আমরা সবাই জানি যে, পড়াশোনা ছাড়া জ্ঞানার্জন করা খুবই কঠিন কাজ। আর জ্ঞানার্জনের জন্য পড়তে হয় বইপুস্তক। তবে, কেবল পাঠ্য বই পড়লেই পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব নয়। এ জন্য কুরআন-হাদিস, ইসলামী বইপুস্তক ও পত্রপত্রিকা পড়া দরকার। মানুষ যাতে সহজেই বই সংগ্রহ করে জ্ঞানার্জন করতে পারে সেজন্য বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে পাঠাগার। তাছাড়া, পরিবারের সদস্যরা যাতে জ্ঞানার্জন করতে পারে সে জন্য অনেক বাড়িতে গড়ে তোলা হয়েছে ছোটখাট পাঠাগার। জ্ঞানের চর্চা ও বিকাশের ক্ষেত্রে লাইব্রেরী বা পাঠাগারের ভূমিকা অনেক বেশি বলেই যুগে যুগে পাঠাগার গড়ে উঠেছে। এখানে একটি কথা বলা জরুরি আর তা হলো- এই পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা ইসলামী সভ্যতার একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। পাঠাগার হচ্ছে একটি মুসলিম ঐতিহ্য। মূলতঃ ধর্মীয় নির্দেশনার কারণেই মুসলমানরা পাঠাগার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জ্ঞান চর্চায় আগ্রহী হয়ে ওঠে। পবিত্র কুরআনে নামাজ পড়ার ব্যাপারে ৮২ জায়গায় তাগিদ দেয়া হলেও জ্ঞান- চর্চার ওপর তাগিদ দেয়া হয়েছে ৯২ জায়গায়। এ থেকেই বুঝা যায় যে, ইসলাম জ্ঞানচর্চার ওপর কত বেশী গুরুত্ব দিয়েছে! মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থের নাম হচ্ছে কোরআন যার অর্থই হলো 'অধ্যয়ন'। আর পবিত্র কোরআনের প্রথম নাজিলকৃত শব্দ 'ইকরা' অর্থাৎ 'পড়'। অন্যদিকে রাসূল (সাঃ) বলেছেন, 'জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর ওপর ফরজ’, ‘দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অর্জন করতে থাকো, ‘জ্ঞান অর্জনের প্রয়োজনে যদি সুদুর চীন দেশে যেতে হয় তাহলে সেখানেই যাও।' ইসলামের এসব সুস্পষ্ট বক্তব্যের কারণেই মধ্যযুগে যখন গোটা ইউরোপ অজ্ঞানতার অন্ধকারে ডুবে ছিল, তখন মধ্যপ্রাচ্য, স্পেন, উত্তর আফ্রিকা, গ্রানাডা ও কর্ডোভাসহ মুসলিম দুনিয়ার প্রায় সর্বত্র পাঠাগার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জ্ঞানচর্চার প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যায়। অষ্টম শতাব্দীতে বাগদাদের খলিফাগণ 'দারুল হিকমা' প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্লেটো, এরিস্টেটল প্রমূখ বিশ্বখ্যাত মনীষীর গ্রন্থাবলী গ্রীক ভাষা থেকে আরবী এবং পরবর্তীতে ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করেন। এর মাধ্যমে মুসলমানরা ইউরোপের জ্ঞান বিজ্ঞানকে সংরক্ষণ করেছেন। শুধু গ্রীক ও ইউরোপই নয়, প্রাচীন ভারতবর্ষে ইসলামের আগমনের পূর্বে প্রচলিত শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শনেরও সংরক্ষন করেছে মুসলমানরা। জ্ঞান তৃষ্ণা নিবারণ ও পাঠাগার গড়ার ব্যাপারে মুসলমানরা সবসময় ছিলেন দৃঢ় প্রত্যয়ী। এজন্য তাদেরকে বিভিন্ন বাঁধার সম্মূখীন হতে হয়েছে; এমনকি জ্ঞান চর্চা করতে গিয়ে অনেককে জীবনও দিতে হয়েছে। এ সম্পর্কে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা এখানে উল্লেখ করছি। 