সিলেটের মাটিতে ‘পা’ রাখার সাথে সাথে মনটা চনমনিয়ে উঠলো! অবশেষে পুণ্যভূমিতে পৌঁছলাম। পাঠ্য পুস্তকে সিলেট সম্পর্কে কত কথা পড়েছি! চা বাগানের দেশ, হযরত শাহ জালাল-শাহ পরানের দেশ, সুরমা নদীর দেশ।
একটা নতুন শহর দেখা আমার কাছে একটা নতুন দ্বীপ আবিষ্কারের মত!! সবকিছুই অবাক দৃষ্টিতে দেখি। দোকানের সাইন বোর্ড, রাজপথ, অন্ধগলি, বাড়ির নকশা, ঝুল বারান্দা, টিনের বাড়ি, পানের দোকান, ঝলমলে মার্কেট, ঘর্মাক্ত রিক্সাওয়ালা, কালো সানগ্লাস পরা যুবক, ছুটন্ত মানুষ, ফ্যাশনদুরস্ত তরুণী!!
দেখি আর মনে মনে আমার চেনা গণ্ডির সাথে ‘মিল অমিল’ খুঁজি!! সবচেয়ে ভাল লাগে এক এক রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করা এবং হাঁটতে হাঁটতে হারিয়ে যাওয়া! তারপর লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে আবার আস্তানায় ফিরে আসা। প্রথম প্রথম চলে এই উত্তেজনা। ধীরে ধীরে রাস্তা-ঘাট পরিচিত হতে থাকে। মুখগুলো আপন হতে থাকে! হারিয়ে যাওয়ার উত্তেজনা আর উপভোগ করা যায় না। এক সময় মনে হয়- কত যুগ ধরে যেন চেনা এই শহর!!
প্রতিদিন মাজারের আঙ্গিনা দিয়ে অফিসে যাই। যেতে যেতে ‘মাজার জিয়ারতে’ আসা মানুষজন দেখি!! কত বিচিত্র মানুষ যে আসে!
কেহ আসে শুধু মাজার দেখতে! কেহ আসে মানত নিয়ে! কেহ কেহ ভক্তিতে গদগদ হয়ে দেয়ালে কপাল ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে।
আসে শিক্ষা সফরকারী! মাজারের আশপাশ ঘুরে-ফিরে দেখে! জালালী কবুতরের পাশে দাঁড়িয়ে পটাপট ছবি তুলে! তারপর বেরিয়ে পড়ে জাফলং বা মাধবকুণ্ডের উদ্দেশ্যে।
আসে ভক্তবৃন্দ! দূর-দূরান্ত †থকে বাস ভাড়া করে চলে আসে। বাসের ছাদে লাগানো মাইকে বাজতে থাকে ভক্তিমূলক গান। মাজারের সামনে রাস্তার দু’পাশে জমজমাট হোটেল। গভীর রাত পর্যন্ত চলে খাওয়া-দাওয়া।
সূর্য উঠার আগেই এলাকাটা জেগে উঠে। শুরু হয় লোকজনের আনা-গোনা। হোটেল বয়দের চিৎকার, চেঁচামেচি। ভিক্ষুকের কাকুতি!!
প্রতিদিন এখান দিয়ে যাই আর জীবনের স্পন্দন টের পাই!
কে যেন বলেছিল- ‘এক একজন মানুষ এক একটা পৃথিবী।’
সত্যিই তাই! মানুষের এই এক জীবনে কত ঘটনা ঘটে। মুখ দেখে যদি তা বোঝা যেত তবে এক একটা মুখ হতো এক একটা মহাকাব্য।
এত মহাকাব্যের ভীড়ে- জীবনের উষ্ণতা থাকবে সেটাই স্বাভাবিক! তবে মাঝে মাঝে হাঁটার সময় ভিক্ষুকের দল পথরোধ করে! একজনকে দিলে আর দশজন ছুটে আসে! কত রকম ভিক্ষুক যে আছে এখানে!!
প্রতিদিনের মতো আজও সকালবেলা এখান দিয়ে যাচ্ছি। অফিসে যাওয়ার প্রচণ্ড ব্যস্ততা। দ্রুত হাঁটছি! হঠাৎ এক খোড়া ভিক্ষুক সামনে এসে দাঁড়াল। খুব কষ্টে ধাক্কা সামলালাম!!
কাতর কন্ঠে ভিক্ষুকটি বলল, একটা টেকা দেন স্যার,
ভ্রু কুচকে বললাম, মাফ করেন। ওকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত চলে এলাম!!
দুপুর বেলা! লাঞ্চ আওয়ারে রুমে ফিরছি। মাজার প্রাঙ্গনে এসে সেই ভিক্ষুকটিকে চোখে পড়ল। ময়লা কাপড় পড়া এক মহিলা পরম যত্ন করে ‘ভাত-দলা’ করে ওকে খাইয়ে দিচ্ছে। এক লোকমা শেষ হলে আরেক লোকমা তুলে দিচ্ছে।
বুকটা ধক করে উঠলো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটি দেখলাম! ভিক্ষুকটিও আমাকে দেখতে পেল। এগিয়ে গিয়ে মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম,
কি হয় আপনার?
স্বামী।
আপনিও কি ভিক্ষা করেন?
মহিলা বিরক্তমুখে বলল, না! বাড়িতে কাম করি।
আর কিছু জানতে ইচ্ছা করলো না! হাঁটতে শুরু করলাম! মাথায় সূক্ষ্ম একধরনের যন্ত্রণা হচ্ছে।
জীবনে আমি অনেক রোমান্টিক দৃশ্য দেখেছি, ভালোবাসার দৃশ্য দেখেছি। বিশ্ববিদ্যালয়, পার্কে, বোটানিক্যাল গার্ডেনে কিংবা ধানমণ্ডির লেকে- প্রেমিক-প্রেমিকারা ঘনিষ্টভাবে বসে আছে! হয়তো একজন আরেকজনকে খাইয়ে দিচ্ছে।
কিন্তু সেদিন যে দৃশ্য দেখেছিলাম- তা ছিল- একজন স্ত্রী যে তার পঙ্গু ভিখারী স্বামীকে পরম মমতায় ভাত খাইয়ে দিচ্ছে। সভ্য সমাজ থেকে যার ভালোবাসা পাওয়ার বিন্দু মাত্র ক্ষমতা নাই!
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৩:৩৩