somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সুন্দরবন ভ্রমণ

১৩ ই অক্টোবর, ২০১৫ বিকাল ৩:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রায় বছর খানেক আগের ঘটনা। বাংলাদেশের তথা বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান সুন্দরবন ভ্রমণে গিয়েছিলাম। সময়টা ছিল শীতের শুরুতে, ৫-৭ নভেম্বর, ২০১৪।

২০১৪ এর মাঝামাঝি সময়ে মাথায় প্ল্যান আসে সুন্দরবনে যাবার। কয়েকজন বন্ধুকে বললাম আমার প্ল্যানের কথা। প্রথমে অনেকেই আগ্রহ দেখালেও পরে সবাই পিছিয়ে যায়। কিন্তু আমি তো একগুয়ে মানুষ, সহজে নিজের প্ল্যান বাতিল করতে রাজি নই। ভা্বলাম অন্যরা যাবেনা তাতে কি, একটি বন্ধু আছে যে সব সময় আমার সাথে আছে। শুধুমাত্র তাকে নিয়েই যাব। তো তাই হল, প্ল্যান ফাইনাল, বরাবরের মত আমার প্রিয় স্ত্রী+বন্ধু নিপাকে নিয়ে যাব এই ভ্রমনে।

সুন্দরবন হলিডেজ ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলস এর সাথে আগে থেকে কথা বলে রেখেছিলাম। তারা জানিয়েছিল, তিন দিন দুই রাতের প্যাকেজে যাওয়া সবচেয়ে ভালো হবে, এবং নভেম্বরে ৫-৭ তারিখের প্যাকেজে যাওয়া আমাদের জন্য পারফেক্ট হবে, কেননা এই সময়ে আমরা রাস মেলা দেখতে পারবো। তো তাদের কথা মত সব কিছু রেডি করলাম।

নভেম্বরের ৪ তারিখে সকালে নীলসাগর ট্রেনে করে ঈশ্বরদী থেকে খুলনার উদ্দ্যেশে রওনা দিলাম। দুপুর নাগাদ খুলনা ৌছালাম। হোটেল এম্বেসেডরে আগে থেকেই রুম বুকিং দিয়েছিলাম। রুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। এবার লঞ্চ সেরে খুলনা শহরের নিউমার্কেট সহ আসে পাসের যায়গায় ঘুরে বেড়ালাম। সন্ধ্যার দিকে চলে এলাম রুপশা ঘাটে। সুন্দরবন ভ্রমনের জন্য যে সমস্ত ট্যুর অপারেটর রয়ে্ছে, তাদের প্রায় সবকটির অফিসই এখানে আছে। আরো উল্ল্যেখ্য যে, যে লঞ্চগুলোতে করে সুন্দরবন ভ্রমনের আয়োজন করা হয় তাদের বেশির ভাগই এখান থেকে ছাড়ে। আমরা আমদের ট্যুর অপারেটরের অফিসে গেলাম এবং জানতে পারলাম পরদিন অর্থাৎ ৫ই নভেম্বর সকাল ৭ টার মধ্যে আমাদের লঞ্চে উঠতে হবে। প্রয়োজনীয় কাজ শেষে আমরা সেখান থেকে বের হয়ে রুপসা নদীর ঘাটে অনেক্ষন বসে রইলাম। বড় বড় মাল্বাহী জাহাজগুলো নদী দিয়ে যাওয়া আসা করছে। আর নিপা মনভরে দেখছে। আসলে খুলনাতে এটাই প্রথম আসা নিপার জন্য, তাই ও সব কিছুতেই আনন্দ পাচ্ছিল। রাতে রুমে এসে ্ডিনার করে দ্রুত ঘুমাতে গেলাম, কারণ পরদিন ভোরে উঠতে হবে।

