পুরো বাসে একটা সিট ফাঁকা। আসলে পুরো সিট না। আংশিক। পাশের সিটে যিনি, তার দখলে দেড়খানা সিট। কাছে যেতেই হেভি ওয়েটের লোকটি হে হে হাসি দিয়ে বললো ‘বসুন বসুন’।
কোটা সংস্কারের দাবিতে অবরোধ শেষে সড়ক মাত্র খুলেছে। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, ‘কোটা থাকবে না।’ বাসের মধ্যেও চাপা খুশি। অনেকেই খুশি না। একজন বললনে, 'এইটা কেমুন কথা! এট্টু এট্টু কোটা না থাকলে কিরাম হবে! পোলাপান তো হালকা পাতলা বৃষ্টি চাইছে। এখন তো হাতে ঝড় তুফান ধরায় দিছে।'
লম্বা পথ। বসাই উচিৎ। হেভি ওয়েট লোকটি একটু নড়েচড়ে যায়গা দিতে চাইলেন। তাতে হোৎকা ভুড়িটা দোল খেলো শুধু, যায়গা বাড়লো না। বসে পরলাম। বসা মানে নিতম্বখানা কোনোমতে সিটে লাগিয়ে ডান পা’টাকে বাঁশের খুটি বানিয়ে শরীরটাকে আটকে রাখলাম।
সামনে ফাঁকা। বাসচালক কষে টান দিলেন। বাড্ডা রোডে যে ছোট ছোট পুকুর আছে সেই পুকুড়ের দিকে তার খেয়াল নাই। ২০টাকায় জার্নিতে দু’শ টাকার রোলার কোস্টারের স্বাদ পাচ্ছি। কিছু যাত্রী বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। কপাল ফাঁটার রিস্ক নিতে চাচ্ছেন না।
আমার অবস্থা আরও খারাপ। এমনিতে একপেশে হয়ে আছি। এর মধ্যে কষে ব্রেক। দাঁড়িয়ে পরলাম। হেল্পার বললেন, ‘সামনে বিশাল জাম। গাড়ি ঘুরবো সবাই নামেন। ওস্তাদ সামনে চিপা দিয়া ঢুকাইয়া বামে নেন টিরিপ কেন্সেল।’
আল্লাহ ভরসা । নেমে পরলাম।
ফুটপাতে তরমুজের দোকান। সব্জির দোকানও আছে। রড,লোহা লোড-আনলোড হচ্ছে, বাইক মেরামতও হচ্ছে ফুটপাতে। পেঁয়াজু ভাজা হচ্ছে। গরম গরম পেঁয়াজু। আমার সামনের লোক হঠাৎ দাড়িয়ে ১০টা পেঁয়াজুর অর্ডার দিলেন। আমি শরীর বেঁকিয়ে একবার রাস্তায় নামি একবার ফুটপাতে উঠি।
শত শত লোক হাঁটছেন । সবাই একবার রাস্তায় নামছেন একবার ফুঁটপাতে উঠছেন। আসলে ফুটপাত বলে কিছু নাই। সবই দখলে।
কেউ একজন বললো, 'ছাত্ররা কবে ফুটপাত দখলের বিরুদ্ধে আন্দোলন করবে? আরেহ এ তো সেই লোক, যিনি বাসে আমার পাশে ছিলেন। প্রশ্নটা তিনি আমাকেই করেছেন।
'ফুটপাত দখলমুক্ত করতে আন্দোলন কবে করবেন?' এবার সরসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লেন তিনি। আমি একটা হে হে হাসি দিলাম। উত্তর দিতে পারলাম না। কি উত্তর দেবো??
আসলে আন্দোলনের সাথে পেটের সম্পর্ক থাকতে হয়। রুটি রুজীর সম্পর্ক থাকতে হয়। তবেই আন্দোলন গণআন্দোলন হয়। দখলমুক্ত ফুটপাত তো নাগরিক অধিকার। এই নিয়ে আন্দোলন হবে না। বাংলাদেশে তো আরও না!
আমি দ্রুতপায়ে হাঁটছি। মুক্ত ফুটপাত সড়কের আন্দোলন শুরু হলে কেমন হবে তাই ভাবছি। মনে মনে দুই একটি স্লোগানও বানিয়ে ফেললাম। হঠাৎ সামনে খোলা ড্রেন। স্লাব উঠিয়ে উন্নয়ন কাজ চলছে। আমি পরতে পরতে বেঁচে গেলাম।
কিছুদিন আগে পল্টনে ড্রেনে পরে গেছিলো একজন। পরে তার লাশ পাওয়া গেছে। লোকটিকে পাওয়া যায়নি। আমি তো ভাগ্যবান!
এই ভাবতে ভাবতে স্লোগানগুলো ভুলে গেলাম। পরে অনেক ভেবেও স্লোগানগুলো পেলাম না। আহারে আমার স্লোগান!
এ শহরে স্লোগানগুলো হারিয়ে যায়। আমি হারিয়ে যাওয়া স্লোগানের আবেশ বুকে হাঁটছি। হেঁটেই চলছি।