somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঈদ স্পেশাল রম্যগল্পঃ জলিলের বাস ভ্রমন

১৪ ই অক্টোবর, ২০১৩ সকাল ১০:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি জলিল।

না না! জলিল নাম শুনিতেই যে জলিলের চিত্র আপনাদের চোখের সামনে ভাসিয়া উঠিছে, আমি সেই জলিল না। আমার পুরা নাম জলিল খন্দকার। আমি আসম্ভবকে সম্ভব করিতে মোটেও পারদর্শী নই। বরং সম্ভব কাজগুলিও আমার কাছে অসম্ভব বলিয়া মনে হয়।

পাবলিক বাসে চড়িবার উদ্দেশ্যে ঘণ্টা খানেক যাবত গুলিস্তানের মোড়ে দাঁড়াইয়া আছি, বাসের দেখা মিলিতেছে না। মনটা অত্যধিক খারাপ হইয়া আছে। তাই ভোর বেলা বাড়ি হইতে বাহির হইয়াছি মগবাজার যাইব বলিয়া। দাঁড়ান, দাঁড়ান! মগবাজার যাইবার কথা শুনিয়া আপনাদের ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসি দেখা যাইতেছে কেন? আমার চরিত্র লইয়া খারাপ কিছু ভাবিয়া বসিয়েন না। মগবাজারে আমার বন্ধু মাহতাব থাকে। মন খারাপ হইলে আমি তাহার সহিত সাক্ষাৎ করি। অচিরেই মন ভাল হইয়া যায়।

আপনাদের হয়ত ভাবিতেছেন মাহতাব রসিক মানুষ। হাসি তামাশা দ্বারা মন ভাল করিতে উস্তাদ। প্রকৃত পক্ষে তেমন কিচ্ছু নহে। বন্ধু মাহতাব হইতেছে পৃথিবীর সবচাইতে দুঃখী মানুষের একজন। সমস্ত পৃথিবীর মানুষের দুঃখ এক করিলে তাহার দুঃখ অপেক্ষা কম না হইলেও সমান হইবে। তাই আমার মনখানা খারাপ হইলেই তাহার নিকট গিয়া উপস্থিত হই। তাহার দুঃখের কথা শুনিলে আমার মন ভাল হইয়া যায়। মনে হয় জগতে আমার চাইতেও দুঃখী মানুষ আছে! এই তো সেবার জুলেখার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হইবার পর মনের দুঃখে মাহতাবের কাছে গেলাম। মাহতাব শুনাইল আরও কষ্টের এক করুন কাহিনী...

মাহতাব ইডেন কলেজের এক ললনার সহিত হৃদয়ঘটিত সম্পর্কে জড়াইয়া গিয়াছিল। কন্যার সহিত ফেসবুকে পরিচয় মোবাইলে প্রেম। অবশেষে একদিন বিকেলে তাহারা শুভদিন বিবেচনা করিয়া দেখা করিবার প্লান করিয়াছিল।

যথাসময়ে দেখা হইল কিন্তু দেখা হইতেই ললনা বলিয়া উঠিল, “তুমি তো শুকনা! প্রেম করবা কীভাবে?”

এই কথা বলিবার পর ললনা তাহাকে ফেলিয়া চলিয়া গেছে, শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত পুনরায় তাহাকে বিরক্ত করিলে লেডি গুন্ডা দ্বারা মাইর খাওয়ানোর হুমকি দিয়াছে!

