
ইসলামী দর্শনের সাথে পাশ্চাত্য দর্শনের পদ্ধতিগত পার্থক্য রয়েছে। অনেকে ধারনা করে থাকেন যে, দর্শনের আদি ভূমি হলো গ্রীস। যদিও এ বিষয়টি আজও সমাধান হয় নি যে, হিকমাত ও দর্শনের আদি উৎপত্তি স্থান কোথায়। তবে পাশ্চাত্যে প্রচলিত দর্শনের আদিসূত্র হলো গ্রীস। আর গ্রীকরা তৎকালীন প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ, যেমন মিশর, সিরিয়া, ইরান ও ভারতীয় সভ্যতা থেকে দর্শনের মূল সূত্রসমূহ অর্জন করেছিলেন। ১ পাশ্চাত্য দর্শনের সাথে ইসলামী দর্শনের গভীর তুলনামূলক আলোচনা এই সংক্ষীপ্ত প্রবন্ধে ও পরিসরে সম্ভব নয়; বরং এর জন্য স্বতন্ত্র ভাবে গ্রন্থ রচনা করা প্রয়োজন। তাই এখানে মাত্র কয়েকটি বিষয়ের প্রতি ইশারা করা হবে।
যা হোক পাশ্চাত্য দর্শনকে কালগত দিক থেকে সাধারণত তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। যথা :
১. প্রাচীন গ্রীক দর্শন;
২. মধ্যযুগীয় দর্শন এবং
৩. আধুনিক দর্শন।
প্রাচীন গ্রীক দর্শন যদিও সক্রেটিস থেকে শুরু বলে ধারণা করা হয়ে থাকে, তারপরও তাঁর পূর্বে কয়েকজন পন্ডিতের কথা আমরা দর্শনের ইতিহাসে দেখতে পাই। যেমন : Thaleo de Milat, Anaximandre, Anaximene, Heraclite, Pythagoros, Empedocle, Democrite, Anaxagore.
।
মধ্যযুগের দর্শনকে আবার তিনটি অধ্যায়ে বিভক্ত করা হয়ে থাকে। যথা :
১. পোপ শাসিত যুগ,
২. পাশ্চাত্য দর্শনের পতনের যুগ,
৩. বিদ্যালয়ভিত্তিক (scholastique)
দর্শনের যাত্রা শুরু হয় কয়েকটি মৌলিক প্রশ্ন নিয়ে : আমি কে, আমি কোথা থেকে এসেছি, আমার সর্বশেষ গন্তব্য কোথায়, আমার চারপাশে বিদ্যমান অস্তিত্বসমূহ কিভাবে অস্তিত্ব লাভ করল, তাদের আসল পরিচয় লাভ করা কি সম্ভব, আমি যা কিছু দেখছি সবই কি কল্পনা, না এর পেছনে বাস্তবতা রয়েছে।
এ জাতীয় প্রশ্ন থেকে দর্শনের মূল তিনটি বিষয় বের হয়ে আসে। আর তা হলো :
১. বাস্তবতা- এ কারনেই দর্শন প্রাচীনকাল থেকে বাস্তবতার অনুসন্ধান ও পরিচিতি লাভের চেষ্টায় তার যাত্রা শুরু করে আজও অব্যাহত রেখেছে;
২. এই বাস্তবতা উপলব্ধির মাধ্যম হিসাবে প্রজ্ঞা বা বুদ্ধিবৃত্তিকে অবলম্বন;
৩. এই বুদ্ধিবৃত্তি বা প্রজ্ঞা আসলেই কি সঠিক ও নির্ভূলভাবে বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে সক্ষম? এ প্রশ্নের মাধ্যমে দর্শন সংশয়মুক্ত সত্যে উপনীত হতে চায়। তাই এখানে সত্যে উপনীত হওয়ার একটি মাধ্যম হলো বুদ্ধিবৃত্তি। আর এ জন্য আমাদের উচিত বুদ্ধিকে কষ্টিপাথরে যাচাই করা যে, সে নির্ভূলভাবে বাস্তবতা উপলব্ধি করতে সক্ষম কি না? আর সে যা কিছু উপলব্ধি করে সেক্ষেত্রে সন্দেহ পোষণ অথবা নিশ্চিত বিশ্বাস স্থাপন করা যায় কিনা?
উল্লিখিত প্রশ্নসমূহ আলোচনার ক্ষেত্রে দর্শনকে আবার দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে : প্রমাণবিদ্যা (epistemology) ও অস্তিত্ববিদ্যা (ontology)। প্রমাণবিদ্যার আলোচ্য বিষয় হলো জ্ঞান ও পরিচিতি। জ্ঞানের সংজ্ঞা, বিশুদ্ধ জ্ঞান লাভের সম্ভাব্যতা, বাস্তবতার মানদন্ড অর্থাৎ আমার অর্জিত জ্ঞানই যে বাস্তানুরূপ তার মাপকাঠি কী, প্রথম শ্রেণীর স্বতঃসিদ্ধ বিষয় ও প্রত্যক্ষ জ্ঞান ইত্যাদি সম্পর্কিত বিষয়। আর অস্তিত্ববিদ্যার মূল আলোচ্য বিষয় হলো অস্তিত্ব কেন্দ্রিক। এটি অস্তিত্বের শ্রেণীবিন্যাস ও সার্বিক অস্তিত্ব, গতি, কার্যকরণ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে থাকে।
পাশ্চাত্য জগতে প্রাচীন গ্রীক দর্শনের যুগ থেকে মধ্যযুগের শেষ ভাগ অর্থাৎ রেনেসাঁ পর্যন্ত (১৫ শতাব্দী পর্যন্ত) দর্শনের মূল বিষয়বস্তু ছিল অস্তিত্ব কেন্দ্রিক। আর প্রমাণবিদ্যা প্রাসঙ্গিকভাবে আলোচিত হতো, তবে মূল বিষয় ছিল না। তবে Rene Descartes (রেনে ডেকার্ট) এর পর থেকে পাশ্চাত্য দর্শন নতুন রূপে যাত্রা শুরু করে এবং দর্শনের মূল আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয় প্রমাণবিদ্যা।
অস্তিত্ববিদ্যা প্রাসঙ্গিক ভাবে আলোচিত হতে থাকে। কিন্তু অস্তিত্ববিদ্যায় বর্তমানে তাদের কোনো ভূমিকাই নেই বললে ভূল হবে না। আর যারা অস্তিত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন, যেমন অস্তিত্ববাদীরা (existentialist), তাঁদের অস্তিত্বগত ধারণার সাথে ইসলামী দর্শনের অস্তিত্বগত ধারনার ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে।
অন্যদিকে ইসলামী দর্শন তার যাত্রা শুরু করে সার্বিক অর্থের দর্শন (সকল প্রকারের বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান) চর্চার মাধ্যমে। তবে অধিবিদ্যায় তাদের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল অস্তিত্ব কেন্দ্রিক, আর প্রমাণবিদ্যা প্রাসঙ্গিকভাবে আলোচিত হত। মোল্লা হাজী সাবজেওয়ারীর [1797–1873] পর থেকে দর্শন কেবল অধিবিদ্যার রূপ লাভ করে। কিন্তু এর পূর্বে বা তিনি নিজেও গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও অধিবিদ্যাকে দর্শনের অংশ হিসেবে আলোচনা করেছেন। তারপর আল্লামা তাবাতাবাঈ [(16 March 1903 – 15 November 1981]- এর যুগে দর্শন অধিবিদ্যার রূপ লাভ করার পাশাপাশি প্রমাণবিদ্যাকে এর মূল আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভূক্ত করা হয়। যার স্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে অধ্যাপক মুর্তাজা মোতাহ্হারীর [January 31, 1919 – May 1, 1979] লেখায়।২ তবু ইসলামী দর্শনে আজও মূল আলোচ্য বিষয় হলো অস্তিত্ব। তবে মুসলিম দার্শনিকদের মধ্যে নীতি ও পদ্ধতিগত পার্থক্য থাকলেও তাদের মধ্যে একটি একক সত্বা বা ভিত্তি রয়েছে, যে মূল নীতিকে বা আদর্শকে কেউ অতিক্রম করেন নি।
কিন্তু পাশ্চাত্য জগতে (রেনেসাঁর পর থেকে) দার্শনিক ধারা বা চিন্তার গতিতে একক কোন ভিত্তি দেখা যায় না। ফলে তাদের মধ্যে ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদের দর্শন জন্ম নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে ভিত্তিগত পার্থক্য রয়েছে। যেমন প্রয়োগবাদীরা (pragmatists) মনে করেন মানুষের বুদ্ধিলব্ধ বিষয় যদি বাস্তবতার মানদন্ডে যুক্তিযুক্ত এবং বাস্তবতার সাথে মিল থাকে তাহলে সে ক্ষেত্রে তা গ্রহণীয়। নির্বিচারবাদীরা (dogmatist) মনে করেন বস্তু যেমনটি বিদ্যমান আমরা ঠিক তেমনটিই দেখি, তবে তাঁরা এক্ষেত্রে জ্ঞানতত্বের ওপর নির্ভর করার প্রয়োজন মনে করেন না। আবার চরম সংশয়বাদীরা (scepticists) বলেন, মূলত বাস্তবতা বলে কোন কিছুরই অস্তিত্ব নেই। আর থাকলেও তা মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। এ ক্ষেত্রে অজ্ঞেয়তাবাদীরা (agnosticists) বলেন, আসলে আমরা জানি না যে, মানুষের পক্ষে নির্ভূল জ্ঞান অর্জন সম্ভব কিনা? অন্যদিকে Sophist রা মনে করেন বাস্তবতার মাপকাঠি হল প্রত্যেকের নিজস্ব বুদ্ধি। বুদ্ধির বাইরে বাস্তব বলে অন্য কিছুই নেই।
অনুরূপ ভাববাদীরাও ((idealist) মূল বাস্তবতাকে বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয় বলে মনে করেন। তাঁদের দৃষ্টিতে বাস্তবতা এই বস্তুগত বাহ্যিক বিষয়ের উর্ধ্বে অবস্থান করছে। তাই আমাদের চারপাশে দৃশ্যত বাহ্যিক বাস্তবতাসমূহ বুদ্ধিবৃত্তিরই প্রতিচ্ছবি মাত্র। আর এসবের বিপরীতে অবস্থান করছে বাস্তববাদী (realist), বস্তুবাদী(materialist) ও প্রকৃতিবাদীরা (naturalists)। তাঁরা মনে করেন বিশ্বে কোন ইন্দ্রিয় বহির্ভূত বুদ্ধিবৃত্তিক বাস্তবতা নেই।
পাশ্চাত্য দর্শনে এমনকি বাস্তবতা উপলব্ধি বা গবেষণা পদ্ধতির ক্ষেত্রেও বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে। যেমন কেউ কেউ বাস্তবতায় উপনীত হওয়ার জন্য ন্যায়ানুসৃত অবরোহ পদ্ধতি (deduction) বেছে নিয়েছেন। আবার কেউ আরোহ পদ্ধতি (induction) অবলম্বন করেছেন। কেউ কেউ অতিন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ মাধ্যম বা অন্তর্জ্ঞান পদ্ধতিকে (intuition) অবলম্বন করেছেন।
দর্শনের শুরু থেকে খ্রিস্টধর্মের আবির্ভাবকাল পর্যন্ত পাশ্চাত্য জগতে দর্শন ছিল বিশ্বকেন্দ্রিক (cosmocentric)। দর্শনের মূল লক্ষ্য ছিল বিশ্ব পরিচিতি। কিন্তু মধ্যযুগে (খ্রিস্টধর্মের আবির্ভাব কাল থেকে ১৫০০ সাল পর্যন্ত) এসে দর্শন খ্রিস্টধর্মের সেবায় নিয়োজিত হয়ে খোদাকেন্দ্রিকতায় (theo centrism) রূপান্তরিত হয়। ফলে খ্রিস্টধর্মের বিকৃতি ও ধর্মযাজকদের চিন্তাগত অবনতির কারনে মুক্তচিন্তা বাধাগ্রস্ত হয়। ঠিক এ সময়ই এ জাতীয় চিন্তার আবির্ভাব ঘটে যে, প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের চিন্তাধারার উর্ধ্বে আর কিছুই বলার নেই। যা হোক, এ সময়ে পাশ্চাত্যজগতে দর্শন ও মুক্তচিন্তার ক্ষেত্রে এক ভয়াবহ পতন নেমে আসে। অন্যদিকে জাতি ও গোত্রগত অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের কারনে পাশ্চাত্য জগতের অনেক চিন্তাবিদ চিন্তার আলোর সন্ধানে প্রাচ্যে পাড়ি দেন। পাশ্চাত্য যখন মধ্যযুগের আঁধারে নিমজ্জিত ঠিক তখনই প্রাচ্যে ইবনে সীনার [980 –1037] মতো মহান ব্যক্তিরা আলোর মশাল জ্বেলে মানব জাতির মাঝে আলো বিতরণ করছেন। অতঃপর প্রাচ্য তথা মুসলিম বিশ্ব থেকে দর্শন পাশ্চাত্যে প্রত্যাবর্তন করার মাধ্যমে পাশ্চাত্যে দর্শনের আধুনিক যুগের সূচনা হয়। আগামীতে বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মে, ২০২০ দুপুর ১:২৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




