কোথায় যেন শুনেছিলাম অবিবাহিতদের জন্য ইহ-জিন্দেগিতে একবার হলেও নাকি থাইল্যান্ডে যাওয়া ফরজ! ব্যাংককের মাটিতে পা দেয়ার আগ পর্যন্ত কথাটার শানেনজুল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলাম না। থাইল্যান্ডে বিশেষ করে ব্যাংককে পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্য সবরকম বন্দবস্ত মজুদ আছে, রাস্তার চিপায়-চাপায় সুন্দরী মেয়েদের দিয়ে বডি ম্যাসেজ থেকে শুরু করে নাইট ক্লাবগুলো বিদেশীদের জন্য সদা প্রস্তুত। জীবনে আছে কি কাঁথা আর বালিশ, আপনার পকেট যদি ভারি থাকে তাহলে ব্যাংকক হতে পারে আদর্শ জায়গা, ব্যাংকক আপনার মানিব্যাগকে চিকুনগুনিয়ার মত চিকুন বানিয়ে ছাড়বে এটা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
আমি ভ্রমণ পিপাসু মানুষ। বেশ কিছু দেশ ভ্রমণের সৌভাগ্য হয়েছে আমার।একবার আমার এক কনফারেন্সর পরল থাইল্যান্ডের নোং-কাই শহরে।আমি, আমার সুপার ভাইজার আর এক ল্যাব-মেট এই তিনজন মিলে গেলাম থাইল্যান্ডে কনফারেন্সে পেপার প্রেজেন্টেশনের জন্য।আমাদের প্লান হল প্রথম তিন দিন কনফারেন্সে থাকব বাকি চার দিন ব্যাংককে ঘুরাঘুরি করব।নোং-কাই শহর ব্যাংকক থেকে বেশ দূরে অবস্থিত, বাস বা ট্রেনে প্রায় দশ/বার ঘণ্টা লাগে যেতে।তাই আমরা ব্যাককে গিয়ে সেখান থেকে ডোমেস্টিক এয়ারে চেপে ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই চলে গেলাম নোং-কাই শহরে।
সুন্দর ছিমছাম গুছানো শহর, ব্যাংককের মত এতটা ব্যস্ত নয় অনেকটা ফাকা।কনফারেন্সে অনেক দেশের থেকে লোকজন এসেছে।কয়দিনেই আমার সাথে বেশ কয়েকজন থাই, জাপানিজ এবং আর কিছু বিদেশীর সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠল।আমরা যেই কয়দিন কনফারেন্সে ছিলাম একসাথেই শহরের আশেপাশে ঘুরাঘুরি করতাম।থাই খাবারের প্রতিও আমার দুর্বলতা সেখান থেকে শুরু।থাইল্যান্ডে বৌদ্ধ মন্দির অনেক, আমরা প্রচুর ঘুরাঘুরি করেছি আশে পাশের বৌদ্ধমন্দির গুলোতে, অনেক পর্যটক আসত সেই মন্দির গুলোতে।
কনফারেন্সের শেষ দিনে সিদ্ধান্ত হল কনফারেন্স কর্তৃপক্ষ আমাদের সবাইকে পাশের দেশ লাউস ভ্রমণে নিয়ে যাবে। আমি ভ্রমণ প্রিয় মানুষ , লাউস ভ্রমণের সংবাদে আমার খুশিতে লম্ফঝম্ফ করার কথা ছিল কিন্তু আমি হতাশ হয়ে গেলাম।হতাশ হবার কারণ হল আমি লাউস ভিসা নেই।আমার প্রফেসর আর ল্যাব-মেট হেভি-ওয়েট দেশ থেকে এসেছে বিদায় ওদের ভিসা লাগবে না।আমি দুখী দুখী ভাব নিয়ে বসে আছি ! কবি হলে একটা বিরহী কবিতা লিখে ফেলতাম সেই সুযোগে, কবি নই বলে বুকের ভিতর থেকে শুধু একটা দীর্ঘ নি:শ্বাষ বেরিয়ে এলো।আমার প্রফেসর বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা , তিনি বললেন চিন্তা করনা তোমাকে ছাড়া আমরা যাব না, দেখি কি করা যায়।
সেই দিন সন্ধ্যায় প্রফেসর আমার রুমে এসে বললেন কনফারেন্স কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে একটা উপায় বের করেছি। টাকার নাম বাবাজি, দুই দেশের ইমিগ্রেশোনে টাকা দিব শুঁড় শুঁড় করে সব কাজ হয়ে যাবে। তোমাকে শুধু কয়েকটা মিথ্যে কথা বলতে হবে! আমি শরিফ লোক, সত্যের পথে অকুতোভয় বীর, এই ধরনের মিথ্যা বলার পাত্র আমি নই। আমি জ্বাজ্বালো ভাষায় প্রফেসরের এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলাম। প্রফেসর সাহেবও নাছোড় বান্ধা, হাল ছাড়ার পাত্র তিনি নন!আমার ল্যাব-মেট আর তিনি দুজন মিলে আমাকে বুঝাতে লাগলেন, জিন্দিগিতে এই রকম দুই একটা মিথ্যা কথা বলাটা নাকি মামুলী ব্যাপার।এবার আমি কড়া ভাষায় জানিয়ে দিলাম পুনরায় অনুরোধ করা হলে বরদাস্ত করা হবে না!
প্রফেসর সাহেব কনফারেন্সের প্রধানকে জানালেন ব্যাপারটা,ভদ্রমহিলা চলে এলেন আমাদের হটেছে। তিনিও আমাকে এসে অভয় দিলেন কোন সমস্যা হবে না তুমি চল আমাদের সাথে। আমি হাবভাবে বুঝিয়ে দিলাম নিতিবষ্ট হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নহে। ভদ্র মহিলা আমার কথায় কর্ণপাত না করে বললেন, সারাদিন আমরা লাউসে ঘুরাঘুরি করব, লাঞ্চ করব সেখানকার দামি এক রেস্টুরেন্টে ,অনেক মজা হবে।আমি ভ্রমণ পিপাসু তার উপর ভোজন রসিক আদমি হিসেবে পরিচিত মহলে অল্প বিস্তর কু-পরিচিতি আছে। তাই বেশীক্ষণ আর নিজের নীতিতে অটল থাকতে পারলাম না। আমি সম্মতি জানিয়ে বললাম তথাস্থ, আপনাদের ইচ্ছাই শিরোধার্য!
থাইল্যান্ড এবং লাউস দুই দেশের মাঝে পার্থক্য শুধু মেকং নদী।নদীর ওপর ব্রিজ আছে, নদীটা পার হলেই লাউস। আমরা কয়েকটা মাইক্রো-বাস চেপে সকাল সকাল বেরিয়ে পরলাম লাউসের উদ্দেশ্যে।মেকং নদীর পার হবার পথে থাইল্যান্ডের ইমেগ্রেশন অফিস আমাদের আটকালও পাসপোর্ট চেক করার জন্য, চোরের মন পুলিশ পুলিশ। ভয়ে আমার বুকের ভিতরটা ধরাস করে উঠল!কনফারেন্স কর্তৃপক্ষের একজন আমাকে দেখিয়ে দিয়ে কিছু দিনার দিয়ে দিল ইমিগ্রেশোন অফিসে, আমার পাসপোর্ট চেক না করে ছেড়ে দিল, আমি আরামছে গাড়ীর ভিতর গিয়ে বসলাম ।
আমাদের গাড়ি ছুটে চলল মেকং নদীর উপর দিয়ে লাউসের পথে। নদী পার হয়ে পৌঁছে গেলাম লাউস ইমেগ্রেশোনের সামনের।থাই ইমিগ্রেশোনের মত এতটা সহজ ছিল না লাউস ইমিগ্রেশন। সেখানে পাসপোর্ট আর চেহারা দেখে দেখে ঢুকাচ্ছে দেশের ভিতর। আমি লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, আমার কিছু থাই বন্ধু এসে অভয় দিল।এখানেও কিছু দিনার দিয়ে পার পেয়ে গেলাম। লাউসের ঢুকার পথে আমার থাই বন্ধুরা আমার ঘিরে ধরে একসাথে নিয়ে যাচ্ছিল, ইমিগ্রেশোন পুলিশ বলছিল হি এজ এ থাই গাই! আমি কোন এঙ্গেল থেকে থাই দেখতে সেই রহস্য এখনও উদ্ধার করতে পারলাম না!
সারাদিন লাউস ঘুরে বেড়ালাম। সেখানকার দর্শনীয় স্থান থেকে শুরু করে ট্র্যাডিশনাল কিছু মার্কেটেও ঘুরে দেখলাম। সেদিন দুপুরে ভাল একটা রেস্তরাঁয় ভোজন কর্ম সম্পাদন করলাম!সারাদিন ঘুরাঘুরি করে সন্ধ্যায় দিকে গেলাম সীমান্ত এলাকার বাজারে। সেখানে থাই-লাউস দুই দেশেরই জিনিশ পত্র বিক্রির হাট বসে।থাই আর লাউসের ঐতিহ্যবাহী জিনিসপত্র থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকমের সুস্বাদু খানা-দানা রয়েছে। আমরা সেখানে ডিনার সেরে থাইল্যান্ডে ফিরে এলাম।
পরদিন সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলাম ব্যাংককে ঘুরার উদ্দেশে । বিভিন্ন দেশ ঘুরে বেরালেও থাই-লাউস ট্রুর আমার কাছে বিশেষ স্মরণীয় হয়ে আছে বিভিন্ন কারণে।থাই খাবারের স্বাধ এখনও ভুলার নয়, এখনও যেখানে থাকি থাই রেস্টুরেন্ট খুঁজে অনেক সময় ভোজ কর্ম সারার চেষ্টা করি! থাই কিছু বন্ধুর সাথে এখনও আমার নিয়মিত যোগাযোগ আছে। ব্যাংকক ট্রুরটাও ছিল বিশেষ কিছু সেই গল্প আরেকদিন বলা যাবে।
নিচে থাইল্যান্ড এবং লাউসের কিছু ছবি শেয়ার দিলাম।
ছবিটা লাউসের কোন পর্যটন স্থান থেকে নিয়েছিলাম।
নোং-কাই শহরের ছবি
বৌদ্ধ মন্দিরের ছবি
ব্যাংককের নদীতে ঘুরে বেরানোর ছবি
ঠাডা ভাঙ্গা রোধে ব্যাংককের ষ্টিট মার্কেটে ঘুরছি
ব্যাংককে খুব সম্ববত কোন পার্লামেন্ট ভবনে !
কোন এক রেষ্টুরেন্টে খানা দানা করছিলাম
সুস্বাদু খানা দানা
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০২৩ দুপুর ২:১৪