ডিজিটাল পাসপোর্ট করতে চান, তবে ডিজিটাল হয়রানির জন্য প্রস্তুত থাকুন
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
বিদেশে চাকুরী, ভ্রমন ও ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে যেতে চান সেজন্য আপনার প্রয়োজন পাসপোর্ট। পাসপোর্ট ছাড়া বৈধ ভাবে দেশের গন্ডি পেরোনোর কথা ভাবাই যায় না। তাই বিদেশে যাওয়ার জন্য দেশের প্রত্যেকটি নাগরিকের জন্য পাসপোর্ট সংগ্রহ বাধ্যতামূলক। বন্ধুরা আজ আপনাদের শোনাব পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে গিয়ে কি ধরনের বিড়ম্বনার শিকার হতে পারেন সে কথা।
পাসপোর্টের আবেদনের জন্য প্রথমেই আপনাকে ব্যাংকে টাকা জমা দিতে হবে। তবে কোন কোন ব্যাংকের কোন কোন শাখায় টাকা জমা দেয়া যাবে সে ব্যপারে কোন বিস্তারিত তথ্য পাওয়াটা মুশকিল। তবে কোন এক জায়গায় দেখেছিলাম আবেদনকারী স্ব স্ব এলাকার সোনালী ব্যাংকে আবেদনের টাকা জমা দিতে পারবেন। বাড্ডায় থাকি বলে মধ্য বাড্ডায় সোনালী ব্যাংকের শাখায় গিয়ে যোগাযোগ করলে তারা জানায় তারা টাকা জমা নেন না, মহাখালী ব্রাঞ্চে যোগাযোগ করতে বললেন। মহাখালী ব্যাংকে টাকা জমা দিতে চাইলে তারা জানালো যেহেতু আমি বাড্ডায় থাকি তাই আমাকে উত্তরা মডেল টাউন ব্রাঞ্চে টাকা জমা দিতে হবে। সেখান থেকে উত্তরা রাজলক্ষীর অপজিটে অবস্থিত সোনালী ব্যাংকে টাকা জমা দিতে চাইলে সংশ্লিষ্ট একজন আমাকে বলল আপনি ৭ নম্বর রোডের ১৫ নম্বর বাড়িতে যান। সেখানে যখন পৌছলাম তখন বিকাল চারটা বাজতে ৫ মিনিট বাকি। টাকাটা জমা দিয়ে দিলাম। সেখান থেকে বাসায় ফিরে ভাবলাম বড় ঝামেলার কাজটা শেষ হয়ে গেছে।
অনলাইনে আবেদনের কাজ সেরে মনে কারলাম আসল কাজ শেষ, এখন যাব সিরিয়ালে দাড়াব, ছবি তুলব আর আংগুলের ছাপ দিলেই কাজ শেষ। কিন্তু বিধি বাম।
২৪ আগস্ট সকাল ৯ টায় হাজির হলাম উত্তরার ১২ নম্বর সেক্টরের ৭ নম্বর রোডের আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে। গিয়ে দেখি বিশাল লাইন। সেখানে সিরিয়াল দিতে হয়। আমার সিরিয়াল হলো ১৪৭। ঘন্টার পর ঘন্টা পার হয়ে যায় কিন্তু লাইন এগোয় না। এমন ও হয়েছে দেড় ঘন্টা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, এই সময়ের মধ্যে এক পাও এগোতে পারিনি। একটু আগ্রহ নিয়ে লাইন থেকে বের হয়ে সামনের দিকে গিয়ে দেখি বড় সড় একটা জটলা। গেটে দায়িত্বে আছেন পুলিশ সদস্য, সেনা সদস্য ও নিজস্ব নিরাপত্তা কর্মী। তারা সুযোগ বুঝে লাইন ছাড়া ৪-৫ জন করে ভেতরে ডুকতে দিচ্ছেন। এই কারনে লাইন যে এগোতে পারছে না সেটা বুঝতে বেশী সময় লাগল না। কাগজ পত্র পরিক্ষার জন্য যে দুজন বসে আছেন তারা গড়ে প্রতি মিনিটে ২ জনের কাগজপত্র পরিক্ষা করে দেখছেন। তাহলে ঘন্টায় ও দুজন ব্যক্তি ১২০ জনের কাজ পরিক্ষা সম্পন্ন করতে পারেন। দুপুর যখন ১ টা বেজে গেলো তখন কোন ঘোষণা ছাড়াই কাগজপত্র পরিক্ষা করেন যে দুজন কর্মকর্তা তারা চলে গেলেন। ততক্ষনে সিরিয়াল গিয়েছে মাত্র ১১৫ নম্বরে। সবাই তখন ও লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে দায়িত্বরত কেউ বলছেন না যে দুপুর ১ টার পর আর আবেদন পত্র জমা নেয়া হবে না। সেখানে দায়িত্বরত এক সেনা সদস্যকে জিজ্ঞেস করলাম লাঞ্চের পর আর আবেদনপত্র জমা নেয়া হবে কি না? জবাবে তিনি জানালেন, নেয়া হবে। পরে সেখানকার নিজস্ব নিরাপত্তা কর্মীকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানালেন আজকের জন্য এখানেই শেষ।
