কোন কোন সংজ্ঞা ও তার প্রয়োগ সবসময়েই প্রত্যাশিত ফলাফল বহন করে না। অনেক সময় ভাল ভাল থিওরী তার প্রয়োগ স্থান ও সময়োপযোগী না হওয়ায় বাস্তবায়িত হতে পারে না। উদাহরণ- সমাজতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা। সম্পদের সুষম বন্টনের মাধ্যমে ধনী, দরিদ্রের পার্থক্য ঘোচানোর স্বপ্নে এর চেয়ে ভাল উদাহরণ হতে পারে না। কিন্তু প্রয়োগে তা হয় নি। রাজনৈতিক ক্ষমতাধরেরা বিলাস ব্যাসনে মত্ত হয়েছে, বাইরে সুষম বন্টনের নামে ধাপ্পাবাজী। রাষ্ট্রমালিকানায় যাওয়া কলকারখানা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো প্রশাসনিক কারনে হারিয়েছে তাদের গুনাগুন আর উৎপাদন ক্ষমতা ও পরিনামে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় পরাজয় । কেন এমন হয়েছে ? কেন এমনি সমাজতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা সারা বিশ্বে এখন মৃত ? আমার মতে ্থমানব চরিত্র্থ কে এর সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে দেখা যেতে পারে। সৃষ্টির সেবা জীব হিসেবে বিবেচিত হলেও লোভ, হিংসা, প্রতিশোধপরায়নতা সহ বিভিন্ন দোষ মানুষের মাঝে সৃষ্টির আদি থেকে শুরু করে আজ অবধি পুরোপুরি বিদ্যমান। সমাজতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা মানবকল্যানের বড় পথ হলেও মানবচরিত্রের এ সব দিকগুলোর সথে পেরে উঠতে পারেনি। পরিনামে ভরাডুবি।
মানব চরিতের এসব দিকগুলো বাদ দিয়ে মানুষকে কল্পনা করা যায়না। সে জন্যেই যুগে যুগে মনিষীরা এসেছেন, কোন কোন ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধর্মের, কোন কোন ক্ষেত্রে মানব কল্যানের বানী নিয়ে। মানব চরিতের এসব নেতিবাচক দিকগুলো যদি না থাকতো, তাহলে এসবের কোন দরকার পড়তো না। আসলে মানবতা বলতে আমরা যা বুঝি, মানুষের প্রতি মানুষের দ্বায়িত্ব, ভালোবাসা এবং এসব গুনাবলীকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যেই বিভিন্ন ধর্মের অবতারনা ঘটেছে। প্রতিটি ধর্মের লক্ষ এক হলেও পথ আলাদা। কোন কোন ধর্ম একেশ্বরবাদী, কোন কোন ধর্ম অনেক ঈশ্বর, কোন কোন ধর্ম প্রকৃতির মাঝেই ঈশ্বরকে খোঁজে, কোন কোন ধর্ম ঈশ্বরের অস্তিত্বেই বিশ্বাসী নয়। এ বিশ্বাসগুলো নিয়ে এদের মাঝে দন্ধ তো রয়েছেই, তার পাশাপাশি আসে সামাজিক, বাষ্ট্রনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগীতা। এই দন্ধের মাঝে প্রান হাবিয়েছে ও হারাচ্ছে লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ মানুষ, ধ্বংস হয়েছে সে মানুয়েরই গড়া শহর, বন্দর ও স্থাপত্যশিল্পের মুল্যবান নিদর্শন। যারা সচেতন, তারা নিজ ধর্মের ভেতরে আবদ্ধ না থেকে অনেক সময় বাইরের দৃষ্টিকোন থেকে এর কারণ খোঁজায় সচেষ্ট হয়। তাতে মুহুর্তেই আঁতকে উঠে অন্ধবিশ্বাসীরা। ধর্ম গেল, সমাজ গেল বিলাপে আকাশ পাতাল মাত করে, যে কোন ধর্মের মূলমন্ত্র যে মানবিকতা, তা চুলোয় ফেলে তাদের সংজ্ঞামতে ধর্মহীনদের বিনাশে উস্মাদ হয়ে ওঠেন।
শাওনের একটি পোষ্ট থেকে এই প্রসঙ্গের অবতারনা। শাওনের পোষ্টটি খারাপ ছিল না। সে তার নিজের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে ইসলামের ভাল দিক গুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। সেখানে আমার বক্তব্য ছিল, রাষ্ট্রচালনায় ধর্মকে না জড়ানোর স্বপ। তাতে যে সমালোচনা এসেছে, তার উত্তরেই আমার এই পোষ্ট।
