somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমেরিকার অরিগণ থেকে এরিজোনায় রোড ট্রিপ (পর্ব দুই): যাত্রা শুরুর দিন

২২ শে মে, ২০২৩ ভোর ৫:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


রাত বেশী না বড়-জোর সাড়ে নটার মত হবে, ঘুটঘুটে অন্ধকার এবং আলোর স্বল্পতায় মনে হচ্ছে রাত অনেক গভীর। চারদিকে পাহাড় বেষ্টিত একটি রেস্ট এরিয়াতে গাড়ির ভিতর ঘুমিয়েছি। গাড়িতে তিল ধরার জায়গা নেই, এক বছরের একটি সংসার গাড়ীতে ভরেছি যে, আমি ড্রাইভিং সীটে কোনোমত স্লিপিং ব্যাগে নিজেকে পুরে বাম দিকে মাথা কাত করে ঘুমিয়েছি। আমার স্ত্রী এবং ছেলে আমার সঙ্গে নেই তারা প্লেনে করে এরিজোনাতে যাবে পরে। হঠাৎ পিট পিট শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল, আমি স্লিপিং ব্যাগের জিপার খুলের গলাটা বের করে বাহিরে তাকালাম। আমার গাড়িটি একটি গাছের নীচে পার্ক করা, আশে পাশে দুই তিনটি গাড়ি, সামনের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় সুউচ্চ পাহাড়, আশে পাশে প্রায় একশত কিলোমিটারের মধ্যে বোধ হয় কোন আদম বসতি নেই। শব্দের উৎস খুঁজতে চোখ গেল বামে পার্কিং করা একটি RV (recreational vehicle) গাড়ির দিকে, সেই গাড়িতে একটি ছোট লাইট জ্বলছিল এবং কিছুক্ষণ পরপর পিট পিট শব্দ করছিল।

ভ্রমণ সব সময়ই আমার ভাল লাগে তবে আমার কাছে এই ভ্রমণটা শুধু একটি ভ্রমণ নয় বরং তার চেয়েও বেশী কিছু। একটি জামা অনেকদিন ধরে পরলে সেটার প্রতি একটি মায়া জমে যায়। পোর্টল্যান্ড শহরটাতে বছর-খানেক ছিলাম, পুরনো কর্মস্থল, পরিচিত-জন, ছেলের প্রাইমেরী স্কুল, বাসার সামনের গাছপালা ঘেরা পার্কটা ছেড়ে এলাম, জানিনা আবার কখন আসব এ-শহরে, এলেও হয়ত অতিথির মত এসে চলে যাব! যদিও এক বছর ছিলাম এই শহরটাতে, তবে এই বছরটাতে অনেক ঘুরাঘুরি করেছি, কিছু মানুষের সাথে মিশেছি, অদ্ভুত একটি মায়া জমে গেছে। তাই এটা শুধু মাত্র ভ্রমণই না আমার কাছে, একটি শরের মায়া ছিন্ন করে অজানা, অচেনা আরেকটি শহরের দিকে যাত্রা।



রেস্ট এরিয়ার ছবি। প্রথম ছবিটা রাতের, ঘুটঘুটে অন্ধকার কিছু দেখা যাচ্ছে না, শুধু সামনে একটি ল্যাম্পপোষ্টে আলো জ্বলছিল। ২য় ছবিটা পরের দিন সকালে নিয়েছিলাম, নীল রং এর গাড়িটি আমার।

