চতুর্থ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-(৪)
চলে এলাম আজিজিয়ায়, নতুন হোটেলে অবস্থান গ্রহণঃ
০১ জুন ২০২৫ তারিখে আজিজিয়ায় আমাদের হোটেলে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত হয়ে গেল। হোটেলটির নাম ছিল “আত-ত্বারিকি বিল্ডিং”। এটা উত্তর আজিজিয়ায়, সাব-মিউনিসিপালিটি অফিসের পেছনে অবস্থিত। হোটেলটি হুজ্জাজদের জন্য বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। এখান থেকে পায়ে হেঁটেই হারাম শরীফ ব্যতীত হজ্জ্বের অন্যান্য Key Point গুলোতে যাওয়া যায়। এছাড়া দৈনিক পাঁচ ওয়াক্তিয়া নামাযের জন্য হোটেলের কাছেই একটা বড় মাসজিদ আছে। খাবার দাবারের দোকান-পাটও হোটেলের আশেপাশেই আছে। এজেন্সি কিংবা হোটেল কর্তৃক সরবরাহকৃত খাবারের বাইরে হাজ্জী সাহেবগণ নিজের স্বাদ ও পছন্দ অনুযায়ী কিছু কিনে খেতে চাইলে সহজেই এসব খাবারের দোকানের মেনু অনুযায়ী খেতে পারেন। দলের সকলের সম্মতিক্রমে আজিজিয়ার হোটেলে মহিলা এবং পুরুষ হাজ্জীগণের জন্য পৃথক পৃথক কক্ষ বরাদ্দ করা হয়। শান্তিপূর্ণ এই বিভাজনে মহিলারাও খুশি ছিলেন, আমরাও। একেকটি কক্ষ সাইজ অনুযায়ী ৩/৪/৫ জনের জন্য বরাদ্দ করা হয়। আমার এবং আমার ছেলের সাথে আরও তিনজন যোগ করে মোট ৫ জনের জন্য আমাদেরকে কক্ষটি বরাদ্দ করা হয়। আমরা দ্রুত নিজস্ব বোঝাপড়ায় আমাদের অবস্থান গ্রহণ করলাম এবং বিছানা বেছে নিলাম। যথাসময়ে লাগেজ আমাদের রুমে পৌঁছে গেল।
নতুন মুখ, নতুন বন্ধুত্বঃ
আমাদের রুমমেটদের মধ্যে আমি ও আমার ছেলে ব্যতীত অপর তিনজন ছিলেন জনাব ফুয়াদ তানভীর, জনাব নূরুজ্জামান খান এবং জনাব তাওফিক আহমেদ চৌধুরী প্রবাল। প্রথোমোক্ত জনের সাথে ঢাকায় এজেন্সী কর্তৃক নির্ধারিত চূড়ান্ত সমন্বয় সভায় দেখা হয়েছিল, তার মুখে পরিচিতিমূলক কিছু কথাও শুনেছিলাম। দ্বিতীয়জন সম্ভবতঃ সেদিনের সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন না, তবে রওনা হবার দিনে তার সাথে বিমানবন্দরে টুকটাক আলাপচারিতা হয়। আমরা একই সারিতে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে চেক-ইন করেছিলাম। এ ছাড়া মদিনা শরীফে অবস্থানকালীন সময়ে ‘রিয়াজুল জান্নাত’ প্রথম দর্শনের সময় ওনার সাথে নিবিড় ইন্টার-অ্যাকশন হয়, সে কথা আগেও “মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব-২০২৫-(২)” পর্বে সবিস্তারে উল্লেখ করেছি। তৃতীয় জনকে মদিনা শরীফে অবস্থানকালীন সময়ে মাসজিদে নবুবীতে যাতায়াতের পথে কিংবা হোটেল লবীতে মাঝে মাঝে দেখেছি, হয়তো সামান্য কিছু কথাবার্তাও হয়েছে, কিন্তু তার স্ত্রীর সাথে আমার স্ত্রীর পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে যাবার পথে মাঝে মাঝে একসাথে যেতে যেতে এবং একই স্থানে অবস্থান করাতে ভালো আলাপ পরিচয় হয়েছিল।
নানা প্রতিভায় মেধাবী মানুষ, ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বলঃ
আমাদের যে তিনজন রুমমেট এর কথা উপরের অনুচ্ছেদে লিখেছি, এরা প্রত্যেকেই একেকজন নানা প্রতিভায় মেধাবী মানুষ, আচরণে আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল। এত কম বয়সেই এরা সবাই একেকজন কর্পোরেট জগতের সম্মানীয় পদস্থ কর্মকর্তা, উজ্জ্বল নক্ষত্র। বয়সে এরা আমার বড়ছেলের সমবয়সী হবে বলেই আমার ধারণা, হয়তো কেউ তার চেয়ে দুই এক বছরের বড়ও হতে পারে। সেই হিসেবে এরা সবাই আমার পুত্রবৎ। আর হয়তো সেটা বিবেচনা করেই এরা আমাকে অনেক সম্মান দিয়েছে, একই রুমে থেকে আমার যেন কোন অসুবিধে না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে অনেক ছাড় দিয়েছে। যেমন, রুমে ঢুকেই প্রথম দুটো বিছানা ওরা আমাকে আর আমার ছেলেকে দিয়েছে, যেন পাশাপাশি বিছানায় থেকে প্রয়োজনে আমি আমার ছেলের কাছ থেকে টুকটাক সাহায্য পেতে পারি। ৫ জনের কাপড়-চোপড় রাখার জন্য মাত্র একটা ward-robe ছিল; সেটার সিংহভাগ অংশই এরা আমার ব্যবহারের জন্য ছেড়ে দিয়েছিল। বয়সের কারণে আমার ওয়াশরুম ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা ওদের চেয়ে একটু অধিক ছিল, সেই স্পর্শকাতর বিষয়টির প্রতি ওরা খুব সংবেদনশীল ছিল। প্রত্যেকেই ওয়াশরুম ভিজিটের পূর্বে খেয়াল রাখতো, আমার কোন আশু প্রয়োজন রয়েছে কিনা। সেটা ওরা বিনয়ের সাথে জিজ্ঞাসা করে নিত।