প্রেম করিতে মোটা হওয়া লাগে ইহা আমার ধারণাতীত ছিল! বন্ধু মাহতাব হাপুশ নয়নে কাঁদিতেছিল এই কাহিনী বলিবার সময় যাহা দেখিয়া আমি জুলেখার শোক ভুলিয়া গিয়াছিলাম। তাইত মন খারাপ হইতেই তাহার খোঁজে যাইতেছি। জানি এবারো মাহতাব আমাকে হতাশ করিবে না।

***

পাবলিক বাস চলিয়া আসিছে। বাসে উঠিবার নিমিত্তে দাঁড়াইয়া থাকা যাত্রীগণের সহিত যুদ্ধ করিবার লক্ষে প্রস্তুতি গ্রহন করিলাম। অনেক কষ্ট করিয়া, দুই চারশ গ্রাম ঘাম ঝড়াইয়া, কোমরের ধাক্কায় দুই চার জনকে কুপোকাত করিয়া অবশেষে পাবলিক বাসে চড়িতে সমর্থ হইলাম। বাসের হ্যান্ডেল একখান পাকাইয়া ধরিয়া মানুষের ভিড়ে “মানুষিক চাপে” পিষ্ট হইয়া যখন প্রানান্ত অবস্থার সৃষ্টি হইয়াছে, তখনই খেয়াল হইল সম্মুখের আসনে একখানা ছোট খাট হস্তি বসিয়া রহিয়াছে। মনুষ্যআসনে হস্তী বসিয়া থাকিবার হেতু বুঝিয়া পাইলাম না। অবশ্য দৃষ্টিশক্তির ক্রমাগত কসরত চালাইয়া ঠাহর করিলাম সম্মুখের আসনে বসিয়া থাকা হস্তীখানি প্রকৃতরুপে হস্তী নয়, উহা একখান মানবশিশু! বোধকরি তাহাকে মানব শিশু অপেক্ষা হস্তিশিশু নামে সম্বোধন করাই শ্রেয় হইবে।

হস্তীশিশুর পাশেই দেখিলাম দশাসই চেহারার এক পূর্ণাঙ্গ হস্তীও অবস্থান করিতেছে। যেমন পিতা, তাহার তেমন সুপুত্র দেখিয়া বাস সুদ্ধ লোকে “ওরে বাবারে!”, “এইটা আমি কি দেখলাম?”, “কেউ আমারে মাইরালা”, “খোদা আমারে উডায় লও” ইত্যাদি বাক্য দ্বারা উহাদের সাধুবাদ জানাইতে লাগিল।

হস্তীদ্বয় অতি কষ্টে তিনজনের সিটে দুজনে বসিয়া রহিছে। ইহার পরও তাহাদের আরাম করিয়া বসিতে কষ্ট হইতেছিল। বলাবাহুল্য তাহাদের এহেন কষ্ট দেখিয়া কেউ তাহাদের চাপিয়া বসিয়া আর একজনের বসার যায়গা দেওয়ার কথা বলিতে পারিলেন না, অথবা বলিতে সাহস পাইলেন না!

খানিক বাদে লক্ষ করিলাম বাসে মধ্যে মশক বাহিনীর খালাত ভাই একখান মাছির উদ্ভব হইল। মাছিখানা হস্তীশিশুর আশে পাশে ভন ভন রবে ঘুরিতে লাগিল। হস্তী শিশু বিরক্ত হইয়া মাছিটা পর্যবেক্ষণ করিতে লাগিল। তাহাদের সম্মুখের আসনে একজন মুরাদ(মাঝবয়সী) টাকলা সিটে হেলান দিয়া ঘুমাইয়া ছিলেন। হঠাৎ মাছিখানা তাহার স্টেডিয়ামরুপী মস্তকে বসিয়া গেল। হস্তী শিশু আচমকা চপেটাঘাতে তাহার মাস্তিস্কের সাথে মাছিটিকে লেপটাইয়া দিল। বাচ্চা হাতির এহেন ত্বরিতকর্ম দেখিয়া আমি বিস্ময়ে প্রায় অজ্ঞান হইয়া যাইতেছিলাম।

ওদিকে মুরাদ টাকলা তাহার টাকে এইরূপ মোক্ষম আঘাত খাইয়া “রানা প্লাজা ভাইঙ্গা পড়ছে রে” বলিয়া ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিলেন! সেকেন্ড পাঁচেক কাটিবার পর বুঝিতে পারিলেন তাহার স্টেডিয়ামে কেহ ছক্কা পিটাইয়াছে! চক্ষু গরম করিয়া পিছনে তাকাইলেন, উদ্দেশ্য চপেটাঘাতকারীকে কিছু মুখরোচক গালি গালাজে ভস্ম করিয়া দিবেন।

কিন্তু হস্তীশিশু আর তাহার হস্তী বাপকে দেখিয়া তিনি কাচুমাচু হইয়া কহিলেন, “বাবু! খেলাধুলা করছ? ভাল তো! খেল খেল!”

