প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার আপনজনকে হারিয়েছিল। কেউ কেউ আবার বলে মহিলাটি একজন নেটিভ আমেরিকান, কেনিয়নে ঘুরতে বেরিয়ে অক্কা পেয়েছিল। যুগে যুগে গ্র্যান্ড কেনিয়নকে ঘিরে এরকম অজস্য কিংবদন্তি এবং ভৌতিক কাহিনী গড়ে উঠেছে। আমেরিকার এরিজোনাতে অবস্থিত গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর একটি বিখ্যাত প্রাকৃতিক নিদর্শন, যার গভীরে বয়ে চলেছে কলোরাডো রিভার। কয়েক মিলিয়ন বছরে ধীরে ধীরে এই কেনিয়ন গড়ে উঠেছে।
এরিজোনাতে আসার পরই আমার প্রথম স্বপ্ন ছিল এই গ্র্যান্ড কেনিয়ন নিজের চোখে ঘুরে দেখব। গত সপ্তাহের শনিবারে বেরিয়ে পরলাম গ্র্যান্ড কেনিয়নের উদ্দেশ্য, আমি যেই শহরে থাকি সেখান থেকে এর দুরুত্ব প্রায় ৩০০ মাইল(৪৮২ কিমি) এর মত, তাই সিদ্ধান্ত নিলাম ড্রাইভ করেই যাব। প্ল্যান অনুসারে প্রথম দিন ঘুরব এরিজোনার আরেক বিখ্যাত লাল পাহাড়ের শহর সেডোনা, এবং সেখানে ঘুরে রাতে একটি হোটেলে থেকে সকালে আবার সেখান থেকে যাব গ্র্যান্ড কেনিয়নে।
সেডোনার পথে, অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য।
লাল পাহাড়!!
প্রচণ্ড গরম পরেছে কিছুদিন যাবত। বাসা থেকে যখন বের হলাম তখন ঘড়িতে বাজে ৯টার মত। আমি ভোজন রসিক মানুষ, তাই বাসা থেকে বেশী করে বিরয়ানী রান্না করে নিয়ে নিলাম, যাতে যাত্রা পথে ক্ষুধা লাগলে পেটের ভিতর দানার-দান খানা খাদ্য চালান করতে পারি। বছরের এই সময়টা এমনিতেই বেশ গরম পরে বিশেষ করে আমি যেই শহরে থাকি সেখানে ভয়াবহ গরম পরে, গরমে মানুষ ওহ-আহ করে অবস্থা। তবে আজ যাবার পথে বেশ টিপ টিপ বৃষ্টি পরছিল। যতই সেডোনার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম ততই চারপাশের দৃশ্য দেখে বিমোহিত হচ্ছিলাম। আমাদের গাড়ি বয়ে চলছে বন জঙ্গল বেদ করে, চারদিকে লাল পাহাড় আর আকা বাঁকা রাস্তা দেখে মনে হয় যেন এই প্রকৃতিতে হারিয়ে যাই।
যাইহোক আমরা দুপুরের দিকে সেডোনা পৌঁছলাম, এবং সাঁরা দিন বেশ কিছু টুরিস্ট স্পট ঘুরে দেখলাম। সেডোনা সত্যিই সুন্দর, প্রকৃতির এক আশ্চর্য নিদর্শন, তবে এই লেখায় সেডোনা নিয়ে কিছু লেখব না। আমি গোস্যা করেছি তাই লেখছিনা ব্যাপারটা এমন না, এই লেখায় সেডোনা সমন্ধে লেখতে গেলে লেখার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ অনেক বেড়ে যাবে। যাইহোক সেডোনা সমন্ধে অন্য