কথায় কথায় মানুষ না পাওয়ার আক্ষেপ নিয়ে বলে “ছেলের হাতের মোয়া” না যে চাইলাম আর পাইলাম। ক্রিকেট খেলায় জয় যেন এখন বাংলাদেশের কাছে ছেলের হাতের মোয়ার চেয়েও সহজলভ্য। একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশের গুটিকয়েক মানুষ ক্রিকেট বুঝতো এবং ক্রিকেট সম্পর্কে ধারনা রাখতো। আর এখন ছেলে বুড়ো সবাই ক্রিকেট খেলা হলে সেটা নিয়ে মেতে থাকে। অনেকটা ঈশপের গল্পের মত। বলা হয়ে থাকে যে ব্যক্তি কোন দিন স্কুলে যায়নি কিংবা কোনদিন পড়ালেখাই করেনি সেও ঈশপের গল্প জানে। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষও ঠিক তেমনি এখন ক্রিকেট খেলা সম্পর্কে ধারনা রাখে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা,দ্রব্যমূল্যের লাগাম ছাড়া উর্ধ্বগতি আর নানা বিধ সমস্যার মধ্যে আনন্দের উপলক্ষ্যতো ক্রিকেটই এনে দেয়। ক্রিকেটে বাংলাদেশের উত্থান বৃষ্টি শেষে আচমকা রংধনু ওঠার মত। তবে রংধনুর স্থায়ীত্ব নেই কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটীয় উত্থান দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। যখন বাংলাদেশ মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেললো তখন যারা একটু আধটু ক্রিকেট নিয়ে থাকতো তারা জানে কি উদ্দামতা আর কি আকাঙ্খা ছিল আমাদের মনে। অবশেষে জয় করলাম এবং সেই জয়ের ধারা এখনো অব্যাহত আছে। কোন কিছু বলতে গেলেই মাঝে মাঝে দেখি বঙ্গবন্ধুকে টেনে আনতে হয়।
কেন আনবোনা বলুন? প্রায় ক্ষেত্রেই তিনি যা বলেছিলেন তা আমরা এখন প্রমান পাচ্ছি। স্বাধীনতার আগে তিনি আঙ্গুল উচিয়ে বলেছিলেন “কেউ আমাদের দাবায় রাখতে পারবেনা”। সত্যিইতো আমাদের দাবিয়ে রাখা যায়নি। ক্রিকেটেও এখন আমাদের জয় জয়কার। আগে আমরাই কামনা করতাম যেন কোন মত একশো রান করতে পারি কিংবা যেন টেনেটুনে পঞ্চাশ ওভার খেলতে পারি, সেই বাংলাদেশ দল এখন ওসব নিয়ে ভাবেনা। আমরা ভাবি কিভাবে কত কম রানে বিপক্ষ দলকে বেঁধে ফেলা যায়,আমরা ভাবি কত কম উইকেট হারিয়ে জয় ছিনিয়ে আনা যায়। আমরা তা পেরেছি এবং সেই ধারা এখন অব্যহত আছে। ক্রিকেট আমাদের রক্তের সাথে ছিলনা ঠিকই কিন্তু এখন তা আমাদের শিরা উপশিরায় মিশে গেছে।
সেদিন সুদুর অতীতে হারিয়ে গেছে যখন বাংলাদেশ কোন একটা উচু সারির দলকে হারালে বিশ্বব্যাপী তোলপাড় হতো এই বলে যে এটা ছিল একটা অঘটন। আর আজকে? যুগ পাল্টে গেছে। আজকে বরং বাংলাদেশ না জিতলে সবাই বলে আহ এরকমতো কথা ছিলনা। আমরা জেগে উঠেছি এবং আমাদের জাগরণটা হয়েছে বীরের মত। আমরা এখন সেই সব মানুষদের জানাতে চাই যে আমরা শুধু ছোট দলের বিপক্ষেই ভাল খেলিনা বরং যে কোন দলের বিপক্ষেই আমরা বিজয়ীর মত খেলি। বাঙ্গালী বরাবরই ক্ষমাশীল এবং ভদ্র জাতি। তাইতো একাত্তুরে অনেক অপরাধীকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছিল। বিশ্বকাপ থেকে শুরু হলো আমাদের নতুন রূপে পদযাত্রা। সে যাত্রা এখন ক্রমাগত ভাবে সাফল্যের স্বর্ণ শিখর অবধি পৌছাতে প্রস্তুত।