somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও নেপালঃ একটি অজানা অধ্যায়

০৯ ই এপ্রিল, ২০১০ রাত ২:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নেপালের সাথে আমাদের সাংস্কৃতিক যোগাযোগের ইতিহাস বেশ পুরোনো। প্রথমত অতীশ দীপংকরের বৌদ্ধধর্মের বানী নিয়ে নেপাল হয়ে তিব্বত গমন। তার পরে নেপাল রাজদরবারে চর্যাপদের আবিস্কার। তবে আজকে যে বিষয়টি নিয়ে বলছি সেটা আরো আধুনিক ইতিহাস- মুক্তিযুদ্ধ।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বড় মিত্র ভারতের অবদান এবং এর ইতিহাস আমরা অনেকভাবেই অবগত। ছোট খাট ভাবে হলেও নেপালি জনগনেরও একটা ভূমিকা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে রয়েছে। নেপালিদের অংশগ্রহণ মূলত দুরকমের।

প্রথমত, ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটা অংশ গুর্খা রেজিমেন্ট। নেপালের মধ্য অঞ্চলের জনগন (তামাং, মগর, লিম্বু, রাই) সহ আরো কিছু জনগোষ্ঠীকে নিয়ে গুর্খা জাতীগোষ্টী। এরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর হয়ে আমাদের যুদ্ধে অংশ নেয়। সেসব সৈন্যদের এখনো অনেকে জীবিত আছেন এবং নেপালে বসবাস করছেন। তেমনি একজন হলেন লাচুমান মগর। যিনি প্যারট্রুপিং করে বাংলাদেশের মাটিতে নেমেছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর হয়ে।

দ্বিতীয়ত, নেপালি কংগ্রেসের মুক্তিযুদ্ধে অবদান। নেপালের রাজনীতিতে যে পরিবারটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও প্রতাপশালী সেটি হল কৈরালা পরিবার। এ প্রসংগে কৈরালা পরিবার সম্পর্কে একটু বলে নেই। কৃষ্ণ প্রসাদ কৈরালার তিন ছেলে। মাতৃকা প্রসাদ (বলিউডি সিনেমার নায়িকা মনীষা কৈরালার দাদা), বিশ্বেশ্বর প্রসাদ (বিপি কৈরালা) এবং গিরিজা প্রসাদ (জিপি কৈরালা)। বিপি এবং জিপি কৈরালা দুজনেই নেপালের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। জিপি কৈরালা মোট চার বার প্রধানমন্ত্রী হন।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে কৈরালা ভাইয়েরা ভারতে নির্বাসিত ছিলেন। সেখানে গিরিজা ভাতৃদ্বয় (জিপি এবং বিপি)নেপালে গণতন্ত্রের পুনর্বাসনের জন্য জনমত সংগঠিত করছিলেন এবং রাজার বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্ততি নিচ্ছিলেন। তারা কিছু অস্ত্রও জোগাড় করেছিলেন। কিন্তু তারা পরে ভারতীয় নেতা জয় প্রকাশ নারায়ণের অনুরোধে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সেগুলো দিয়ে সাহায্য করেন।

কৈরালা ভাইদের মধ্যে কনিষ্ঠ গিরিজা প্রসাদ গত ২০ মার্চ, ২০১০ বার্ধক্য জনিত কারনে মৃত্যু বরন করেন। ২০০৯ এর ৯ মে, তিনি মুক্তিযুদ্ধে তার সহযোগিতার বিষয়ে একটি বিবৃতি দেন। এই বিবৃতিটি সংগ্রহ করেছেন নেপালে বাংলাদেশ দূতাবাসের হেড অফ চ্যাঞ্চারি সংস্কৃতিকর্মী নাসরিন জাহান লিপি। বিবৃতিটি ইংরেজিতে। তিনি বলেন—