'জাহেজ' নামে তৎকালীন আরব বিশ্বের একজন জ্ঞান তাপস ছিলেন। বৃদ্ধ বয়সে এসেও তার বইপ্রীতি এতটুকুওকমে যায়নি। তিনি যখন কোন বই পেতেন তা নিজ ঘরে স্তুপাকারে সাজিয়ে রাখতেন। একদিন তিনি তার বিশালবই ভান্ডার থেকে একটি বই টেনে বের করার চেষ্টা করছিলেন। এমন সময় বইয়ের ভারকেন্দ্র নড়ে যায়। আর চারপাশ থেকে এক এক নেমে আসা বইয়ের নিচে চাপা পড়ে মারা যান এই জ্ঞান তাপস।' প্রাসঙ্গ কিভাবে এখানে একটি বিষয় জানানো জরুরি মনে করছি। আর তার হলো, বই তৈরী করার জন্য দরকার কাগজ। আর এ কাগজ তৈরীর বিদ্যা মুসলমানরাই সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। হিজরী প্রথম শতাব্দীতে মুসলমানরা সমরখন্দের চীনা সম্প্রদায়ের কাছ থেকে এ বিদ্যা শিখে তা আরব বিশ্বে নিয়ে আসেন। এরপর হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীতে বাগদাদ ও মিশরে কাগজের কল স্থাপন করা হয়। খলিফা মামুনের রাজত্বকালে বাগদাদে কাগজের ব্যাপক প্রচলন দেখা যায়। অথচ সে সময় ইউরোপীয়রা কী করে লিখতে হয় তাও জানতো না! ইসলামী শাসনামলে মুসলিম বিশ্বে তিনটি খ্যাতিমান জ্ঞানচর্চা কেন্দ্রের একটি হলো মিশরের রাজধানী কায়রো। সেখানকার অসংখ্য পাঠাগারের একটি হলো বায়তুল হিকমা। ৯৮৮ সালে ফাতেমী খলিফা আল আজিজ এটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই পাঠাগারে এক লক্ষ ভলিয়ুম বই ছিল। এরমধ্যে অন্তত ছয় লক্ষ বাঁধাই করা বইসহ দুই হাজার চারশ' চিত্রিত কোরআন শরীফ ছিল। আর ইউরোপে যখন কোন স্কুল ছিল না তখন স্পেনের মুসলমানরা জ্ঞানচর্চার জন্য যে অগণিত বই ব্যবহার করতো তার নামের তালিকাটিই ছিল ৪৪ খন্ডে বিভক্ত!.. ইতিহাস থেকে আরো জানা যায়, হালাকু খান বাগদাদ দখল করে 'দারুল হিকমাতে' আগুন ধরিয়ে দিলে মানবেতিহাসের সবচেয়ে বড় পাঠাগারটি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সেই ছাই দজলা নদীতে নিক্ষেপ করা হলে দীর্ঘ ছয় মাস দজলা নদীরপানি কালো রং ধারণ করে। এসব তথ্য প্রমাণের মাধ্যমে একটা জিনিস পরিস্কার যে, ধর্মীয় বাধ্যবাধকতার কারণে মুসলমানরা জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে যে ধারার সূত্রপাত করেছিলেন তা-ই তাদের দুনিয়ার নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত রেখেছিল। কিন্তু তারা যখন জ্ঞান চর্চাকে ছেড়ে দিয়ে মুর্খ তাকে গ্রহন করেছিল তখন তাদের ওপর নেমে এসেছিল নানারকম জুলুম, নির্যাতন আর লাঞ্ছনা।
সুতরাং পাঠাগার গড়ার ক্ষেত্রে অতীতের মুসলমানরা যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে গেছেন, নিজেদের স্বার্থেইতার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। আমরা একটু কষ্ট করলেই আমাদের আশেপাশে চমৎকার সব পাঠাগার গড়ে তুলতে পারি; পারি জ্ঞানের আলোয় সমাজকে আলোকিত করতে। তাই এসো বন্ধুরা, আমরা শ্লোগান ধরি; 'বই হোক আমাদের নিত্য সঙ্গী আর পাঠাগার হয়ে উঠুক আমাদের জ্ঞান চর্চার প্রাণকেন্দ্র।'
সংরক্ষিত