somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইচ্ছা পূরণের গল্পঃ দ্বিতীয় পর্ব

১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সকাল ১১:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



(প্রথম পর্বঃ view this link)

বিকেলটা সজীবের ওখানে কাটিয়ে সন্ধ্যার আগেভাগেই বাসায় ফিরে এলো মাশুক। মৃন্ময় বা বাবা, কেউ-ই এখনো ফিরে নি। নিজের রুমে এসে ঢোকার সাথে সাথেই কাজের ছেলেটা এসে জানালো, খালাম্মা চা নিয়া বইসা আছেন। আপনেরে যাইতে কইছেন।

এই সময়টার জন্যই অপেক্ষা করছিল ও। মা-ও মোক্ষম সময়টাই বেছে নিয়েছে। বাসায় এখন কেউ-ই নেই! মাশুক মনে মনে একটু প্রস্তুতি নিলো, কথাগুলো গুছিয়ে ফেললো। বিকেলের চা খেলে ওরা সিটিং রুমের লাগোয়া বারান্দাতেই খায়। তাই সরাসরি সেখানেই চলে এলো ও। মা-র পেছনটা দেখা যাচ্ছে। আকাশের দিকে উদাসভাবে তাকিয়ে আছে। বসার ভঙ্গিতে কেমন যেন একটা অসহায়, বিপর্যস্ত ভাব! মাকে এই অবস্থায় দেখে ওর সব চিন্তা-ভাবনা এলোমেলো হয়ে গেল। পেছন থেকে মাকে জড়িয়ে ধরলো ও। কিছুক্ষণ স্তব্ধভাবে বসে থেকে মা বললো, আয়, বোস। চা খাবি।
মাকে ছেড়ে দিয়ে সামনের চেয়ারটাতে বসলো মাশুক। মার হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে চুমুক দিল। নীরবেই দু’জনের চা-পান চললো, কারো মুখেই কোন কথা নেই। তবু নীরবেই যেন মা-ছেলের মধ্যে অনেক কথা হয়ে গেল। অবশেষে মা-ই নীরবতা ভাংলেন।
- তুই জন্মাবার পর থেকে আমি সবসময়, যতোটা সম্ভব তোকে চোখে চোখে রেখেছি। ছোটবেলায় তোর খুব অসুখ হতো, ঘুমের মধ্যে মা মা বলে কাদতিস! আমি সাথে সাথে তোর কাছে ছুটে যেতাম। এখন এতোদুরে যাবি, একা একা থাকবি! অসুখ-বিসুখ হলে কেউ দেখবে না, আর তোর মা ডাকও আমি শুনতে পাবো না। এভাবে থাকা যে আমার জন্য কতো কষ্টের, তা-কি তুই জানিস?
- জানি মা, তোমাকে ছেড়ে থাকতে আমারও কি কম কষ্ট হবে?....মাশুক আর কিছু বলতে পারলো না। ওর গলা ধরে এলো। মার ছলোছলো চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, তুমি যদি যেতে না করো, তাহলে আমি যাবো না।
- তোর বাবা সবসময় আমাকে একটা কথা বলে। যেন মাশুকের কথা শুনতেই পাননি এভাবে বলে চললেন, ছেলের প্রতি মায়াটা একটু কমাও, একটু প্র্যাকটিক্যাল হও। আমিও চেষ্টা করি, কিন্তু পারি না। কি করবো বল? আমি তো পারি না! জানিস, কাল সারারাত আমি একফোটাও ঘুমাইনি। শুধু চিন্তা করেছি, কিভাবে থাকবো? আজ সারাটা দিন এই চিন্তাই করেছি। দুপুরে তোর বাবা ফোন করে বললো, আমাদের এতোটা স্বার্থপর হওয়া বোধহয় ঠিক হবে না। মাশুক এখন বড় হয়েছে, ওর ও তো একটা ইচ্ছা-অনিচ্ছা আছে, তাই না! তাছাড়া আমার এই ব্যবসাটা ঠিকভাবে দেখার জন্যও তো ওর তৈরী হওয়া দরকার। তোর বাবার কথাটা আমি বুঝতে পেরেছি। তোকে আটকাবো না। বাস্তবতা আমাদের সবাইকেই বুঝতে হবে। তুই চিন্তা করিস না, আমি সামলে নেব। যাওয়ার জন্য গোছগাছ শুরু কর। খুব খারাপ লাগলে তোর বাবাকে নিয়ে তোকে দেখতে আসবো। তোর খারাপ লাগলে তুই-ও কিছুদিন এখানে এসে থেকে যাবি। কি, আসবি না?
- অবশ্যই আসবো মা, অবশ্যই আসবো। মাশুক উঠে এসে মাকে আবার জড়িয়ে ধরলো।

বাকী ক’টা দিন যেন চোখের পলকে কেটে গেল। বাসায় গোছগাছ, সজীবের সাথে বিভিন্ন রকমের পরিকল্পনা, অন্যান্য বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে বিদায়ী আড্ডা, একসাথে খাওয়া-দাওয়া হৈ-হুল্লোড় ইত্যাদি ইত্যাদি। এরই মধ্যে আদনান সাহেব দু’টা ব্যাপার মাশুককে জানিয়ে দিলেন। প্রথমতঃ ইউনিভার্সিটির ডর্মে থাকা চলবে না। তাতে পড়াশুনার প্রতি মনোযোগ নষ্ট হবে। দ্বিতীয়তঃ মাশুক যেন ওখানে কোন রকমের কাজ করে টাকা আয়ের চেষ্টা না করে। তাতেও পড়াশুনার ক্ষতি হবে। মাশুক সাধারনতঃ কোন টাকা-পয়সা চায় না, নির্দিষ্ট করে দেয়া হাতখরচেই চলে। সেজন্যেই উনার এই সাবধানতা। লন্ডনে আদনান সাহেবের ব্যবসায়িক পার্টনার এবং ছোটবেলার একমাত্র ঘনিষ্ঠ বন্ধু আছেন, সেলিম আহমেদ। মাশুকও উনাকে খুব ভালোভাবেই চিনে। উনাকে দিয়েই লেস্টার শহরে দুই বেডরুমের একটা ফুল ফার্নিশড এপার্টমেন্ট ভাড়া করে দিলেন যাতে করে সজীব আর ও একসাথে থাকতে পারে। এইচ এস বি সি ব্যাংকে মাশুকের নামে একটা একাউন্ট খুলে বড় ধরনের এমাউন্টও ট্রান্সফার করে দিলেন। কোন কাজে খুত রাখা আদনান সাহেবের চরিত্রের বাইরে। দেখতে দেখতে যাওয়ার দিন ঘনিয়ে এলো। এর মধ্যে ছোট্ট একটা সমস্যা দেখা দিল। সজীবের বাবা একটু অসুস্থ হওয়াতে ও যাওয়াটা সপ্তাহ খানেক পিছিয়ে দিল। এদিকে মাশুক আর দেরী করে মায়া বাড়াতে চায় না, তাই ও যথাসময়েই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। ঠিক হলো, সেলিম সাহেব ওকে হিথ্রোতে রিসিভ করে বাসায় সেট করে দিয়ে আসবেন।

যাত্রা শুরুর কয়েকদিন আগে থেকেই বাসায় দেখা করতে আসা বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের ভীড়ে কেউ আর সেভাবে মন খারাপের সুযোগই পেলো না। মাশুকও হাফ ছেড়ে বাচলো। বিশেষ করে মাকে নিয়ে ও খুবই দুশ্চিন্তায় ছিল।

