হাঁটতে হাঁটতে বাংলামোটর মোড়ের একটু আগে এসে দাঁড়াল হিমু। মিসির আলীকে এক মিনিট দাঁড়ান বলেই সে হাওয়া হয়ে গেল। বিশাল ভবনটার ভেতরে ঢুকে সে লিফটে চড়ে বসল। এরপর নির্দিধায় এপার্টমেন্টের দরজাতে থাকা কলিংবেল টিপল। খুলে দিলেন এক ভদ্রলোক। হিমু তাকেই খুঁজতে এসেছিল।
: স্লাামালেকুম। রুপা আছে?
: আপনি ভুল করছেন। এটা রুপাদের বাসা না। হেনাদের বাসা। আপনি কে?
: আমি দেবদাস। পত্রিকা পড়ে জানলাম বহিস্কারাদেশ পাওয়ার পর আপনি নাকি 'রাজনৈতিক দেবদাস' হয়ে গেছেন?
: শরৎচন্দ্রের দেবদাস বহু আগেই মারা গেছে। পার্বতীর এতদিনে কী হয়েছে জানি না।
ভদ্রলোক দরজা বন্ধ করে দিলেন। সম্ভবত হিমুকে তার পাগল মনে হয়েছিল। হিমু ফিরে এসে দেখল মিসির আলী সাহেব রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছেন। হিমুকে দেখে তিনিই মুখ খুললেন।
: আমি জানি, তুমি কার কাছে গিয়েছিলে। হাতি কাদায় পড়লে তাকে চামচিকাও লাথি মারে।
: আমি অবহেলা করতে যাইনি। সহানুভূতি জানাতে গিয়েছিলাম।
: তোমার চোখ-মুখ বলছে তুমি তার সমালোচনা করতে গিয়েছিলে। শোন, ফোর্ড তার তৈরিকৃত প্রথম মোটর গাড়িতে ব্যাকগিয়ার দিতে ভুলে গিয়েছিলেন। এডিসন একটি উদ্ভাবনের জন্য 20 লাখ ডলার খরচ করার পর দেখলেন তেমন কিছুই করতে পারেননি। আসলে সে-ই ভুল করে যে কিছু না কিছু করে, আর যে কিছুই করে না সে অপরের সমালোচনা করে।
: বোমা হামলা হচ্ছে চারদিকে। বিচারক, পুলিশ, আইনজীবী আর সাধারণ মানুষকে মেরে ফেলা হচ্ছে। দেশের সব সম্ভাবনাকে যারা বোমাবিদ্ধ করছে তাদের কিংবা সরকারের দায়-দায়িত্দ্ব কি সমালোচনা করা যাবে না?
: যাবে (বলেই মিসির আলী দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তার মনে পড়ল এই বাংলাভাইকে পুলিশ প্রশ্রয় দিয়েছিল। মুফতি হান্নান এক সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে মার্সি পিটিশনও দিয়েছিল। হায়, তখন যদি তাদের ধরা যেত!) আসলে চারটি জিনিস কখনো ফিরে আসে না। বলা কথা, ছোড়া তীর কিংবা বুলেট অথবা কামানের গোলা, অতীত সময় এবং হারানো সুযোগ! আর একটা সিংহের গল্প শোন। একটা ষাঁড়কে আস্ত চিবিয়ে খাওয়ার পর আনন্দে এক সিংহ গর্জন করতে লাগল। গর্জন শুনে শিকারি বুঝতে পারল সিংহ কোথায় আছে এবং সহজেই তাকে গুলি করে মেরে ফেলল। এই গল্পের শিক্ষণীয় বিষয়টা হলো, খেয়ে পেট ভর্তি হলে পরে চুপচাপ থাক। জঙ্গিরা সিংহের মতো না। তারা বোমা মেরে নিজেরাও মরে। আর তাদের গডফাদাররা থাকে চুপচাপ। যেন সরকার কিংবা বিরোধী দল কেউ তাদের নাগাল না পায়।
চা খাওয়া শেষে আবারো তাদের পদযাত্রা শুরু হলো। তাদের গন্তব্য শাহবাগ। সেখানে রুপা আসার কথা। আসার কথা সুনীল গাঙ্গুলীর নীরা'র। জীবনানন্দ দাশের সুরঞ্জনা কিংবা বনলতা সেন আর রবীন্দ্রনাথের লাবণ্য এবং অমিতসহ আরো অনেকের। শাহবাগে জমজমাট আড্ডা শেষে ওদের সবার দাওয়াত মাসুদ রানার বাসায়। মাসুদ রানাই তাদের নিতে আসবে। হাঁটতে হাঁটতে দুজন চলে এলো শাহবাগ। তাদের দুজনকে দেখে সবাই হৈ হৈ করে উঠল। হিমুই জিজ্ঞাসা করল_
: আরে সুরঞ্জনা আপু আপনি? আপনার সেই যুবকের খবর কী?