রাতে মানুষের মন অনেকটা তরল থাকে, তার উপর কোলাহল মুক্ত এই নীরব রেস্ট এরিয়া, সামনে দু-তিনটা ল্যাম্পপোস্ট ছাড়া আর কিছু নেই, যেদিকে চোখ যায় নির্জন পাহাড় আর বৃষ্টির শব্দ হচ্ছে, সব মিলিয়ে জমে যেন একেবারে ক্ষীর! স্লিপিং ব্যাগ থেকে মাথা বের করে সামনের দিকে তাকিয়ে আছি, সামনে যেই পাহাড়টা দেখা যাচ্ছে তার ওপারেও নিশ্চয়ই পাহাড়, আমার জাগতিক কোন চিন্তা নেই, সকালে ঘুম থেকে উঠে ছেলেকে স্কুলে দিয়ে অফিসে যাবার তাড়া নেই, বাসায় কোন টুকটাক কাজ নেই, নেই কাজের কোন প্রেশার, কোন ডেডলাইন নেই, আছে শুধু ফেলা আশা একটি শহরে নস্টালজিক অনুভূতি এবং নতুন আরেকটি শহরের যাবার উত্তেজনা। আজ স্মৃতির ক্যানভাসে অনেককিছুই ভেসে বেড়াচ্ছে, আমি পুরনো স্মৃতিগুলো সব সময় প্রশ্রয় দেই না, তবে এখনকার এই পরিবেশ, অমাবস্যার কালো রাত, পাহার বেষ্টিত পরিবেশে নিজের পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করতে ইচ্ছে করছে খুব। আমি জানি ভ্রমণ কাহিনীর নিদিষ্ট একটি ফরম্যাট থাকে হয়ত, যেমন বিখ্যাত কোন জায়গায় গেলে জায়গার গুনগান গাইতে হয়, জায়গাটার ইতিহাস বা পাতিহাঁস কি জানাতে হয়, জায়টাই কেন বিখ্যাত ইত্যাদি সব বলতে হয় তবে আজকে আমার সেই ফরমেট ফলো করতে মন চাইছে না। পোর্টল্যান্ড শহরে কিছু মানুষের সাথে সখ্যতা হয়েছিল, মানুষজনকে বিদায় জানিয়েছি আজ। বিদায় সবসময় কষ্টের, বিচিত্র এক জীবন আমার, যখনই এক জায়গায় কিছুটা মায়া জমে যায় ঠিক তখনই অন্যত্র যাবার ডাক আসে।

গত বছরের মে মাসে অরিগনে এসেছিলাম আমেরিকার দক্ষিণ পূর্বের একটি স্টেইট অ্যালাব্যামা থেকে। আমি প্রথম আমেরিকায় এসেছিলাম অ্যালাব্যামার টাস্কালুসা শহরে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, সেই হিসেবে টাস্কালুসা আমার আমেরিকায় গ্রামের বাড়ি বলা যায়। সেখানে অনেকগুলো পরিবারের সাথে সখ্যতা ছিল, আমার ছেলের প্রথম স্কুল সেই শহরে, প্রায় শুক্রবারে কোন বন বা পার্কে চলে যেতাম, পিকনিক করতাম কয়েকটি পরিবার মিলে। গাছের শুকনো ঢাল দিয়ে এক সাথে রান্না করে চলত আমাদের খাওয়া দাওয়া এবং আড্ডা। তাই সেই শহরটাকে বিদায় দেয়াটাও কষ্টের ছিল আমাদের জন্য।

আমেরিকায় আসার আগে পড়াশুনার কারণে ডেনমার্কে ছিলাম প্রায় চার বছর, আমার সাথে শুরুতে যারা ছিল তারা প্রত্যেকেই আমার আগেই চলে গিয়েছিল পড়াশুনা শেষ করে। আমার সাথে আমার এক পাকিস্তানি ল্যাব-মেট ওমরের খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল, ওর বাসায় প্রায় আমাদের দাওয়াত দিত, আমিও ওকে আমার বাসায় বলতাম। ল্যাবে কাজের ফাকে ফাকে ওমরের সাথে বিভিন্ন বিষয়ের আড্ডা হত। ওমরের বাসা একদিকে আর আমার বাসা আরেক দিকে ছিল, ওমরের গাড়ী ছিল, অফিস শেষে ওমর আমার জন্য প্রায় বসে থাকত আমাকে বাসায় ড্রপ করবে বলে, যদিও আমি ওকে বলতাম আমি নিজেই যেতে পারব তুমি চলে যাও। আমি যাবার বেশ আগে থেকেই দেখতাম ওমরের মন খারাপ, একদিন শুকনো মুখে বলল তুমি চলে গেলে তোমার এই ডেক্সটার দিকে তাকালে খারাপ লাগবে, ডেক্সটা থাকবে অথচ তুমি থাকবে না। আমি ডেনমার্ক থেকে চলে যাবার আগে আমার বিদায় উপলক্ষে ওমর ওর বাসায় আমাকে এবং আরও কয়েকজন বাঙ্গালীকে দাওয়াত দিল, এবং পরদিন খুব সকালে আমার বাসায় এসে ওর গাড়ি দিয়ে আমাদের এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিল।


যাবার পথের দৃশ্য।

তারও কয়েক বছর আগে আমি কোরিয়াতে ছিলাম পড়াশুনার জন্য, সেই আন্ডার গ্রাজুয়েট থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত কোরিয়াতে। সেই হিসেবে লম্বা সময় ছিলাম কোরিয়ার গোয়াংজু শহরে। সেখানে আমরা বাঙ্গালীরা এক সাথে ক্রিকেট এবং ফুটবল খেলতাম, এক বাসায় থাকতাম কয়েকজন মিলে। বাঙ্গালী কমিউনিটি আমাকে বিদায় দিল, সেটাও অনেক কষ্টের ছিল। আসলে বিদায় কষ্টের, নস্টালজিক। দেশ থেকে বের হয়েছি সেই ২০০৮ সালে, নিজের বাসা, বন্ধুবান্ধব ছেড়ে নতুন একটি দেশে, ভেবেছিলাম ফিরে আসব শীঘ্রই তারপর আর ফেরা হয়নি আমার, ফেরা হয়না আসলে আগের মত! নিজের বাসাটা, শোবার ঘরটা আর কখনই আগের মত নিজের হয়নি কোন দিন! একটি অদ্ভুত দুরুত্ব তৈরি হল। যাইহোক, এখন বর্তমানে ফেরা যাক, রাত দশটার মত বাজে, কিছুটা ক্লান্ত লাগছে, আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঘুমাবার চেষ্টা করলাম।আজ সারাদিন অনেক ধকল গেছে, আমি ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, প্রায় চারশত মাইলের মত ড্রাইভ করে এখানে এই রেস্ট এরিয়াতে পৌঁছেছি।

আজ সারাদিন যেভাবে কেটেছিল।
আজ শুক্রবার, ৫ই মে ২০২৩, যাত্রা শুরুর দিন। সকাল ৭টা ৪৫ মিনিটের দিকে ঘুম থেকে উঠলাম। হাতে অনেক কাজ বাকি। আমি আমেরিকার উত্তর পশ্চিমে স্টেইট অরিগনের পোর্টল্যান্ডে থাকি। পূর্ব পরিকল্পনা-মত আজ সকাল সকাল রওনা দেবার প্ল্যান করলাম আমার গন্তব্য এরিজোনাতে। এরিজোনা আমেরিকার দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত, আমার সম্ভাব্য দুটি রুট ছিল, ১। অরিগনের কিছুটা পূর্ব দিকের স্টেইট নেবাদা, লাস ভেগাস হয়ে এরিজোনা। ২। আমেরিকার পশ্চিম রাজ্য ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রানসিসকো, সান-জোস, এবং লাস ভেগাস হয়ে এরিজোনা। এই দুই রুটের দুরুত্বের প্রায় একই, প্রায় ১৪০০ মাইল/২২৫৩ কিলোমিটার। অনেক ভেবে চিনতে প্রথমটা ধরেই আগাবার চিন্তা করলাম, কারণ ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রানসিসকো হয়ে গেলে অনেক কিছু ঘুরে ঘুরে দেখতে পারব।

