
হাদির হত্যাচেষ্টা আমাদের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে একটি অশনি সংকেত। জুলাই ২০২৪ আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের দ্বিধাবিভক্ত সমাজে, যখন নানামুখী বিদেশি চক্রান্ত এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অন্তর্কলহে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আয়-উন্নতির গুরুত্বপূর্ন প্রশ্নগুলো হারিয়ে গেছে। যখন কে কাফের, কে মোনাফেক - এই জাতীয় নিম্নবুদ্ধির কোন্দলের ভেতরে আমাদের চিন্তা-চেতনা আটকা পড়েছে, তখন জুলাই বিপ্লবের প্রাণশক্তির প্রতীক ওসমান হাদিকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করার ঘটনা সামনের দিনগুলোতে আমাদের জন্য একটি বিপদ সংকেত।
হাদি সম্পর্কে ব্লগার কলিমুদ্দি দফাদার বলেছেন, "জুলাই-পরবর্তী সময়ে ক্ষমতা ও টাকার সঙ্গে আপোসহীন একমাত্র তরুণ নেতা ছিলেন হাদি। হাদি সারা বাংলাদেশের মজলুম জনতার কণ্ঠস্বর।" হাদি সম্পর্কে কলিমুদ্দি দফাদারের পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত নিখুঁত। জুলাই আন্দোলনে যে তরুণেরা সম্মুখসারিতে ছিলেন, আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে তাঁদের প্রায় সকলেরই আত্মার অবনমন হয়েছে। সেটা তাঁদের নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে হোক বা পতিত হাসিনা গং কোনোভাবে ফিরে আসার আত্মরক্ষার তাগিদে হোক। একথা সত্য যে জুলাইয়ের পরে তাঁদের আত্মত্যাগ ফাঁপা বেলুনের মতো নিষ্প্রভ হয়ে গেছে।
কিন্তু এর মধ্যে ব্যতিক্রম ছিলেন হাদি। হাদির যে ক্লিপগুলো ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে, তার মধ্যে একটি ছিল প্রচণ্ড উচ্ছ্বাসে সারা হাত-পা, শরীর কাঁপিয়ে তাঁর নজরুলের "বিদ্রোহী" কবিতা আবৃত্তি। এই আবৃত্তিতে তাঁর প্রাণের উচ্ছ্বাসের ছবিটা প্রকাশ পেয়েছে। বিপ্লবের প্রতি তিনি যে কত আন্তরিক ও সৎ, এই আবৃত্তি দেখলে সেটা বোঝা যায়। তাই আমার মনে হয়, হত্যার লক্ষ্যবস্তু হিসেবে সারল্য, সততা ও প্রাণোচ্ছ্বাসে ভরা হাদিকে খুব ভেবেচিন্তে বেছে নেওয়া হয়েছে।
ব্লগার নতুন নকিবের পোস্ট "হাদিকে গুলি করলো কে?"-এই পোস্টের কলিমুদ্দি দফাদার বলেছেন, "হাদিকে গুলি করেছে পতিত স্বৈরাচারের দোসররা! সঙ্গে সহায়তা করেছে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা 'র'। স্লোগান হবে-দিল্লি না ঢাকা, দালালি না রাজপথ! ব্যাস! এতটুকুই।" দফাদারের মন্তব্যের শেষ লাইনগুলো-"স্লোগান হবে দিল্লি না ঢাকা, দালালি না রাজপথ! ব্যাস! এতটুকুই।" আমার কাছে খুবই ইঙ্গিতপূর্ণ ও কৌতূহলোদ্দীপক মনে হয়েছে!
এই কাজে যে আওয়ামী লীগ জড়িত, এটার ছবি-সহ প্রমাণ, ঘটনার ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ে দিয়ে দিয়েছেন অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের। তাঁর ভাষ্যমতে, ওসমান হাদির ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত একজনকে শনাক্ত করা হয়েছে-ফয়সাল করিম মাসুদ (ছদ্মনাম দাউদ বিন ফয়সাল)। সে ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি ও আদাবর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। ছবিতে ফয়সালকে দেখা যায় ৯ ডিসেম্বর ২০২৫ একটি বৈঠকে হাদির ঠিক পাশে বসে থাকতে। আরও বলা হয়েছে, তিনি জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আসাদুজ্জামান খান কামালের বিশ্বস্ত অনুসারী।
গোয়েন্দা গল্পগুলোতে প্রায়ই দেখা যায়, অপরাধী হিসেবে প্রথমে যাকে মনে হয়, পরে দেখা যায় যে আসলে সে অপরাধী নয়। এ ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছে কি না, সেটি দেখার বিষয়। অনুসন্ধানটিকে এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা যেতে পারে যে, হাদিকে হত্যাচেষ্টার মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে ফায়দা লাভের সম্ভাবনা কার বেশি?
হাদি যে আসন থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন, সেখানে বিএনপির প্রার্থী তাদের বর্ষীয়ান নেতা মির্জা আব্বাস। রামপুরা-খিলগাঁও থেকে মির্জা আব্বাস যখন বিএনপির এমপি, তখন আমি রামপুরায় থাকতাম। সন্ত্রাসী ও ডাকাত-সর্দার হিসেবে মির্জা আব্বাসের কুখ্যাতির কথা আমার অবিদিত নয়। মির্জা আব্বাসকে যদি দোষী সাব্যস্ত করা যায়, তাতে জামায়াতের লাভ সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে যখন দেখা যাচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে জামায়াত অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।
আওয়ামী লীগ এই কাজ করে থাকতে পারে - এই সম্ভাবনাটাই এখন সবার কাছে বেশি বোধগম্য বলে মনে হয়। এই হত্যাকাণ্ডের ভেতর দিয়ে তারা মানুষকে ভয় দেখাতে পারে। অতীতে বাসে আগুন দিয়ে বহু মানুষকে পুড়িয়ে মারার রেকর্ড এই দলের আছে। মানুষ হত্যায় '৭১-এর জামায়াতের পর বড় বড় রেকর্ডগুলো আওয়ামী লীগের দখলে। অতএব, এটা খুব সম্ভব যে আওয়ামী লীগ এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে একটি ভিন্ন কিন্তু যুক্তিপূর্ণ মন্তব্য করেছেন মাথা পাগলা। তিনি নতুন নকিবের সেই পোস্টে বলেছেন, "আজকের ঘটনা দিয়ে হাদিকে সামনে রেখে সহজ-সরল বাঙালিদের সহানুভূতি আদায় করা এবং হাদিকে আইকন বানিয়ে লীগ-ভারতবিরোধী ভাবনা উস্কে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। গত ১৫ মাসের তুলনায় এখন লীগের জনপ্রিয়তা অনেকটাই বেড়েছে। অন্যদিকে, ইউনুস-রাজাকারদের জনপ্রিয়তা তলানিতে।"
আমার মতে, মাথা পাগলা এই বক্তব্য খুবই যৌক্তিক। আর তাই, আমার মতে এখানে একটি তৃতীয় সম্ভাবনা আছে। সেটা হলো-এই কাজটি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে করে আওয়ামী লীগের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। গত এক বছরে আমরা বাংলাদেশে পরিকল্পিতভাবে ঘৃণা তৈরির বাস্তব রূপ দেখেছি।
আওয়ামী লীগ এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত নয় - এটা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। এই হত্যাকাণ্ড ব্যবহার করে পতিত শক্তি ফিরে আসার আগাম ঘোষণা দিতেও পারে। তবে প্রশ্ন থাকে, তারা কি হাদির মতো কাউকে বেছে নেবে, যাকে আঘাত করলে তাদের প্রতি মানুষের ঘৃণা আরও বাড়বে?
নাকি কেউ পরিকল্পিতভাবে এই ঘৃণা তৈরি করে নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য উদ্ধারের ছক কষছে? মব ব্যবহার করে জনমতকে একদিকে ঠেলে দেওয়ার চক্রান্ত হচ্ছে না তো? ৩২ নম্বর জ্বালিয়ে দিয়ে যেভাবে জনতার আবেগকে কাজে লাগানো হয়েছিল- একই ভাবে নির্বাচনকে বানচাল করে ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার কৌশল হিসেবে এমন ঘটনা ঘটানো হয়ে থাকতে পারে?
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:১৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




