somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

০৮ ই নভেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পঞ্চম পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-(৫)

আজিজিয়ায় আমাদের হোটেলে আমি ও আমার ছেলে ছাড়াও অপর যে তিনজন হাজ্জ্বী মিলে আমরা পাঁচ শয্যার কক্ষটি ভাগাভাগি করে নিয়েছিলাম, তাদের সম্বন্ধে কিছু কথা আগের পর্বেও বলেছিলাম। তার অতিরিক্ত ওদের আরও কিছু গুণাবলী আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল বলে সে কথাগুলোও এখানে বলে নিচ্ছি, কেননা এক মুসাফিরের সৎকর্মের কথা অপর মুসাফিরকে প্রেরণা যোগাতে পারে। জনাব ফুয়াদ তানভির তার নিকটাত্মীয়া দুইজন বয়স্কা মহিলার মাহরাম হিসেবে গিয়েছিলেন। তিনি পুরোটা সফরে তাদের দুইজনের এবং তার নিজের ব্যাগগুলো হাতে, কাঁধে ও পিঠে বহন করেছেন। এর পরেও তিনি সুযোগ পেলেই আমার হাতের ব্যাগ নিয়েও টানাটানি করেছেন বহন করার জন্য। আরব মরুভূমির দেশে জুন মাসের সর্বোচ্চ গরমের সময় তার এ নিঃস্বার্থ কায়িক শ্রম এবং আত্মত্যাগ আমার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছে। জনাব নূরুজ্জামান খান এর সহৃদয়তার কিছু কথা আমি “মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব-২০২৫-(২)” পর্বে লিখেছি। কিন্তু আজ লিখছি তার অন্য একটা অনন্য গুণের কথা। আমাদের রুমে যে যত ফল আনুক না কেন, ফলগুলো সুন্দর করে কেটে সবাইকে পরিবেশন করতেন জনাব নূরুজ্জামান খান। এ কাজে তিনি বিশেষ পারদর্শিতার অধিকারী ছিলেন। তবে শুধু পারদর্শিতা থাকলেই সবাই এত মনযোগের সাথে এ কাজটি করতে এগিয়ে আসেন না। এর জন্য আগ্রহ থাকতে হয়। তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে স্বেচ্ছায় অনেক আগ্রহের সাথে এ কাজটি করতেন। আজিজিয়া থেকে মক্কায় চলে আসার পরেও তিনি তার এই অসামান্য সার্ভিস আমাদেরকে দিয়ে গেছেন, বিশেষ করে লাঞ্চের সময় যখন মেনুতে ফল থাকতো।

তৃতীয় রুমমেট জনাব তাওফিক আহমেদ চৌধুরী প্রবাল বেশ ঘন ঘন চা পান করতেন। তিনি যখনই চা পান করতেন, সবাইকে জিজ্ঞেস করে নিতেন কে কে চা পান করতে চান। যারা চাইতেন, সবাইকেই তিনি চা বানিয়ে দিতেন। এছাড়া তিনি একজন দক্ষ ফটোগ্রাফার ও ভিডিওগ্রাফার। দর্শনীয় স্থানসমূহ সফরের সময় তিনি ধারা বর্ণনাসহ ভিডিওচিত্র ধারণ করে রাখতেন। ইউটিউবে “টুকটাক গল্প” নামে তার একটি চ্যানেল রয়েছে, যেখানে তিনি তার দেশবিদেশে ঘুরে বেড়ানো নিয়ে গল্প বা ট্রাভেলগ লিখে থাকেন। ওয়াইল্ড লাইফ নিয়েও তিনি লিখেন। এমনিতেও তিনি গল্প করতে ভালোবাসেন। হজ্জ্বের এক মাস যেমন তার মুখে অনেক গল্প শুনেছি, এখন তার ইউটিউব চ্যানেল দেখেও তার কণ্ঠে অনেক “টুকটাক গল্প” শুনে থাকি। এই তিনজন ছাড়া আরও কয়েকজন সফরসঙ্গী হজ্জ্বযাত্রী তাদের আচরণে আমাকে মুগ্ধ করেছেন। তাদের মধ্যে আছেন জনাব মোহাম্মদ এহসানুল হক মজুমদার। অস্ট্রেলিয়ার সিডনী-মেলবোর্নের মাঝামাঝি কোন এক জায়গায় তিনি সপরিবারে বাস করেন। তিনি সিডনী থেকে সস্ত্রীক এসেছিলেন, কিন্তু পুরোটা সময় তিনি আমাদের সাথে থাকতে পারেন নাই। বাচ্চাদেরকে অস্ট্রেলিয়ায় রেখে এসেছিলেন বলে হজ্জ্বের পরে পরেই তিনি সিডনী ফেরত চলে গিয়েছিলেন। তিনি অসামান্য একজন সহৃদয় ব্যক্তি। যখনই আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছে, তখনই তিনি আন্তরিকভাবে কুশলাদি জিজ্ঞেস করেছেন এবং উভয়ের কমন ইন্টারেস্ট এর বিষয়াদি নিয়ে আলাপ আলোচনা করেছেন। লন্ডন থেকে দুই ভাই আর তাদের বাবা এসেছিলেন। ঐ দুই ভাইয়ের মধ্যে যে কে কার চেয়ে বেশি ভালো ছিল তা নিরুপণ করা কঠিন। ওরা যে কোন ব্যাপারে সাহায্যের জন্য ভলান্টীয়ার ছিল। ওদেরকে কোন সাহায্যের ব্যাপারে কখনও কোন অনুরোধ জানাতে হতো না। ওরা নিজেরা দেখেই এগিয়ে আসতো। জনাব সরোয়ার এবং তার স্ত্রী জেনি উভয়ে ছিলেন ভীষণ পরোপকারী ব্যক্তি। ফিরে আসার আগের রাতে জনাব সরোয়ার একাই আমার সবগুলো লাগেজের ওজন পরীক্ষা করে ওকে করে দিয়েছিলেন এবং ওজনের ব্যাপারে আমার অনুমানের প্রশংসা করেছিলেন। তার স্ত্রীও “রিয়াজুল জান্নাত” দর্শনের ব্যাপারে আমার স্ত্রীকে অনেক সাহায্য করেছিলেন। এরা সবাই একেকজন উজ্জ্বল প্রফেশনাল ক্যারীয়ারের অধিকারী। তথাপি এরা প্রত্যেকেই কি সুন্দর করেই না সাংসারিক এবং অন্যান্য বিবিধ গুণও রপ্ত করেছেন!

০৫ জুন ২০২৫ তারিখে আমাদেরকে বাসে করে মিনায় নিয়ে আসা হলো। যেহেতু আমি এর পূর্বেও বিশ বছর আগে একবার হজ্জ্ব পালন করেছিলাম, সেহেতু মিনা ও আরাফাতে অবস্থানকালে আমাদেরকে মানসিকভাবে কী কী প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে, সে ব্যাপারে আমার মোটামুটি একটা ধারণা ছিল। কিন্তু আমার স্ত্রী এবং ছেলের জন্য এবারেই প্রথম হজ্জ্ব পালন ছিল বিধায় তাদের কোন ধারণা ছিল না। আমি যতটুকু পেরেছি, বলেছি। আমরা এতদিন ছিলাম আমাদের বাংলাদেশি মুয়াল্লেম বা এজেন্সী’র (জনাব শাহীন) প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। বাংলাদেশ থেকে হাজ্জ্বী নিয়ে আসা তার মত আরও অনেক এজেন্সী মিলে একজন সৌদি মুয়াল্লেমের অধীনে তার লোকজনের নির্দেশমত কাজ করতেন। মিনায় গিয়ে মনে হলো, অনেকগুলো নদীর স্রোতধারা যেমন সাগরে নিপতিত হবার আগে একটি মোহনায় এসে মিলিত হয়, তেমনি মিনাও যেন বিভিন্ন দেশীয়, বিভিন্ন ভাষাভাষী, বিভিন্ন সংস্কৃতির হাজ্জ্বীদের এক মোহনা। তবে চেষ্টা করা হয়ে থাকে একই তাঁবুতে যেন একই ভাষাভাষী হাজ্জীগণ অবস্থান করতে পারেন। এতে অনেক প্রশাসনিক জটিলতা এড়ানো যায়। আমরা যে তাঁবুতে অবস্থান নিয়েছিলাম, সেখানকার অন্যান্য সকল হাজ্জী ছিলেন বাংলাদেশ থেকে আগত, বিভিন্ন এজেন্সী’র অধীনে। বিভিন্ন দল উপদলের পৃথক নেতা ছিলেন, যাদের হাতে হ্যান্ডমাইক ধরা ছিল এবং তারা কারণে অকারণে সেটার যথেচ্ছ অপব্যবহার করছিলেন। তাদের উচ্চঃস্বরে শব্দদূষণ অন্যান্য হাজ্জ্বীগনের জন্য কোন অসুবিধার কারণ হচ্ছে কিনা, সেদিকে তাদের ভ্রূক্ষেপ ছিল না। তারা মাইকে যেসব ওয়াজ নসিহত করছিলেন, হজ্জ্বের প্রাথমিক জ্ঞান হিসেবে সেগুলো সকল হাজ্জ্বীর জানার কথা। তথাপি তারা অন্যের অসুবিধা করে হলেও তাদের তথাকথিত নেতৃত্বের (এবং অর্বাচীনতার) স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছিলেন।