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যখন ভাল খেলার পরও কেউ কেউ বলছিল পাকিস্তান দুর্বল বলে তাদের হারিয়েছি এবং শক্তিশালী দলের বিপক্ষে লজ্জা জনক ভাবে হারবো ঠিক তখনই গতবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের আমরা ধরাশায়ী করলাম এবং দেখিয়ে দিলাম আমাদের শক্তিমত্তা। যে দেশের ক্রিকেটবোর্ড মনে করতো বাংলাদেশকে তাদের দেশে ডেকে নিয়ে সিরিজ খেলালে তাদের টিকেট বিক্রি হবেনা সেই দেশকে দেখিয়ে দিয়েছি বাংলাদেশ ক্রিকেট বানের জলে ভেসে আসা কোন খড়কুটো নয়। এর ভিত্তি অনেক শক্ত। যুগের পর যুগ ক্রিকেট খেলে তারা শচীনের মত প্রতিভাবান খেলোয়াড় তৈরি করেছে ঠিকই কিন্তু আমাদের মত কেউ একই সময়ে সব ধরনের ক্রিকেটে বিশ্বসেরা হতে পারেনি।
যখন ইন্ডিয়ান টিম বাংলাদেশের সাথে হেরে গেল তখন ইন্ডিয়ান মিডিয়াতে নানা ভাবে সেটার অপব্যাখ্যা দাড় করাতে ব্যস্ত হয়ে উঠলো। যেন তারা এমন কোন দল যে তাদের হারতে মানা এবং বাংলাদেশ তাদের হারিয়ে দিয়ে মহা অন্যায় করে ফেলেছে। বিশ্বের অগণিত ক্রিকেট প্রেমী জানে কাদের মনোভাব কেমন। এর পর যখন সাউথ আফ্রিকা সফরে আসছে বলে ঘোষণা হলো তখন সেই সব মানুষ বলাবলি করতে লাগলো এবার বাংলাদেশ হোয়াইট ওয়াশ হবে। এমনকি এই দেশের কতিপয় সুযোগ সন্ধানী সমর্থকও সেই দলে ছিল। আর বাংলাদেশ যখন দুর্ভাগ্যজনক ভাবে প্রথম ম্যাচটা হাতছাড়া করলো তখন তারা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো।
কিন্তু বাংলাদেশের উত্থানতো এমনি ভাবে রংধনুর মত ক্ষণিকেই মিলিয়ে যাবার জন্য নয়। তাই পরের ম্যাচেই মাশরাফি বাহিনী ঘুরে দাঁড়ালো। প্রথম ম্যাচ হেরে যাওয়ার পর বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দলের বিপক্ষে জয়ের ধারায় ফিরে আসতে পারে কেবল সাহসীরাই, এবং মাশরাফি বাহিনী সেটা করে দেখিয়েছে। অবশেষে শেষ ম্যাচ এলো। মাশরাফি বাহিনীর প্রবল প্রতাপে আগের ম্যাচে যখন দক্ষিণ আফ্রিকা টিম বাকরুদ্ধ তখন থেকেই তারা শেষ ম্যাচের জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো। যদিও তারা পাকিস্তান আর ভারতের সাথে সিরিজ জেতার পর থেকেই বাংলাদেশকে নিয়ে পিএইচডি করতে ছাড়েনি। যার ধারাবাহিকতায় তারা অনুশীলনে ড্রোন পর্যন্ত পাঠিয়ে সমালোচিত হয়েছিল।
