somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চিতোরগড় ট্র্যাজেডিঃ কিংবদন্তি রাণী পদ্মাবতীর কথা

১৭ ই এপ্রিল, ২০১৭ রাত ৯:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


চিতোরগড়, রাজপুতদের দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাসে উজ্জ্বল এক নাম। মেওয়ার রাজ্যের রাজধানী চিতোরে অবস্থিত এ দুর্গটি বিভিন্ন সময়ের মুসলিম শাসকদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে বেশ কয়েকবার। প্রতিবারই পরাজিত হন রাজপুতরা। কিন্তু জীবন বাজি রেখে লড়াই করে প্রতিবারই তারা জন্ম দিয়েছিলেন অসামান্য বীরত্বগাঁথার।

প্রথমবার চিতোরগড় আক্রমণ করেছিলেন সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী। সেসময় সুলতান আলাউদ্দিন খিলজীর সৈন্যদলের হাতে পরাজয় নিশ্চিত হওয়ার পর রাণী পদ্মিনী সহ দুর্গের অন্য সকল নারীরা আত্মাহুতি দিয়েছিলেন আগুনের কুণ্ডলীতে; চিতোরগড় কেল্লার ইতিহাসে সূচনা হয়েছিল ‘জওহর’ প্রথার।এ প্রথা অনুসারে যখন পরাজয় নিশ্চিত হত তখন শত্রুপক্ষের হাত থেকে নিজেদের সম্ভ্রম রক্ষার্থে সকল নারীরা একযোগে আত্মহত্যা করতেন, সাথে থাকত শিশুরাও। আমাদের আজকের লেখা চিতোরগড়ের প্রথমবার আক্রান্ত হওয়া এবং রাণী এ পদ্মিনীর এ মর্মান্তিক পরিণতি নিয়েই।

চতুর্দশ শতকের প্রথমদিকের কথা। গুজরাটের এবং মধ্যপ্রদেশের সীমানায় অবস্থিত মেওয়ার রাজ্যের রাজা তখন রাজপুত রাওয়াল রতন সিং। তার প্রথম স্ত্রী রাণী নাগমতি। এদিকে সিংঘাল রাজ্যের রাজকন্যা পদ্মাবতীর অসামান্য রূপের কথা তখন সর্বজনবিদিত। স্ত্রী নাগমতি ও মায়ের কঠোর আপত্তি সত্ত্বেও পদ্মাবতীর রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিয়ে করেন রতন সিং। বিয়ের পর পদ্মাবতী পরিচিত হন রাণী পদ্মিনী নামে।

রাজা রতন সিং সাহিত্য, সংগীতের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাই সেসময় তার সভাসদে ঠাঁই পান অনেক জ্ঞানী-গুনি ব্যক্তি। তাদেরই একজন ছিলেন বংশীবাদক রাঘব চেতন। কিন্তু সেসময় রাঘব চেতনের বিরুদ্ধে মন্ত্র সাধনার মাধ্যমে মানুষের অনিষ্ট করার অভিযোগ উঠে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে রাজা রতন সিং শাস্তি হিসেবে তার মুখে চুনকালি মেখে গাধার পিঠে করে ঘুরানোর আদেশ দেন আর বিতাড়িত করেন রাজ্য থেকেও। রাঘব চেতন এ অপমান মেনে নিতে পারেননি। প্রতিশোধ পরায়ণ রাঘব এক ভয়াবহ ফন্দি এঁটে রওয়ানা দেন দিল্লী অভিমুখে। শুরু হয় অনন্য এক ইতিহাসের।

দিল্লীর মসনদে তখন সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী; ভারতবর্ষের ইতিহাসে অন্যতম প্রভাবশালী সুলতানদের একজন। আলাউদ্দিন খিলজী ছিলেন সুদক্ষ প্রশাসক এবং দুর্ধর্ষ সমরনায়ক। মুসলিম সাম্রাজ্য বিস্তারে তার ভূমিকা অনন্য। যুদ্ধ জয়ের জন্য তিনি শক্তির পাশাপাশি নিপুণ কূটনীতির চাল চালনায়ও ছিলেন সমান দক্ষ। আলাউদ্দিন খিলজী তখন দিল্লীর উপকণ্ঠে এক বনে শিকারে এসেছিলেন। রাঘব চেতন সুযোগ বুঝে সুলতানের কাছাকাছি বনের এক জায়গায় বসে বাঁশি বাজাতে শুরু করে। তার বাঁশির সুরের মূর্ছনায় মোহাবিষ্ট হয়ে সুলতান তাকে ডাকলেন এবং সুলতানের দরবারে ঠাঁই ও হয়ে গেল রাঘব চেতনের।

রাঘব এ অপেক্ষাতেই ছিল এবার সে তার মোক্ষম চালটি চালতে থাকলো। সুযোগ বুঝে সে প্রায়ই সুলতানের কাছে রাণী পদ্মাবতীর অসামান্য রূপের কথা বর্ণনা করতে লাগল। সুলতানকে বলতে থাকলো যে এমন রূপবতী নারী কেবল সুলতানের হেরেমেই শোভা পায়। এভাবে মেওয়ার হামলার জন্য সে প্রলুব্ধ করতে থাকল সুলতানকে এবং একসময় সফলও হল সে। সুলতান তার বিশাল সৈন্যবহর সহ রওয়ানা দিলেন মেওয়ারের রাজধানী চিতোর অভিমুখে।

কিন্তু চিতোরগড় দুর্গের কাছে এসে সুলতান বুঝতে পারেন চিতোরগড় জয় মোটেই সহজ হবে না। সপ্তম শতকের সময়ে নির্মিত চিতোরগড় প্রায় দুর্ভেদ্য দুর্গ। তাই তিনি কৌশলের আশ্রয় নিলেন রাজা রতন সিং এর কাছে এই বার্তা দিয়ে দূত পাঠালেন যে রাজ্য হরণ করার কোন ইচ্ছে তার নেই, তিনি রাণী পদ্মিনীর রূপের কথা অনেক শুনেছেন তাকে এক নজর দেখেই চলে যাবেন। একদিক দিয়ে এটি রাজপুতদের আত্মমর্যাদার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াল কিন্তু তবুও প্রজাদের কল্যাণের কথাও ভাবতে হলো তাদের। কেননা চিতোরগড় কেল্লা যতই দুর্ভেদ্য হোক সুলতান অবরোধ করে বসে থাকলে একসময় যুদ্ধে নামতে হবেই আর সুলতানের বিশাল সৈন্যবহরের সাথে পেরে উঠাও সম্ভব নয়। রাণী পদ্মিনীও রাজি হলেন কিন্তু শর্ত দিলেন, সরাসরি নয় আয়নার প্রতিফলনের মাধ্যমে তার প্রতিচ্ছবি দেখার সুযোগ পাবেন সুলতান।

সে এক নজর দেখাই কাল হল। সুলতানের কল্পনাকেও হার মানিয়ে গেল রাণী পদ্মিনীর রূপ। রোখ চেপে গেল আলাউদ্দিন খিলজীর। রাণী পদ্মিনীকে তার চাই-ই-চাই। চিতোরগড় থেকে ফেরার পথে সুলতান ও তার সহযোগীরা সুকৌশলে বন্দি করে নিয়ে আসলেন রাজা রতন সিং কে। এবং ঘোষণা দিলেন রাণী পদ্মিনীর বিনিময়েই কেবল রাজা রতন সিংকে মুক্তি দেয়া হবে। এতে করে বীর রাজপুতদের আত্মসম্মানে চূড়ান্ত ঘা লাগল।

রাজপুতদের দুই দুর্ধর্ষ সেনাপতি গোরা এবং বাদল মিলে এক সুচতুর ফন্দি আঁটলেন। তারা সুলতানকে জানালেন তারা এ বিনিময়ে রাজি আছেন। রাণী পদ্মিনী যাবেন সুলতানের কাছে। কিন্তু রাণী তো আর একা যাবেননা সাথে যাবে তার সই, পরিচারিকা সহ অনেকে। কথা মতো একের পর এক পালকি আসতে থাকল সুলতানের শিবিরে। কিন্তু কোথায় রাণী পদ্মিনী, কোথায় তার পরিচারিকা! সব পালকি গুলোতেই ছদ্মবেশে লুকিয়ে আছে রাজপুত সৈন্যদল। মুসলিম সৈনিকদের অতর্কিত আক্রমণ এর মাধ্যমে রাজা রতন সিংকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়াই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। তারা এতে সফলও হল তারা। রাজা রতন সিং এবং বাদল নিরাপদে চিতোর পৌঁছলেও মারা পড়েন অন্য সেনানায়ক গোরা।