মোটকথা, হজ্জ্বের স্পিরিটটাকে এরা চিন্তা চেতনায় ধারণ করে পুরোপুরি আত্মস্থ করে, পূর্ণ মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে হজ্জ্বে যোগদান করেছিল। শুধু এই তিনজনই নয়, আমি অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করেছি, আমাদের গ্রুপে এদের সমবয়সী যারাই ছিল, তারা প্রত্যেকেই এদেরই মত সংবেদনশীল মনের অধিকারী ছিল এবং প্রত্যেকেই সচেষ্ট থাকতো, একে অপরের প্রতি স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সহায়তার হাত প্রসারিত করে দিতে। এমন কি, গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোতে ওয়াশরুমে অপেক্ষার লাইন দীর্ঘ হলে এরা নিজেদের রুম খুলে অন্যদেরকে ডেকে নিয়ে যেত আশু প্রয়োজন মেটানোর জন্য। কোন মুরুব্বীর হাঁটতে, এহরাম সামলাতে কোন অসুবিধে হচ্ছে, এমন কিছু লক্ষ্য করলে এরা সাথে সাথে এগিয়ে আসতো সাহায্য করতে। প্রচণ্ড দাবদাহেও নিজের মাথাকে হাতে ধরা ছাতার বাইরে রেখে ছাতাহীন অন্যকে অকাতরে ডেকে নিয়ে ঠাঁই দিয়েছে নিজ ছাতার আশ্রয়ে। এইসব হৃদয়স্পর্শী আন্তরিকতার জন্য এরা প্রত্যেকেই আমার অন্তরে চিরস্থায়ী আসন গড়ে নিয়েছে। দয়াময় আল্লাহ রাব্বুল ‘আ-লামীন এদের প্রত্যেকের এই ইহসানগুলোকে ক্ববুল করে নিয়ে এর যথাযোগ্য বিনিময় দান করুন! এর আগে আমি আমার জীবনের প্রথম হজ্জ্ব পালন করেছিলাম আজ থেকে ২০ বছর আগে। তখন আমার বয়স ছিল এখনকার চেয়ে ২০ বছর কম। বলতে দ্বিধা নেই, তখন তো আমি আমার চেয়ে বয়স্কদের প্রতি এদের মত এতটা পরোপকারী কিংবা সংবেদনশীল হতে পারিনি!
হজ্জ্বের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবার পূর্বে তিন দিনের বিশ্রামঃ
আমাদের এজেন্সী তথা স্বদেশী মু’য়াল্লেম জনাব আবদুল্লাহ আল মাহবুব শাহীন আমাদেরকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন আজিজিয়াতে ০২, ০৩ ও ০৪ জুন, এই তিনটি দিন পূর্ণ বিশ্রাম নিয়ে, পরবর্তী তিন দিনব্যাপী কঠোর শারীরিক পরিশ্রমের জন্য (যেমন মানুষের ভিড় ঠেলে হাঁটা, হাঁটার সময় জনস্রোত ও হুইলচেয়ারের ধাক্কা সামলানো, ইত্যাদি) মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রস্তুত থাকতে। হজ্জ্বের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়ে গেলে স্বদেশী মু’য়াল্লেমদের আর করার বা বলার কিছু থাকে না। প্রত্যেক হাজ্জীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ চলে যায় সৌদি মুয়াল্লেম, সৌদি পুলিশ এবং সৌদি হজ্জ্ব মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য স্টাফদের অধীনে। তখন যেথায় যথা আদেশ আসে, সেথায় তথা চলতে হবে। আবার আদেশ ক্ষণে ক্ষণে বদলাতেও পারে। আমরাও মুয়াল্লেম এর পরামর্শ অনুযায়ী ইবাদত বন্দেগী ব্যতীত বাকিটা সময় যথাসাধ্য বিশ্রামে কাটালাম। তবে ঘড়ির কাঁটার সাথে প্রতিটা আমল বা কর্ম বাঁধা ছিল বলে দেহ-মন-ইন্দ্রিয় এ কয়দিনে টিউনড-আপ হয়ে গিয়েছিল। ০৫ জুন ২০২৫ তারিখে আমাদেরকে আজিজিয়া থেকে মিনায় নিয়ে যাওয়া হবে বলে জানানো হলো। আমরাও তদনুযায়ী অপেক্ষায় থাকলাম হজ্জ্বের প্রতিটি আমলে ব্যাপৃত হতে, সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লার উপর সম্পূর্ণ ভরসা রেখে।
ঢাকা
২০ অক্টোবর ২০২৫
শব্দ সংখ্যাঃ ৮৪০
পরের পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই নভেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৫৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