বাসাটা বেশ কয়েকদিন ধরেই খালি করছিলাম, আসলে পোর্টল্যান্ড এসেছি গত বছরের মে মাসে, আবার এই মে মাসেই চলে যাচ্ছি। এক বছরের সংসারেও অনেক কিছু জমে গেছে, বাসার ফার্নিচার, সোফা, ডাইনিং টেবিল, মেট্রেস থেকে শুরু করে টুকটাক আরও অনেক কিছু। আমার স্ত্রীর আগে থাকতেই মন খারাপ ছিল এই জিনিষগুলো আবার ফেলে দিতে হবে ভেবে। আসলে জিনিষগুলোর প্রতিও বিশেষ মায়া জমে যায় তার উপর মালপানিও খরচ-তো হয়েছেই । এক একটি ফার্নিচারের ওজন অনেক, এগুলো ফেলার জায়গাও নাই, গত সপ্তাহে অনলাইনে একটি ফার্নিচার ফেলার কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করে ২০০ ডলার দিয়ে ভারি ফার্নিচার ফেলে দিয়েছিলাম। আর এখানে যেই দুটি ফ্যামিলির সাথে খুব ঘনিষ্ঠতা তারা সাহায্য করেছে বাকিগুলো ফেলতে। বড় অনেকগুলো কাগজের বক্স যোগাড় করে ঘরের জিনিষ পত্র ভরেছি, তার মধ্যে পাঁচটি বক্স মেইলের মাধ্যমে পাঠাব এবং বাকিগুলো গাড়িতে নিয়ে যাব বলে ঠিক করেছি। কবির ভাই এর আজ সকালে আমার বাসায় আশার কথা সাহায্য করার জন্য,তার সাথে গত বছর এই শহরেই পরিচয়, কাকতালীয় ভাবে সেও এই শহরে একই দিনে এসেছিল, এবং একই ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করেছিলাম আমরা এবং আমাদের নামও একই! সে ছাড়াও আরেকটি পরিবারের সাথে এই শহরেই পরিচয়, অল্প দিনে ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে গত সপ্তাহে তারা একটি রেস্টুরেন্টে আমাকে বিদায় জানিয়েছিল। যাইহোক কবির ভাইকে ফোন করার আগেই দেখি দরজায় নক, দুজন মিলে পাঁচটি বক্স গাড়িতে ভরে পোষ্ট অফিসে দিয়ে এলাম। আর বাকি ঘরের জিনিষ পত্র, ছেলের খেলনার বক্স, কিচেনের জিনিসপত্র, পাতিল, মশলা পাতি থেকে শুরু করে ঘরের যাবতীয় অনেক কিছু, গাড়ীতে তুললাম, তিল ধরার জায়গা নেই গাড়িতে আর। কবির ভাই আমাকে সাহায্য করে বাসায় চলে গেল এবং বলল বারটার দিকে তার বাসায় খেয়ে যেন রওনা দেই। আমার বাসা থেকে কবির ভাইয়ের বাসার দুরুত্ব দেড় মাইলের মত। দুপুর বারটার দিকে তার বাসায় গিয়ে দুপুরের খাবার খেলাম। তারপর কিছুক্ষণ গল্প করে সেখান থেকে বের হতে হতে প্রায় আড়াইটা বেজে গেল, যাবার সময় ভাবি কিছু খাবার দিয়ে দিল। আমি বিদায় নিয়ে শুরু করলাম আমার যাত্রা।



