ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)
০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন। তাই আরাফাতে পৌঁছেই অধিকাংশ হাজ্জ্বী ব্যক্তিগতভাবে নফল ইবাদতে মশগুল হয়ে গেলেন। উচ্চঃস্বরে ঘন ঘন তালবিয়া এবং নিচুস্বরে তাসবিহ, তাহলিল ও দরুদ শরীফ পাঠ করতে থাকলেন। বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষাভাষী হাজ্জ্বীগণ দলে দলে আরাফাতের ময়দানে এসে জড়ো হতে থাকলেন। তার মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশের হাজ্জ্বীগণকেই দেখলাম, হাতে নিজ নিজ এজেন্সীর পরিচিতি ব্যানার সহকারে বিভক্ত হয়ে তাঁবুর অভন্তরীণ এলাকায় দড়ি দিয়ে সীমারেখা টেনে নিজেদের জন্য জায়গা দখল করে নিতে। হজ্জ্বে এসেও তাদের এ দখলদারী মনোবৃত্তির প্রদর্শন দেখে আমি রীতিমত তাজ্জব বনে গেলাম। তাদের কিছু নেতা ও পাতিনেতার হাতে হ্যান্ডমাইক ধরা ছিল। সেটা দিয়ে মাঝে মাঝেই তারা অনাবশ্যক ওয়াজ নসিহত করতে শুরু করলেন। নিজস্ব ইবাদতে বিঘ্ন ঘটায় এতে অনেক হাজ্জ্বী বিরক্ত বোধ করতে থাকলেন। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েই কয়েকজন হাজ্জ্বী সাহেব তাদের নেতাদেরকে এসব থামাতে বিনীতভাবে অনুরোধ করেছিলেন। এতে অবশ্য কাজ হয়েছিল, তবে প্রবণতাটা মাঝে মাঝেই মাথা চাড়া দিয়ে উঠছিল।
আমার একটা দুশ্চিন্তা ছিল ওয়াশরুম ব্যবহার ও গোসলের ব্যবস্থা নিয়ে। তাই সকাল সকাল ওয়াশরুম ব্যবহার করে গোসল সেরে নিলাম। নিজ হাতে এহরামের কাপড় ধুয়ে নিয়ে রৌদ্রে শুকাতে দিলাম এবং দ্বিতীয় সেটটা পরে নিলাম। সেদিন অত্যধিক গরম পড়েছিল। প্রখর সূর্যতাপে এক ঘণ্টার মধ্যেই এহরামের মোটা কাপড়ও শুকিয়ে গেল। ওয়াশরুম ও গোসলের ব্যবস্থাপনা যতটুকু আশা করেছিলাম, তার চেয়ে ভালোই ছিল। তারপর তাঁবুতে ফিরে ইবাদতে মনোনিবেশ করলাম। যোহর ও আসরের নামায তাঁবুর ভেতরেই জামাত বেঁধে পড়ে নিলাম। মাঝে মাঝে ক্লান্তিজনিত কারণে ঘুমে চোখ বুঁজে আসছিল। দোয়া দরুদ পড়তে পড়তে ন্যূনতম বিশ্রাম নিয়ে পুনরায় উঠে অযু করে ক্ষণে ক্ষণে প্রার্থনায় আত্মনিয়োগ করতে থাকলাম।
মধ্যাহ্নের পর আমরা এসি’র তাঁবু ছেড়ে বের হয়ে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে যে যার মত প্রার্থনা করতে থাকলাম। প্রচন্ড দাবদাহে যেন প্রাণ ওষ্ঠাগত, তথাপি প্রার্থনায় একাগ্রতা আনার জন্য সবাই একটু নিরিবিলি জায়গা খুঁজছিল, যেখানে দাঁড়িয়ে কোন distraction ছাড়াই আপন মনে প্রার্থনা করা যায়। যারা একটু সৌভাগ্যবান, তারা হয়তো কোন গাছের ডালের নিচে একটুখানি সরু ছায়ার আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিল। বাকিদের অধিকাংশই কাঠফাটা রোদে উন্মুক্ত আকাশের নিচে দাঁড়িয়েই দু’হাত তুলে মোনাজাত করছিল। এহরাম পরা অবস্থায় মাথা অনাবৃত রাখতে হয়। ফলে, মাথায় সরাসরি রৌদ্রের তাপ পড়ায় মনে হচ্ছিল যেন মাথার মগজও তপ্ত হয়ে বের হয়ে আসবে। তাঁবুর অদূরে দেখলাম চলৎশক্তিহীন এবং অসুস্থ হাজ্জ্বীগণকে এ্যাম্বুলেন্সে করে তারকাঁটার ওপারে একটি খোলা জায়গায় সমবেত করা হয়েছে যেন তারা আরাফাতের ময়দানে স্বশরীরে উপস্থিত থেকে ইমামের বয়ান শুনতে পান। স্থানীয় এবং প্রবাসী দানশীল ব্যক্তিরা এবং সৌদি হজ্জ্ব মন্ত্রণালয়ের স্বেচ্চছাসেবকরা দফায় দফায় এসে ক্রেটের পর ক্রেট পানি ও সফট ড্রিঙ্কস রেখে যাচ্ছিল সর্বত্র, অতিরিক্ত গরমে তৃষ্ণা নিবারণের জন্য।
আসরের নামাযের পর থেকে সূর্যের প্রখরতা একটু একটু করে হ্রাস পেতে শুরু করলো। প্রায় সকল হুজ্জাজ তখন একে একে তাঁবু থেকে বের হয়ে আশেপাশের এলাকায় পায়চারি করতে করতে প্রার্থনা করতে থাকলেন। কেউ কেউ ক্বিবলামুখি হয়ে এক জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে নিবিষ্ট মনে দোয়া দরুদ পড়তে থাকলেন। এক সময় তাকিয়ে দেখি আমার স্ত্রী ও পুত্রও আমার কাছাকাছিই রয়েছেন এবং তারা তাদের মত করে প্রার্থনা করে যাচ্ছেন। অন্যরাও কেউ কারও সাথে কথা বলছেন না, খুব প্রয়োজনে ইশারা-ইঙ্গিতে কমিউনিকেট করছেন। সময়টা মহামূল্যবান। এ সময়ে বিশ ত্রিশ লক্ষ লোক একসাথে স্রষ্টার নিকট তাদের চাওয়া পাওয়ার আর্জি জানাচ্ছেন। উদ্দেশ্য, স্রষ্টার সন্তুষ্টি ও ক্ষমা এবং ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণ অর্জন।
নিয়মানুযায়ী আরাফাতের ময়দানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সশরীরে অবস্থান করতে হয়। তারপর মুজদালিফার উদ্দেশ্যে রওনা হতে হয়। পথিমধ্যে একটি নির্দিষ্ট মাসজিদে থেমে মাগরিব ও এশার নামায একসাথে পড়তে হয়। যানজট কিংবা লোকজটে আটকে গেলে মুজদালিফা এলাকার যে কোন সুবিধামত একটি জায়গা খুঁজে নিয়ে সেখানে মাগরিব ও এশার নামায একসাথে পড়তে হয়। আমি যখন অনুমান করলাম যে মুজদালিফার উদ্দেশ্যে যাত্রার সময় প্রায় সমাগত, তখন স্ত্রী ও পুত্রকে কাছে ডেকে নিয়ে আমরা একসাথে কিছুক্ষণ মুনাজাত করলাম। ইতোমধ্যে বাসে উঠে আসন গ্রহণ করার আহবান জানানো হলো। আমরা ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে নিয়ে আমাদের জন্য চিহ্নিত বাসে আসন গ্রহণ করলাম। বাস মাগরিবের ওয়াক্তের কাছাকাছি সময়ে মুজদালিফার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। আরাফাত ময়দান ত্যাগের প্রাক্কালে হুজ্জাজগণ অশ্রুসিক্ত নয়নে শেষবারের মত আরাফাতের দিকে তাকিয়ে সমস্বরে তালবিয়া পাঠ করতে লাগলেনঃ “লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাাব্বাইক। লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক! ইন্নাল হামদা, ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক। লা-শারিকা লাক”। অর্থাৎ, “আমি হাজির, হে আল্লাহ, আমি হাজির! আমি হাজির, তোমার কোনো শরীক নেই, আমি হাজির; নিশ্চয়ই যাবতীয় প্রশংসা ও নেয়ামত তোমারই এবং রাজত্বও তোমার। তোমার কোনো শরীক নেই”!
ঢাকা
১৫ ডিসেম্বর ২০২৫
শব্দ সংখ্যাঃ ৬৮৫
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৪৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