৫ তারিখে সকালে ৭টার মধ্যেই রুপ্সা ঘাটে এসে আমাদের লঞ্চে উঠালাম। কিন্তু লঞ্চ ্ছাড়তে বেশ দেরি হলো। প্রায় সাড়ে নটার দিকে লঞ্চ ছাড়লো। আমাদের লঞ্চে প্রায় ২০ জনের মত গেষ্ট ছিলো, স্টাফ ছিল ৭-৮ জনের মত। বেশি্ লোকজন না থাকায় বেশ ভালো লাগছিলো। গেষ্টরা ছিলেন বিভিন্ন পেশার বিভিন্ন জায়গার। ৪জনছিলেন প্রোফেশনাল ফটোগ্রাফার। সবাইকে নিয়ে রুপশা ঘাট থেকে শুরু হলো আমাদের সুন্দরবন ভ্রমনের যাত্রা।

লঞ্চ ছাড়ার পরপরই আমাদের সকালে নাস্তা দেওয়া হলো। লঞ্চের ডেকে বসে সবাই একসাথে নাস্তা করছিলাম। আশপাশ দিয়ে ছোটবড় জাহাজ যাওয়া আসা করছিল। নাস্তার টেবিলে সবাই একে অপরের সাথে পরিচিত হলাম। ধীরে ধীরে আমরা সবাই একটি ফেমিলির মত হয়ে গেলাম। মনে হচ্ছিল সবাই সবাইকে অনেকদিন ধরে চিনি। আমি কেমেরা নিয়ে রেডি ছিলাম ছবি তোলার জন্য। কিন্তু জাহাজ বাদে আর কিছু পাচ্ছিলাম না তোলার মত। আমাদের ট্যুর ম্যানেজার জানাল, বনের এলাকায় পৌছাতে আরো অনেক সময় লাগবে, তাই এখন বিশ্রাম নেওয়ায় ভালো। তার কথা মত নিপাকে নিয়ে আমদের কেবিনে চলে এলাম। বিছানায় শুয়ে পড়ে জানালা দিয়ে নদী, নদীর পাড়ের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম। ্কিছুক্ষনের মধ্যেই আমরা রুপশা ব্রিজ পার হয়ে এলাম।

দুপুর নাগাদ আ্মরা মংলা পৌছালাম। আ্মাদের লাঞ্চের জন্য ডাকা হলো। সবাই লাঞ্চে বসলাম। খেয়াল করলাম, এখানে সুবিশাল দানব আ্কৃতির অনেক জাহাজ দেখা যাচছে। এগুলো বিভিন্ন দেশ থেকে কার্গো নিয়ে মংলা বন্দরে এসেছে। আমি এবং নিপা দুজনেই প্রথম এমন সব দানব আকৃতির জাহাজ দেখলাম।

দুপুরের পরপর আমরা পৌছলাম বাগেরহাটের সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ চাঁদপাই রেঞ্জের ঢাংমারী ষ্টেশনে। এখানে ট্যুরিষ্টদের লিষ্ট চেক করা এবং অন্যান্য ফর্মালিটিজ সম্পন্ন করা হলো। দুজন সশস্ত্র গার্ড নেওয়া হলো। এরা আমাদের নিরাপত্তা দেবে।

আবার লঞ্চ যাত্রা শুরু করলো। বিকাল নাগাদ আমরা পৌছলাম হাড়বাড়ীয়ায়। লঞ্চের সাথে বেধে রাখা নৌকায় উঠলাম আমরা। নৌকা আমাদের ঘাটে নামিয়ে দিল। সকালের পর এই প্রথম মাটিতে পা পড়লো, মাটিতে বলছি কেন, বলতে হবে সুন্দরবনে আমাদের পদধুলি পড়লো। মনের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলো। অবশেষে সেই কাংখিত জায়গায় ভ্রমনের শুরু হলো। মনের মাঝে উকি দিচ্ছে বাঘ দেখার স্বপ্ন। কিন্তু পরক্ষনেই মনে ভয় ধরে গেলে। ম্যানেজার সবাইকে দিক নির্দেশনা দিতে শুরু করলোঃ “এই জায়গার নাম হাড়বাড়িয়া, এই ঘাট থেকে হেটে আমরা বনের ভিতর দিয়ে সার্চ টাওয়ার পর্যন্ত যাবো, কেউ সিগারেট খাবেন না, কোন প্রকার আবর্জনা ফেলা যাবেনা, এবং এখানে প্রাইয় বাঘের আগমণ গঘটে তাই সবাইকে সাবধান থাকতে হবে, এবং দলবদধ ভাবে চলাচল করতে হবে।”