মুরাদ টাকলা চিরতার পানি খাইয়াছেন এমন ভাব করিয়া পুনরায় তাহার সিটে বসিয়া পরিলেন। এখন আর পিছনে হেলান দিতেছেন না। তিনি জানেন অমন চপেটাঘাত আর একখান পরিলে আর আপন পদ দ্বারা হাঁটিয়া বাড়ি ফিরিতে পারিবেন না।

এক্ষনে আমি কাণ্ড দেখিয়া হাসিতে ছিলাম। হঠাৎ খেয়াল হইল একখান মাছি আমার মুখের সামনে দিয়া আপন সুখে গুনগুন করিয়া উড়িয়া বেড়াইতেছে। হস্তীশিশু আওয়াজ লক্ষ করিয়া অগ্নি দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাইল। ভয়ে তখন আমা আত্মারাম খাঁচাছাড়া হইবার যোগাড়!

***

পাশ থেকে একজন লোক বলিয়া উঠিল,” ভাই দেখেন! কতক্ষন ধইরা খাঁড়াইয়া আছে!”
আমি আতঙ্কিত চোখের তাহার দিকে তাকাইলাম, “কি খাঁড়াইয়া আছে ভাইজান?”
“বাসটা। সিগ্ন্যাল পড়েনাই কিছুনা, হুদাই খাঁড়াইয়া আছে!”
আমি হাফ ছাড়িয়া বাঁচিলাম। “যাক! অন্য কিছু খাঁড়া হয় নাই”।

বাস খানা বিজয়নগর মোড়ে আসিয়া অযথাই দাঁড়াইয়া রহিল, যদি আরও কিছু যাত্রী উঠানো যায়! এমনিতেই বাসের ভিতরে দম ফেলিবার উপায় পাইতেছি না, ডাইভার আরও যাত্রী উঠাইতে ইচ্ছুক। মনে হইতেছিল ড্রাইভারকে একটা কইন্না দেই ধরে!

বসিয়া থাকিতে থাকিতে অতিষ্ঠ হইয়া উঠা যাত্রীগনের কেউ একজন হঠাৎ তড়াক করিয়া দাঁড়াইয়া কইয়া উঠিল। “ঐ ড্রাইভার! গাড়ি ছাড়বি নাকি দিমু কানের নিচে একটা?”

এহেন বাক্যবাণ পাবলিক বাসে নিত্যদিনের ব্যাপার। অবাক হইবার কিছু নাই। তথাপি বাস সুদ্ধ লোক অবাক হইয়া হুমকি প্রদানকারীর দিকে উৎসুক চোখে তাকাইয়া রহিল। কারন এহেন হুমকি দেওয়া মানুষটি কার্যত একজন মহিলা। আমি তাকাইয়া দেখিলাম আমার মায়ের বয়সী খালার মত দেখতে একজন মহিলা চোখ গরম করিয়া অঙ্গুলি উচা করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। কিঞ্চিৎ ভীমরি খাইয়া গেলাম!

অতি উৎসাহী যাত্রী গনের একজন আবার কহিয়া উঠিল, “ও খালা! ড্রাইভারের কানের নিচে কি দিবা? থাবড়া না উশটা?”
খালামনি বত্রিশ দণ্ত প্রদর্শনপূর্বক কহিল, “কিছুই না। ওরে চুম্মা দিমু!”

বলা বাহুল্য এই কথা শুনিবা মাত্রই ড্রাইভার ফুল স্পীডে গাড়ি ছুটাইল। কানের নিজে খালামনির একটা থাবড়া হয়ত তাহার সহ্য হইবে কিন্তু চুম্মা সহ্য হইবার নয়!