কিন্তু আমরা যখন জেগেছি তখন আমাদের কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবেনা। টাইগার বাহিনীকেও তাই কোন অস্ত্র দিয়েই ঠেকাতে পারেনি। শেষ ম্যাচটা হেসে খেলেই আমরা জিতেছি এবং পাকিস্তান,ইন্ডিয়ার পর দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সিরিজ জিতে আমরা দেখিয়ে দিয়েছি দিন পাল্টে গেছে। ক্রিকেটের তিন পরাশক্তির দুজনকে ঘায়েল করেছি বাকি থাকলো অস্ট্রেলিয়া। ঠিক জানিনা তারা হয়তো তখন থেকেই রোজ দুবেলা প্রার্থনা করতে শুরু করেছিল যেন বাংলাদেশের সাথে তাদের কোন সিরিজ না থাকে। কারণ এটাতো নিশ্চিত যে সিরিজ থাকলেই সেটা বাংলাদেশ জিতে নেবে। দিন শেষে অন্তত ডি ভিলিয়ার্স স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলতে পারবেন ভাগ্যিস আমি ছিলাম না নইলে আমাকেও লজ্জার ভাগিদার হতে হতো।
এবং অবশেষে সত্যি সত্যি অষ্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশ সফরের ঘোষণা আসলো। আমরা আপামর বাঙ্গালী অপেক্ষায় ছিলাম পাকিস্তান ইন্ডিয়া আর সাউথ আফ্রিকার পর অষ্ট্রেলিয়াকেও ধরাশায়ী করবো। কিন্তু বিধিবাম। ওইযে ওই দিন দলকে নাস্তানাবুদ করার সময় থেকে অস্ট্রেলিয়া প্রার্থনায় বসেছিল যেন বাংলাদেশের সাথে তাদের সিরিজ খেলতে না হয় কিন্তু সেই প্রার্থনা বোধহয় কবুল হয়নি। তাই যখন একান্তই বাংলাদেশে সফরে আসতেই হবে এরকম অবস্থা তখন অজুহাত তৈরি করলো অস্ট্রেলিয়া। বাংলাদেশে নাকি নিরাপত্তার অভাব!
কিন্তু বাঙ্গালীরা অতটা বোকা নয় যতটা অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ড ভেবেছে। যে বাঙ্গালী ১৯৭১ এ ইয়াহিয়া, ভুট্টদের কূটকৌশল ধরতে সময় নেয়নি সেই বাংলাদেশতো এগিয়েছে বহুগুণে। এবং তারা অষ্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটবোর্ডের কূটচাল ধরতে পেরেছে সহজেই। অবধারিত পারজয়ের লজ্জা এড়াতে এটা অষ্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটবোর্ডের একটা বানোয়াটি কৌশল ছাড়া যে আর কিছুই নয় সেটা বিশ্বের সব ক্রিকেট অনুরাগীদের বোধগম্য। ঠিক আছে তাহলে বাংলাদেশে যদি নিরাপত্তার অভাবই থাকে তো মাশরাফী বাহিনীকেই আমন্ত্রন জানানো হোক অস্ট্রেলিয়াতে গিয়ে ওদের ধবল ধোলাই করে আসার জন্য। বাংলাদেশ কোন অজুহাত দেখাবেনা। সোজা অষ্ট্রেলিয়ার মাটিতে গিয়ে বাংলাওয়াশ করে আসবে। এটা কোন কথার কথা নয়! এটা বিশ্বাস এটা শক্তি ও সাহসে ভরপুর বীর বাঙ্গালীর দৃঢ় প্রত্যয়। নজরুলের ভাষায় “বিশ্ব ছাড়িয়ে উঠিয়াছি আমি,চির উন্নত শীর”। অভিনন্দন মাশরাফি বাহিনী,ক্রিকেটীয় শীর উচু করার জন্য।
………….
জাজাফী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা অক্টোবর, ২০১৫ দুপুর ১:৪৫