somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সময় ও জীবনের রোজনামচা

৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এক;
সময়কে কাছে পাবার সময় কই? সবকিছু কিংবা কোনো কিছু কি নতুন করে শুরু করা যায়? একটি জীবন, একটি স্বপ্ন, একটি মৃত্যু বা কোনো একটি অপমৃত্যুকে? যদি নতুন করে কিছু শুরু করা যেত তবে আপনি কোন জিনিসটি সবার আগে করতে চাইতেন? জীবনের কোন বাঁকটিকে আবার রিওয়াইন্ড করে আগের জায়গায় আনতে চাইতেন আপনি? নিজের শৈশবকে? কলেজের প্রথম দিনটাকে? প্রথম যেদিন প্রেমিকার হাতটি হাতে ধরলেন সেই দিনটাকে?

কিছুই কি ফেরত আসে কিংবা কিছই কি হারিয়ে যায় আদৌ? সত্য আর মিথ্যা-দুই অমোঘ সত্যি আমাদের জীবনে। আপনি কোনটাতে বিশ্বাস করেন? নিশ্চই বলতে চাইছেন এ আবার কী প্রশ্ন? অবশ্যই সত্যি। সত্যিই কি তাই? সত্যি অথবা মিথ্যা কি এতটাই সরল? যে মা তার সন্তানকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন তাকে যখন পাকি... কু....র বাচ্চারা জিজ্ঞেস করল তোমার ছেলে কই? তিনি বলেছিলেন জানি না। সেটা কি সত্যি ছিল? বা মিথ্যাই কি ছিল? আপনার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় দিনটি কবে? আপনার জন্মদিন? মা যেদিন আপনাকে চুলে সিঁথি করে স্কুলে পাঠাল সেই দিন? যেদিন “ও”কে প্রথম বললেন “ভালবাসি” সেই দিন? যেদিন একটি মানবসন্তান আধো আধো বোলে “বাবা” বলে ডেকেছিল সেই দিনটি কি? পরের জনমে আপনি কী হতে চাইবেন? একজন রবীন্দনাথ? টম ক্রূজ? হো মো এরশাদ? একজন অভিজিত? সদরঘাটের কুলি? বিশ্বখ্যাত কোনো মাল্টিন্যাশনালের CEO (আসলে চিফ এক্সপ্লয়টিং অফিসার)? নায়িকা মাধুরীর মেক আপ ম্যান? জীবনানন্দের বনলতা? কিংবা অতি সৌভাগ্যবান একজন রানা প্লাজা সারভাইভার রেশমা?

দুই;
সহকর্মী ও পরিচীতদের সাথে প্রায়ই একটা ইস্যূতে কথা হয়। জীবনের সফলতা নিয়ে। জীবনের একটা স্টেজ পর্যন্ত ধারনা ছিল বা আরো ভাল করে বলতে গেলে, আমাদের শেখানো হত, যেকোনো ভাবেই হোক, জীবনে খুব করে লেখাপড়া করতে হবে। পড়াশোনা ছাড়া জীবন অন্ধকার। কোনোমতে এমএ পাশ করতে না পারলে জীবন বরবাদ। মজার বিষয় হল, আমার হাইস্কুলের মেটদের মধ্যে একজনের সাথে আমার দেখা হয় দীর্ঘ ২০ বছর পরে মিরপুরে। খারাপ রেজাল্ট করতে করতে, এক পর্যায়ে ওকে স্কুল হতে বের করে দেয়া হয়। ওর কাছে জানতে পারলাম, সে তার নিজের ফ্লাটে থাকে মিরপুরের কাছের একটি এলাকায়। শুক্রবার দেখে নিজের গাড়ি ড্রাইভ করে বাজারে এসেছে সখের কবুতর কিনতে। আমি আমার দুই হাতে থাকা কাঁচাবাজারের ব্যাগের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারা মানকচুর ডাটো লুকাতে ব্যস্ত হই। আমার অন্তত হাফ ডজন স্কুল বা ইউনিভার্সিটি মেট ক্লাসে প্রচন্ড রকম খারাপ রেজাল্টধারী ছিলো। তাদের বর্তমান সোস্যাল স্টাটাস আকাশ ছোঁয়া। পড়ালেখা করে যে, গাড়িঘোড়ায় চড়ে সে। মুশকীল হল, গাড়িতে দুই গ্রূপই চড়ি। তবে যারা পড়াশোনা করেনি ওরা প্রাডোতে চড়ে। আমি ঢাকার মুড়ির টিনে। বাল্যশিক্ষা কি তবে ভুল ছিল?