আরেক দিন না হয় লেখা যাবে। (সেডোনার বিখ্যাত স্লাইড স্টেট পার্কের একটি ভিডিও করেছিলাম, আমাদের সেডোনার ফেইসবুক ভিডিও লিংক!) সারাদিন সেডোনা ঘুরে, রাতে একটি হোটেল নিলাম হাতির সমান একশত ডলার দিয়ে রাতে থাকার জন্য। রাতে হোটেলে গিয়ে ওভেনে সাথে থাকা বিরয়ানী গরম করে খেয়ে নিলাম, সারাদিন অনেক ধকল গিয়েছে, চোখ বুঝতেই নিদ্রায় ডুবে গেলাম।
গ্র্যান্ড কেনিয়নের পথে, রাস্তার দু-ধারে তুষার।
সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করলাম হোটেলে, তারপর ৯ টার দিকে রওনা দিলাম আমাদের গন্তব্য গ্র্যান্ড কেনিয়নের উদ্দেশ্যে। আমাদের হোটেল থেকে কেনিয়নের দুরুত্ব একশ মাইলের একটু বেশী। এরিজোনা সাধারণত গরম, তবে কেনিয়ন উত্তরে পরেছে বিদায় এখানকার তাপমাত্রা অনেক কম। আমরা রাস্তা দিয়ে যাবার পথে দেখলাম রাস্তার দু-পাশে তুষার পরেছে অনেক। এরিজোনা আসার পর এরকম তুষার চোখে পরেনি কখনো, এরিজোনাতে রাস্তায় ধারে তুষার পরতে পারে কল্পনাও করিনি। আমাদের গাড়ি ছুটে চলছে, মাঝে মাঝে এমন জায়গা দিয়ে যাচ্ছিলাম যেখানে আশে-পাশে মাইলের পর মাইল কোন বাড়িঘর নেই, শুধু ধূ-ধূ করছে!
আমরা সকাল সাড়ে দশটার দিকে পৌঁছে গেলাম গ্র্যান্ড কেনিয়নে। এখন গ্র্যান্ড কেনিয়ন কিভাবে নাযিল হল এটা নিয়ে কিছু বলা যাক, একটি শক্তিশালী ধারনা অনুসারে দুজন শক্তিশালী দেবতা টোচোপা (Tochopa) এবং হোকোটামা (Hokotama) এই গ্র্যান্ড কেনিয়ন সৃষ্টি করেছিলেন। এই অংশটুকু পড়ে পাঠক ধাক্কা খেতে পারেন, কিভাবে ব্যাপারটি আমি খুলে বলছি। নেটিভ আমেরিকান হাবাসুপাই (Havasupai tribe) জনগোষ্ঠীর কিংবদন্তি অনুসারে পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ নেবার জন্য দুই দেবতা টোচোপা এবং হোকোটামা গ্র্যান্ড কেনিয়ন নামের এই স্থানে ধুম মাচিয়েছিলেন। হোকোটামা ছিল রগচটা, সারা পৃথিবী তিনি বন্যায় প্লাবিত করেন, এই প্রবল বন্যার জলধারার জন্যই গ্র্যান্ড কেনিয়নের সৃষ্টি হয়। আরেকটি পুরাতন নেটিভ আমেরিকান জনগোষ্ঠী হোপির (Hopi tribe) মিথ অনুসারে দুই দেবতা পোকাংহোয়া (Pokanghoya) এবং পোলোংহোয়া (Polongahoya) এই গ্র্যান্ড কেনিয়নের সৃষ্টি করেন। তারা দুজনেই ছিলেন ভাই, তাদের দায়িত্ব ছিল এই পৃথিবী সৃষ্টির। তারা তাদের বিধ্বংসী লেজার শক্তি ব্যাবহার করে কলোরাডো নদী এবং পাথর কেটে এই গ্র্যান্ড কেনিয়নের সৃষ্টি করেন।