হোষ্টেলে থেকে পড়াশোনা করেছি। ডাইনিংএ দুটো পাশাপাশি ঘর। একটি বড়, আরেককটি ছোট। বড়টায় মুসলমানরা আর ছোটটায় খাওয়াদাওয়া করে হিন্দুরা। আলাদা খাওয়াদাওয়া হলেও সবার মাঝেই ভাল সম্পর্ক। একদিন সন্ধ্যায় খাওয়া পর্ব চলছে। হঠাৎ একজন এসে আরেকজনের কানে কি এসে বলল। থালা বাসন ছুড়ে ফেলে ছুটল প্রায় সবাই পাশের ডাইনিং রুমে। হিন্দু ছাত্রদের এলোপাথাড়ি পিটিয়ে রক্তারক্তি কান্ড ঘটালো। আমার যারা বাঁধা দিতে গেলাম, দলে ভারী ছিলাম না, নিজেরাও মার খেলাম তাই। কারণ হলো, হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা বেধেছে ভারতে, স্বাভাবিকভাবেই মুসলিমরা সেখানে বেশী মার খেয়েছে, পরিনামে আমাদের হোষ্টেলে এই অবস্থা। ধর্মের প্রভাব এতো বেশী কেন হবে যে, মানুষ মুহুর্তেই পশু হয়ে যাবে ? উত্তরে অনেকেই বলবেন, ধর্মে এভাবে অন্যধর্মালম্বীদের মারার কোন সমর্থন নেই। ঠিক ! কোন ধর্মেই এর প্রতি সমর্থন পাওয়া যাবে না। হ্যা, থিওরি সঠিক, কিন্তু প্রয়োগে ঘটছে অন্যরকম। আজ থেকে নয়, হাজার হাজার বছর ধরে। এত বছর ধরে কি করলেন বিভিন্ন ধর্মের মহামনিষী, রথি মহারথীরা ? তখনই প্রশ্ন ওঠে ধর্মের প্রভাব নিয়ে। তখনই মাপার প্রশ্ন আসে কতোটা প্রভাব হিতকর, কতোটা মঙ্গলজনক। ব্যাস! লাগলো আগুন আবার। ধর্ম গেলো, ধর্ম গেলো বলে হাহুতাস আর উগ্রতার নর্তনকুন্দন।
দেশের সেনাবাহিনীর ট্রেনিং সেন্টারে প্রতিটি মুসলিম ক্যডেটের জন্যে জুম্মার নামাজ বাধ্যতামূলক। অমুসলিমদের জন্যে আলাদা কোন উপাসনাঘর নেই। কিন্তু জুম্মার দিনে মুসলিমরা বাধ্যতামূলক নামাজ পড়বে, আর অমুসলিমরা সে সময়টুকু কিছু করবে না, এ বৈষম্য তো চলতে দেয়া যেতে পারে না। সুতরাং উর্বর মস্তিস্কের সমাধান হলো এই যে, নামাজের সময় অমুসলিমদের মসজিদের চত্তরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। আমার কাছে এটা অমানবিক এবং অন্য সত্বা ও ধর্মালম্বীকে অপমান ছাড়া আর কিছুই নয়। এখানে রাষ্ট্র ও এক রাষ্ট্রীয় সংস্থা ধর্মের প্রভাবে ছোট করছে অন্য ধর্মের মানুষকে। অন্যথায় ধর্ম পালন যার যার নিজস্ব বিষয় হতো ও অন্যকে অপমান করা হতো না।
একজনের তাধৈ তাধৈ নর্তন দেখলাম শাওনের পোষ্টের পরিপ্রেক্ষিত। আমাদের দেশের হিন্দুরাও মুসলমানদেরও অপমান করার সাহস রাখে দেখে ওনি পরিতৃপ্তির ঢেকুড় তুলছেন। বলছেন, কতো মহান আমাদের এই ধর্মীয় সমাজ। হাস্যকর ও নোংরা এই ঢেকুড়ের দুর্গন্ধ এই ইন্টারনেট সংযোগ বেয়ে এখানে বসেই পাচ্ছি। বড় বড় লেখা লিখে থাকেন এই ব্লগার, চাওয়া তার এতো ছোট কেন? আমার চাওয়া অনেক বড়। আমার চাওয়া, আমাদের দেশে বা অন্যকোন দেশে, কোথাও এক ধর্মাবলম্বী অন্য কোন ধর্মাবলম্বীকে যেকোন ধরণের অপমান করার সুযোগ ও সাহস যাতে না পায়, সে সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘু যাই হোক না কেন। আরেকজন ব্লগার চাইছেন ইসলাম ধর্মের সমাজব্যবস্থা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে। এক ধরনের ধর্মীয় আগ্রাসন যে তার খায়েস, প্রাতিটি ছত্রেই তার প্রকাশ। অথচ অন্য ধর্মলিম্বীদের দেশে বাস করে, তাদের সামাজিক ও উদার ধর্মীয় সমাজের সুবিধাদি ভোগ করে লন্ডন সিডনী করে বেড়াতে তার সামন্যতমও দ্ধিধা হয়না।