শুরু হলো হাটা, আমরা সবাই লাইন ধরে এক সাথে হেটে চলেছি। সুযোগ পেলেই ছবি তু্লছি। নিপা ম্যানগ্রভের শাঁচ মূল আবিস্কার করলো, আর আমি আবিস্কার করালআম গোলপাতা। গোলপাতা যে আসলে গোল নয় তা জানতে পারলাম। কিছুক্ষন হাটার পর একজন বাঘের পায়ের ছাপ আবিস্কার করলো। গার্ড আমাদের জানালো, বাঘটি ১০-১২ মিনিট আগেই এখান দিয়ে গেছে। আমাদের সবার মন খারাপ হয়ে গেল বাঘ দেখতে না পাওয়ার জন্য। আবার ভয়ও পেলাম, যদি বাঘটি আসে পাসেই থাকে। সবাই বাঘের পায়ের ছাপ কে নিয়ে ছবি তোলা শুরু করলাম। হাটতে হাটতে পৌছলাম সেই সার্চ টাওয়ারে কাছে। টাওয়ারটির অবস্থা খুবই করুন। দীর্ঘদিনের পরাতন হওয়ায় ভেঙ্গে পড়ার অবস্থা। গাইড আমাদের বললো একজন করে উঠতে। সবাই ওঠার মত সাহস পেলো না। আমি নিপা কে বললাম চলো উপরে উঠি, কিন্তু ওর রাজি হলো না। কি আর করা আমিতো আর বাদ দিতে পারি না, তাই টাওয়ারে চড়লাম। টাওয়ারের উপর থেকে বনের অনেটা অংশ দেখা যায়। এখানে একটা ছবি তোলার ইচ্ছা হলো, কিন্তু ক্যমেরাতো নিপার ্কাছে। তাই আশা পুরন হলো না। নিচে নেমে এলাম। দেখলাম নিপা গাইডের কাছে থেকে কোনটা কি গাছ সেই বিশয়ে জ্ঞান নিচ্ছে। ওর থেকে ক্যামেরা নিয়ে আমি ছবি তোলা শুরু করলাম। এখানে কাঠের তৈরী এ্কটা রাস্তা আছে, যেটার ছবি বিভিন্ন সাইটে এবং ক্যালেন্ডারে দেখা যায়। এখানে পুকুর আছে এবং বিশ্রামের জন্য বসার জায়গা এবং ছাউনি তৈরী করা হয়েছে। এগুলো আমার কাছে ভালো লাগ্লো না। দেখে অনেকটা পার্কের মত মনে হলো, যা এই প্রকৃতির মাঝে বেমানান। এবার গাইড আমাদের তাগাদা দিল ফিরে চলার জন্য । আমরা লঞ্চে ফিরে এলাম। তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।

লঞ্চ নোঙ্গর তুলে আবার চলা শুরু করলো। এবারের গন্তব্য কটকা। সন্ধ্যার পর সবাইকে চা নাস্তা দেওয়া হলো। চা নাস্তা সেরে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে লঞ্চের সামনে পিছনের ফাকা জায়গা গুলোতে বসে আড্ডা জমিয়ে দিলাম। বিভিন্ন টপিক্স নিয়ে আলোচনা হলো। ফটোগ্রাফারদের মধ্যে একজন ছিলেন ব্যাংকার। তার সাথে আমার এবং নিপার বেশ ভাব জমে গেলো। তিনি এর আগেও সুন্দরবন এসেছেন। তার থেকে বনের অনেক কিছু জানতে পারলাম। বাঘের দেখা পাবো কিনা জান্তে চাইলে তিনি বলেন এটা ভাগ্যের বিষয়। কারণ তিনি এর আগেও তিনবার সুন্দরবনে এসেছেন কিন্তু বাঘের সাথে সাক্ষাত হয়নি। আমাদের মনটা খারাপ হয়ে গেল। সুন্দরবনে এসে যদি সরাসরি বাঘ না দেখতে পারি তাহলে কেমন হয় বলেন।