বৃষ্টির ছবি। প্রায় সারাদিন বৃষ্টি পরছিল।

ছুটে চলছি গন্তব্যের দিকে। আমি একা যখন লম্বা ভ্রমণে বের হই তখন আগে থাকতেই কোন হোটেল ঠিক করিনা রাতে থাকার জন্য। হোটেলে থাকলে মালপানি খরচ হয় তারপর সময়মত চেক-ইন করাও একটা ঝামেলার কর্ম, তার চেয়ে বরং হাইওয়ের পাশে, পাহাড়ের কোল ঘেষা কোন রেস্ট এরিয়াতে গাড়ির ভিতর নিদ্রা নেয়াটা আমার কাছে অনেক বেশী রোমাঞ্চকর মনে হয়। আমেরিকায় ৩০/৪০ বা সর্বোচ্চ ১০০শত মাইল পরপর রেস্ট এরিয়া থাকে। দূর পাল্লার গাড়ি, বড় বড় ট্রাকগুলো সাধারণত রাতে এই রেস্ট এড়িয়াতে থামে। রেস্ট এরিয়াগুলো সাধারণত এমন নির্জন জায়গায় থাকে যেখানে আশে পাশে ৫০ থেকে ১০০ মাইলের ভিতর কোন জনবসতি থাকে না। এখানকার রেস্ট এরিয়াতে কোন খাবারের দোকান থাকে না, তবে পুরুষ এবং মহিলাদের আলাদা ওয়াশ রুম থাকে, গাড়ি পার্কিং এর ব্যবস্থা থাকে যাতে মানুষ গাড়ি রেখে কিছুটা ঝিমিয়ে নিতে পারে বা রাতে ঘুমাতে পারে। আমি রাতে কোথায় থাকব তা ঠিক করিনি, প্লান আছে যতদূর এবং যতক্ষণ মন চায় গাড়ী চালাব, ভাল না লাগলে কোন নির্জন রেস্ট এড়িয়াতে গাড়ি থামিয়ে রাতটা কাটিয়ে দিব।


এই গ্যাস স্টেশনে থেকে গ্যাস নিয়েছিলাম।

বিকেল সাড়ে তিনটার মত বাজে, পোর্টল্যান্ড শহর ছেড়ে চলে এসেছি। আজ সারাদিনই টিপ টিপ বৃষ্টি, ভেজা রাস্তা, পাহাড় এবং বনের ভিতর দিয়ে দূর্বার গতিতে এগিয়ে চলছি। অরিগনে আসলে সব সময়ই বৃষ্টি হয়, দুই তিনদিন পরপরই বৃষ্টি, চলে প্রায় সারাদিন। এই স্টেইটে এই একটি সমস্যা, সামারের ২/৩ মাস বাদ দিলে সাড়া বছরই একই অবস্থা। গাড়ির মিটারের দিকে তাকিয়ে দেখি গ্যাস অর্ধেক, কিছুটা গ্যাস নেয়া দরকার। সামনে কোন গ্যাস স্টেশন পেলে গ্যাস ফুল করে নেব চিন্তা করলাম, কারণ আমেরিকা বড় দেশ, অনেক সময় এমন দুর্গম জায়গা দিয়ে যেতে হয় যেখানে আশে পাশে মাইলের পর মাইল কিছু থাকে না, গাড়ি বসে গেলে বেকায়দায় পরতে হবে। কিছুক্ষণ গাড়ি চালানোর পরই পেয়ে গেলাম একটি গ্যাস স্টেশন।



প্রাকৃতিক দৃশ্য।

যাবার সময় প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম। যেদিকেই চোখ যায় বিস্তীর্ণ ভূমি, কখনও ফসলের মাঠ বা কখনও পাহারের বুক চিরে দিগন্তের পথে। কোন মানুষ নেই, গাড়িগুলো ছুটে চলছে নিজ নিজ গন্তব্যে। আমি এগিয়ে চলছি, কখনও সমতল ভূমি বা কখনই উঁচু পাহার বেয়ে। গাড়ী চালানোর সময় ছবি তোলা যায় না, কারণ আমেরিকায় গাড়ীগুলো খুব জোরে চলে, একই গতিতে গাড়ি না রাখলে হিতে বিপরীত হতে পারে। আমি একটি ওয়ারেবল ক্যামেরা পরে গাড়ি চালাচ্ছি, যেটা ছোট রিমোট দিয়ে কন্ট্রোল করা যায়। মাঝে মাঝে সেটা দিয়ে ছবি তুলছি, ভিডিও করছি। আসলে ভ্রমণে বের না হলে প্রকৃতির এরকম অপার সৌন্দর্য দেখা সম্ভব না। কবি এই প্রকৃতি দেখলে নিশ্চয়ই তার কবিতা কিছুটা পরিবর্তন করে লিখতেন "আমেরিকার রূপ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর" অথবা "ও আমার আমেরিকার মাটি তোমার তরে ঠেকাই মাথা!" এটুকু পড়েই পাঠক গোস্বা করবেন না, ইয়ে মানে একটু মজা করলাম আরকি।

আজকে কোথাও লম্বা সময় যে ঝিমিয়ে নেব সেই উপায় নেই, মুসল ধারে বৃষ্টি নামছে। তার উপর রওনা দিয়েছি বিকেলে, সন্ধ্যা ছয়টা বাজতেই দেখি ঘন অন্ধকার নেমে এসেছে। অরিগণ থেকে আমেরিকার পশ্চিমের স্টেইট ক্যালিফোর্নিয়া ঢুকে পরলাম প্রায় চারশত মাইল চালানোর পরই। এখানে বলে নেই ক্যালিফোর্নিয়া হল আমেরিকার বড় তিনটি স্টেইটের একটি, আয়তনে বাংলাদেশের প্রায় তিনটার সমান! রাস্তাটা খুব একটা সুবিধার না, চারদিকে আলো কম, তারপর আকাশ কালো হয়ে আছে, হাইওয়েতে খুব একটি লাইট নেই। তারপরও দুই ঘণ্টার মত ড্রাইভ করলাম, এখন পুরো অন্ধকার, সামনে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

আমি মনে মনে একটি রেস্ট এরিয়া খুজছিলাম, লিটারেলি শেষের দিকে মনে হচ্ছে আন্তাজে চালাচ্ছি গাড়ি, যেই গাড়িগুলো বিপরীত দিক থেকে আসছে সেগুলোর লাইট দেখতে পাচ্ছি শুধু, আমার পুরো জার্নির এই রাস্তাটা সব থেকে অবহেলিত মনে হয়েছে, কারণ রাস্তা ঠিক আছে তবে লাইট নেই বললেই চলে, রাতে এখানে গাড়ি চালানো বিপদজনক। অবশেষে একটি রেস্ট এড়িয়ার সাইন দেখতে পেলাম, আর পাঁচ মাইলের মত চালাতে হবে, ঘড়িতে তখন আঁটটা ত্রিশ এর মত বাজে। অন্ধকারে রেস্ট এড়িয়ার সাইন ঠিকমত দেখা যায় না, আমি অন্ধকারে রেস্ট এরিয়ার এক্সিট মিস করে প্রায় ২০ ফুটের মত সামনে চলে গেলাম, এই রেস্ট এড়িয়া মিস করতে মন চাইল না, আমি গাড়ি ইমারজেন্সি মুডে নিয়ে কিছুটা ব্যাক এ গিয়ে ঢুকে পরলাম রেস্ট এরিয়াতে। রাত তখন আটটা চল্লিশ, রেস্ট এরিয়াটাতে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার, পাহার-বেষ্টিত জায়গাটা, দুই তিনটি গাড়ি পার্ক করে মানুষজন ঘুমিয়ে আছে। আমি আমার প্রথম দিনের যাত্রা এখানেই শেষ করলাম।

প্রথম দিনের ভিডিও ব্লগ

চলবে...

আগের পর্ব
আমেরিকার অরিগণ থেকে এরিজোনায় রোড ট্রিপ (পর্ব এক): ভ্রমনের ইতিকথা


সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুন, ২০২৩ রাত ১২:৪৪
১৭টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×