে হাসানকে আসতে বল তারপর আমাদের জন্য তিন কাপ কফি দিয়ে যাও।
উর্মী বলল, সরি ভাই আমি এখন কিছু খাব না।
জামান সাহেব বললেন, তাহলে দু’কাপ।
কয়েকমিনিট পর হাসান ভিতরে ঢুকল।
জামান সাহেব উর্মীর অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার এবং শুভ্রর কাছ থেকে জয়েনিং লেটারটা নিয়ে হাসানকে দিয়ে বললেন, হাসান এই হলো উর্মীর অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার আর শুভ্রর জয়েনিং লেটার, তুমি উর্মীর জয়েনিং লেটারটা তৈরী করে নিয়ে আসো।
জি ভাই আনছি, বলে হাসান চলে গেল।
কিছুক্ষণ পর কফি চলে এলো।
কফি খেতে খেতে জামান সাহেব অনেক আলাপ করলেন। তারপর ইন্টারকম তুলে বললেন, ভাই আমি কি উর্মী আর শুভ্রকে আপনার কাছে নিয়ে আসব।
অপর পাশ থেকে কি বলল তা শোনা গেল না।
ওকে ভাই থ্যাংক ইউ।
জামান সাহেব ইন্টারকম রেখে বললেন, উর্মী চল তোমাদের একবার এডিটর ভাই’র সঙ্গে পরিচয় করে দিই।
দু’জনে জামান সাহেবের সঙ্গে গেল।
এডিটর সাহেবের সঙ্গে কথা বলে জামান সাহেব তাদের দু’জনকে তাদের সেকশনের সকলের সঙ্গে পরিচয় করে দিয়ে ডেস্ক দেখিয়ে দিয়ে বললেন, উর্মী তুমি এখানে বসবে আর শুভ্র তুমি পাশের ডেস্কে বসবে। উর্মী তোমার জয়েনিং লেটারটা নিয়ে এলে সই করে দিও।
থ্যাংক ইউ ভাই।
তোমরা তাহলে বস। কোন কাজ না বুঝলে আমার কাছে চলে আসবে। মনে রাখবে আমাদের কম্পিউটার সেকশন অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং কাজের মান অত্যন্ত উন্নত আমরা এই গুডউইলটা ধরে রাখতে চাই।
দু’জনে বলল, জি ভাই, আমরা আপনাকে সহযোগিতা করব।
শুভ্র আপন মনে ভাবতে লাগল, এত পরিচিত কণ্ঠস্বরযেন অনেকদিন আগে শুনেছে কিন্তু উর্মীকে সেকথা জিজ্ঞেস করতে গিয়ে যেন তার মুখ আড়ষ্ট হয়ে গেল।
কিছুক্ষণ দু’জনে নীরব। পিয়ন একটা কাগজ এনে উর্মীকে দিল।
উর্মী কাগজটা নিয়ে ইন্সট্রাকশনটা পড়ে কাজ শুরু করল।
কয়েকমিনিট পর উর্মীই প্রথম কথা বলল, মিঃ শুভ্র একটু দেখবেন?
শুভ্র তার চেয়ার ছেড়ে উর্মীর কাছে গেল। কম্পিউটারে ডিজাইনটা দেখে বলল, খুব সুন্দর হয়েছে।
শুভ্র সাহেব আপনি কিন্তু আমাকে খুশি করার চেষ্টা করছেন। আমি জানি আসলে ডিজাইনটা আরো সুন্দর করা যেত। প্লিজ আপনি যদি একটু দেখতেন, প্রথম কাজ তো, বলে উর্মী চেয়ার ছেড়ে দিল।
শুভ্র কিছুক্ষণ কাজ করার পর উর্মী ডিজাইনটা দেখে বলল, আরো সুন্দর হয়েছে, আমি বলেছিলাম না আপনি দেখলে আরো সুন্দর হবে, থ্যাংক ইউ মিঃ শুভ্র।
মোস্ট ওয়েলকাম মিস্ উর্মী, বলেই শুভ্র জিহব্বায় কামড় কাটল, সরি এখনো জানা হয়নি আপনি মিস্ নাকি মিসেস্?
উর্মী মনে মনে বলল, সরি বলার দরকার নাই, আমি আনমেরিড কি না জানার জন্য আপনি ইচ্ছা করেই একথা বলেছেন।
শুভ্র উর্মীর দিকে তাকিয়ে রইল।
উর্মী বলল, কোনটাই বলতে হবে না, আপনি আমাকে শুধু উর্মী এবং তুমি বলেই ডাকবেন।
শুভ্রর উর্মীর কণ্ঠস্বর আবারো খুব পরিচিত বলে মনে হলো।
সে বলল, আচ্ছা উর্মী তোমার তোমার কণ্ঠস্বরআমার খুব পরিচিত মনে হচ্ছে, মনে হচ্ছে তোমাকে কোথায় যেন দেখেছি?
উর্মী যেন চমকে উঠল, সরি শুভ্র সাহেব আপনাকে কোথাও দেখেছি বলে তো আমার মনে পড়ছে না।
উর্মী তুমি কিন্তু নিয়ম মানলে না আমরা একসঙ্গে, একই পোস্টে কাজ করছি আমাকে তুমি বলে ডাকলেই খুশি হব।
উর্মী কোন কথা বলল না।
কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর শুভ্র আবার বলল, উর্মী তোমার গ্রামের বাড়ী যেন কোথায়?
উর্মী পাশ কাটিয়ে বলল, শুভ্র তুমি কিন্তু একেবারে ব্যক্তিগত প্রশ্ন করলে?
সরি উর্মী।
শুভ্র আর কোন কথা বলল না। বার বার করে তার মনে হলো উর্মী যেন তার অনেকদিনের চেনা কিন্তু নাম কিংবা চাল-চলন কিছুই মিলছে না। তার সঙ্গে একটা মেয়ে পড়ত তার গলার স্বর ঠিক উর্মীর মতোই, মেয়েটার নাম ছিল মায়া। ক্লাস এইট পর্যন্ত ধামইরহাট একসঙ্গে লেখাপড়া করেছে তারপর থেকে আর কোন যোগাযোগ নাই। মায়ার পুরো নাম ছিল মৌসুমী আক্তার মায়া। আর উর্মীর নাম আফসানা বেগম উর্মী। শুধুমাত্র কণ্ঠস্বরপরিচিত বলে মনে হচ্ছে, শুভ্র একবার উর্মীর দিকে তাকাল কিন্তু কোনকিছু বলল না।
চলবে...
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে অক্টোবর, ২০১০ রাত ৮:৫৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