“প্রথমেই সে সময়ের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি নিয়ে বলি।স্নায়ু যুদ্ধের সময়ে আমাদের এই অঞ্চল স্পষ্টত দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। ইন্দো-রুশ ব্লক এবং সিনো-মার্কিন ব্লক। সে সময়ে আমাদের পার্টি নেপালি কংগ্রেস এর নেতারা ভারতে নির্বাসিত ছিল। আমরা নির্বাসিত ছিলাম কারন সে সময়ে রাজা নির্বাচিত গনতান্ত্রিক সরকার কে উচ্ছেদ করে নিজেই ক্ষমতা দখল করেন। আমরা ভারতে থেকেই নেপালে গনতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন করে যাচ্ছিলাম। তারই অংশ হিসাবে আমরা বেশ কিছু অস্ত্র শস্ত্র জোগাড় করেছিলাম।
বামপন্থী নেতা জয় প্রকাশ নারায়ণ ছিলেন আমাদের খুব ভালো বন্ধু। বিশেষকরে আমার বড় ভাই বিপি কৈরালা (যিনি তৎকালীন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন কিন্তু রাজা সে ক্ষমতা দখল করে নেন) ও জয় প্রকাশ নারায়ণ ছিলেন খুবই ঘনিষ্ঠ।
মুক্তিযুদ্ধ যখন একটি গুরুত্বপুর্ণ অবস্থা পার করছিল তখন জয় প্রকাশ নারায়ণ নেপালি কংগ্রেসকে সাহায্য করতে অনুরোধ করলেন, বিশেষকরে অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে। উল্লেখ্য যে, মি নারায়ণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সহযোগী ছিলেন।
আমরা বিষয়টা নিয়ে অনেক আলোচনা করি। জয় প্রকাশ, আমার ভাই বিপি কৈরালা এবং আমি উত্তর প্রদেশের মোগলসরাই রেল স্টেশনে ট্রেনের একটি বগিতে বসে আলোচনা করি। জয় প্রকাশ সেই ট্রেনে করে দিল্লী ফিরছিলেন। এ সময়ে পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য আমি সরোজমিনে দেখার সিদ্ধান্ত নেই এবং চুপি চুপি বাংলাদেশের একটি অঞ্চলে প্রবেশ করি ও কয়েকদিন সেখানে কাটাই। ফিরে আসার পরে আমরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যের সিদ্ধান্ত নেই। আমরা মনে করেছি যে বাংলাদেশের এই যুদ্ধ এ অঞ্চলের উন্নতি ও সংহতিতে ভূমিকা রাখবে।
আমরা তখন আমাদের লোকজনদের বলি (চক্র প্রসাদ বাসতলা, কর্নেল বিডি রাই এবং আমার শ্যালক সুধীর উপাধ্যায়) আমাদের অস্ত্র ও গোলা বারুদ গেরিলাদের কাছে হস্তান্তর করতে। আমি বিশেষভাবে নির্দেশ দেই যাতে অস্ত্র হস্তান্তরের আগে তারা যেন আকাশের দিকে একটা গুলি বর্ষণ করে আমাদের সংহতির প্রতীক হিসাবে। তারা ঠিক সেভাবেই কাজ করে।

আজ অতীতের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হয়, মুক্তিযুদ্ধে আমি জড়িয়েছিলাম মূলত তিনটি কারনে-
প্রথমত, বাঙ্গালি জনতার সাথে আমার একটি আবেগ জড়িয়ে আছে। আমার বাবা কৃষ্ণ প্রসাদ কৈরালা, বাংলাদেশ থেকে একজন ডাক্তার নিয়ে এসেছিলেন আমাদের বিরাটনগর (কৈরালার গ্রামের বাড়ি) হাসপাতালের জন্য, যাতে করে বিরাটনগর শহর আরো উন্নত হয়। তখন বৃটিশ উপনিবেশ চলছে, ভারত পাকিস্তান কেউই স্বাধীন নয়। বিরাটনগরে সেই ডাক্তার পরিবারের অভিবাবক-বন্ধু ছিলাম আমরাই। আমার বাবার অনুমতি স্বাপেক্ষে আমি সেই ডাক্তার পরিবারের সাথে বাংলাদেশে তাদের বাড়িতে যায় এবং বেশ কয়েকমাস সেখানে কাটাই। আমি বেশ আনন্দেই ছিলাম সেই সময়টাতে। এই পারিবারিক বন্ধন আমাকে উৎসাহ যুগিয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহায্য করতে। আমার মনে হয়েছে বাঙ্গালিদের নিজেদের জাতীয় পরিচয়ের দরকার।

দ্বিতীয়ত, আমাদের এই নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছিল যে, বাংলাদেশের যুদ্ধের পরে আমাদেরকেও যথা সময়ে সাহায্য করা হবে নেপালে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য,

তৃতীয়ত, আঞ্চলিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে আমাদের মনে হয়েছিল যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এই অঞ্চলের স্থিতি, গনতান্ত্রিক সংস্কৃতি এবং শান্তি প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে”

এই হল জিপি কৈরালার বিবৃতি। আমাদের গেরিলা বাহিনীর দিক থেকেও এই তথ্যগুলো ভেরিফাই করা গেলে ভালো হত। হয়ত করাও যাবে। তবে মি কৈরালা কোন নাম মনে করতে পারেন নি। তবে এর বাইরেও নেপালে অনেক ঘটনা ঘটেছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। বেশ কিছু সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে, লিটল ম্যাগ এ প্রকাশিত হয়েছে প্রবন্ধ। এমনকি খোদ কাঠমুন্ডুর রাস্তায় হয়েছে বিক্ষোভ মিছিল। সে সবের রেফারেন্স এখন তেমনভাবে সংরক্ষিত নেই। অনেকের স্মৃতিও হয়ে গেছে ফ্যাকাসে। তবে অনেক কিছুই উদ্ধার করা যেতে পারে এখনো।
হয়ত নেপালের বরফে ঢাকা নিরিবিলি পাহাড়ের কোলে বসে যে বৃদ্ধ তাকিয়ে আছে আগুনের দিকে, একদিন সেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আকাশ থেকে আরেকটি জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের ভেতর- যে অগ্নিকুণ্ডের নাম ছিল মুক্তিযুদ্ধ। যে আগুন এখনো অনির্বাণ আমাদের রক্তে।
১২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছায়ানটের ‘বটমূল’ নামকরণ নিয়ে মৌলবাদীদের ব্যঙ্গোক্তি

লিখেছেন মিশু মিলন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



পহেলা বৈশাখ পালনের বিরোধীতাকারী কূপমণ্ডুক মৌলবাদীগোষ্ঠী তাদের ফেইসবুক পেইজগুলোতে এই ফটোকার্ডটি পোস্ট করে ব্যঙ্গোক্তি, হাসাহাসি করছে। কেন করছে? এতদিনে তারা উদঘাটন করতে পেরেছে রমনার যে বৃক্ষতলায় ছায়ানটের বর্ষবরণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বয়কটের সাথে ধর্মের সম্পর্কে নাই, আছে সম্পর্ক ব্যবসার।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৫০


ভারতীয় প্রোডাক্ট বয়কটটা আসলে মুখ্য না, তারা চায় সব প্রোডাক্ট বয়কট করে শুধু তাদের নতুন প্রোডাক্ট দিয়ে বাজার দখলে নিতে। তাই তারা দেশীয় প্রতিষ্ঠিত ড্রিংককেও বয়কট করছে। কোকাকোলা, সেভেন আপ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানুষের জন্য নিয়ম নয়, নিয়মের জন্য মানুষ?

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৪৭



কুমিল্লা থেকে বাসযোগে (রূপান্তর পরিবহণ) ঢাকায় আসছিলাম। সাইনবোর্ড এলাকায় আসার পর ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি আটকালেন। ঘটনা কী জানতে চাইলে বললেন, আপনাদের অন্য গাড়িতে তুলে দেওয়া হবে। আপনারা নামুন।

এটা তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন খাঁটি ব্যবসায়ী ও তার গ্রাহক ভিক্ষুকের গল্প!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৪


ভারতের রাজস্থানী ও মাড়ওয়ার সম্প্রদায়ের লোকজনকে মূলত মাড়ওয়ারি বলে আমরা জানি। এরা মূলত ভারতবর্ষের সবচাইতে সফল ব্যবসায়িক সম্প্রদায়- মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে অভ্যাসগতভাবে পরিযায়ী। বাংলাদেশ-ভারত নেপাল পাকিস্তান থেকে শুরু করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×