গাফ্ফার চৌধুরী এই দুই সাহাবীর নাম নিয়ে কথা বলার সময় রাদিয়াল্লাহু আনহু (আল্লাহ তাঁর উপর সন্তুষ্ট) শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি। তিনি বরং বলেছেন, রাসুল (সাঃ) ঠাট্টা করে আবু হোরায়রা বলেছেন। রাসুল (সাঃ) তো এভাবে কাউকে নিয়ে কখনো ঠাট্টা করেন নি। তিনি বরং আদর করেই প্রখ্যাত এই সাহাবীকে আবু হোরায়রা বলে সম্বোধন করেছিলেন। আর আবু হোরায়রা (রাঃ)-এর কাছেও সেই সম্বোধনটি ছিলো খুব প্রিয়। তাই এই নামেই তিনি পরিচিত হতে পছন্দ করতেন। রাসুলের পিতার নাম আবদুল্লাহ কী করে হলো? গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর বক্তব্যের স্বপক্ষে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে নিউ ইয়র্কের একটি টেলিভিশনকে বলেছেন, “আল্লাহ নামতো আগে কাফেরদের দেবতার নাম ছিলো। তা না হলে রাসুলের পিতার নাম আবদুল্লাহ কী করে হলো? এটা তো মুসলমান নাম নয়।” আরবে কোথাও কোন দেবতার নাম আল্লাহ ছিলোÑএমন কোন দলিল- প্রমাণ নেই। তাছাড়া গাফ্ফার চৌধুরী বলেছেন, রাহমান, রাহিম, গাফুর এগুলো দেবতার নাম ছিলো। কিন্তু এর পক্ষে তিনি কোন রেফারেন্স কিংবা প্রমাণ উপস্থাপন করেননি। ধর্মীয় বিষয়ে হাদিস ও কোরআনের রেফারেন্স ছাড়া মনগড়া কোন ব্যাখ্যা দেয়া গর্হিত অন্যায়। আল্লাহ শব্দটি আল্লাহতায়ালার মূল নাম। আর আবদুন শব্দের অর্থ বান্দা বা দাস। সুতরাং আবদুল্লাহ নামের অর্থ আল্লাহর বান্দা। রাসুলের (সাঃ) পিতা যদি কাফেরও হয়ে থাকেন তাহলে তার নামটি তো কোরআনিক নাম। একজন কাফেরের ইসলামিক নাম হতেই পারে। যেমনÑ কোন নাস্তিক ব্যক্তির নাম যদি আহমদ শরীফ হয়, তাহলে তাঁর নামটি তো আর নাস্তিক বা কাফের হয়ে যায় না। আহমদ তো মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আরও একটি নাম ছিলো। এখানে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর পিতা-মাতা সম্পর্কে একটি বর্ণনা দিতে চাই। রাসুলের জন্মের ছয় মাস আগে তাঁর পিতা আবদুল্লাহ ইন্তিকাল করেন। আর জন্মের ৬ মাস পরে ইন্তিকাল করেন তাঁর মা আমেনা। তাঁর পিতা-মাতার পরকালীন অবস্থা কী হতে পারেÑ তা দুটি হাদিস থেকে পরিষ্কার হওয়া যেতে পারে। মুসলিম শরীফের ২০৩ নং হাদিসে হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, একদিন রাসুল (সাঃ)-এর কাছে এক ব্যক্তি এসে বললোÑ হে আল্লাহর রাসুল আমার (মৃত) পিতা কোথায়? জবাবে রাসুল (সাঃ) বললেন, দোজখে। এ কথা শুনে লোকটি যখন বেরিয়ে যাচ্ছে তখন রাসুল (সাঃ) তাঁকে ডাকলেন এবং বললেন, নিশ্চয় আমার পিতা ও তোমার পিতা দোজখে। মুসলিম শরীফের ১৭৬৩ নম্বর হাদিসে হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে, একদিন রাসুল (সাঃ) তাঁর মা’র কবর জেয়ারত করতে গেলেন, তিনি সেখানে কাঁদলেন এবং তাঁর সঙ্গীরাও কাঁদলেন। এব্যাপারে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বললেন, আমি আল্লাহর কাছে আমার মায়ের রুহের মাগফেরাতের জন্য দোয়া করতে অনুমতি চেয়েছিলাম, আমাকে দোয়ার অনুমতির পরিবর্তে শুধু কবর জেয়ারত করার অনুমতি দেয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে তোমরা কবর জেয়ারত করো, এতে তোমাদের মৃত্যুর কথা স্মরণ হবে। এই হলো হাদিসের ভাষ্য। তবে এব্যাপারে অর্থাৎ রাসুলের পিতা-মাতা সম্পর্কে কোন ধরনের মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। হিজাবের পরিবর্তে শাড়ি পরা ও কপালে টিপ দেয়া বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার জন্য হিজাব না পরে বরং শাড়ি এবং কপালে টিপ পরতে বলেছেন সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। হিজাব হচ্ছে পর্দার একটি অনুষঙ্গ। ইসলাম আসার আগে আরবে মহিলারা পর্দাহীন চলাফেরা করতেন। এমনকি রাসুলের (সাঃ) স্ত্রীরাও পর্দা করতেন না। পঞ্চম অথবা ৬ষ্ঠ হিজরিতে পর্দার বিধান নাজিল হয়। সূরা আহযাবের ৫৯ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলছেন, “হে নবী, আপনি আপনার স্ত্রীদেরকে, আপনার মেয়েদেরকে ও বিশ্বাসীদের স্ত্রীদেরকে বলুন, ‘‘তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের ওপর টেনে দেয়। এতে করে তাঁদের চেনা সহজতর হবে (তাঁরা যে মুসলমান নারী) এবং তাদের উত্ত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু”। এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর থেকে মূলত মহিলারা নিজেদেরকে আবৃত বা পর্দা করতে শুরু করেন। পর্দা শরীয়তের একটি অর্ডার বা ফরজ বিধান। ফরজ কাজ ছাড়লে শাস্তি প্রাপ্য হয়। তবে কেউ কাফের বা অমুসলমান হয়ে যায় না। কিন্তু যদি কেউ আল্লাহতায়ালার বিধানের ব্যাপারে সাংঘর্ষিক কোন বক্তব্য দেয় অর্থাৎ আল্লাহর আদেশের বিরুদ্ধে কাজ করতে বলে তখন প্রতীয়মান হয় তিনি ফরজকেই অস্বীকার করছেন। হজ কি কাফেরদের দ্বারা প্রবর্তিত? আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর বক্তব্যের স্বপক্ষে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আরও বলেছেন, হজও ইসলামের হজ নয়। এটাও ২ হাজার ৩ হাজার বছর আগে কাফেরদের প্রবর্তিত হজ। ইসলামে পূর্ণ হজরীতি ফরজ হয়েছে ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু হজ তো মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম (আঃ)-এর সময়েও ছিলো। আদম (আঃ) পবিত্র কাবাঘর নির্মাণ করে তওয়াফ চালু করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন নবীর সময়ে বিভিন্ন নিয়মে হজের প্রচলন ছিলো। আজ থেকে প্রায় ৪ হাজার বছর আগে জাতির পিতা ইব্রাহিম (আঃ) হজ পুনঃপ্রবর্তন করেন। পবিত্র কোরআনের সুরা হাজ্জ-এর ২৭ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন “হে ইব্রাহিম, মানুষের মধ্যে হজের ঘোষণা দাও...।” কিন্তু তাঁর ইন্তিকালের পর ধর্মকে বিকৃত করে অনুসারীরা মূর্তিপূজা শুরু করে। চালু করে ভিন্ন প্রক্রিয়ার হজ। কাফেররা উলঙ্গ হয়ে কাবাঘর তওয়াফ করতো এবং সাফা ও মারওয়া পর্বতে দৌড়াতো। আল্লাহতায়ালাই মুহাম্মদ (সাঃ)-এর উপর ওহি নাজিল করে হজের সঠিক পন্থা শিখিয়ে দেন। সুতরাং কাফেরদের হজ অনুসারে হজ প্রবর্তন হওয়ার কোন যৌক্তিকতা নেই। কোন প্রমাণাদিও নেই। কোরআন আল্লাহতায়ালার বাণী। মুহাম্মদ (সাঃ)-এর উপর এটি অবতীর্ণ হয়েছে। কোরআনের কথাগুলো একান্তই আল্লাহতায়ালার। জিবরাইল (আঃ) এসে রাসুল (সাঃ)কে বলেছেন। রাসুল (সাঃ) কথাগুলো মুখস্থ করেছেন। পরে তাঁর সঙ্গীদের জানিয়েছেন। মুসলমানরা দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করেছেন। রাসুল (সাঃ) তাঁর মনগড়া কোন কিছু বলেন নি, করেন নি। এখন কেউ যদি বলেন, হজ কাফেরদের প্রবর্তিত। তাহলে প্রতীয়মান হবে কাফেরদের হজ থেকেই এই বিধান রাসুল (সাঃ) কোরআনে এডাপ্ট (সংযোজন) করেছেন। অর্থাৎ এটি আল্লাহতায়ালার বিধান নয়, মুহাম্মদ (সাঃ) কাফেরদের থেকে এটি প্রচলন করেছেন। আলোচনা আর দীর্ঘ করতে চাই না। অনেক দীর্ঘ হয়ে গেছে। আশাকরি এই আলোচনা বুঝতে সহায়তা করবে সাংবাদিক গাফ্ফার চৌধুরীর বক্তব্য কোরআন-হাদিসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি-না? পাদটীকা: যেহেতু লেখাটি অনেক অমুসলিমও পড়তে পারেন, যাদের কোরআন-হাদিস সম্পর্কে ধারণা নেই তাদের জন্য একটি পাদটীকা সংযোজনের প্রয়োজন বোধ করছি। কোরআনের কথাগুলো একান্তই আল্লাহতায়ালার। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)কে জিবরাইল আলাইহিস সালামের (ফেরেশতা বা দূতের নাম) মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা তাঁর কথাগুলো জানিয়ে দেন। ৬০৯ থেকে ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দীর্ঘ ২৩ বছর সময়ে প্রয়োজন অনুযায়ী সামান্য সামান্য করে ৩০ পারা কোরআন অবতীর্ণ হয়। আর হাদিস হচ্ছে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর বাণী। অর্থাৎ রাসুল (সাঃ) তাঁর জীবনে যেসব নির্দেশনা দিয়েছেন, যেসব কাজ করেছেন অথবা সমর্থন দিয়েছেন সেগুলোই হচ্ছে হাদিস। রাসুলের (সাঃ) জীবনের যাবতীয় কর্মকা- একাধিক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশের হাদিস বিশেষজ্ঞদের মতে সিহাহ সিত্তাহ বা বিশুদ্ধ ছয়টি গ্রন্থ হচ্ছেÑ বোখারী, মুসলিম, তিরমিজি, আবু দাউদ, ইবনে মাজা, নাসাঈ। এই ছয়টির মধ্যে বোখারী ও মুসলিম হচ্ছে সবচেয়ে বিশুদ্ধ হাদিস গ্রন্থ। এ লেখায় আমি বোখারী ও মুসলিম শরীফের বিশুদ্ধ হাদিসগুলোই উল্লেখ করেছি। মুসলমান মাত্র কোরআন-হাদিসের সবগুলো কথা বা নির্দেশনার প্রতি অবশ্যই শতভাগ বিশ্বাস থাকতে হবে। এছাড়াও এ লেখায় কিছু আরবি বাক্যের সংক্ষিপ্ত রূপ রয়েছে। এব্যাপারে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন। যেমন (সাঃ) শব্দটি সংক্ষিপ্ত হয়েছে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে। এর অর্থ ‘আল্লাহতায়ালা তাঁর ওপর শান্তি প্রেরণ করুন।’ (সাঃ) বাক্যটি শুধুমাত্র রাসুলের নাম উচ্চারণের পর বলতে হয়। (রাঃ) শব্দটি রাদিয়াল্লাহু আনহু’র সংক্ষিপ্ত রূপ। এর অর্থ ‘আল্লাহতায়ালা তাঁর ওপর সন্তুষ্ট’। সাহাবা অর্থাৎ রাসুলের সঙ্গীদের (যেমন: আবু বকর, আবু হোরায়রা, ওমর) নাম উচ্চারণ করার পর এই বাক্যটি উচ্চারণ করতে হয়। (রাহঃ) বাক্যটি রাহমাতুল্লাহ আলাইহি’র সংক্ষিপ্ত রূপ। বাক্যটির অর্থ তার ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। সাধারণত এই বাক্যটি বিশিষ্ট আলেম ও চিন্তাবিদদের (ইমাম আবু হানিফা, হযরত শাহজালাল, হযরত শাহপরান প্রমুখ) নাম উচ্চারণ করার পর বলতে হয়। আর (আঃ) বাক্যটি সংক্ষিপ্ত হয়েছে আলাইহিস সালাম থেকে। এই বাক্যের অর্থ আল্লাহ তাঁর উপর করুণা করুন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ছাড়া অন্যান্য নবী- রাসুলদের নামের পর এই বাক্যটি উচ্চারণ করা হয় যেমন: ইব্রাহিম (আঃ), ইসা (আঃ), দাউদ (আঃ)।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৪:১৫