: চুপ করো। তোমরা এরশাদ-বিদিশাকে নিয়ে যা করলে, এরপর নো মোর পার্সোনাল কোয়েশ্চেন। এরপর আর একবারও জিজ্ঞাসা করবে না কী কথা তার সঙ্গে?
খুব কষ্ট হলো মিসির আলীর রাস্তার আইল্যান্ডে বসতে। বয়স হয়ে যাচ্ছে। তবু বসলেন। আড্ডা বলে কথা। তিনি বললেন, বনলতা তোমার কাছেই এসেছি। আমাদের এখানে শান্তির বড় অভাব। তুমি কী আমাদের দু'দন্ড শান্তি দিতে পার না?
: দিতে তো চাই। কিন্তু যখন প্রয়োজন তখন কেউ নেয় না। ছোট বেলায় আমার একবার বড় বসন্ত হয়েছিল। বসন্ত হলে তখন অবশ্য কারো রক্ষা ছিল না। অবাক হয়ে আমি খেয়াল করেছিলাম তখন কেউ আমার কাছে আসত না। এখনো আমি যখন শান্তি দিতে চাই তখন আর কেউ যোগাযোগ করে না।
এর মধ্যে কথা বলে উঠল নীরা। খুব সুন্দর কণ্ঠে বলল_
: আমি অবশ্য নিজ থেকে যোগাযোগ করেই এসেছি। ভয় শুধু এখানে যে, এই দেশটা ভারত ও পাকিস্থানের দালালে পরিপূর্ণ। এখানে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল একে অপরকে এভাবেই গালাগাল করে। আমাকে অবশ্য কেউ কেউ 'র'-এর এজেন্ট বলতে পারে। তবু সুনীল গাঙ্গুলী যেমন লিখেছিলেন_এই হাত ছুঁয়েছে নীরার দু'ঠোঁট, এই হাত কি কোন পাপ করতে পারে? এই আমি, আপনাদের নীরা ছুটে যাব রাজনীতিবিদদের কাছে। তাদের চুমো দেব। দেখবেন তারা আর মিথ্যে বলতে পারবে না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও চুমো দেব গ্রেফতার হওয়া জঙ্গিদের। তারা নিশ্চয় গড় গড় করে তখন বলে দেবে কে তাদের প্রশ্রয় দাতা! এরপর প্রয়োজনে যাব সেসব প্রশ্রয়দাতার কাছে। জঙ্গি এবং তাদের আশ্রয়দাতা কিংবা গডফাদারদের হাত ছুঁয়ে দেব। তারা নিশ্চয় এরপর আর ওই হাতে পাপ করতে পারবে না অর্থাৎ বোমা মারবে না।
এরপর মুখ খুলল অমিত। লাবণ্য খুব মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনতে লাগল।
: রবিঠাকুরের শেষের কবিতার ডায়ালগটা মনে করুন। মানুষ ভালোবাসে সমুদ্র কিংবা দীঘির জলকে। দুটোতেই সে অবগাহন করতে পারে কিল্পস্নু যেটা জরুরি নয়। জীবন ধারণের জন্য মানুষের চাই ঘড়ার বা কলসের জল। স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য, বোমাবাজদের হাত থেকে বাঁচার জন্য এখন আমাদের চাই ঘড়ার জলের মতো পারফেক্ট গোয়েন্দা। যারা সময়মতো সবকিছু বলে দেবে। সব ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেবে। আমরা সবাই কিন্তু তেমন একজনের অপেক্ষাতেই বসে ছিলাম। সেই মাসুদ রানা কী আসবেন না?