***

আমার মধ্যে একটু ঝিমানি ভাব চলিয়া আসিল হঠাৎ শুনিলাম কেউ একজন পিছন হইতে প্রশ্ন করিতেছে, “ভাই সানি লিওন?” আমি ঘাবড়াইয়া গেলাম! কসম কাটিয়া কহিতেছি সানি লিওনের সাথে আমার চেহারা বা শারীরিক বৈশিষ্ট্যে কোনরূপ সাদৃশ্য খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না!

“ভাই সাইড দিবেন?” ওহ! এক্ষনে প্রশ্নখানা পরিষ্কার ভাবে বুঝিলাম। তাকাইয়া দেখি দানবাকার এক দৈত্য দাঁড়াইয়া আছে ঠিক পেছনেই। “দানবাকার দৈত্য” শব্দে উপমার ভুল প্রয়োগ বা দ্বিত্বতা সংক্রান্ত ব্যাকরণগত ভুল কেউ খুঁজিতে যাইয়েন না। উহার শারীরিক অবয়বের বর্ণনা দিতে ইহা হইতে উত্তম উপমা খুজিয়া পাইলাম না। আমি পড়িমরি করিয়া সাইড দিলাম।

দানবাকার দৈত্য সামনে আগাইয়া আসিয়া কহিল, “আমজাদ ভাই, ভাল আছেন?”
আমজাদ সম্বোধন ছুঁড়েছেন তিনি হস্তী পিতাকে লক্ষ করিয়া। হস্তীপিতা উঠিয়া দাঁড়াইলেন। “আহারে, খলিল ভাই যে!”
দুই দানবে কোলাকোলি করিতে লাগিলেন।

দানবে দানবে দাপাদাপি শুরু হইল যেন! আমাকে একবার জানোয়ার নামরুপী এক ব্লগার বাজে কথা কহিয়াছিলেন, দীর্ঘদিন যাবত তাহার উপর রাগিয়া আছি আমি। তাহাকে মনে মনে দুই দানবের মাঝে দাড় করাইয়া দিলাম! “মর-মট-মরাট!” আহা! হাড় ভাঙ্গিবার শব্দ স্পষ্ট শুনিতে পাইলাম যেন! “মট্টর!” এইবার ফাটিয়াছে মাথার খুলি!

কোলাকোলি অর্থাৎ দাপাদাপি শেষ হইলে আমজাদ হস্তী কহিল, “ভাই আছি ভালই। ছেলেটা ভাল নাই”।
আমার চোখ উলটাইবার উপক্রম! “এই বাচ্চা হাতি ভাল নাই? খানিক আগে চপেটাঘাত দ্বারা একজনকে খুন করিয়া ফেলেছিল প্রায়!”
খলিল দৈত্য বলিল, “কি হয়েছে?”
“কিচ্ছু খাইতে চায়না! ওর মা কত কিছু খাওয়াতে চেষ্টা করে সারাদিন”!
আমার অবস্থা এই কথা শুনিয়া কি হইল তাহা আর না বলিলাম। আপনাদের অবস্থা দ্বারাই আমার অবস্থা অনুমান করিয়া লন!
খলিল দৈত্য কহিল, “আহারে! এই জন্যই তো বেচারা শুকিয়ে গেছে!”
আমি কহিলাম আপন মনে, “হে খোদা, উপর থেইকা দড়ি ফালাও আমি বাইয়া উইঠা জাইগা!”
আমজাদ হস্তী কহিল, “খাওয়ার মধ্যে সারাদিন খালি চিকেন খায়! আর কিছু খায়না!”
এইবার হাসিলাম! “হে হস্তী শিশু! এইবার না তোর বাহুল্য মাংশের রহস্য বুঝিলাম! আকাম যা করার ঐ চিকেনই করিয়াছে! মাহতাবকে বলিতে হইবে অতিরিক্ত চিকেন ভক্ষন করিতে, তাহা হইলে তাহার শুকনা হইবার বদনাম ঘুচিয়া যাইবে”।