রাতের খাওয়া শেষে সবাই যার যার কেবিনে গেল। আমি আর নিপা চলে এলাম লঞ্চের সামনে। সোফার উপর দুজনে বসলাম। লঞ্চ আকাবাকা নদী পথ ধরে এগিয়ে চলছে। হাল্কা কুয়াশা রয়েছে চারিদিকে। আকাশে তখন ভরা পূর্নিমা। কি অসাধারণ দৃশ্য বলে বোঝাতে পারবোনা। বুজতে পারলাম জ্যোৎস্না রাতে সুন্দরবনের সৌন্দর্যই আলাদা, যা নিজ চোখে না দেখলে বোঝা যাবেনা। তাই বলে রাখি যারা সুন্দরবনে আসবেন অবশ্যই প্ল্যান করবেন জ্যোৎস্না যেন থাকে এমন সময়। আমি অবাক হয়ে চারিদিকে পরিবেশ উপভোগ করছিলাম। এমন সময় নিপা গুন গুন শব্দে গান গাওয়া শুরু করলো। সব মিলিয়ে মনে হলো At the end of the day, life is beautiful. আস্তে আস্তে শীতের প্রকোপ বাড়তে লাগলো। আমারা কেবিনে চলে এলাম। রাতে খাবার সময় সবাইকে বলে দেওয়া হয়েছিল যে, যদি হরিণ দেখতে চান তবে সবাইকে ভোর ৫টার মধ্যে ঘুম থেকে উঠতে হবে। সে অনুযায়ী মোবাইলে এলার্ম সেট করলাম। মাঝরাতে মানষের কথাবার্তায় ঘুম ভেঙ্গে গেল। বুঝতে পারলাম লঞ্চ থেমে গেছে। বাইরে এসে দেখলাম আমাদের লঞ্চ নোঙ্গর ফেলছে। আশেপাশে বেশ কয়েকটি লঞ্চ আগে থেকেই এসে নোঙ্গর করেছে। গাইডকে জিজ্ঞাস করে জানতে পারলাম আমরা কটকা এসে পোইছেছি। কেবিনে এসে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।

