আধুনিক কথাশিল্পের স্থপতি কমরেড সোমেন চন্দঃ
কমরেড সোমেন চন্দ। বাংলা সাহিত্যের তিন উদীয়মান তরুণ সাহিত্যিকদের একজন। সুকান্ত কবি হিসেবে আর সোমেন চন্দ আধুনিক কথাশিল্পের স্থপতি হিসেবে এবং খান মোহাম্মদ ফারাবী উভয়কেই ধারণ করে বাংলা সাহিত্যে পরিচিতি অর্জন করেন। এই তিন সাহিত্যিকের কেউ ২২ বছর বাঁচতে পারেননি। অর্থাৎ ২১শের ঘরে তাঁদের জীবনের সম্পাত্তি ঘটে। কমরেড সোমেনকে হত্যা করা হয়। অন্য দু'জন মরণব্যাধী যক্ষা ও ক্যান্সারে মারা যান।
তারুণ্যের গান, সৃষ্টির উম্মাদনা ও বিদ্রোহের অগ্নি জেলে সাহিত্যে বিপ্লব ঘটাতে চেয়েছিলেন সোমেন চন্দ। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে লিখেছিলেন, 'নিজস্ব একটি জীবনদর্শন না থাকলে সাহিত্যিক হওয়া যায় না। সোমেন চন্দ ছিলেন কমিউনিস্ট। তাই তার রচনায় নানা ভাবে ফুটে উঠেছে সমাজ পরিবর্তন তথা কমিউনিজমের প্রাসঙ্গিকতা'।
অন্যায়, অত্যাচার, অসঙ্গতি ও অসহায়ত্বের কাছে কখনো মাথা নত করেননি। সোমেন চন্দের সাহিত্যের বিষয় ছিল কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষকে ঘিরে। শোষণ-বৈষম্য থেকে মানুষকে মুক্ত করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য ও স্বপ্ন। এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য নিজেকে নিয়েজিত করেন সেই শৈশব থেকেই। কমরেড সোমেন চন্দ এমন একজন আলোকিত মানুষ, যে হতাশাগ্রস্থ প্রতিটি মানুষকে জাগ্রত করে নতুন উদ্যমে পথ চলতে সহয়তা করে।
কমিউনিজম ছিল তার প্রেরণা। তাই চেতনাকে শান দিয়েছেন প্রতিনিয়ত। কমিউনিজমই ছিল তার মূল দর্শন। কলম তার সংগ্রামের পাথেয়। আর খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষ ছিল তার বেঁচে থাকার প্রেরণা। খাঁটি কমিউনিস্ট বলতে যা বুঝায়, সোমেন চন্দ ছিলেন তাই।
নির্মল ঘোষকে লেখা এক পত্রে সোমেন জানায়, ....আর এই বিপ্লবের অনুভূতি কেবল আমার নয়। আরো অনেক সাহিত্য-সেবকের মনেই জেগেছে মনে হয়, তার মধ্যে অনেকেই প্রকাশ করতে পারছেন, বা অনেকেরই কণ্ঠ ক্ষীণ হয়ে গেছে তথাকথিত সাহিত্য ডিক্টেটরদের গোলমালে। কিন্তু সেই অনুভূতির অস্তিত্ব আছে অনেকের মনেই। এইসব দেখে মনে হয়, আগামী দশ বছরে বাংলাসাহিত্যের ইতিহাস হবে একটা উজ্জ্বল অধ্যায়, একটা বৈপ্লবিক অপূর্ব সৃষ্টি।
১৯৪১ সালের ২২ জুন। হিটলার সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণ করে। বিশ্বযুদ্ধ নতুন দিকে মোড় নেয়। এ সময় ভারত উপমহাদেশের প্রতিবাদী প্রগতিশীল জনতা ফ্যাসিস্ট হিটলারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং কমরেড স্তালিনের নেতৃত্বে সংগ্রামরত দেশপ্রেমিক সোভিয়েত যোদ্ধাদের প্রতি সমার্থন জানিয়ে জনযুদ্ধ ঘোষণা করে। এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শান্তির লক্ষে হীরেন মুখোপাধ্যায় ও স্নেহাংশু আচার্যকে আহ্বায়ক করে কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদদের নিয়ে বঙ্গদেশে গড়ে উঠে ‘সোভিয়েত সুহ্রদ সমিতি'। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৪২ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকায় প্রগতি লেখক সঙ্ঘের উদ্যোগে গড়ে উঠে 'সোভিয়েত সুহ্রদ সমিতি'। এর যুগ্ম-সম্পাদক ছিলেন, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত ও দেবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। এই সমিতির প্রধান প্রধান কাজগুলোর মধ্যে একটা অন্যতম কাজ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার অগ্রগতি প্রসঙ্গে চিত্র প্রদর্শনী করা। এই প্রদর্শনীতে প্রগতি লেখক সঙ্ঘের সোমেন চন্দের ভূমিকা ছিল অনন্য। তাঁর অবিরত শ্রমের কারণে ঢাকায় অল্পদিনের মধ্যে প্রগতি লেখক সঙ্ঘ ও সোভিয়েত সুহ্রদ সমিতি ফ্যাসিবাদ বিরোধী জনমত গড়ে তুলতে সক্ষম হন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ লিখেছেনঃ 'সোমেন হত্যার ব্যাপারটি , বিশেষ করে তখনকার পটভূমিতে এবং প্রেক্ষিতে এই হত্যাকাণ্ড গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবাহী। কমরেড সোমেন ছিলেন সে সময়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন, সোভিয়েত সুহ্রদ সমিত, আর প্রগতি লেখক সঙ্ঘের অনেকখানি'। ১৯৪২ সালে সোমেন চন্দের মৃত্যুর পর কলকাতায় সম্মেলনের সময় প্রগতি 'লেখক সঙ্ঘের' নামকরণ হয় 'ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ'। ১৯৪৫ সালে কলকাতায় আবার এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় 'প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ'।
সোমেন চন্দের মৃত্যু সম্বন্ধে সরদার ফজলুল করিমের স্মৃতিচারণঃ 'ফ্যাসীবাদ বিরোধী আন্দোলন বাংলার সব জেলা শহরে ছড়িয়ে পড়ে যার মধ্যে ঢাকা শহর ছিলো অন্যতম শক্তিশালী কেন্দ্র। ১৯৪২ সালের ৮ই মার্চ ঢাকার বুদ্ধিজীবি, লেখক প্রভৃতি শহরে এক ফ্যাসীবাদ বিরোধী সম্মেলন আহবান করেন। স্থানীয় জেলা পার্টির অনুরোধে কমরেড বঙ্কিম মুখার্জি ও জ্যোতি বসু সেখানে বক্তা হিসেবে যান। সম্মেলন উপলক্ষ্যে শহরে খুবই উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং রাজনৈতিক মহল প্রায় তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রথম যারা সম্মেলনের পক্ষে, দ্বিতীয় যারা সরাসরি বিপক্ষে, তৃতীয় যারা মোটামোটিভাবে তুষ্ণীভাব অবলম্বন করে নিরপেক্ষতার আবরণ নিয়েছিলেন। শেষোক্তদের মধ্যে প্রধানত কংগ্রেস মতবাদের অনুসারীরা ও দ্বিতীয় দলে ছিলেন জাতীয় বিপ্লবী, বিশেষত শ্রীসংঘ ও বিভির লোকেরা। যাই হোক, সম্মেলনের দিন সকালে উদ্যোক্তাদের অন্যতম তরুণ সাহিত্যিক সোমেন চন্দ আততায়ীর হাতে নিহত হন। তিনিই বাংলার ফ্যাসীবাদী বিরোধী আন্দোলনের প্রথম শহীদ। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের পরও যথারীতি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং আমাদের প্রতি আরও লোক আকৃষ্ট হয়'।