এমন কোন উদাহরণ খুজে পাওয়া দুষ্কর, যেখানে ধর্মভিত্তিক সমাজ ব্যাবস্থা সাধারণ মানুষের জীবনে ইতিবাচক কোন প্রভাব রাখতে পেরেছে। সৌদী আরব কথা বলতে চান ? সৌদী শেখরা নিজেদের দেশের বাইরে এসে টাকার গরমে বেলেল্লাপনায় সবার উপরে। নিজেদের দেশে এরা অমানবিকতার প্রশ্নে অদ্বিতীয়। সারা বিশ্বে যেখানে শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যত গড়ায় অলোচনা চলে, সৌদী শেখরা তখন দেশের বাইরের শিশু পাচারকারীদের সাথে ষড়যন্ত্রে ব্যাস্ত। তাদের উট দৌড়ের জন্যে তখন জকির প্রয়োজন। আরবীয় দেশগুলোর পুরুষরা ইউরোপে এসে সবচ্থ বড় লম্পট হিসেবে পরিচিত হয়।
জার্মানীতে প্রতিটি স্কুলের ক্লাশে খ্রীষ্টান ধর্মের নিদর্শন হিসেবে ক্রশ টানানো হতো। একসময় প্রতিবাদ আসে অন্যধর্মীয় ছাত্রছাত্রীদের বাবা-মার কাছ থেকে। তাদের বক্তব্য বিদ্যায়তন ধর্মনিরেপেক্ষ হওয়া দরকার। পার্লামেন্টে আলোচনার পর প্রতিটি স্কুল থেকে সে ক্রশ সরিয়ে নেয়া হয়। শুধুমাত্র একটি প্রদেশ বাদে, বাভারিয়া। বাভারিয়া পাড় দক্ষিনপন্থী প্রদেশ হিসেবে জার্মানীতেই চিহ্নিত। জার্মানীতে জার্মান বাবা-মারা তাদের শিশুদের স্কুলে দেবার আগে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, ছেলেমেদের ধর্মশিক্ষা দেবেন কি না। যারা না চান, তাদের জন্যে এথিক রয়েছে। সেজন্যে কি এখানকার সমাজ আমাদের সমাজের চেয়ে খারাপ ? এখানকার সমাজের সততা, কর্মনিষ্ঠা এই স্বাধীন শিক্ষাকে ভিত্তি করেই গঠিত হয়েছে। কেউ কেউ তুলবেন এখানকার তথাকথিত বেলেল্লাপনার কথা। আমার প্রশ্ন, কোনটি ভাল, পথ চলার প্রতিটি পদে সন্ত্রাস - নাকি সামাজিক নিশ্চয়তা ? কোনটি ভাল, বোরখা পড়েও সন্মান ও শ্লীলহানির ভয় - নাকি যে কোন পোষাক পড়েও সন্মান বজায় রাখার শক্তশালী পদক্ষেপ ? কোনটি গ্রহনযোগ্য, ধর্মের নামে সংখ্যালঘুদের উপর নিষ্পেষন নাকি ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ ব্যাবস্থা, যেখানে ধর্মকে নিষ্পেষনের অস্ত্র হিসেবে ব্যাবহৃত হয় না। কোনটি ভাল, সাতারের পোষাকে সাঁতার কাটা, নাকি হিজাব পড়েও ধর্ষিত হওয়া ? এরকম আরো অনেক উদাহরণ রয়েছে। তখন বলবেন, ধর্ম তো এসব কুশিক্ষার বিরুদ্ধেই। আমার তাতে আপত্তি নেই । কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রে ধর্মের প্রয়োগ যে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তৈরী করছে, সে কথাটি তুললেই বলবেন, সমাজ খারাপ বলে তো ধর্ম খারাপ নয়। অর্থাৎ এবার আবার আলাদা করছেন ধর্ম ও সমাজকে। একবার বলছেন ধর্মভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যাবস্থাই সঠিক পথ, পরমুহুর্তেই আবার আলাদা করছেন তাদেরকে। একে সুবিধাবাদী দ্বৈত মানসের চিন্তা হিসেবে আখ্যা দিতে আমার সামান্যতমও দ্বিধা নেই । আমার স্বাধীনচেতা ও প্রগতিবাদী মানস এ দ্বৈতচিন্তাকে প্রতিহত করার বক্তব্যে সবসময়েই সোচ্চার থাকবে।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০