ঘড়ির এলার্ম বাজার সাথে সাথে উঠে পড়লাম। আজকে হরিন দেখা যাবে। মনের মধ্যে অন্য রকম এক অনুভুতি। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নিপাকে নিয়ে রেডি হয়ে লঞ্চের সামনে চলে এলাম। দেখলাম ফটোগ্রফাররাও আসছে। যারা এখনো রেডী হয়নি গাইড তাদের তাড়া দিচ্ছে। অবশেষে সবাই মিলে সূর্যদয়ের আগেই নৌকায় উঠলাম। নৌকা এগিয়ে চললো ঘাটের দিকে। অসাধারণ একটি পরিবেশ, হাল্কা কুয়াশা, চারিদিকে ধীরে ধীরে আলো ফুটছে, আর আমরা নৌকায় করে এগিয়ে চলছি। ঘাটের কাছাকাছি আসতেই একজন বলে উঠলো হরিণ হরিণ………। আমারা সেইদিকে তাকালাম, দেখলাম পাড়ের কছাকাছি একটি হরিণ ঘোরাফেরা করছে। এর পর দেখলাম আর একটা, তারপর আরেকটা এভাবে কয়েকটি। নৌকা ঘাটে এসে ভিড়লো। ্নৌকা থেকে নেমে আমরা হাটা শুরু করলাম। লক্ষ্য এখান থেকে জামতলা সী বিচ পর্যন্ত হেটে যাওয়া। গাইড বললো সময় লাগবে প্রায় ৪০মিনিট। আমি ভাবলাম নিপা কি পারবে এই টানা ৪০ মিনিট হাটতে বা অন্য মহিলা গেষ্ট যারা আছেন তারা কতটুকু পারবেন। কিন্তু আমার ধারণা পুরো পুরি ভুল প্রমানিত হলো। প্রকৃতির সৌন্দর্যের মাঝে মানুষ যে তার ক্লান্তি ভুলে যাতে পারে তা আমার যানা ছিলনা। আমরা একসঙ্গে হাটছি, সবার আগে আছে একজন সশত্র গার্ড তারপর আমি ও নিপা, এরপর লাইনে অ্ন্যরা, সবশেষে আরেকজন গার্ড। ্কিছুদুর হাটার পর একটা উন্মুক্ত জায়গায় চলে এলাম, বিশাল ফাকা ্জায়গা। বনের গাছপালা অনেক দূরে সরে গেছে। প্রকৃতি যে কত সুন্দর হতে হতে পারে কি করে বল্বো বলেন। আমি যদি ্লেখক হতাম তাহলে হয়তোবা এই সৌন্দর্য লিখে বোঝাতে পারতাম। আকাশ লাল হয়ে উঠছে, কয়াশা কেটে যাছে, পূর্ব আকাশে সূর্য উকি দিচ্ছে তার সাথে দূরে চারিদিকে হরিণের দল ছুটো ছূটি করছে। কি বিশাল বিশাল হরিণ রে বাবা। চিড়িয়াখানার হরিণ গুলো এদের অর্ধেকও হবেনা। কোনটি দেখবো, হরিণ নাকি প্রকৃতি। দুটোই দেখতে দেখতে এগুতো লাগলাম। হরিণের দল আমাদের দেখলেই দৌড় দিয়ে বনের কাছাকাছি চলে যায়, মাথা উচু দেখার চেস্টা করে আমরা কি করছি, কখনো তারা এলো মেলো লাফালাফি করে। কি দারুন পরিবেশ।

নিপা গার্ডকে জিজ্ঞাসা করলো বাঘ বনের কোথায় থাকে। উত্তর শুনে নিপা নিজেয় ভয় পেয়ে গেল, হরিণ যেখানে থাকে বাঘ তার কাছাকাছিই থাকে। চারিদিকে এত হরিণ, অতএব বাঘ আশেপাশে থাকতে পারে। গার্ড আমাদের দেখালো হেতাল পাতা, এগুলো অনেকটা ঝোপের মত। এগুলোর মধ্যে নাকি বাঘ লুকিয়ে থাকে। নিপা আবার গার্ডকে জিজ্ঞাসা করলো, যদি বাঘ আমাদের আক্রমণ করে তাহলে কি হবে ? গার্ডের উত্তরঃ আল্লাহ চাইলে জানে বাচতে পারবেন, নয়তো জীবন শেষ। নিপার প্রশ্ন তাহলে আপনার এই রাইফেল কি জন্য? গার্ডের উত্তরঃ এটা দিয়ে ফাকা গুলি করে বাঘকে ভয় দেখানো যাবে, কিন্তু বাঘকে কোন প্রকার গুলি করা যাবেনা। দেকলাম নিপার মুখে ভয়ের ছাপ। এবার আমি নিপাকে বললাম ভয় পাচ্ছো কেন, আমিতো আছি, আমি বেচে থাকতে বাঘ তোমাকে কিছু করবেনা। দুজনেই খুব মজা পেলাম। হাটতে থাকলাম। ফাকা জায়গা পার হয়ে আমরা এবার বনের ভিতরের দিকে প্রবেশ করছি। এখানে জাম গাছ অনেক দেখলাম। হয়তো এই জাম গাছ থেকেই নাম হয়েছে জামতলা। আমাদের একজন হরিণের এ্কটি পুরাতণ শিং পেল। সে তো মহা আনন্দিত। বনের মধ্যে হাটতে হাটতে আমরা বাঘের গর্জনের মত কিছু শুনতে পাচ্ছিলাম। গাইড আমাদের অভয় দিল, এটা সমুদ্রের গর্জন। এবার বুঝলাম আমরা আমাদের কাংখিত লক্ষ্যের কাছাকাছি চলে এসেছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা পৌছে গেলাম জামতলা সী বিচে।