১৯৪২ এর ৮ মার্চ ঢাকায় এক সর্বভারতীয় ফ্যাসিবিরোধী সম্মেলন আহ্বান করে। তথাকথিত জাতীয়তাবাদী কিছু দল এ সম্মেলন বিঘ্নিত করার চেষ্টা করে। পরে রেল শ্রমিকদের মিছিল নিয়ে সোমেন যখন সম্মেলনে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। ওই দিন ঢাকার সুত্রাপুরে সেবাশ্রমের কাছে বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক পার্টির (আর আস পি) গুন্ডারা তাঁর উপর ধারালো অস্ত্র দিয়ে হামলা চালায়।
'সোমেন চন্দ ছিলেন ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের পুরোভাগে। হিটলার-মুসেলিনী ফ্যাসিস্ট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করেছিল পৃথিবীকে শাসন করার জন্য। তারা স্পেনের ফ্যাসিস্ট ফ্যাঙ্কোর সঙ্গে সে সময়ে মিত্রতা গড়ে তোলে। এই ফ্যাসিস্ট চক্রের হাতেই সোমেন চন্দ শহীদ হয়। সোমেনের তাঁজা রক্ত ঢাকা রাজপথ রঞ্জিত করে আন্দুলেশিয়া আর স্পেনের রাজপথের সঙ্গে মিত্রতা গড়ে তোলে' চৌধুরী সুধীর নাথ।
সোমেন চন্দের জন্ম ১৯২০ সালের ২৪ মে। ঢাকার নিকটবর্তী টঙ্গী স্টেশনের কাছে আসুলিয়া গ্রামে। আদিবাস ঢাকার নরসিংদি জেলার বালিয়া গ্রামে। বাবা নরেন্দ্রকুমার চন্দ। তিনি ঢাকার মিটফোর্ড মেডিকাল স্কুল ও হাসপাতালের স্টোরস বিভাগে চাকুরি করতেন। মা কেরানীগঞ্জের মেয়ে হিরণবালা। মাত্র ৪ বছর বয়সে সোমেন চন্দ তাঁর মাকে হারান। এরপর তিনি সরযূদেবীকে মা বলে জানতেন এবং তাঁর স্নেহেই তিনি বড় হয়েছেন। পিতার চাকুরির কারণে ঢাকায়ই সোমেনের বেড়ে ওঠা। এখানেই তাঁর শৈশব-কৈশর ও মানস চেতনা গড়ে উঠে।
সোমেন চন্দের পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। তারপর অশ্বিনী কুমার দত্ত মহাশয়ের কাছে পড়েন। প্রাথমিক পড়াশুনা শেষে ১৯৩০ সালে তাঁকে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি করে দেয়া হয় পুরান ঢাকা পোগোজ হাই স্কুলে। এই স্কুল থেকে ১৯৩৬ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ডাক্তারী পরার জন্য ভর্তি হন ঢাকা মিডর্ফোট মেডিকেল স্কুলে। কিন্তু খারাপ স্বাস্থ্যের কারণে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারেন নি।
১৯৩৫ সালের নভেম্বরে লন্ডনে ভারতীয় ও বৃটিশ লেখকদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন ই এম ফরস্টার, হ্যারল্ড লাস্কি, হার্বাট রিড, রজনী পাম দত্ত, সাজ্জাদ জহীর, মূলক রাজ আনন্দ, ভবানী ভট্টাচার্য প্রমুখ। নানা আলোচনার পর তারা একটি ইশতেহার প্রকাশ করেন ডিসেম্বরে। এরই সূত্র ধরে ভারতে প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ গঠিত হয়। চার বছর পর ঢাকায় স্থাপিত হয় এর শাখা।
১৯৩৫ সালে লন্ডনে বৈঠকে সাহিত্যিকরা এ সংগঠনের নাম 'প্রগতি সাহিত্য সংঘ' রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। যখন ইশতেহার প্রকাশিত হয় তখন প্রস্তাবিত নাম রাখা হয় 'প্রগতি লেখক সংঘ'। ১৯৩৬ সালের ১০ এপ্রিলের এ সভায় সভাপতিত্ব করেন বিখ্যাত হিন্দি লেখক মুন্সী প্রেমচান্দ। সভায় সংগঠনের নামকরণ করা হয় 'নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সংঘ'। এর সভাপতি নির্বাচিত হন প্রেমচান্দ, সম্পাদক সাজ্জাদ জহীর।
১৯৩৭ সালে তিনি প্রত্যক্ষভাবে কম্যুনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। কম্যুনিস্ট পাঠচক্রের সম্মুখ প্রতিষ্ঠান প্রগতি পাঠাগারের পরিচালকের দায়িত্ব নেন। প্রগতি পাঠাগার-এর পরিচালক হন ১৯৩৮ সালে। এসময় তিনি বিপ্লবী শতীশ পাকড়াশীর মতো বিপ্লবী শিক্ষকের রাজনীতি ও দর্শনের পাঠ নেন। রনেশ দাশ গুপ্তের সানিধ্যে থেকে বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎ, বিভূতিভূষণ, ম্যাক্সিম গোর্কী, মোপাঁসা, রঁলা, বারবুস, জিদ, মারলো, কডওয়েল র্যালফ ফক্সসহ আরো অনেকের লেখা পড়ে ফেলেন।
রালফ্ ফক্সের নাম শুনেছো?
শুনেছো কডওয়েল আর কনফোর্ডের নাম?
ফ্রেদরিকো গার্সিয়া লোরকার কথা জান?
এই বীর শহিদেরা স্পেনকে রাঙিয়ে দিল,
সবুজ জলপাই বন হলো লাল,
মার ' বুক হল খালি '
তবু বলি, সামনে আসছে শুভদিন।
চলো, আমরাও যাই ওদের রক্তের পরশ নিতে,
ওই রক্ত দিয়ে লিখে যাই
শুভদিনের সংগীত।
১৯৪১ সালে সোমেন চন্দ প্রগতি লেখক সংঘের সম্পাদক নির্বাচিত হন। প্রগতি লেখক সংঘের প্রধান সংগঠক ছিলেন তিনি। সংঘের সাপ্তাহিক ও পাক্ষিক বৈঠকগুলোতে নিয়মিত লেখা উপস্থাপনের তাগিদ থেকেই তার সাহিত্যচর্চার বিস্তারলাভ। ১৯৪০ সালের শেষের দিকে কম্যুনিস্ট পার্টির সক্রিয় কর্মী হিসেবে ট্রেড ইউনিয়নের আন্দোলনের কাজ শুরু করেন। সোমেনের স্বপ্ন ছিল কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হওয়া। ১৯৪১ সালে সে স্বপ্ন তার পূরণ হয় মাত্র বিশ বছর বয়সে।
'ঢাকায় প্রগতি লেখক সংঘের শাখা স্থাপিত হয়েছিল একটা সন্ধিক্ষণে। শাখা স্থাপনের প্রস্তুতির মুখে ছিলেন কয়েকজন তরুণ লেখক। যারা ভাবছিলেন প্রগতি লেখক সংঘের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও গণমুখী ঘোষণাপত্র অনুযায়ী অবিলম্বে কিছু করা দরকার। যারা এ প্রয়োজন অনুভব করছিলেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে তরুণ বয়সী ছিলেন সোমেন চন্দ, যার বয়স তখন আঠারো আর সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন সতীশ পাকড়াশী বাংলার অগ্নিযুগের পথিকৃৎদের একজন, যার বয়স সে সময়ে পঁয়তাল্লিশ অতিক্রম করেছে। সোমেনের দুই সমবয়সী বন্ধু একেবারে গোড়ার দিকে উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন। একজন কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত সে সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অতি আধুনিক কবিতা লিখে নাম করেছিলেন… অপরজন অমৃত কুমার দত্ত।' এদের সঙ্গে একত্রিত হয়েছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত, তার বয়স তখন ২৭। পুরানো ঢাকা শহরের দক্ষিণ মৈত্রী মহল্লায় প্রগতি পাঠাগার ছিল সংঘের প্রথম কেন্দ্র' রণেশ দাশগুপ্ত। ১৯৪০ সালের মাঝামাঝি গেন্ডারিয়া হাইস্কুল মাঠে সম্মেলন করে প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘের উদ্বোধন করা হয়। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন কাজী আবদুল ওদুদ। রণেশ দাশগুপ্ত সংগঠনের সম্পাদক ও সোমেন চন্দ সহসম্পাদক নির্বাচিত হন।
প্রগতি লেখক সংঘের নেতৃত্বে ১৯৪১ এ ঢাকায় তৈরি হয় ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগঠন ' সোভিয়েত সৃহৃদ সমিতি। একপর্যায়ে এ সমিতির তিনিই হয়ে উঠেন অন্যতম সক্রিয় সংগঠক।
নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া সোমেন চন্দ সমাজ পরিবর্তনে বিশ্বাস করতেন। বিশ্বাস করতেন বিপ্লবে। সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার অনুষঙ্গ হিসেবেই রাজনীতি চলে আসে তার লেখায়। নিত্যদিনের ঘরকন্নার মধ্য দিয়ে তিনি অবলীলায় দেখিয়ে দেন শাসনযন্ত্রের কুটিল চালপ্রয়োগ, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে থাকা ক্ষমতার সুক্ষ্ম জাল। তাঁর সৃষ্টি চেতনার কারফিউ ভেঙ্গে জাগিয়ে দেয় মাহনতি মানুষের মুক্তির কথা বলতে। যোগায় আত্মপরিচয় খোঁজার অনুপ্রেরণা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের যবনিকা পতনের কিছু পরেই বিশ্বমঞ্চে তার আবির্ভাব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আনাঙ্খাকিত মৃত্যু তাঁকে প্রচণ্ড পরিমানে ক্ষুব্দ করে। সোমেন তাই আঞ্চলিক সমস্যা যে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সমীকরণের একটি উপাত্ত তা বলতে 'একটি রাত গল্পের' সনাতনী মা ছেলের রাজনৈতিক মতাদর্শ বুঝে নিতে বই খুলে বসেন।
দাঙ্গা গল্পে দুই ভাইয়ের আদর্শগত বিরোধের মধ্য দিয়ে রূপক আকারে বেরিয়ে আসে উপনিবেশবাদের শেষ ছোবল জাতিগত বিভেদের ভয়াবহ চেহারাটি। দাঙ্গা গল্পের 'অজয়' একটি বাস্তব চরিত্র। ওই সময় আমি এমনটাই ছিলাম কল্যাণ চন্দ।
ইঁদুর গল্পের ইঁদুরগুলো যেন দারিদ্রেরই কিলবিলে রূপ যা এক মুহূর্ত শান্তিতে থাকতে দেয়না। ক্রমাগত শ্রেণীস্বাতন্ত্র টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে রত নিম্ন মধ্যবিত্তদের। নিরেট প্রেমের গল্প রাত্রিশেষ এও মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে শ্রেণীসংঘাত যা থেকে মুক্ত নয় আপাত সংস্কারত্যাগী বৈষ্ণবরাও।
অকল্পিত গল্পে তিনি দেখান “যারা রাষ্ট্রদেবতার মন্দিরের কাছাকাছি থাকেন, যারা বিশ্ব মানচিত্রে নিজের ক্ষুদ্র অবস্থান সম্পর্কে বেশ সচেতনই বলা চলে, যারা দেখতে পায় কিংবা দেখেও না দেখার ভান করে 'আমাদের চারিদকে চাপা কান্নার শব্দ, আমাদের চারিদিকে জীবনের হীনতম উদাহারণ, খাদ্যের অভাবে, শিক্ষার অভাবে কুতসিত ব্যারামের ছড়াছড়ি, মানুষ হয়ে পশুর জীবন-যাপন। আমাদের চারিদিকে অবরুদ্ধ নিশ্বাস, কোটি কোটি ভয়ার্ত চোখ, তারা যেন খুনের অপরাধে অপরাধী একপাল মানুষ'।