সেদিনের মত বাসায় ফিরে আসলাম। পরদিন সকাল ৭ টায় আবার হাজির হলাম পাসপোর্ট অফিসে। আগের দিনের অসহায় মানুষ গুলো আজ খুব ভোরে হাজির হয়েছে। চেনা চেহারা গুলো দেখে চিনতে পারলাম। এত সকালে গিয়েও আমার সিরিয়াল হলো ৮৩। তবে এতটুকু নিশ্চিত যে আজ ভেতরে যেতে পারব। তবে আজকে যেটা হলো, গতকাল যারা ফর্ম জমা দিতে পারেন নি তারা আজ এক জোট হলো, সিরিয়াল ছাড়া কাউকে গেটের ভেতর ডুকতে দেয়া হবে না। আমাদের মধ্যে একজন সেই মহান দায়িত্ব নিলেন। লাইন ছাড়া কেউ ভেতরে গেলেই সবাই সমস্বরে চিৎকার করে উঠতে লাগল তাকে বের করে দেবার জন্য। তাতে কাজও হলো। এভাবে প্রায় ১০-১৫ জনকে ভেতর থেকে বের করে দিতে সক্ষম হয়েছিলাম সবাই এক জোট হওয়ার কারনে। তবুও লাইন ভেঙ্গে অনেকে ভেতরে প্রবেশ করেছিলেন যারা কোন সিরিয়ালই নেন নি। আর এই কষ্ট লাঘব করতে তারা প্রত্যেকে দালালকে দিয়েছেন সাধারন পাসপোর্টের জন্য ৪৫০০টাকা এবং এক্সপ্রেস পাসপোর্টের জন্য ৮০০০ টাকা। তবে কেউ যদি ৩ দিনে পাসপোর্ট নিতে চায় তাকে দিতে হবে ১০০০০ টাকা।
সবার জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি, পাসপোর্ট অফিসে ৩ বার লাইনে দাড়াতে হয়। তবে যারা অনলাইনে আবেদন করেছেন তাদের দুবার। ঘুষ ও দালাল ছাড়া পাসপোর্ট করতে চাইলে কিছুটা ভোগান্তি পোহাতে হবে। আবেদন পত্র জমা দেয়ার জন্য লাইনে দাড়াতে হবে কমপক্ষে সাড়ে ৩ ঘন্টা থেকে ৪ ঘন্টা। আবেদন পত্র মঞ্জুর হবার পর সিরিয়াল নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে হবে। যারা হাতে আবেদন পত্র পূরন করেছেন তাদেরকে দোতলায় আবেদনপত্র ডাটাবেজে আপডেট করার জন্য লাইনে দাড়াতে হবে। সেখানে সময় লাগতে পারে কমপক্ষে ২ থেকে আড়াই ঘন্টা। সবশেষে ছবি তোলা ও ফিংগার প্রিন্টের জন্য লাইনে দাড়াতে হবে সেখানে সময় লাগবে দেড় থেকে ২ ঘন্টা।
আবেদনপত্র পরিক্ষায় যে অনিয়ম দেখলাম তা সত্যি বিস্মিত হবার মত। কারো লেখা স্পস্ট নয়, আবেদনপত্র ২ সেট জমা দিতে হয়, অপর কপি ফটোকপি দেয়া যাবে না, জন্মনিবন্ধনের কপি হাতে লেখাটা চলবে না, কম্পিউটার কম্পোজটা লাগবে, ভোটার আইডি কার্ডে নামের বানান ভুল থাকলে চলবে না, সব ঠিক থাকলে বিদ্যুৎ বিলের কাগজ দেখতে চাইবে যেটা মোটেও জরুরী না, সব কাগজপত্র সত্যায়িত করে নেবার পরও হঠাৎ করে অরিজিনাল কাগজপত্র দেখতে চাইতে পারে এ রকম হাজারো অজুহাত। কিন্তু একটা কথা হলো একটা মানুষ ৩-৪ ঘন্টা লাইনে দাড়ানোর পর একটা ঠুনকো অজুহাতে তার আবেদন বাতিল করে নতুন করে আবেদন করতে বলা হয়। ব্যর্থ হয়ে বের হবার পর তাকে দালাল চক্র আমন্ত্রন জানবে। তার কাছে ১৫০০ টাকা চাইবে। দিতে পারলে তার ওই আবেদনপত্র মঞ্জুর হয়ে যাবে। তাকে লাইনে দাড়াতে হবে না, পুলিশ ভেরিফেকেশন ও লাগবে না। তাহলে একটা ঘংবদ্ধ দালাল চক্র এখানে কাজ করছে যেখানে কাজ করছে পুলিশ সদস্য, সেনা সদস্য, পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারী, নিজস্ব নিরাপত্তা কর্মী। তার অর্থ দাঁড়ায় এখানে প্রতিটা মানুষ দালাল।