এ ঘটনায় সুলতান ভীষণ ক্ষিপ্ত হন এবং তার বাহিনীকে চূড়ান্ত ভাবে চিতোর আক্রমণের নির্দেশ দেন। কিন্তু দুর্ভেদ্য চিতোরগড়ে অনেক আক্রমণেও কোন ফল না পাওয়ায় তারা লাগাতার কেল্লা অবরোধ করে রাখন। একসময় দুর্গের খাবার ফুরিয়ে যেতে থাকে, আত্মসমর্পণ অথবা সম্মুখ যুদ্ধ ছাড়া আর কোন পথ খোলা থাকেনা রাজপুত সৈন্যদের সামনে। ‘সাকা’ প্রথা অনুসরণ করে তারা আত্মসমর্পণের চেয়ে যুদ্ধ করতে করতে মৃত্যুর পথ বেছে নেন। নিশ্চিত পরাজয় জেনেও দুর্গের সকল সৈন্য গায়ে জাফরান রঙের কাপড় জড়িয়ে বেরিয়ে আসেন দুর্গ ছেড়ে। মরণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুসলিম বাহিনীর সামনে।

ফলাফল যা হওয়ার তাই হলো। সুবিশাল শক্তিশালী সুলতান বাহিনীর কাছে পরাজিত হলো রাজপুত সৈন্যদল। বিজয়ীর বেশে চিতোরগড় দুর্গে প্রবেশ করেন সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী।কিন্তু দুর্গের ভেতর ততক্ষনে রচিত হয়েছে এক মর্মান্তিক উপাখ্যান। পরাজয় নিশ্চিত জেনে রাজপুত নারীরা একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন আগুনের কুণ্ডলীতে। সাথে করে নিয়ে গেছেন তাদের শিশুসন্তানদেরও। আত্মাহুতি দিয়েছিলেন রাণী পদ্মিনী, রাণী নাগমতি সহ সকলেই। জীবন দিয়ে তারা লিখে গেছেন এ ট্র্যাজিক উপাখ্যানের পরিসমাপ্তি।

দুর্গে প্রবেশ করে আলাউদ্দিন খিলজীর সৈন্যদল ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকা অগ্নিকুণ্ড দেখতে পেলেন। যেখানে বিলীন হয়ে গেছে পদ্মাবতী; যার উপলক্ষে এত যুদ্ধ, এত রক্তক্ষয়। এরপর আলাউদ্দিন খিলজী খিজির খানকে মেওয়ার শাসনের ভার দিয়ে ফিরে যান দিল্লীতে। মেওয়ারের নতুন নাম হয় খিজিরাবাদ।

তবে আলাউদ্দিন খিলজীর চিতোর বিজয়ের কথা ইতিহাস স্বীকৃত হলেও পদ্মাবতীর অস্তিত্ব নিয়ে দ্বিমত আছে ঐতিহাসিকদের মধ্যে। বিতর্কের কারণও অবশ্য কম নয়। পদ্মাবতীর উপাখ্যান সর্বপ্রথম লিখিত ভাবে বর্ণিত হয় মালিক মুহাম্মদ জায়সির লেখা ‘পদ্মাভাত’ কাব্যে; যা লেখা হয়েছিল ঘটনাকালের প্রায় দুইশ চল্লিশ বছর পর। মালিক মুহাম্মদ ঐতিহাসিক নয় একজন কবি ছিলেন। এরপর অনেক ঐতিহাসিকের কলমে বিভিন্নভাবে পদ্মাবতীর উপাখ্যান উঠে এলেও পদ্মাবতী ঐতিহাসিক চরিত্র নাকি নিছক কবির কল্পনা ছিলেন এ বিতর্কের অবসান হয়নি আজো।

তবে ঐতিহাসিকদের মধ্যে দ্বিমত থাকলেও অধিকাংশ সাধারণ মানুষই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে এ কাহিনী। রানী পদ্মাবতী আজও তাদের কাছে সতীত্বের প্রতিমূর্তি, এক প্রেরণার বাতিঘর।

তথ্যসূত্রঃ
১)https://en.wikipedia.org/wiki/Rani_Padmini
২) https://blog.mukto-mona.com/2015/10/11/47803/
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই এপ্রিল, ২০১৭ রাত ৯:৪৪
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×