তিন;
পুরুষ বিশেষত বিবাহিত পুরুষ এবং যদি সে ন’টা-পাঁচটা চাকরীজীবি হয় তবে তো কথাই নেই। সকাল সন্ধ্যা অফিস, রাতে ফিরে বউকে সময় দাও, বাচ্চাকে আদর, পড়া দেখানো, সপ্তাহের ছুটির দিনে বাজার, ইউটিলিটি সার্ভিস, শ্বশুর বাড়ি হাজিরা, পাড়ার দাদাদের চায়ের নিমন্ত্রণ আরো কত কী? প্রায় পুরোটা সময়ই নিবেদিত পরিবার, সমাজ, সংসার ও অফিসের জন্য। আমরা সারাজীবন কারো না কারো জীবনের প্রয়োজন মেটাতে বেঁচে থাকি। কখনো নিজের প্রয়োজনটাকে দেখেছি কি? কখনো ভেবে দেখার সময় হয়নি, আমার জন্য আমি কতটুকু? সবাইকে এত এত সময় দিই। আমার সময়টুকু কই? একদম আমার?

চার’
দেড় কুড়ি বছর বয়সে বিয়ে। সেই হতেই প্রাইভেট জব। ২৪ ঘন্টা দিনের সকাল ৮ টা হতে রাত ৮ টা-১২ ঘন্টা কমপক্ষে থাকতে হয় বাইরে। রাত ৮ টা হতে সর্বোচ্চ রাত ১১ টা পর্যন্ত জেগে থাকলে গড়ে প্রতিদিন নিজ নিজ ঘরনীদের সাথে দেখা, কথা, মন বিনিময়, মান অভিমান, হিসেবনিকেশ মাত্র ৩ ঘন্টা। মানে সারাজীবনে যদি দু’জনে আরো ৩০ বছর একত্রে বাঁচি তবে মোট ৩০ বছরের বিবাহিত জীবনে দু’জনের মুখোমুখি সাক্ষাত (ঘুমের সময় অবশ্য যদি গোণায় ধরেন তবে ভিন্ন হিসাব।) মাত্র (৩ X ৩০ X ১২ X ৩০) = ৩২,৪০০ ঘন্টা+প্রতি বছর ৫২ টি শুক্রবার ও সর্বোচ্চ ২১ দিন ছুটির পুরোটাতে যদি একত্রে থাকেন তবে সর্বোচ্চ (১৮ X ৭৩ X ৩০) = ৩৯,৪২০ ঘন্টা অর্থাৎ মোট ৭১,৮২০ ঘন্টা বা ২৯৯২.৫ দিন বা ৮.১ বছর দু’জন দু’জনকে চোখের দেখা দেখা হবে। বাকিটা ঘুমে বা চোখের আড়াল। ৩০ বছরের দাম্পত্যে মাত্র ৮.১ বছর? এর নাম যৌথ জীবন? প্রতিদিন যদি ৬ ঘন্টা গড়ে ঘুমাই আর গড়ে ৬০ বছর বাঁচি তবে জীবনের প্রায় ১৫ বছর ঘুমিয়েই কাটিয়ে দেয়া হবে। মানে চার ভাগের একভাগ। কী ভয়ানক অপচয় অসামান্য মূল্যবান ও ওয়ানটাইম মানব জীবনের, তাই না?

পাঁচ;
বদ খাসলত, ভিমরতি, ক্রেজী-যাই বলেন এটাকে, আমার দু’টো নেশা আছে। একটা হল নগরের রাজপথে অগ্যস্ত হাঁটতে বের হওয়া। কোনো টার্গেট নেই, গন্তব্য নেই, উদ্দেশ্য নেই, স্রেফ হাঁটতে থাকা। আরেকটা হল, রাত জাগা। রাত জেগে লেখা, পড়া, মুভি দেখা, আমার খুব ভাগ্য করে পাওয়া দু’রকম চরিত্রের দুই বারান্দায় বসে গভীর রাতের নগরজীবন দেখা। দু’টো নেশারই অপটিমাম লেভেল পর্যন্ত শুষে নিয়েছি যখন ঢাকা বিশ্বঃবিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কাটিয়েছি জীবন। বিশেষ করে শেষ ২ বছরের ক্যাম্পাস/হল জীবনের প্রায় পুরোটাই মনে হয় হেঁটে হেঁটে আর রাত বিরাত জেগেই কাটিয়েছি। একবারতো আসাদগেট হতে হাঁটতে হাঁটতে সাভার হেমায়েতপূর চলে গেছি। আমি আজও মিস করি হেয়ার রোডের সোনালু গাছ, বড় বড় সিরিষ গাছ, মিন্টো রোড, ভূতের গলি, আজিমপুর, মিরপুরের শহরতলী, কমলাপুর স্টেশনে টো টো করে ঘুরে বেড়ানো। আজও সেই নেশা কমেনি। এখনো হুটহাট একেকটা শুক্রবারে বেরিয়ে পড়ি। ওজনে হাতি হয়ে যাওয়া আর একটু কর্পোরেট রক্ত হয়ে যাওয়ায় এখন অবশ্য অতটা পারি না। তবে মিরপুরের রাস্তায় হাঁটতেও মজা লাগে। আমাকে কি হিমু হওয়া রোগে পেয়েছিল? নাহ, তা নয় তবে হুমায়ূনের লেখা গোগ্রাসে যে গিলি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর কোনো না কোনো সময় হিমু হবার সখ যে হয়নি তাও নয়। চাইলেই কি হিমু হওয়া যায়?

ছয়;
আমাকে কেউ একজন বলেছিলেন, আপনি এত অল্প বয়সে এত বুড়া কেন? আপনি এত নৈরাশ্যবাদী কেন? আপনি এত মরাটে কেন? আমার মতো জীবনকে এতটা করে চায়-এমন খুব কম মানুষই হয়তো আছেন। আমার মতো আশা নিয়ে বাঁচছে-এমন খুবই কম পাবেন। আমার মতো বেঁচে থাকার এমন উদগ্র বাসনা আছে-এমন লোক কম পাবেন। তবু এই ভুল ভাবনা কেন? অধিকাংশ সময়ই আমরা মানুষকে নিজের ভাবনার সাথে ট্যালী করে বিচার করি। আমাদের নিজস্ব ভাবনাতে একজন মানুষকে সাইড বাই সাইড রেখে বিচার করি। যদি না মেলে তবেই তাকে একটা নিজস্ব লেবেল দিয়ে দিই। কখনো জ্ঞানী কখনো মূর্খ, কখনো চমৎকার মানুষ কখনো খবিশ, কখনো কঞ্চুস, কখনো দিলদার, কখনো মহামানব আবার কখনো দানব। সবই নিজের নিজের মতো করে। আমরা এই লেবেলড হয়ে যাবার ভয়ে সারাটা জীবন অন্যের জীবনটাকে নিজের জীবন বলে যাপন করি। অন্যের দৃষ্টিভঙ্গীর আয়নায় নিজেকে মিলিয়ে ভেঙে গড়ে নিই। অন্যের মতো করে নিজেকে দেখি। আমার পুরোটাই তো অন্যের। তাহলে আমি কোথায়?

সাত;
আমার ছোটবেলায় আমি প্রচুর বকবক করতাম। মুরব্বী, পাড়ার বড়রা বা বাসার বড় ভাই-বোনরা বলত বাঁচাল। আমি নাকি কথা বলে জ্বালিয়ে মারতাম সবাইকে। একবার তো আম্মা একঘর মেহমানের সামনেই ধমক দেন বেশি বেফাঁস কথা বলার কারনে। আমাকে কথা কম বলিয়ে মানুষ করার জন্য অনেক মানুষই দায়ীত্ব নিয়েছিলেন ছোটবেলায়। বড় হয়ে আমি নিরব হয়ে গেলাম। কথা বলার চেয়ে পৃথিবীকে দেখাতেই আমার বেশি আগ্রহ ছিল। একাডেমী শেষ করলাম। চাকরীতে ঢুকলাম। আমার কম কথা বলার অভ্যাস রয়ে গেল। মিটিং, ব্রিফিং, সেমিনার, গ্রূপ ওয়ার্ক-সবখানে আমি দেখি বেশি, বলি কম। আমার নতুন ব্রত হল-কথা যদি রূপা হয়, নিরবতা তবে স্বর্ণ। তো শুরু হল নতুন করে টিজিং। এবার উল্টো। কথা বলি না। এই বুড়ো বয়সে এসে দেখি কথা বলার চেয়ে আমি কথা বেশি লিখছি। নিজে লিখি। অন্যের লেখায় মন্তব্য করি। অন্যের মন্তব্যে প্রতিমন্তব্য করি। লেখাও তো একরকম বলা, তাই না? এখানে আবার নতুন আরেক হ্যাপা। মন্তব্য করা যাবে তবে সেটা হতে হবে একমাত্র পজিটিভ তথা পক্ষে। যাই লেখা থাকুক, কোনো সমালোচনা নয়, শুধু প্রশংসা করতে হবে। বিশ্লেষনাত্মক মন্তব্য করে বকা খাই। আমি অন্য কারো মন্তব্য কাটি না। কিন্তু আমার মন্তব্যে মানুষ তীব্র প্রতিক্রীয়া জানায়। কারো পোষ্টে মন্তব্য করি। আরেকজন এসে সেই মন্তব্যের জন্য বকা দেয়। পর্যালোচনাকে সমালোচনা, খোলামনে নিজের অনুভুতি বলাকে দম্ভ, খুঁটিনাটি বলে দেয়াকে হীনতা আখ্যা দেয়। দেখছি এখানেও আমি ফেল। জীবনে কথা বলাই শিখলাম না। কথা বলার সত্যিকারের নর্মসটি কী, বলতে পারেন?

আট;
যখন ক্লাস ফাইভ সিক্সে পড়ি, তখন জীবনের লক্ষ্য ছিল বড় হয়ে পাইলট হব। স্কুল শেষ করতে না করতে দেখলাম সায়েন্স খুব কঠিন আর রসকসহীন। চলে গেলাম আর্টসে। ইচ্ছা, শিক্ষক হব। ইউনিভার্সিটিতে সোসাল সায়েন্সে। লক্ষ্য এনজিওতে যাব। সমাজসেবার চুড়ান্ত করব। সরকারী চাকরী ভাল লাগত না, তাই গেলাম বেসরকারী জবে। ভাবলাম টাকা বানাব। এ্ররই মাঝে নানারকম কাজে নিজেকে জড়িয়েছি। যখন যেটা ভাল লেগেছে সেটাতেই নিজেকে ভাল লাগাতে চেয়েছি। জীবনের লক্ষ্য বারবার বদলেছে। এখন লক্ষ্য, জীবনের যত কথা, সব লিখে যাব। রোজ লিখছি। আর লিখছি। ভাবি লেখক হব। সেখানেও হ্যাপা। আজকার আর শুধু লিখতে জানলেই হয় না। বিদ্যাকে ব্রান্ডিং বা মার্কেটিং করাও জানতে হয় লেখককে। সেটা না জানায় নিজেই লিখি, নিজেই পড়ি। পাঠক লেখা খায় না। হতাশ হয়ে মাঝে মাঝে ভাবি, কমেডিয়ান হয়ে গেলে কেমন হয়? সমাজের চোরা স্রোতে গা ভাসানোর সহজ তরিকা কী? এত এত লক্ষ্যের মধ্যে আমার জন্য সঠিক লক্ষ্যটা কী হতে পারত?

নয়;
আমার বাবার বাবার বাড়ি (দাদা বাড়ি) বরিশালের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। সুদীর্ঘকাল সেখানে যাইনি। ঝাপসাভাবে সেই বাড়ির কিছু ছবি মাথায় আছে। কিছুদিন পরপরই সেই বাড়িটিতে যাবার তীব্র ইচ্ছা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বাবা থাকতেও কখনো এই ইচ্ছা জাগেনি। হয়তো বসে আছি, হঠাৎ ফ্ল্যাশব্যাকে তীব্র একটা অনুভুতি হয়, মনে হয় ছুটে যাই এখুনি। আমার গিন্নী এই ব্যাপারটাকে ভয় পায়। তার ধারনা এই টান এবং ইচ্ছাটা যেন কেমন কেমন। তার ধারনা, এতদিন যে ইচ্ছাটা হয়নি হঠাৎ সেই ভুলে যাওয়া স্মৃতির কুহক টান কেমন একটা অশুভ কুচিন্তায় টানছে। আমার কিছু অতি ধর্মপ্রাণ বন্ধু হয়তো বলবেন কুসংস্কার। আর অন্য বন্ধুরা বলবেন বুড়ো চিন্তা। জাগতিক, অজাগতিক ও অতিজাগতিক জগত আমার জ্ঞানের বাইরে। আপনার কী মনে হয়, এটা কি মাটির টান, নাকি বিদায়ের চোরা টান?

দশ;
বিখাউজ নামে একটা শব্দ আছে আঞ্চলিক বাংলাতে। ইংরেজিতে রোবটিক, বোরিং, মনোটোনাস, ডিসগাস্টিং বলে সাহেবী ‍কিছু তকমা আছে। বাংলায় অবশ্য আমরা এত পালিশ ভাষার ধার না ধেরে সোজাসুজি খাচ্চর, খাইশটা, বিখাউজ, বাতুল, আজারিয়া-ইত্যাদি শব্দ দিয়ে রাগ ঝাড়ি। আমি আর আমার পত্নি নিটোল প্রায়ই একটা বিষয় নিয়ে আমাদের কমোন বিষ্ময় প্রকাশ করি। সেটা হল, কেন যেন আমরা যেখানেই থাকি, সেখানকার বাড়িওলা, প্রতিবেশী, আর স্থানীয় দোকানদার বা বাসার দারোয়ান এমনকি বাজারের বাঁধা দোকানীদের সাথে ঠিক জমে ওঠে না। হয়তো দোকানে গিয়েছি বাজার করতে। দোকানী আমাদের পাশে দাড়ানো মহিলাকে নিজের এক্স গার্ল ফ্রেন্ডের খাতির দেখিয়ে রসিয়ে রসিয়ে কথা বলছে। দোকানের তাবৎ জিনিস পারলে তার পায়ের কাছ হাজির করে। দুজনে কী হাসি মুখে শপিং/সেলিং সারছে। কিন্তু আমাদের সাথে তার ছিঁটেফোঁটাও নেই। বাজারের ফর্দ হাতে নিয়ে বোয়াল মাছের মতো হাই তোলে। জিনিস চাইলে এমন মরার মতো তাকায়, ঢিমে তেতালা করে দেয় যেন, তার সম্প্রতি পাইলস সার্জারী হয়েছে। বাসার দারোয়ান সব বাসার ডিমের প্যাকেটটাও পারলে বাসায় পৌছে দেয়, গেটে ঢোকার সময় গেট টেনে খুলে দেয়। অথচ আমাদের দেখলে নিচু হয়ে নখ খোঁটে। প্রতিবেশীদের সাথে মানুষের দেখি গলায় গলায় খাতির। নিয়মিত কলাটা, মুলাটা বিনিময় হয়। সামান্য ভাতুয়া শাক রান্না হলেও এক ভাবি আরেক ভাবিকে না দিয়ে খায় না। কিন্তু আমাদের সাথে বিমাতা। কেন ঘটে এমন? ওই যে বললাম, বিখাউজ। তবে সেটা আমরা না বাকিরা সেটা হল প্রশ্ন। প্রতিবেশি, দোকানদারদের খাতির পাবার জন্য আর যা যা লাগে লাগুক, একটা কমোন জিনিসের ব্যাপক ব্যবহার লাগে-সবার প্রতি মধ্যবয়সী সুন্দরীদের বা সুন্দরীদের প্রতি পুরুষের ঢলে পড়া/গায়ে পড়া বা প্রশ্রয়পূর্ন হাসি আর আদুরে গলা। ওটা পারি না বলেই কি খাতির জমে না? নাকি আমার প্রতিবেশী বা মেটরা আমার বাবার জানাযায় আসেননি- তাদের প্রতি স্বাভাবিক বিতৃষ্ণা ভুলতে না পারার আমার নিজস্ব ব্যর্থতা?

এগারো;
জীবনে সবকিছুতেই আমি লেট লতিফ। স্কুল শুরু করেছি গড়পড়তা সবার চেয়ে দেরীতে। চাকরী পেয়েছি দেরীতে। বিয়ে দেরীতে। চাকরীতে সিরিয়াস হয়েছি দেরীতে। ফেবুতে এসেছি দেরীতে। স্মার্টফোন কিনতেও দেরী। ক্যারিয়ারে ‘প্রতিষ্ঠা’ পেতে দেরী। গাড়ি, বাড়ি কিনে উঠতে দেরী। ফলে চলমান সামাজিক জীবনের অনেক ছন্দময় আনন্দ হতে দূরে। বন্ধুবান্ধবদের সূক্ষ্ন ইয়ার্কি বা জটিল হিউমার বুঝতে দেরী। কখনো কখনো না বুঝে বোকার মতো রিএ্যাক্ট। আ্ড্ডার চলমান ইস্যূ ধরতে দেরী। ফলে আড্ডার মধ্যমনি হয়ে ওঠা হয় না। বন্ধুরা হয়তো জমে গেছে আড্ডায়। আমি অনেকক্ষন পরে খেয়াল করি, আমি শুধু বসেই আছি। কিছু যোগ করতে পারিনি ওই মজমায়। বারোয়ারি আড্ডায় নিজেকে জড়াতে পারি না কখনো। ইনফেরিয়রিটি কমপ্লেক্স কি এটাকেই বলে? জীবনে সবকিছুতেই আমি লেইট। লেইট আর বিরক্তিকর ধরনের মনোটোনাস। একঘেঁয়ে গোঙানীর মতো বোরিং গল্প লিখে চলি দিনের পর দিন, মজার গল্প বা কমেডী লিখে লোক হাসাতে পারি না। ফ্রান্স মানে যে বন্ধু-সেটা বুঝতে আমার অনেকদিন লেগেছে। আমি গোপাল ভাঁড়ের গপ্পের মধ্যেও ইথিকস খুঁজি। মিরাক্কেল দেখে হাসি আসে না, আসে শরম। ১৮+ না রীতিমতো ৩৬+ বয়সে এসেও এডাল্ট গল্প বা জোক শুনতে অস্বস্তি লাগে। বন্ধূদের আড্ডায়ও সেই শিল্প, সাহিত্য, আন্তর্জাতিক রাজনীতি, ব্যবসা, অর্থনীতি মানে যত্তসব ভেজ আইটেমেই খানাপিনা সারি। ইয়ারদের সাথে ননভেজের রেসিপি দিতে পারি না। ফলে স্বভাবতই আড্ডাতে আমি অচল, বিরক্তিকর। সত্যিকারের বয়স তবে কবে শুরু হবে? কবে বড় হব? কবে সবার সাথে মিলে দশজনের একজন হতে পারব?

বারো;
পৃথিবীতে লিগ্যাল ও এথিক্যাল এবং ইলিগ্যাল ও আনএথিক্যাল এই চারটি বিপরীতধর্মী বিষয় আছে। অনেক বিষয় আছে যা লিগ্যাল কিন্তু আনএথিক্যাল। আবার অনেক কাজ ইলিগ্যাল কিন্তু এথিক্যাল। একজন পথশিশু রাস্তায় ক্ষুধার জ্বালায় দোকান হতে একটি বনরুটি চুরি করল। এটিকে কী বলবেন-ইলিগ্যাল বাট ইথিক্যাল নাকি আনইথিক্যাল বাট লিগ্যাল? ’৯০ এর দশক জুড়ে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে রাস্তায় মানুষের আন্দোলন দমাতে পুলিশ গুলি ছুড়েছে, মানুষ মরেছে। পুলিশ রাষ্ট্রীয় কর্মচারী হিসেবে তার উর্দ্ধতনের আদেশে গুলি করেছে। ওই কাজটা কি লিগ্যাল বাট আনএথিক্যাল নাকি লিগ্যাল ও এথিক্যাল? যেই মানুষেরা স্বৈরাচার হটাতে রাস্তায় ঢিল ছুড়েছেন বা গাড়ির গ্লাস ভেঙেছেন তারা কী ধরনের কাজ করেছেন-ইলিগ্যাল বা ইথিক্যাল নাকি ইলিগ্যাল ও আনইথিক্যাল? দুইরকম ভুল আছে-ভুল হওয়া আর......... ভুল করা। একটা হল ভুলক্রমে কোনো কাজ করা যেমন-আমি ভুলে আমার ব্যাগটা ফেলে গেছি। আর আরেকটা হল অন্যায়স্বরুপ কোনো কাজ করা-যেমন-আপনি এতিমের হক নষ্ট করছেন, আপনি ভুল করছেন। হোয়াইট কলার জব ও Blue কলার জব যেমন আছে তেমনি হোয়াইট কলার ক্রাইম ও Blue কলার ক্রাইম আছে। একজন রিক্সাওয়ালা দ্রূত যাবার তাড়ায় রাস্তার ট্রাফিক আইন ভেঙে ডানের রাস্তা দিয়ে গেল। আর একজন সচিব সাহেব শালির বিয়েতে জয়েন করার তাড়ায় তার নিশান জিপ নিয়ে রাস্তার ডানে উল্টো পথে গেল। কোনটা হোয়াইট কলার আর কোনটা Blue কলার ক্রাইম হবে? মাথা ঘুরছে কি?

তেরো;
শেষ কবে আপনি আপনার প্রিয়জনকে বলেছেন, “ভালবাসি”? পূর্ণ উচ্চারনে, স্পষ্ট কন্ঠে, আবেগের প্রগাঢ়তায় শেষ কবে তার হাতটি ছুঁয়েছেন? পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকে কবে দেখেছেন? আপনি কী ভাবছেন আমি প্রেমিকার কথা বলছি? না গো, আমি যেকোনো প্রিয়জনকে মিন করছি। “ভালবাসি” কথাটা কি শুধু প্রেমিকার জন্য? মায়ের জন্য নয়, বাবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, একজন বোন বা ভাই, একজন বন্ধু কি এই কথাটির যোগ্য নয়? শেষ কবে আপনি বারান্দায় দাড়িয়ে রাতের আকাশ দেখেছেন? রাতের প্রগাঢ় অন্ধকারকে চ্যালেঞ্জ জানায় নগরের নিয়ন আলো-এই ঠোকাঠুকি শেষ কবে আগ্রহ ভরে লক্ষ্য করেছেন? আপনার কোটি টাকায় কেনা ফ্ল্যাটের মাষ্টার বেডের একপাশে একটি ছোট মাকড়শা তার সুখের নীড় রচনা করেছে-সেটা কি খেয়াল করেছন? দরজার ফাটলে একদল পিঁপড়া ডিম, ছানাপোনাসহ মহাসুখে বাস করছে আপনার অসুখী টাকায় বানানো অসুখী জীবনের চৌহদ্দির মধ্যেই-সেই সুক্ষ্ম বোধ আপনার আছে কি? সময় কই? জীবনকে যাপন করবার ব্যস্ততা, কর্পোরেটে আরো উপরে সবার উপরে ওঠার ব্যস্ততা, পার্টি, সোসাইটি, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, পরকীয়ার পুঁজদুর্গন্ধ সিরিয়াল, ক্রমবর্ধমান ভুড়িটির চিন্তা, কোষ্ঠকাঠিন্য, নতুন আসা সুন্দরী কলিগের নম্বর যোগাড়ের দুশ্চিন্তা-আমাদের কত কত কাজ,কত ব্যস্ততা। সময় কই?

শেষ ঘুম দেবার আগে ঘুমিয়ে নিন। জীবনকে উপভোগ করুন। পৃথিবী কেউ কারো নয়। আপনি যখন আর কিছু দিতে পারবেন না, তখন কেউ খোঁজ রাখবে না। সারাজীবন অমানুষিক শ্রম দিতে গিয়ে যখন শেষ জীবনে নির্ঘুম জীবন কাটাবেন তখন কেউ রাত জেগে সঙ্গ দেবে না। আরো একটি বছর চলে গেল। এই বছরেই অনেক মেটস, সহকর্মী, মুরব্বী, বন্ধূ, সমবয়সী ছেড়ে গেল পৃথিবী। আমি কবে ছাড়ব তার কোনো নির্দিষ্টতা নেই। তাই রেডি হই এখুনি। জীবনকে সাঁজিয়ে নিই, রাঙিয়ে নিই এখুনি। জীবনকে যাপন করে নিই প্রাণভরে-এখুনি। যা করব আজই। এখুনি। সময় আর নেই পাঞ্জেরী।

সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১:৫২
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×