কি আপরুপ প্রাকৃতিক নৈসর্গ। একদিকে বঙ্গোপসাগর অন্য দিকে সুন্দরবন। সাগরের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে বনভুমির পাড়ে। সবাই ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ পর অন্য একটি গ্রুপ এসে এখানে পৌছুল। এদের মধ্যে কয়েকজন বিদেশী পর্যটক ছিলেন। ইচ্ছে হচ্ছিল সাগরের পানিতে নেমে শরীর টা একটু ভিজিয়ে নেই। কিন্তু সাথে অতিরিক্ত কাপড় না থাকায় বিরত রইলাম। সাগর নিপার কাছে সবসময় প্রিয়। সাগরের সামনে এলে ও যেন সব কিছু ভুলে যায়। এর আগে কক্সবাজার সেন্টমার্টিনে সাগরের সামনে ও যা করছিল এখানেও তার বেতিক্রম ঘটলনা। পানিতে পা ডুবিয়ে সাগরের দিকে মুখ করে সাগরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলো। আমি ওর কিছু ছবি তুলে নিলাম। আমরা বেশ কিছুক্ষন এখানে কাটানোর পর গাইড আমাদের ফেরা জন্য জানালো। আমরা ফেরার পথ ধরলাম। ফেরার সময় তেমন আনন্দ পাইনি। কারণ বেশ কয়েকটি গ্রুপ তখন সেখানে যাওয়া আসা করছিল। এত মানষের আগমনের কারনে হরিণ গুলো সব চলে গায়েব হয়ে গেছে। ছবি তুলতে তুলতে আর প্রকৃতি দেখতে দেখতে আমরা লঞ্চে ফিরে এলাম।

সবাইকে নাস্তা দেওয়া হলো। নাস্তা শেষে আমাদের এবারের গন্তব্য কটকা অভয়ারণ্য কেন্দ্র। এটি পড়েছে। শরনখোলা রেঞ্জে। আবার আমাদের নৌকায় করে ঘাটে নামিয়ে দেওয়া হলো। সুন্দরবনের এই জায়গাটি অসাধারণ। প্রাকৃতি যে কত সুন্দর হতে পারে তা বলে বোঝাতে পারছিনা। এখানে জোয়ার ভাটার কারণে শুকনো জায়গা কম। তবে ট্যুরিষ্টরা যেন বনের ভিতরে ঢুকতে পারে সে জন্য দীর্ঘ কাঠের পথ তৈরী করা হয়েছে। কিছুদুর হাটার পরও হরিনে দেখা পাচ্ছি না। অথচ শুনেছি এখানেই নাকি সবচেয়ে বেশী হরিণ দেখা যায়। নিপা আমাকে এই সমস্যার কারণ বলে দিল, যেহেতূ এখন আমরা বেশ কয়েকটি গ্রুপ একসাথে আছি, তাই কথাবার্তা ও শব্দ হচ্ছে বেশি। এই কারনে হরিণ অনেক দূরে চলে গেছে। নিপা আর আমি সবাইর অনেকটা এগিয়ে গেলাম। বেশ কিছুদুর যাওয়ার পর আবারো হরিনের দেখা পেলাম, এবং অনেক হরিণ একসাথে। ইচ্ছে হচ্ছিল কাদা পানিতে নেমে ওদের আরো কাছে যাই। কিন্তু সাহস হলো না। এখানে একটা বিশেষ জিনিস লক্ষ্য করলাম, সবগুলো গাছের ডাল পালা নিচের দিকে একই সমান করে কাটা, কি নিখুত মাপ, একটুও উচু নিচু নয়। আসলে এগুলো মানুষের দারা করা হয়নি। এগুলো করেছে হরিণ। ওরা গাছের পাতা খাওয়ার সময় এমন নিখুত অবস্থার তৈরী হয়েছে। বনরক্ষীদের সাথে দেখা হলো। তাদের সাথে কিছুক্ষণ কথা বললাম। ততক্ষণে আমাদের গ্রুপ এবং গাইড আমাদের কাছে চলে এসেছে। সবাই আবার লঞ্চে ফিরে এলাম। লঞ্চ ছেড়ে দিল। এবারে গন্তব্য দুবলার চর।

এবার আমরা সাগরের খুব কাছ দিয়ে যাচ্ছিলাম। বড় বড় ঢেউয়ের কারনে আমাদের ছোট লঞ্চটি দোল খাচ্ছিল। আমরা কিছুটা ভয় পেলাম। পরে লঞ্চ দিক পরিবর্তন করে নদী পথে এগিয়ে চললো। আমারা যখন দুপুরের খাবার খাচ্ছিলাম তখন কোস্টগার্ডের একটি জাহাজ আমাদের অতিক্রম করলো। বাবা নৌ বাহিনীতে চাকরি করায় যুদ্ধ জাহাজ আমার কাছে নতুন কিছু নয়, কিন্তু নিপা এই প্রথম যুদ্ধ জাহাজ দেখলো। বিকেল নাগাদ আমরা পৌছে গেলাম দুবলার চরে। প্রতি বছর এক বার করে এখানে রাস মেলা হয়। আমাদের আগেই অনেক গুলো ট্যুরিস্ট লঞ্চ এখানে পৌছে গেছে। এছাড়াও আরো অনেক লঞ্চ বড় বড় নৌকায় করে মানুষ আসছে। জানতে পারলাম আজকেই মেলার শেষ দিন। কাল সকালে পুন্যস্নান এর মাধ্যমে মেলার শেষ হবে। দুবলার চর মূলত একটি জেলে পল্লী। লঞ্চ থেকেই দেখলাম চরে অনেক মা্নুষ। আমাদেরকে নৌকায় করে চরে নিয়ে যাওয়া হলো। চরে নেমে বুঝলাম, এখানে কোন জেলারা বাদে কোন স্থায়ী মানুষ নেই। সবাই এসেছে মেলা দেখতে। কিন্তু মেলা জাতীয় কোন কিছু আমার চোখে পড়লো না। গাইড জানালো মেলাটি চরের অন্য অংশে। আমাদের হেটে হেটে সেখানে যেতে হবে। কি আর করা সাগরের সাথে ছবি তুলতে তুলতে চর ধরে হেটে চললাম। আমি আর নিপা আমাদের দলের সবার আগে। অবশ্য আমরা দুজনই প্রথম হিসেবে ইতিমধ্যে আমাদের গ্রুপে খ্যাতি অ্জন করেছি। এখানকার জেলেদের এ্কটাই কাজ, মাছ ধরে শুটকি বানা্নো। চারিদিকে শূধু শূটকি আর শুটকি। কি বাজে গন্ধ্য। এখানে শুটকির পরিমান এত বেশী যে, কেউ যদি থুথু ফেলে সেটাও গিয়ে শুটকির উপর পড়ে। কি বাজে অবস্থা। আর মানুষের ভিড় কত হাজার হাজার মানুষের আগমন ঘটেছে মেলা উপলক্ষ্যে। অবশেষে আমরা মেলায় পৌছলাম। কিন্তু মেলায় পৌছে আমার একেবারে খারাপ হয়ে গেল। ভেবেছিলাম রাস মেলা কি না কি। কিন্তু কিছুই নেই এখানে। ততক্ষনে সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। অনেক বিদেশী পর্যটক এসেছেন এই রাসমেলা দেখতে। কিন্তু আমার মাথায় ধরলোনা যে তারা কি দেখতে এখানে এসেছেন। এখানে আপনি খাওয়া বা কেনা কাটা করার মত কিছুই পাবেন না। যেগুলো আছে, সেগুলো আপনার পছন্দ হবেনা। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। মেলাই আমাদের গ্রুপ টা ভেঙ্গে গেছে। বিভিন্ন জন বিভিন্ন দিকে চলে গেছে। সবাইকে বলে দেওয়া হয়েছে রাতের খাবারের আগে ্নৌকায় ফিরতে। আমার আর নিপার জন্য দুকাপ লাল চা দিতে বললাম এক দোকানিকে। উফ, চা যে এত বিষাদ হতে পারে জানতাম না। রাত্রি ৮টা পর্যন্ত মেলাতে থাকলাম, এখানে নাকি সারারাত গান বাজনা হবে। কিন্তু সেটা দেখা হলো না। নিপা অসুস্থ বোধ করায় লঞ্চে ফিরে এলাম। এখানে সাগরের ঢেউ এর সাথে আমাদের লঞ্চটি উঠা নামা করছিল। আমার কাছে বিষয়টি মজার মনে হলেও নিপার জন্য এটি সমস্যা হয়ে দাড়ালো। ও কেবিনে চলে গেলো রেস্টের জন্য। আমি লঞ্চের সামনে বসে সাগর দ্বীপ আকাশ ্দেখতে থা্কলাম। রাতের খাওয়া শেষে ঘুমিয়ে গেলাম।