প্রত্যাবর্তন গল্পে তিনি গাঁয়ের কথা বলেন 'পঁচিশ বছর আগের পুরুষরা একদিন আকাশের দিকে চাহিয়া নিরুপায়ে কাঁদিয়াছে, তার বংশধরেরা আজও কাঁদিতেছে। তাহাদের চোখ-মুখ ফুলিয়া গেল'।
জীবনের এই স্বল্প পরিসরে সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন শেষের কয়েকটি বছর। ২৪টি গল্প, ২টি নাটিকা এবং তিনটি কবিতা নিয়ে তার সাহিত্যের ঝুলি। প্রতিটি রচনাতেই রয়েছে সৃষ্টিশীলতার ছাপ। তার 'ইঁদুর' গল্প বিশ্বের বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ইঁদুর প্রসঙ্গে লেখক হুমায়ূন আহমেদ বলেন,
-সোমেন চন্দের লেখা অসাধারণ ছোটগল্প 'ইঁদুর' পড়ার পর নিম্ন মধ্যবিত্তদের নিয়ে গল্প লেখার একটা সুতীব্র ইচ্ছা হয়। 'নন্দিত নরকে', 'শঙ্খনীল কারাগার' ও 'মনসুবিজন' নামে তিনটি আলাদা গল্প প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই লিখে ফিলি।
'৪০-এ প্রকাশিত সংঘের সংকলন 'ক্রান্তি'তে তার বিখ্যাত গল্প 'বনস্পতি' প্রকাশিত হওয়া ছিল বিরল ঘটনা। মাত্র সতের বছর বয়সে তিনি ভাল একটি উপন্যাসও লিখেছিলেন, নাম বন্যা। কিন্তু জীবিতাবস্থায় তার কোন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের অসাধারণ উপন্যাস চিলেকোঠার সেপাই-এর এক স্থানে সোমেন চন্দের কথা উঠে আসে। বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত হায়াত মামুদের সোমেন চন্দ গ্রন্থটিও উল্লেখযোগ্য। তবুও বাংলাদেশের সাহিত্যে সোমেন চন্দকে খুঁজে পেতে সেলিনা হোসেনের 'নিরন্তর ঘন্টাধ্বনি' হাতে নিতে হবে। সোমেন চন্দকে জানতে এ উপন্যাস প্রয়োজনীয়। লেখিকা উপন্যাসটিতে সযত্নে ফুটিয়ে তুলেছেন সোমেন চন্দকে।
তিনি সাহিত্যেও বিপ্লবের স্রোতধারা আশা করতেন। বিশ্বাস করতেন, সাহিত্য দ্বারা ঘুণেধরা সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন করার অনুপ্রেরণা মানুষের মধ্যে সঞ্চার করা সম্ভব। আর সেই লক্ষ্যকে সামন রেখে মানুষের মুক্তির কথা চেতনায় ধারণ করেছিলেন। রচনা করেছিলেন সমাজ পরিবর্তনের কথাশিল্প।
আধুনিক কথাশিল্পের স্থপতি কমরেড সোমেন চন্দ
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
মা
মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।
অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন
কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।
একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প
তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন
ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে
ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন
জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।
সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন