৮ ই মে বিকেল ৩টা, ২৫ বছর হয়ে গেল তুমি চলে যাবার, কেমন আছো বাবা, অনেক বছর পর তোমায় লিখছি, তোমার শুন্যতাটুকু মা কখনো বুঝতে দেয়নি, আজ সেও নেই চলে গেল তোমার কাছে। মেঘ ছাতা হয়ে ছিলে মাথার উপর ছায়া দিয়ে। কিন্তু সব কিছুই একদিন শেষ হয়ে যায়, ফুরিয়ে যাবার পথের পাশে বসে দেখতে হয়েছে তোমাদের চলে যাওয়া, এ চেয়ে থাকা যে কতটা কষ্টের তুমি কি জানো তা। তোমরা চলে গেলে আমাদের দুই ভাই কে শূন্য আকাশের নিচে রেখে। এই শূন্যতাটা অনেক বিশাল যার দিক পাশ নেই। অদ্ভুত এ শূন্যতা থেকে মুক্তির কোন পথ আমার জানা নেই, খুঁজে চলেছি অবিরাম এ এক মরীচিকা।
দিন গুলো অনেক কঠিন ছিল বাবা, ছোট্ট সে আমি স্কুল ব্যাগ টাও অনেক ভারী মনে হত, কেউ কোনদিন সে ব্যাগটা কাঁধে তুলে দেয়নি। আমার একলা চলার পথ অনেক কষ্টের ছিল। স্কুলে সবার নানান রঙের নতুন ব্যাগ ছিল, শুধু আমারটাই পুরনো মলিন, আমার খুব ইচ্ছে হত একটা নতুন ব্যাগের। দোকান গুলোর পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে নতুন নতুন ব্যাগগুলো দেখতাম আর কল্পনায় সব কাঁধে নিয়ে বাসায় ফিরতাম। কল্পনার ব্যাগে আমার স্বপ্নগুলো জমা হত, কিন্তু কেউ কোনদিন তা খুলে দেখেনি। জানেও নি কেউ কোন দিন ছোট ছোট সে আদরে পোষা আমার স্বপ্ন শুধু আমার স্বপ্ন।
অসহায় পথচলার সময় কত হাত ধরতে চেয়েছি আমার ছোট হাত সেই উচু মানুষদের হাতের নাগাল পায়নি কখনো। মেনে নিয়েছিলাম সব , জীবন এমন ই। অবহেলা অনাদর জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত জুড়ে ছিল। মায়ের একটা আঁচল দিয়ে কতটুকু আগলে রাখা যায়, তোমায় অনেক দরকার ছিল বাবা।
একলা রাতে ঘুমাতে অনেক ভয় লাগত, মনের অজান্তে তোমার হাত খুঁজে বেড়াতাম, খাটের শক্ত কাঠ ধরে আবার ঘুমিয়ে যেতাম মনে হত তুমি আছ। স্বপ্ন দেখা ছেড়ে দিয়েছি, আমি জানি কোন কিছুই আমার জন্য নয়। একটা নতুন জামার স্বপ্ন, এক জোড়া নতুন জুতোর স্বপ্ন, একটা পড়ার টেবিলের স্বপ্ন, একটা সাইকেলের স্বপ্ন, কোন কিছুই আমার জীবনে ছিলোনা, তুমি চলে যাবার সাথে সাথে সব শেষ। হুট করে একটা পর্দা পড়ে গেল তোমার আর আমার মাঝে, কোনদিন আর তা সরেনি।
প্রতিটা ঈদে অনেক কষ্ট হয় বাবা, আমারতো ইচ্ছে হত একটা নতুন পাঞ্জাবীর কিন্তু আমার স্বপ্ন দেখা মানা, এটা মানতে অনেক কষ্ট হত। কেউ কোনদিন পরম মমতায় বলেনি নে বাবা তোর জন্য এই নতুন কাপড়। জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে আমায় শিখতে হয়েছে কিভাবে একলা চলতে হয়, অনেক কষ্ট হত, খোলা জানালার বাইরের জগৎ টা অনেক বেশি স্বার্থপর, অনেকেই পাশে দাঁড়িয়েছে কিন্তু বাবা তোমার হাতের নির্ভরতা তোমার মত মায়া আর সাহসের হাত কারো কাছে ছিলনা, সে তুমি আমার কল্পনাতেই ছিলে।
মনে আছে বাবা তখন বাজারের পলিথিন ছিল গোলাপি সাদা আর নীল সাদা স্ট্রাইপের, মাঝে মাঝে বাজার গুলো অনেক ভারী হয়ে যেত, আমার হাত সে বোঝা বইবার মত সবল ছিলনা, রাস্তায় থেমে থেমে বাসায় আসতাম, তখন খুব দরকার ছিল তোমায় বাবা।
মিষ্টি আমার ভীষণ প্রিয়, একদম ছোট বেলায় যখন খেতে পারতাম না তখন ঘর ভর্তি মিষ্টি থাকত, বাবা মিষ্টির দোকানের সামনে দিয়ে যাবার সময় আমার খুব ইচ্ছে হত নিজের পছন্দ মত মিষ্টি খাব, চকচকে চোখে দেখতাম রসে ডোবানো মিষ্টি গুলো, ছোট্ট সেই আমার তখন অজান্তে ঢোক গেলা ছাড়া আর কিছু করার ছিলনা। অপেক্ষায় থাকতাম আশে পাশে মামা নানু দের বাসায় কখন মেহমান আসবে, কারণ অনেক মিষ্টি আসত তখন, আমার প্রত্যাশিত স্বপ্ন পূরণের দিন। বাবা তখন তোমায় আমার খুব দরকার ছিল।
প্রতিটা মুহূর্তেই সন্তানের জন্য বাবার শক্ত হাতটা দরকার। কিন্তু সবার কপালে তা হয়না। কোন স্বপ্নই অধরা থাকেনা বাবা, আমার কোন কিছুর অভাব নেই আজ সব স্বপ্ন পূরণ হয়ে গেছে, কিছু স্বপ্ন অবহেলায় নিভে গেছে যার আর দরকার নেই, শুধু তোমার অভাবটাই কুঁড়ে কুঁড়ে খায় আমায়, আমৃত্যু যা কোন দিন ও পূরণ হবার নয়।
তোমার প্রতি টান আর ভালবাসা এক বিন্দুও কমেনি এই পঁচিশটা বছরে, আজও তোমার কবরের পাশে দাঁড়ালে আমার ঢুকরে কান্না আসে, আমি দোয়া করি কিন্তু কোন শব্দ বের হয়না আমার মুখ দিয়ে, শুধু ফুপিয়ে কান্না আসে, বুকের ভেতরটা ফেটে যায় এমনই গহীনে কেউ বোঝে না, আমি সেই ছোট্ট আমি হয়ে যাই, যে লাফিয়ে তোমার কোলে উঠতাম, কত কিছুর বায়না ধরতাম। বাবা তুমি কি দেখ আমার চোখের জল, আমি জানি তুমি টের পাও, মনে মনে বল নিশ্চই বোকা ছেলে এসব কেন করিস, একদিন তো আমার কাছে আসবি। হ্যা বাবা আসব, সে পর্যন্ত ভাল থেকো।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০১৮ রাত ১০:৩২