নিচতলা থেকে সিল নিয়ে ৩ তলায় গিয়ে লাইন ধরলাম। কারন অনলাইনে আবেদন করাতে ২য় তলায় লাইন ধরতে হলো না। সেখানে গিয়েও একই চিত্র। বিশাল লাইন। আমি প্রায় ৪০-৫০ জনের পেছনে। এখানেও লাইন এগোয় না। একটু পর পর সেনাবাহিনীর লোক ও অফিসের স্টাফ বাহির থেকে লোক এনে সিরিয়ালে না দারিয়ে সরাসরি ছবি ও আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে চলে যাচ্ছে। যা এক প্রকার মগের মুল্লুক বললেও চলে। প্রায় দেড় ঘন্টা দাড়ানোর পর অতিষ্ঠ হয়ে সবাই আবার একজোট হলো। সিদ্ধান্ত হলো অফিস স্টাফ ও সেনাসদস্য ছাড়া অন্য কোন লোককে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না। এরপর সবাই হাত দিয়ে রাস্ত বন্ধ করে দিলো। কিছুক্ষন পর এক সেনা সদস্য এক লোককে নিয়ে ভতরে ডুকতে চাইলে সবাই প্রতিবাদ জানায়, সেই সাথে সেই লোকের হাত ধরে টেনে সবাই লাইনের পেছনে নিয়ে যায়। অনেক অনুরোধ করেও সেই সেনা সদস্য আমাদের মন গলাতে পারলেন না। দুপুর তখন আড়াইটা বাজে। লাইনে দাঁড়ানো লোক গুলো তখন ও না খেয়ে। তাই মিস্টি কথায় তো আর চিড়া ভিজবে না। সবাই এক জোট হওয়ার পর লাইন দ্রুত এগোতে লাগল। আমার সামনে তখন ও ১০জনের মত। এই দশ জনের কাজ শেষ হয়ে ১০ মিনিটের ও কম সময় লাগল। কারন ভেতরে ছবি তোলার জন্য ৬ টা বুথ আছে। তবে আমাদের মধ্যে থেকে যে ভাই নিজ উদ্যোগী হয়ে এই কাজটি করেছিলেন তার উপর সেনা সদস্য ও অফিস স্টাফটা ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। আমি যখন ভেতরে যাই তখন একজন অপর জনকে বলছে, বাহিরে হলে ওকে পিটিয়ে বের করে দিতাম। সেই সময় বুঝের আরেক জন বলল, যেখানে টাকা পয়সার কারবার থাকবে সেখানে পাবলিকের ক্যাচাল থাকবে তাইটা নিয়ে ভাবার কিছু নাই।
দুপুর ৩ টার দিকে আমার কাজ শেষ হয়। তখন লাইনে পরিচিত হয়েছিলাম এমন কয়েকজনকে খুজে পেলাম দোতলায় যারা এখনও লাইনে দাঁড়িয়ে আছে তাও অনেক পেছনে। তাদের মধ্যে একজনের আবেদন বাতিল করে দিয়েছিল, পরে পুলিশকে ১০০০ টাকা ঘুষ দিয়ে আবেদন মঞ্জুর করিয়েছে। আরও ৫০০ টাকা পুলিশ ভেরিফেশনের সময় দিতে বলেছে।
এই হল ডিজিটাল যুগে মেশন রিডেবল পাসপোর্ট পেতে গিয়ে আমার অভিজ্ঞতা। কয়েকদিন পর পুলিশ ভেরিফিকেশন হবে। সেখানে অবশ্যই ৫০০-১০০০ টাকা দিতে হবে। একটা পাসপোর্ট নেবার জন্য ২ দিনে ১২ ঘন্টা লাইনে দাড়িয়েছি। তাহলে আমরা যে ডিজিটাল ডিজিটাল বলে লাফাই তার সুফল কি এটা!!!
আমাদের সরকারী প্রতিটা প্রতিষ্ঠান এভাবে দালালের কবলে। সরকার যদি কোনদিন উদ্যোগী হয়ে এটা বন্ধ করতে পারে তবেই এ দেশের মানুষ হাফ ছেড়ে বাঁচবে। অন্যথায় বাঁচার কোন পথ নেই। আমরা দালাল মুক্ত সরকারী প্রতিষ্ঠান চাই।
৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?
যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।
নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন
আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত
বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন
বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!
কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন
সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে
সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে
আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন
অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?
এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন