somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লিলি ও লুলু

২৩ শে এপ্রিল, ২০১২ বিকাল ৫:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

[গল্পটা সাহিত্যের ছোটকাগজ উতঙ্কে ছাপা হয়েছে।- লেখক]
বালিশটা টেনে ঘাড়ের নিচে দিয়ে আধ শোয়া হয়ে আরাম করে বসল লুলু। কাগজে মোড়ানো পানটা বের করে মুখে পুরে দিল - এবার পেকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে জ্বালিয়ে জোরসে একটা টান দিল, লুলুর মুখ থেকে বেরুনো রিং আকারের ধোঁয়া ফ্যানের বাতাসে নৃত্য করতে-করতে বিলিন হয়ে যাচ্ছে। প্রতিরাতে খাবারের পর এ-ভাবেই সময়টাকে উপভোগ করে লুলু! এ-ভাবে বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হবার পর লুলু এবার স্ত্রী লিলির দিকে মনোযোগ দিল, পাশেই বালিশে মুখগুজে শুয়ে-থাকা স্ত্রী লিলির মাথায় আলতোভাবে হাত রেখে আদর-মাখানো কণ্ঠে, ‘সে কি, না খেয়ে শুয়ে আছ যে; শরীর খারাপ বুঝি?’ লিলি স্বামীর হাত ছুঁড়ে ফেলে পেছন ফিরে শু’লো! লুলু দ্বিতীয় বার হাত দিতে গিয়েও আবার কী ভেবে হাতটা গুটিয়ে নিল। এ-ভাবে বেশ কিছু সময় নীরবে অতিবাহিত করার পর লুলু বলতে শুরু করলো, ‘না, লিলি এ-তোমার ভারি অন্যায়, এগুলো একদম সে কালের আচরণ - যেগুলো আমাদের দাদা-দাদি নানা-নানিরা করতো, স্বামীর জন্য পথ চেয়ে বসে থাকা; স্বামীকে না-খাওয়ানো পর্যন্ত উপোস থাকা।’ জোরে-জোরে মাথা দোলাতে-দোলাতে - ‘এটা নিঃসন্দেহে পুরানো কালের আবেগ!’ কথাগুলো বলেই প্রত্যুত্তরের আশায় স্ত্রীর দিকে একবার ঘাড় কাৎ করে তাকাল, কোন সাড়া না পেয়ে লুলু আবারও বলতে শুরু কলল, ‘মন ও মননে আমি একজন আধুনিক পুরুষ, আমি চাই আমার জীবনসঙ্গী হোক আমার মতোই আধুনিক - চর দখলের মতো স্বামীকে আঁচল দিয়ে আগলে রাখা - সীতার মতো নিজের সতীপনার জয় গান করা, এ-টা অশিতি-অর্ধশিতি নারীর বৈশিষ্ট্য হতে পারে; কোন উচ্চশিতি নারীর ব্যাপারে মানা যায় না! নিদেনপে আমার মতো আধুনিক সুশিতি রুচিশীল পুরুষের স্ত্রীর ক্ষেত্রে । শুনো লিলি, তুমি আমার স্ত্রী বলে - তোমাকে ভালবাসি বলে, পৃথিবীর আর কোন নারী আমার ভাল লাগবে না, এ-ধারনাটা একদম অ-বৈজ্ঞানিক ও বাস্তবতাবিরুদ্ধ! কেউ একজন যদি গোলাপ ভালবাসে, সুযোগ পেলে কেন সে চামিলির গন্ধ নিবে না? তুমি যান, আমি নিয়মিত পান করি; আমার অসংখ্য নারী বন্ধু আছে; যাদের সঙ্গে আমি অনেক রাত পর্যন্ত ঘুরে বেড়াই - অস্বীকার করব না তাদের সঙ্গ আমি উপভোগ করি, বিশেষভাবে তোমার সন্দেহ সালমা মেয়েটার উপর; হ্যাঁ, তোমার সন্দেহ ঠিকই আছে - এমন আধুনিক রুচিশীল নারীর সঙ্গ কোন সাধু পুরুষই উপো করতে পারে না! আর আমার কথা বলবে? আমি ভাই সাধু পুরুষ নয় - সাধারণ পুরুষ - বিষয়টা নিয়ে আমার কোন অপরাধবোধও নেই! তোমার সাথে পরিচয় হবার পূর্বে অন্য কোন নারী আমাকে আকর্ষণ করেনি, অন্য কোন নারীর প্রেমে আমি পড়িনি - এমন ন্যাকা ও ডাহা মিথ্যে বলার মতো কাপুরুষ আমি না - তবে হ্যাঁ, চটকদারি দৈহিক সৌন্দর্য নয়, আমাকে আর্কষণ করে ব্যক্তিত্ব - সাদামাটা চিন্তার সাধারণ নারী - প্রচলিত অর্থে সুন্দরী যাকে বলা হয়; আমার কাছে সকলেই একই রকম, বুকের উপর মাংশ পিন্ড আর নাভির নিচে ছিদ্রবিশিষ্ট মানুষ ছাড়া অন্য কিছু নয়। প্রথম জীবনে নবিলা নামে যে মেয়েটার প্রেমে পড়েছিলাম, তাকে সুন্দরের স্থুল বিবেচনায় কুশ্রী বললে বাড়িয়ে বলা হবে না - আহ! কি উন্নত রুচির অধিকারিনি ছিল, পড়তো বাংলায়, অথচ জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমস্ত শাখায় ছিল তার অবাধ বিচরণ। সেই স্মৃতিগুলো মনে হলে এখনো শিউরে উঠি! থাকত রোকেয়া হলে, প্রতিদিন নিয়ম করে হলের সামনে যাওয়া; আলো-আঁধারি রাস্তায় বসে আড্ডা দেওয়া, হাত থেকে হাত সরে নিজের অজান্তেই কখন যে চলে যেত মেয়েটার কামিজের ভেতর- আলাপের মাঝে যখন দীর্ঘনীরবতা নেমে আসত তখন আবিষ্কার হতো দু-জনের ঠোঁট আসলে বিলীন হয়ে গেছে পরষ্পরের ঠোঁটের মাঝে! আহ্ নাবিলা! তুমি এখন কোথায়? আমাদের সর্ম্পক ভেঙ্গেছে অতি ঠুনকো কারণে, আদপে ইগোই আমাদের সম্পর্কের মধ্যে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল! শ্রাবণীও বা কম কিসে? না হয় ধনির দুলালি হিসেবে কিছুটা ন্যাকা ছিলই, সে ছিল কবিতার সমাজদার পাঠক! একই সাথে ছিল সুন্দরী, সত্যকে সত্য আর মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে কুণ্ঠা ছিল না মোটেও; কয়টা বাঙালি মেয়ে এমন মতা রাখে বলো? এক দু-জন নয় অসংখ্য পুরুষ বন্ধু ছিল তার, সে অবলীলায় বলতো - সবার সঙ্গই সমান উপভোগ করি! হ্যাঁ, বিয়ে করেছে আমাদেরেই এক বন্ধুকে - বলতে পার বাজি আমরা সবাই ধরে ছিলাম, জয়টা তারই হলো! আমার মনে হয় শ্রাবণীকে নিয়ে অনিমেষ সুখেই আছে। অবশ্যই বিয়ের পরেই তারা দু’জন আমেরিকা পাড়ি জমিয়েছে - দীর্ঘ দিন কোন যোগাযোগও নেই; তারপরও আমি হলফ করেই বলতে পারি - শ্রাবণী যে ধরনের ক্রিয়েটিভ মেয়ে স্রেফ গৃহিণী হয়ে থাকা তার পে সম্ভব নয়, এত দিনে নিশ্চয় আমেরিকাতেও তার অনেক বন্ধু গজিয়েছে! এমন নয় যে শ্রাবণী আমার হৃদয় থেকে মুছে গেছে, শ্রাবণীর স্বামী হবার পর অনিমেষকে আমার হিংসা হয়নি এ-কথা বললেও মিথ্যা বলা হবে - এমনেতেই তো আমি বিদগ্ধ নারীর স্বামীদের খুব হিংসা করি! অনিমেষকে তো রীতিমতো বেশ ক’বার খুনই করতে ইচ্ছা করেছিল! লিলি গো, একজন প্রকৃত আধুনিক মানুষ প্রতি মূহুর্তে নিজেকে বিকশিত করে, দাম্পত্য জীবনে এই বিকাশ স্বামী-স্ত্রী দু’জনকেই সমানতালে পাল্লা দেওয়া চাই। দু’জনের যে কেউ একজন পিছিয়ে পড়লেই পরষ্পর- পরষ্পরের কাছে হয়ে পড়ে পুরানো, পুরানো কাপড় পরা যায়, পুরানো থালে ভাতও খাওয়া যায়; কিন্তু পুরোনো বউ নিয়ে সংসার করা যে কি কান্তিকর সেটা যদি তুমি বুঝতে! কথাগুলো বলেই লুলু স্ত্রীর দিকে একবার তির্যক দৃষ্টিতে তাকাল। তারপর বালিশটাকে ঠিক করে একটু নড়ে-চড়ে বসল, পেকেট থেকে আরেকটা সিগারেট বের করে ধরালো, একটা টান দেওয়ার পর আবারও বলতে শুরু করল, আমার জীবনে যে অসংখ্য নারী এসেছে - যাদের কথা আমি এখনো ভুলতে পারি না, তারা কেউ প্রচলিত অর্থে সুন্দরী ছিল না, অথচ যে সব সুন্দরী নারী আমার চারপাশে ঘুর-ঘুর করেছে তাদের কারো কথাই এখন আমার আর মনে পড়ে না। আমি যাদের ভুলতে পারি না, তারা চিন্তায় ছিল আধুনিক, মন ও মননে ছিল একজন আধুনিক পুরুষের সহযোদ্ধা হবার মতো যোগ্য। যারা নারী-পুরুষের সর্ম্পকের ব্যাপারে নিজেকে রণশীল বলে দাবি করে আদপে তারা ভণ্ড; সত্যি কথা বলতে কি মন আমার ছুটে যায় অন্য কারো কাছে অথচ ভান করছি - আমি তোমার কাছেই আছি, মনে ধারণ করি এক; মুখে বলি আরেক কথা, নানাভাবে এই ভণ্ডামিগুলো আমাদের প্রতি মূহুর্তে করতে হচ্ছে, একই ভণ্ডামি যদি জীবনের সবছেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দাম্পত্য জীবনেও করতে হয় তাহলে দাউদ হায়দারের কবিতার ভাষায় বলতে হয়- ‘জন্ম আমার আজন্ম পাপ’! লুলু কথাগুলো বলেই সিগারেটটা আরেক বার মুখের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, এর মধ্যেই লিলি হঠাৎ শোয়া থেকে উঠে বসল, বসা অবস্থায় লুলুর দিকে একবার তীè দৃষ্টিতে তাকালো! একটু ম্লান হাসি দিয়ে বলতে শুরু করল, লুলু সত্যিই আমি তোমার মতো সত্যবাদী ও আধুনিকতামনষ্ক স্বামী পেয়ে খুব গর্বিত, অথচ দেখ আমি এখনো সেকেলে নারীর মতো অন্ধ অনুগত্য আর পতিভক্তির মধ্যেই আছি! তবে তোমাকে আশ্বস্ত করতে পারি, তোমার সাথে আটমাস সংসার করে আমার রণশীলতার ঘোর অনেকটা কেটে গেছে, আমি চেষ্টা করছি যাতে তোমার মতো আধুনিক ও সত্যবাদী হয়ে উঠতে পারি - তুমি ঠিকই বলেছ, একজন মানুষ সারা জীবন শুধু একজনকেই ভালবাসবে - এটা কি করে সম্ভব! আমাদের দাদা-দাদিরা যে কি করে পেরেছে - এটা ভাবতেই অভাক লাগে! আমার বিয়ে হলো তো চাব্বিশ বছর বয়সে, যদি ধরি নারীর যৌবন আসে চৌদ্দ বছর বয়সে, তাওতো তোমার স্ত্রী হবার পূর্বে আমি যৌবনের একটা যুগ অতিক্রম করেছি, বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করলাম; এত পুরুষের সাথে মিশলাম তাদের কেউ কি আমার কামনা জাগাতে পারেনি? - এটাতো রিতিমতো মানবধর্ম বিরুদ্ধ! তোমার মতো ডজন-ডজন না আসুক, নিদেনপে একজন তো এসেছিল, তোমার মতো এমন লুলু-ফুলু মড়েলের গেঁয়ো নাম ছিল না তার। ‘সুমন’ (স্বামীর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে) কেমন গাল টিপুনে আদূরে নাম না? লুলু এ-কথার কোন উত্তর না দিয়ে লিলির দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে - যেন অন্য গ্রহ থেকে নেমে আসা কোন মানুষ দেখছে! লিলি কিছু সময় নীরব থেকে আবারও বলতে শুরু করলো, সে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার চার ব্যাচ সিনিয়ার ছিল; আমি ছিলাম দর্শনে, ও ছিল চিত্রকলায় - দুনিয়াতে ওর সবচেয়ে বড় বন্ধুর নাম বই, যেখানেই দেখা হোক হাতে অথবা মুখের উপর ধরে আছে একটা বই, যেন বইয়ের ভিতর দিয়েই সে তাবত দুনিয়াকে দেখছে! একটা ছোট্ট ঘটনা বললে ও কতটা কিতাব-নির্ভর ছিল তুমি বুঝতে পারবা। আমরা দু-জনে শিবুর হোটেলে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম, আড্ডার মাঝে হঠাৎ করেই জ্যোতির্ময় নন্দী এসে হাজির, জ্যোতিদা সুমনকে উদ্দেশ্য করে বললে, ‘কাল কলকাতার চিঠি পেলাম, মা’র শরীর নাকি ভাল যাচ্ছে না! আমাকে মাসখানেকের জন্য যেতে হবে - তুমি তোমার বৌ’দি আর আমার মেয়ে দু-টোকে একটু দেখে রাখবে। সুপন তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিল - এর মাঝেই আমি জ্যোতিদার সাথে আলাপ জুড়ে দিলাম, এ-ছিল বড়জোড় মিনিট তিনেকের ব্যাপার; হঠাৎ চেয়ে দেখি এতণ আমার পাশে বসে থাকা সুপন কোথায় যেন উদাও হয়ে গেছে! চারপাশে ভাল করে দেখার পর - চোখ গেল রাস্তার ওপারের লাইব্রেরির দিকে, সুপন লাইব্রেরির এক কোণে দাঁড়িয়ে একটা বই হাতে নিয়ে নাড়া-চাড়া করছে - আমি দ্রুত লাইব্রেরির দিকে ছুটে গেলাম, আমাকে দেখে এক চিলতে লাজুক হাসি দিয়ে- “প্রগতী প্রকাশের, ‘ছেলে মেয়েদের মানুষ করা প্রসঙ্গে’ বইটা কিনলাম, আজ রাতের মধ্যেই পড়ে শেষ করবো। কথাটা বলেই লিলি সশব্দে হো-হো করে হাসতে শুরু করলো। লিলির হাসতে-হাসতে চোখ ভিজে উঠেছে - এক সময় হাসি তামিয়ে চোখ মুচতে-মুচতে লুলুর দিকে একবার তাকালো। লুলু আগের মতই বিস্ময় দৃষ্টিতে লিলির দিকে তাকিয়ে আছে, দৃষ্টি একেবারে স্থির, যেন বজ্রাহত। লিলি, ‘সরি নিজের কথায় নিজেই হাসলাম’! এবার লুলুর হাতের উপর হাতটা রেখে আলতোভাবে একটা চাপ দিয়ে, ‘সত্যি বলতে কি ছেলেটা আমাকে একেবারে পাগলই করে দিল! ইনিয়ে-বিনিয়ে নিজের ভালবাসার কথা কতবার যে বলেছি - সে যেন কিছুই বুঝে না - আসলেই বুঝে না নাকি বুঝেও না বুঝার ভান করে তাও বুঝি না! রাগে-ক্ষোভে কতবার যে মনে-মনে বিড়-বিড় করে বলেছি, ‘বেটা আস্ত নপুংসক!’ ওই যে বললাম, আমাকে পাগল করে দিয়েছে; যে পাগলামিতে আমি আমার লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে বসেছি, অনেকবার ভেবেছি ওকে বলবো, ‘সুপন তোমাকে না পেলে আমি আত্মহত্যা করবো! জানি তুমি মনে-মনে ভাবছো একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর মুখে এ-কথা বেমানান- এ-ধরনের সংলাপ বরং স্কুলছাত্রীর সাথেই ভাল যায়; তাও বলতাম যদি কাজ হতো, জানি এ-কথা বললে সে আমাকে নিশ্চিতভাবেই শুনিয়ে দিত- বিশ্বসাহিত্যে এ-পর্যন্ত আত্মহত্যা নিয়ে কয়টি গল্প-উপন্যাস রচিত হয়েছে, এগুলোর একটা মিনি ম্যারাতন বিশ্লেষণ - এদিকে আমার অবস্থা দিনকে দিন খারাপের দিকেই যাচ্ছিল। শয়নে-স্বপ্নে, দিবা-নিশি সুপনই হয়ে উঠল আমার একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান। যতণ তার কাছে থাকি মনে হয়, আহ্! পৃথিবী কত না সুন্দর, বিচ্ছিন্ন হলেই নেমে আসত বিষাদের ছায়া! তোমাকে তো প্রথমেই বলেছি, সুপন ছিল চিত্রকলার ছাত্র, ছাত্রাবস্থা থেকেই সে নিয়মিত আঁকতো, তার বিষয় ছিল নিসর্গ; আর নিসর্গের কথা বললে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন জুড়ি নেই! পাহাড় আর অরণ্যবেষ্টিত ক্যাম্পাসে এমন স্থানও ছিল যেখানে একা তো কথাই নেই, দলবেঁধে যেতেও ভয় করবে! অথচ সে নির্জন পাহাড়ে সুপন সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে একা-একা চলে যেত ছবি আঁকতে, সে দিন আর আমার চোখে ফাঁকি দিতে পারেনি - আমিও চোখ কান খোলা রেখেছিলাম আজ তার সাথে যাবই! আমি যে তার পিছু নিয়েছি এটা সুপন গন্তব্য পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত বুঝতেও পারেনি, গন্তব্যে পৌঁছে যেই তুলির আঁচড় দিচ্ছে, অমনে তার সামনে গিয়ে হাজির হলাম - হিংস্র জন্তু দেখার মতই আমাকে দেখেই আৎকে উঠল! কিছুণ বিস্ময়ভরে তাকিয়ে তাকার পর, ‘সে-কী, তুমি এখানে কী করে?’
- পায়ে হেঁটে
- মানুষ তো হাঁটার কাজটা পা দিয়েই করে, কিন্তু এলে কেন?
- আপনার সাথে সময় কাটাতে।
সুমন লিলির কথার কোন জবাব না দিয়ে একটু ম্লান হাসি দিয়ে তার আঁকার কাজেই মনোযোগ দিল। এদিকে আমি কিন্তু অস্থির হয়ে উঠছি - তুমিই বল, এই অবহেলা একজন তরুণীর জন্য কতটা অপমানকর? তার মনোযোগের নানা চেষ্টা করলাম - কোন কাজেই হলো না। আমারও সহ্যের সীমা অতিক্রম করল! অস্থিরতার চূড়ান্ত রূপ নিল - ঝাঁপিয়ে পড়লাম তার বুকে! সুমন, ‘এ-কি! বোকা মেয়ে, ছাড়-ছাড়’ - আমি নাছড়বান্দা, একসময় ধস্তা-ধস্তিতে দু-জনেই মাটিতে চিৎ হয়ে পড়ে গেলাম - আবারও দু-জন যখন উঠে বসলাম, আমি আমার মকসুদ হাসিলের আত্মতৃপ্তিতে আত্মহারা; আর সুপন সম্ভ্রমহানির লজ্জায় দু’হাটুর নিচে মুখ গুজে বসে আছে। সারা জীবন শুনেছি লজ্জা নারীর ভূষণ, এই প্রথম উপলব্ধি করলাম লজ্জা পুরুষকে কতটা পৌরুষদীপ্ত আর আত্মমর্যাদাশীল করে তুলে। আমি নিশ্চিত, এ-কথা সুপন কাউকে বলেনি, কারণ তার মতো পুরুষের কাছে এটা গৌরব করে বলে বেড়ানোর মতো বিষয় নয়, আর একজন নারী হিসেবে আমি বলতে পারি, এমন আত্মর্মযদাবান পুরুষই যে কোন নারীর আজীবনের ধ্যান-জ্ঞান। কথাগুলো বলেই লুলুর দিকে মনোযোগ দিল লিলি। বিমূঢ় লুলু, যেন মানুষ নয় মাটির পুতুল! চোখের পলক পড়ছে না, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে লিলির দিকে; দীর্ঘ বয়ান দিল লিলি- অথচ সারা মুখে বিন্দু-বিন্দু ঘাম জমে গেছে লুলুর - লিলি এবার খাট থেকে নেমে, টেবিলের উপর রাখা মগ থেকে ঢেলে এক গ্লাস পানি খেল, তারপর স্বামীর কাছে বসে হাতের উপর আলতোভাবে হাত রেখে বললে, সেই বাসর ঘর থেকেই তোমার এ-তত্ত্বমাখা কথাগুলো শুনে আসছি, কিছুতেই যেন এ-কথা শেষ হতে চায় না; টেলিভিশন চ্যানেলের ম্যাগাসিরিয়ালের মতো কতদিন চলবে,তাও ঠিক বলতে পারছি না - তবে আমার একটা অনুরোধ রাখ, কাল যত খুশি তোমার তত্ত্ব কথা আরো বলো, আমি মনোযোগ দিয়ে শুনব; কিন্তু আজকের মতো আমাকে মা করতে হবে - মাথাটা বড্ড ধরেছে একটু ঘুমাতে চাই, কথাটা বলেই লিলি কোন উত্তরের অপো না করে হাত বাড়িয়ে বেট সুইস ধরে বাতিটা নিবিয়ে দিল; সঙ্গে-সঙ্গেই এতণ আলো ঝলমলে ঘরটাই নেমে এল ঘুট-ঘুটে অন্ধকার! লিলি চাদরমুড়ি দিয়ে শুয়ে পরল। চাদর মোড়ানো অবস্থায় লিলি স্পষ্ট টের পাচ্ছে লিলির অস্থিরতা! লুলু বেশ কিছুণ পায়ে-পায়ে ঘষাঘষি এপাশ-ওপাশ করে এক সময় আবারও শোয়া থেকে উঠে বসল, তারপর বাতিটা জ্বালিয়ে হাত বাড়িয়ে আলতোভাবে লিলির মুখ থেকে চাদরটা সরিয়ে দিল। লিলি আগের মতই নিদ্রার ভনিতায় চোখ বুঝে আছে - লুলু বেশ কিছুণ স্ত্রী লিলির দিকে নীরবে তাকিয়ে থাকার পর; বাহু ধরে ডাকতে শুরু করলো, ‘লিলি ঘুমিয়েছ, লিলি...?’ প্রথম দু’ডাকে লিলি সাড়া দিল না, তৃতীয় ডাকে লিলি পো শঙ্খচূড়ার মত লাফিয়ে উঠে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু লুলুর বিধ্বস্ত মুখের দিকে নজর পড়তেই নিজেকে সামলে নরম কণ্ঠে বললো, ‘কী কিছু বলবে?’ লুলু লা-জবাব, বাকরুদ্ধ লুলুর সারা মুখে বিন্দু-বিন্দু ঘাম! লুলুর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলার জন্য অপোমাণ আসামি! লিলি আবারও জিজ্ঞেস করল, কী কিছু বলবে, না কী ঘুমিয়ে পড়ব? লুলু এবার লিলির হাত চেপে ধরে, পাগলের মত কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে উঠল, প্লিজ লিলি তুমি আমাকে একবার বল, এতণ আমাকে যা বলেছ সব মিথ্যা, সব তোর বানানো গল্প, আমাকে আহত করার জন্য তুমি গল্প ফেঁদেছো। সুপন বলে, ‘কোন পুরুষের অস্থিত্ব তোমার জীবনে ছিল না, আমিই তোমার জীবনের প্রথম পুরুষ আমিই শেষ!’ কথাগুলো বলতে-বলতে লুলুর বাকরুদ্ধ হয়ে আসছে। লিলি লুলুর হাতের বন্ধন থেকে নিজের হাত দুটোকে ছাড়িয়ে নিয়ে এক চিলতে রহস্যময় হাসি দিয়ে শান্ত কণ্ঠে বললো, ‘ছেলেমানুষি করো না, রাত অনেক হয়েছে; এখন ঘুমিয়ে পড়।’ কথাটা বলেই লিলি আবারও বাতিটা নিবিয়ে চাদরমুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল। এই গুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যেই লিলি স্পষ্ট বুঝতে পারছে লুলুর অস্থিরতা। স্বামীর অস্থিরতার দৃশ্য কল্পনা করে লিলির নিঃশব্দ হাসি যেন কানের লতি ছুঁতে চায় !
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে এপ্রিল, ২০১২ রাত ৮:০৫
৫টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×