পর দিন সকালে লঞ্চ ফেরার পথ ধরলো। একটানা যাত্রা শুরু হলো। ফিরতে ইচ্ছা হছিলনা। কত সুন্দর আমাদের এই দেশ। কত কিছু রয়েছে এ দেশে দেখার মত। সুন্দরবন আমাকে এবং নিপাকে তার সৌন্দর্যে বিমোহিত করেছে। মনে হচ্ছিল থেকে যায় এখানে। কিন্তু সেটাতো সম্ভব নয়। লঞ্চ এগিয়ে চলছে। বিকাল নাগাদ আমরা করমজলে পৌছলাম। করমজলে নেমে বেশ কিছুটা সময় বেড়ানো হলো। বানরের বাঁদরামি কাকে বলে, তা জানতে হলে এই করমজলে আসা দরকার। এখানে বানর উন্মুক্ত ভাবে আছে। পায়ে হাটার কাঠের যে রাস্তা রয়েছে এখানে, সেটা দিয়ে হাটার সময় আপনার অবশ্যই ভালো লাগবো। চারিদিকে বানর, বড় মাঝারি ছোট বাচ্চা সব ধরনের বানর রয়েছে এখানে। এদের সাথে ভাব করা খুবই সহজ। এরা আপনাকে দেখে ভয় পেয়ে পালাবে না, বরং আপনার হাত টেনে ধরবে, যদি কোন খাবার পাওয়া যায় এই আসায়। এদের সাথে খুব সহজেই ছবি তোলা যায়। করম জলের অপর প্রন্তের রয়েছে কুমির প্রজনন কেন্দ্র। এখানে খাচার মধ্যে কিছু হরিন রাখা আছে। সব মিলিয়ে করমজলের মূল আকর্ষন বানরের সাথে বাঁদরামী।

সন্ধ্যা নাগাদ আমরা করমজল থেকে রওনা হলাম। আমি আর নিপা খুলনা থেকে রাতের ট্রেন ধরবো, এছাড়াও আমাদের সাথের ফটোগ্রাফারদের আজকে রাতেই ঢাকা ফিরতে হবে। তাই তাদেরও রাত ৮-৯টার মধ্যেই খুলনা পৌছানো দরকার। কিন্তু নদীতে ভাটার সময় হওয়ায় আমাদের লঞ্চ এগোতে পারছিলনা। অগত্য আমরা কজন মংলাতে লঞ্চ থেকে নেমে গেলাম। মংলা হতে বাসে করে খুলনা আসলাম। এরপর রাতের ট্রেনে বাড়ির উদ্দ্যেশে যাত্রা। শেষ হলো আমাদের সুন্দরবন ভ্রমণ।
এই লেখাটি প্রথম আমার ব্লগ সাইট allinbangla.com এ প্রকাশ করা হয়েছে। চাইলে আপনারা ঘুরে আসতে পারেন আমার সাইট থেকে।
বানান ভুল হলে ক্ষমা করবেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই অক্টোবর, ২০১৫ বিকাল ৩:২২
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×