মিনায় হাজ্জীদের শোবার জন্য একটি করে কুশন বা ফোমের বিছানা (তোষক) বরাদ্দ ছিল। সেটা পরিষ্কার সাদা চাদর দ্বারা আবৃত ছিল। লক্ষ লক্ষ হাজ্জ্বীর জন্য এ বিশাল আয়োজন করা সহজ কথা নয়, তাই হজ্জ্বের সময় এ নিয়ে কারও কোন অভিযোগ বা আপত্তিও থাকে না, কারণ সবাই এটা সহজেই উপলব্ধি করতে পারে। ঐ ফোমের বিছানায় সহজেই একজন হাজ্জ্বী চিৎ হয়ে শুয়ে ঘুমাতে পারেন, কিন্তু সমস্যা হয় যখন তিনি পাশ ফিরতে চান। পাশ ফিরতে চাইলে শরীরটাকে তোষক থেকে একটু আলগা করে তবে পাশ ফিরতে হবে, গড়িয়ে পাশ ফেরা যাবে না। অন্যথায় নিজ দেহটা আপন সীমানা পেরিয়ে অন্যের বিছানায় গড়িয়ে যেতে পারে। আরেকটা অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় যখন ওয়াশরুমে কিংবা অন্যত্র যাবার জন্য তাঁবুর বাইরে বের হতে হয়। তখন খুব সাবধানে পা ফেলে এগোতে হয়, নতুবা ঘুমন্ত মানুষের পায়ে পা লেগে হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যাহোক, এইসব অসুবিধাকে কোন হাজ্জ্বীই বড় করে দেখেন না। সবাই সব অসুবিধা মানিয়ে নিয়ে নিজ নিজ উপায়ে শান্তির সাথে সমাধান খুঁজে বের করেন।

অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা মিনার সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার সাথে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নিলাম। জনসংখ্যার চাপের কথা বিবেচনায় রাখলে বলা যায় যে ওয়াশরুম/টয়লেট এবং অজুখানা’র ব্যাবস্থাপনা উত্তম ছিল। নামাজের ওয়াক্তসমূহে ভিড়ের সময়েও লাইনে অপেক্ষা করার সময়সীমা সহনীয় পর্যায়ে ছিল। তার পরেও যদি কারও খুব জরুরী প্রয়োজন দেখা দেয়, তবে অন্যান্য হাজ্জ্বীগণ তাকে স্বেচ্ছায় ছাড় দিয়ে লাইনে অগ্রবর্তী করে দিয়েছেন। পরের দিন আরাফাতের ময়দানে অবস্থানের সময় সেখানকার ব্যবস্থাপনা মিনা’র মত এত ভালো নাও হতে পারে, মনে মনে এ রকমের একটা মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে হাতে যতটা সময় পেলাম, ইবাদতে মনোনিবেশ করলাম।

ঢাকা
০৮ নভেম্বর ২০২৫
শব্দ সংখ্যাঃ ৯৮৭

পরের পর্বের লিঙ্কঃ

সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই নভেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৫৮
৭টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কোরআন-হাদিস অনুযায়ী তারা পাকিস্তান এবং অন্যরা অন্যদেশ

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:২১



সূরাঃ ৮ আনফাল, ৬০ নং আয়াতের অনুবাদ-
৬০। তোমরা তাদের মোকাবেলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ব-বাহিনী প্রস্তত রাখবে। এর দ্বারা তোমরা সন্ত্রস্ত রাখবে আল্লাহর শত্রুকে, তোমাদের শত্রুকে, এছাড়া অন্যদেরকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি আর এমন কে

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:১৩


যখন আমি থাকব না কী হবে আর?
থামবে মুহূর্তকাল কিছু দুনিয়ার?
আলো-বাতাস থাকবে এখন যেমন
তুষ্ট করছে গৌরবে সকলের মন।
নদী বয়ে যাবে চিরদিনের মতন,
জোয়ার-ভাটা চলবে সময় যখন।
দিনে সূর্য, আর রাতের আকাশে চাঁদ-
জোছনা ভোলাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

২০২৪ সালের জুলাই মাস থেকে যেই হত্যাকান্ড শুরু হয়েছে, ইহা কয়েক বছর চলবে।

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪৭



সামুর সামনের পাতায় এখন মহামতি ব্লগার শ্রাবনধারার ১ খানা পোষ্ট ঝুলছে; উহাতে তিনি "জুলাই বেপ্লবের" ১ জল্লাদ বেপ্লবীকে কে বা কাহারা গুলি করতে পারে, সেটার উপর উনার অনুসন্ধানী... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজাকার হিসাবেই গর্ববোধ করবেন মুক্তিযোদ্ধা আখতারুজ্জামান !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:১৮


একজন রাজাকার চিরকাল রাজাকার কিন্তু একবার মুক্তিযোদ্ধা আজীবন মুক্তিযোদ্ধা নয় - হুমায়ুন আজাদের ভবিষ্যৎ বাণী সত্যি হতে চলেছে। বিএনপি থেকে ৫ বার বহিস্কৃত নেতা মেজর আখতারুজ্জামান। আপাদমস্তক টাউট বাটপার একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:১৫


((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×