চুপ করে থাকতে পারলেন না মিসির আলী। তিনি খুব যুক্তি দিয়ে কথা বলেন। এবারো তেমন কথা বলা শুরু করলেন_
: তোমরা জেনে রাখ ব্যাপারটা। ভালো গোয়েন্দারা থাকে শুধু গোয়েন্দা কাহিনী কিংবা ছবিতে। সেটা মাসুদ রানা, জেমস বন্ড কিংবা যেই হন না কেন। বাস্টস্নবের ব্যাপারটা ভিন্ন। ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হয়ে সামরিক ও বেসামরিক গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে পুরো পূর্ব পাকিস্তানটাকে চষে ফেলেছিলেন। গোয়েন্দারা রিপোর্ট দিয়েছিল, নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ বড়জোর 50-60টি আসন পাবে (তখন মওলানা হামিদ খান ভাসানীর দল ন্যাপ নির্বাচন বর্জন করেছিল) ইয়াহিয়া খানসহ সব নীতিনির্ধারক ভেবেছিলেন আওয়ামী লীগ যদি এর চেয়ে 20-25টিও বেশি আসন পায় তাহলেও তি নেই কোনো। মহাসমারোহে ইয়াহিয়া খান নির্বাচনের আয়োজন করেছিলেন। নির্বাচনের পর দেখা গেল পহৃর্ববাংলার জন্য নির্ধারিত 169টির মধ্যে 167টিই আওয়ামী লীগ পেয়েছে। ইরাকের কথাই ধর। সিআইএ'র লোকজন বার বার বলতে লাগল ইরাকে নাকি সভ্যতা ও মানব বিধ্বংসী মারণাস্ট্প রয়েছে। ইরাক আক্রমণের পর দেখা গেল কিছুই নেই। সিনেমায় দেখা যায় অপরাধীরা যতই ধূর্ত হোক, গোয়েন্দারা ঠিকই তাদের ধরে ফেলে। কিন্তু বাস্তবে জঙ্গি অপরাধীরা মরিয়া হলেও গোয়েন্দারা একেবারে ব্যর্থ। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে মাসুদ রানাও জঙ্গি সমঙ্র্কে সঠিক তথ্য দিতে কিংবা এদের ধরতে ব্যর্থ হবে।
ঠিক এমন সময় এলো মাসুদ রানা। সবাই তাকে স্বাগত জানাল। মিসির আলীর কথা লাবণ্যর পছন্দ হয়নি। সে একটা ধাঁধাঁ ছুড়ে দিল এভাবে_আমার চার চারটা ছেলে। ইস আমার যদি একটা মেয়ে থাকত!
হিমু বলল_নেই তো কী হয়েছে? চেষ্টা চালিয়ে যান। একবার না পারলে দেখুন শতবার।
অমিত বলল_আমি কিছুদিন দক্ষিণ আফ্রিকায় ছিলাম। ওখানকার হারবাল ও ভেষজ চিকিৎসার খুব নাম আছে। যোগাযোগ করে দেখতে পারেন।
সুরঞ্জনা বলল_ভালো ডাক্তার দেখান।
নীরা বলল_যোগ ব্যায়ামটাও ভালো ফল দেয়। যোগাসন, একান্ন মনে প্রার্থনার পর স্বামীর সঙ্গে ঘুমান। ফল পেয়েও যেতে পারেন।
সবশেষে মুখ খুলল মাসুদ রানা। সবাইকে সে অবাক করে দিয়ে বলল_লাবণ্য, তুমি আমার কাছে এসেই দেখ না আমি তোমার সেই বিশেষ ইচ্ছার ব্যাপারে কোনো কাজে লাগি কী না!
চশমাটা খুলে নিজের জামা দিয়ে পরম যত্নেমুছতে লাগলেন মিসির আলী। মাসুদ রানাকে নিয়ে তার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে। এরা মেয়েদের ব্যাপারে যতটা আগ্রহী, জঙ্গিদের ব্যাপারে ততটা নয়। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। সেই সঙ্গে হিমুও। তারা হাঁটা শুরু করলেন। জঙ্গিরা আত্দ্মঘাতী বোমা মেরে সব সম্ভাবনা নষ্ট করে দিচ্ছে। এই আত্দ্মঘাতী বোমার ব্যাপারটাও কিন্তু হওয়া উচিত ওয়ানওয়ে। এদের ধরা, নির্মূল করার ব্যাপারটাও ওয়ানওয়ে। এদের এখনই ধরতে হবে, একেবারেই নির্মূল করতে হবে। মিসির আলী জানেন না, জঙ্গিদের পাকড়াও এবং নির্মূল করতে ওয়ান ওয়ে ট্রিটমেন্ট দিতে পারে এমন একজন মাসুদ রানা তিনি কোথায় পাবেন?
বাংলাদেশটা এখন মিসির আলীর মতো!
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০