এখানেই শেষ নয়, আরেক নেটিভ আমেরিকান কিংবদন্তি অনুসারে, সূর্য দেবতা টোশানোয়াই (Tsohanoai) এবং পৃথিবী দেবী কোকিয়ানগুটি (Kokyangwuti) একজন আরেকজনের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন, যাকে বলে ইশকে দিওয়ানা, তাদের এই প্রেম-প্রীতির নিদর্শন সরূপ এই কেনিয়নের সৃষ্টি হয়। বলা হয়ে থাকে সূর্য দেবতা টোশানোয়াই তার প্রেমিকা পৃথিবী দেবী কোকিয়ানগুটিকে উপহার দেবার জন্য এই কেনিয়নের সৃষ্টি করেন। অনেকটা আমাদের উপ-মহাদেশের শাহজাহান-মমতাজের প্রেমকাহিনীর মত। পুরাতন বিশ্বাস অনুসারে এই কেনিয়ন থেকে কোন বস্তু যেমন পাথর, গাছ ইত্যাদি বাসায় নিয়ে গেলে অ-মঙ্গল হয়, তাই সাধু সাবধান! গ্র্যান্ড কেনিয়নকে ঘিরে তৈরি হওয়া কিংবদন্তিগুলো প্রমাণ করে এই নৈসর্গিক কেনিয়নের প্রতি মানুষের ভালবাসা, আগ্রহ এবং মানুষের অপার কল্পনাশক্তি। পুরাতন বস্তু, কাঠামো এবং কিংবদন্তি সম্বলিত জায়গা আমাকে বরাবরই টানে, আর তাই এই গ্র্যান্ড কেনিয়নের কাছে আসতে পেরে আমি পুলকিত, শিহরিত এবং ভীষণ রোমাঞ্চিত বোধ করছি।
গ্র্যান্ড কেনিয়নের আমরা সারাদিনের টিকিট কিনলাম পঁয়ত্রিশ ডলার দিয়ে, অনেকে কয়েকদিনের টিকিটও কিনছে, রাতে তাঁবু গেড়ে থাকার জন্য। গ্র্যান্ড কেনিয়নে বেশ কিছু পয়েন্ট আছে, সেখান থেকে এই কেনিয়ন উপভোগ করা যায়, যেমন সাউথ রিম, ওয়েস্ট রিম, এবং নর্থ রিম। আমরা গেলাম সব থেকে জনপ্রিয় সাউথ রিমে। এই ধরনের টুরিস্ট স্পটে সাধারণ পার্কিং পাওয়া কঠিন, আমার অভিজ্ঞতা অন্তত তাই বলে। তবে এবার আমার ভাগ্য সহায়ই বলতে হয়, যাকে খাশ বাংলায় বলে কপাল ফকফকা! পার্কিং পেলাম একেবারে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের পাশেই।
গ্র্যান্ড কেনিয়নের কিছু দৃশ্য।
প্রচুর মানুষ এসেছে প্রকৃতির এই বিস্ময় দেখতে। আমি তাকিয়ে আছি মুগ্ধ হয়ে, স্বচক্ষে না দেখলে বুঝতাম না প্রকৃতি এতটা সুন্দর হতে পারে। সকালের নরম রোধ, হালকা বাতাস আর চোখ ধাঁধানো কেনিয়ন, সব কিছু মিলে যেন একেবারে জমে ক্ষীর। আমরা উপর দিয়ে হেটে হেটে দেখতে লাগলাম এই কেনিয়ন, আর থেমে থেমে ভিডিও আর ছবি তুললাম (আমাদের গ্র্যান্ড কেনিয়নের ফেইসবুক ভিডিও লিংক)। এই কেনিয়নের নীচ দিয়ে বয়ে গেছে কলোরাডো নদী, তবে উপর থেকে দেখা যায় না। অনেক পর্যটক গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচ বেয়ে হেটে যায়, একেবারে নিচের কয়েকটি হোটেল আছে, ইচ্ছে করলে থাকা যায় সেখানে, তবে মালপানি আলাদা দিতে হয়। আবার অনেকে তাঁবু গেড়েও থাকতে পারে চাইলে। আমি কয়েকজন আমেরিকানের সাথে কথা বললাম, ওরা জানালো কলোরাডো নদী দেখতে চাইলে নীচে হেটে যেতে হবে, আঁকাবাঁকা রাস্তা বেয়ে ২০ মাইলের মত হাটতে হবে সেই নদী স্বচক্ষে দেখতে চাইলে। সেই ক্ষেত্রে যেতেই লাগবে ৭-৮ ঘণ্টা, আর ফিরে আসতে-তো সময় লাগবেই। তবে যেহেতু আমি পরিবার নিয়ে এসেছি, তাই উপর থেকেই উপভোগ করলাম।
সারাদিন ঘুরে, বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে রওনা দিলাম বাসার উদ্দেশ্য, সেখান থেকে মোবাইলে দেখাচ্ছে মোট ৬-৭ ঘণ্টা ড্রাইভ করতে হবে। যখন আসছিলাম, মাইলের পর মাইল শুধু গাছ-পালা, এবং উঁচুনিচু পাহাড়, কোন লোকালয় চোখে পরছিল না সহজে, আর ওদিকে আমাদের প্রচণ্ড ক্ষুধা পেয়ে গেল একটু ড্রাইভ করার পরই। কোন এক জায়গাই গাড়ি থামিয়ে যে রেস্টুরেন্ট খুঁজব এর কোন উপায় নেই। অগত্যা ঘণ্টা দুয়েক গাড়ি চালানোর পর একটি মেগডোনাল্ডে গাড়ি থামিয়ে একটু ঝিমিয়ে নিলাম, সাথে ছেলেকে কিছু কিনে দিলাম। পাশেই একটি একটি গ্যাস স্টেশন ছিল, সেখান থেকে গ্যাস নিয়ে পুনরায় রওনা দিয়ে সন্ধ্যার দিকে এরিজোনার আরেক বিখ্যাত শহর ফিনিক্সে পৌঁছলাম। সেখানে একটি থাই রেস্টুরেন্টে ভোজন কর্ম সম্পাদন করে রাত ১১-টার দিকে বাসায় পৌঁছলাম।
এই টুরের ইউটিউব ভিডিও লিংক।
আমার ভ্রমণ পোষ্ট-সমূহঃ
আমার থাই এবং লাউস ভ্রমনের গল্প
ঘুরে এলাম আমেরিকার সানফ্রানসিসকো
আমেরিকার আলাবামা থেকে ওয়াশিংটন রোড ট্রিপ
অরিগনের সর্বোচ্চ পর্বত মাউন্ট-হুড
সিলভার ফলস পার্ক যেন আমেরিকার বুকে এক টুকরো স্বর্গ
আমেরিকার গ্রামে বেরী-পিকআপে একদিন
আমেরিকার ৯০০০ ফুট উচু পাহাড় মাউন্ট লেমনে একদিন
ঘুরে এলাম আমেরিকার ইন্ডিয়ানা থেকে
অরিগণ থেকে এরিজোনায় রোড ট্রিপঃ
আমেরিকার অরিগণ থেকে এরিজোনায় রোড ট্রিপ (পর্ব পাচ এবং শেষ): পৌছে গেলাম মরুভূমি রাজ্য এরিজোনাতে
আমেরিকার অরিগণ থেকে এরিজোনায় রোড ট্রিপ (পর্ব চার): লস-এঞ্জেলেসে একদিন
আমেরিকার অরিগণ থেকে এরিজোনায় রোড ট্রিপ (পর্ব তিন): পৌছে গেলাম ক্যালিফোর্নিয়ার সান-ফ্রানসিসকো
আমেরিকার অরিগণ থেকে এরিজোনায় রোড ট্রিপ (পর্ব দুই): যাত্রা শুরুর দিন
আমেরিকার অরিগণ থেকে এরিজোনায় রোড ট্রিপ (পর্ব এক): ভ্রমনের ইতিকথা