হঠাৎ সেই মাছিখানা আবার আমার নাকের কাছে ঘুরিতে লাগিল! হস্তি শিশুর অতি আগ্রহ নিয়া আমার নাকের দিকে তাকাইয়া থাকা দেখিয়া ভয়ে আমার আত্তারাম খাঁচাছাড়া হইতে চাইল।

অবশ্য মানীর মান আল্লায় রাখে! বাস ততক্ষনে কাকরাইল মোড়ে পৌঁছাইয়া গেছে। এক গাঁদা বসিয়া থাকা যাত্রী নামিয়া পড়িতেই দাঁড়াইয়া থাকা যাত্রী গনের মধ্যে বসার জন্য হুটোপুটি শুরু হইল। আমি হস্তীগণের নিকট হইতে দূরে একখানা সিট দখল করিয়া লইলাম। আমার সামনের দুখানা সিট ও পাশের সিট খালি পড়িয়া রইল। মনের দুঃখে একখান দুঃখে ভরা গান ধরিলাম, আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে...

***

বাস যতক্ষণে শান্তিনগর মোড়ে পৌছাইছে আমি ততক্ষনে আবিস্কার করিয়াছি আমার সিটখানির গদির অভ্যন্তরে তারকাটা জাতীয় কিছু একটা রহিয়াছে যাহা ক্রমাগত আমার নিতম্বকে খোঁচায় খোঁচায় জর্জরিত করিতেছে। আমি নড়া চড়া করিয়া মানাইয়া লওয়ার চেষ্টা রত। ভাবিতেছি সিট খানা বদল করিব এমন সময় এক জব্বর কাণ্ড ঘটিল। শান্তিনগর মোড় হইতে বাসে একজন হুরপরী উঠিলেন।

আমি কিঞ্চিৎ চিন্তিত হইলাম। এহেন স্থানে স্বর্গের হুরপরীর দেখা মিলিবার হেতু কি হইতে পারে? আমি কি মৃত্যুবরণ করিয়াছি? কিন্তু আমার মত বদের তো স্বর্গ লাভ করিবার কিছুমাত্র সম্ভাবনা নাই! খানিক বাদে হুরপরীর পেছন পেছন বাসের দরজায় আমার ভাইয়ের বড় ভাইয়ের বয়সী বাপের মত দেখতে এক হোঁৎকা বালকের উদয় হইতে বুঝিলাম আমি স্বর্গে যাই নাই, স্বর্গ হইতে একখান হুরপরী মর্তে নামিয়া আসিছে।

বাসে আমার পাশের সিট খানা তখনও খালি রহিয়াছে। আমি জানালার দিকে একটু চাপিয়া বসিয়া সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করিতে লাগিলাম। মনে আশা জাগিছে হয়ত এই হুরপরী আমার পাশেই বসিবে। বুঝ ক্ষমতা হওয়ার পর অর্থাৎ এক বছর বয়স হইতে দেখিয়া আসিতেছি, সাধারণত হুরপরীরা আমার পাশে বসিতে পছন্দ করে। প্রতিবারই তাহাদের সহিত কিঞ্চিৎ লুলামি করিয়া আমি সখ্যতা গড়িয়া লই। আমার জিভ হইতে ততক্ষনে “দি তেঁতুল থিওরি অফ লালা” অনুযায়ী লালা নির্গত হইতেছে। তথাপি সৃষ্টি কর্তার দয়া হইল না। আনন্দের আতিশয্যে খেয়াল হয়নি আমার সামনের সিটখানাও উদোম অর্থাৎ খালি রহিয়াছে। হুরপরী ঠিক আমার সামনের সিটে বসিয়া পরিল। কিন্তু বিমর্ষ হইয়া দুদণ্ড শোক পালন করিবার ফুসরত মিলিল না। তার আগেই হোঁৎকা বালক আসিয়া আমাকে কোমরের ধাক্কায় দিয়া আরও দুই তিন ইঞ্চি যায়গা করিয়া বসিয়া পরিল।

হুরপরী অবলোকন করিয়া আমার নিতম্বের নিচের তারকাটা সমস্যার কথা ভুলিয়া গিয়াছিলাম। এক্ষনে আবার তাহার স্বাদ পাইতে লাগিলাম। সামনের আসনে হুরপরীর পানে দৃষ্টি রাখিয়া আবার বাইন মাছের মত মোচড় খাইতে লাগিলাম। হঠাৎ খেয়াল হইল হোঁৎকা বালক খানিকক্ষণ আমায় দেখে আবার আবার খানিকক্ষণ দেখে হুরপরীকে। তাহার চোখে অগ্নিদৃষ্টি দেখিয়া বুঝিলাম সে সম্ভবত আমার বাইন মাছের মত মোচড় খাওয়া আর সামনের আসনে হুরপরীর বসে থাকার মাঝে কোন যোগসূত্র আবিস্কার করিয়াছে। অগত্যা জান বাচাইবার উদ্দেশ্য নিতম্ব সমস্যা ত্যাগ করিলাম অর্থাৎ তারকাটার গুঁতো বিনা প্রতিবাদে হজম করিতে থাকিলাম।

***

বাস চলিতেছে। হুরপরীর হঠাৎ মোবাইল বাজিয়া উঠিল। আহ কি রিংটোন! “মেরে আশিকি আব তুম হি হো!” আমিও মনে মনে গাইতে লাগিলাম, “মেরে হুরপরী আব তুম হি হো!”

বাস পৌঁছাইল মৌচাকে। হুরপরী মোবাইলফোন বাহির করিয়া কাহারো সাথে ফোনালাপ শুরু করিয়াছে। “জানটুস, এইতো কাছাকাছি চলিয়া এসেছি। আর কিছুক্ষন অপেক্ষা কর লক্ষিসোনা!”
দিলে বড় চোট পাইয়া গেলাম। হুরপরীর একখান ছেলেবন্ধু আছে তাহা ছিল আমার কল্পনার অতীত। বলা বাহুল্য, আজ অবধি মোবাইল ফোনে এহেন মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনিবার সৌভাগ্য আমার হয় নাই। আমি খাড়া করিয়া... মানে কান খাড়া করিয়া তাহার বাক্যালাপ শুনিতে লাগিলাম।

এদিকে বাসের বেরসিক হেলপার চিৎকার করিতেছে, “ওই মৌচাক! মৌচাক নামেন!!” সেই কর্কশ আওয়াজে হুরপরীর ফোনালাপে সমস্যা হইতেছিল। সে অপর হাতের কনিষ্ঠা দ্বারা কানের ফুটো আটকাইয়া কথা বলিতে লাগিল। আমি মনে মনে গাল পাড়িলাম হেলপারকে, “ওরে হতচ্ছাড়া। অমন কর্কশ কণ্ঠে গলা ফাটাইয়া মৌচাক মৌচাক করিতেছিস কেন? সুন্দরী ললনার ফোনালাপ বাধাগ্রস্ত হইতেছে তাহা তুই বুঝিস না? তোর ঘরে সুন্দরী বউ নাই বলে কি সুন্দরী মেয়েদের সম্মান দিবিনা?”

পাশের হোঁৎকা পোলা ততক্ষনে ঝিমাইতে আরম্ভ করিছে। আমার গায়ে হেলান দিয়া পরিল। পাহাড়ের তলে চাঁপা পরিলে পিঁপড়ার কি অবস্থা হইতে পারে ধারনা আছে আপনাদের? আমার অবস্থা তখন তারচেয়েও ভয়াবহ!

***

বাস মৌচাক ছাড়াইয়া ওয়্যারলেস রেলগেট আসিয়া পরিছে। হোঁৎকা পোলা পড়ি মরি করিয়া উঠিয়া বাস হইতে নামিয়া গেল। আমি একটু হাফ ছাড়িবার অবকাশ পাইয়াছি। হুরপরী তখনও ফোনে কথা বলিয়া চলিছে। আহা কি মধুর কণ্ঠস্বর। শুনিয়াই মনে হয় বাহির হইয়া যায়... মানে… প্রান বাহির হইয়া যায় আর কি!
উজবুক হেলপার আবার শুরু করিল, “ওই ওয়্যারলেস নামেন, ওয়্যারলেস”।

হুরপরী আবার অপর হাতের আঙ্গুল দিয়া কানের ফুটা বুজাইয়া বলিতে লাগিল, “এইতো জান্টুস আসিয়া পরেছি। আর একটু দূরে রহিয়াছি”।

সম্ভবত অপরপ্রান্ত হইতে জিজ্ঞাসা করিল, “সেই কখন থেকে বলিতেছ কাছেই আছ, কাছেই আছ! এই মুহূর্তে কোথায় রহিয়াছ প্রানের হুরপর?”

হুরপরী কহিল “দাঁড়াও দেখিতেছি”। অতপর আশে পাশের দোকানের সাইনবোর্ড দেখিয়া সটান হইয়া দাঁড়াইয়া গেল। হেলপারের উদ্দেশ্যে কহিল, “ওই কুত্তার বাচ্চা হেলপার। বাস ওয়্যারলেস আইসা পরছে, তুই কস নাই কেন? মৌচাকে নামাইলি না কেন? শুয়োরের বাচ্চা! তোরে না কইলাম মৌচাকে আসলে বলার জন্য!”

হেলপার তো হেলপার! ড্রাইভার, আমি, হস্তীবৃন্দ এবং বাসের সকল যাত্রী অবাক হইয়া তাহার পানে তাকাইয়া রহিলাম। অমন সুন্দর মুখশ্রী হইতে এইরূপ গালি বর্ষণ হইতে পারে ইহা ভাবনার অতীত! হুরপরী অকথ্য ভাষায় ড্রাইভার আর হেলপারকে অশ্লীল সব গালি গালাজ করিতে করিতে বাস হইতে নামিয়া গেল। মনে মনে সৃষ্টি কর্তাকে ধন্যবাদ দিলাম। ভাগ্যিস ললনাকে আমার পাশে উনি বসান নি! নচেৎ স্বভাব অনুযায়ী হয়ত হুরপরীর সহিত লুলামি করিতে গিয়া উলটো গালিগালাজ শুনিয়া মান সম্মান হারাইয়া জানালা হইতে লাফাইয়া পরিয়া আত্মাহুতি দিতে হইত!

***
বাস মগবাজার পৌছাইতে আমি নামিয়া গেলাম। মাহতাবকে একটা ফোন করা দরকার। মোবাইলের উদ্দেশ্যে পকেটে হাত চালালাম! ওরে! আমি তো শ্যাষ! মোবাইল খানা কোন এক আল্লাহর বান্দা চক্ষুদান করিয়াছে! হায় হায় মানিব্যাগ কই? টাকা পয়সা যা ছিল গেছে! ঘড়িখানাও হাতে নাই! এক্ষনে কি উপায় হইবে রে??

আজকে আমার দুঃখের দিন! মাহতাব যতই দুঃখের কাহিনী শুনাক না কেন, আমার দুঃখ দূর হইবেনা। বরং আমার কাহিনী শুনিলে মাহতাব তাহার এক জীবনের সকল দুঃখ ভুলিয়া যাইতে সমর্থ হইবে!!

*****************************

সিরিয়াস গল্প লিখতে লিখতে একটা একঘেয়েমি চলে এসেছে আমার মধ্যে। ঈদ উপলক্ষে তাই একটু ভিন্ন কিছু করার প্লান ছিল। গল্পের উদ্দেশ্য একটাই আর তা হল মানুষকে হাসানো। যদি হাসাতে পেরে থাকি তাহলে খুব আনন্দিত হব।

উৎসর্গঃ বন্ধু অপু তানভীরকে :)
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই অক্টোবর, ২০১৩ বিকাল ৫:৪০
৫৬টি মন্তব্য ৫৬টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×