প্লেনের পেটের ভিতরে ঢুকে নির্দিষ্ট আসনে বসতেই মায়ের ফোন। এটা সেটা বলতে বলতে কখন যে প্লেন ছাড়ার সময় হয়ে এলো ও নিজেও বুঝতে পারেনি। এয়ার হোস্টেসের 'ফোন সুইচ অফ' করার ইঙ্গিতে ওর হুশ হলো। মা, বাবা, মৃন্ময়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, এবং যখনই সম্ভব হবে ওর আপডেট অবশ্য অবশ্যই জানাবে এই প্রতিজ্ঞা করে অবশেষে ফোন ছাড়লো ও। ইতোমধ্যে প্লেন ট্যাক্সিইং করা শুরু করেছে। এরপর একটা লম্বা দৌড় দিয়ে প্লেনখানা যখন আকাশে ডানা মেলে দিল, ঢাকার সাথে, দেশের সাথে ওর শারীরিক সকল বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেল; কতোদিনের জন্য কে জানে? দেশের বাইরে এর আগেও অনেকবার গিয়েছে মাশুক, কিন্তু এইবার; প্রথমবারের মতো ওর মনে হলো যেন গলায় একগাদা কষ্ট আটকে গিয়েছে। বুকের মধ্যে সব হারানোর কেমন যেন একটা হাহাকার! ওর মনে হলো, গলায় আটকানো জমাটবাধা কষ্টগুলো যদি চোখের জল হয়ে বের হয়ে আসতো; কষ্টটা একটু কমতো, হয়তোবা। আবার কবে ও ঢাকায় ওর চিরচেনা পরিবেশে ফেরত আসতে পারবে? ঢাকা কি তখন অনেক বদলে যাবে? নাকি ও নিজেই বদলে যাবে? নিয়তিই ঠিক করে দিবে সেটা!

আর কোন রকমের ঝামেলা ছাড়াই দোহা থেকে প্লেন পরিবর্তন করে হিথ্রোগামী প্লেনে চড়ে বসলো মাশুক। দোহাতে ট্রানজিট লাউন্জে যতোক্ষন বসা ছিল, দেশে কথা বলেছে। বাবা, মা, মৃন্ময়, সজীব সবার সঙ্গেই। হিথ্রোতে যখন ও নামলো, তখন বিকাল ৬টা বাজে। দেশের সাথে সময়ের ব্যাবধান পাচ ঘন্টার, অর্থাৎ দেশে তখন রাত এগারোটা। এয়ারপোর্টের ঘড়ি দেখে সময় পরিবর্তন করে নিলো। ইমিগ্রেশানের কাজ, লাগেজ সংগ্রহ, কাস্টমস; সব ঝামেলা শেষ করে এরাইভ্যাল গেট দিয়ে বাইরে এসে ওর হাসি পেয়ে গেল। সেলিম আংকেল একজন বিশাল বপুর অধিকারী লম্বা চওড়া মানুষ। উনি দু’হাত উপরে তুলে ছোট ছোট লাফ দিচ্ছেন, আর বাবু, বাবু বলে চিৎকার করছেন। বাবু মাশুকের ঘরোয়া নাম। দু’হাত উপরে তোলার ফলে উনার ভুড়ি টি-শার্টের নীচ দিয়ে খানিকটা বেরিয়ে এসেছে, আর লাফানোর তালে তাল রেখে কাপছে! দৌড়ে এসে তিনি মাশুককে জড়িয়ে ধরলেন। শারীরিক কসরতের কারনেই হোক, আর অতিরিক্ত উত্তেজনাতেই হোক মাশুককে ধরে তিনি বেদম হাপাতে লাগলেন। উনার সাপের মতো ফোস ফোস নিঃশ্বাস আর চাপে পিষ্ট হয়ে মাশুকের তখন ছেড়ে দে মা, কেদে বাচি অবস্থা!

- শেষ পর্যন্ত আইসাই পড়লা! কতোদিন পরে তোমারে দেখলাম!! খাড়াও, একটু ভালো কইরা দেইখা লই। উত্তেজনায় ওনার মুখ দিয়ে আন্চলিক ভাষা বেরিয়ে এলো।
- জ্বী আংকেল, আসলাম। আন্টি আসেন নাই? কোন রকমে হাসি চেপে বললো মাশুক।
- না না, সে আইজকা তিনদিন ধইরা খালি রানতেইয়াছে। কি রানতেয়াছে আল্লাহ মালুম! আমারে কয়, তুমি একলাই যাও, বাবুর লাইগা আরেকটা আইটেমের কথা তো ভুইলাই গেছিলাম!! বুঝছোনি অবস্থা ডা!
- কিন্তু আমার জন্য এত্তো রান্নার দরকার কি? আমি তো লেস্টারেই চলে যাবো, তাই না? একটু আশ্চর্য হয়েই মাশুক বললো।
- হ, হাচাই কইছো। আগে গাড়ীতে বহো। যাইতে যাইতে কথা কই।

মাশুককে কিছুটা টেনে-হিচড়ে, কিছুটা প্রায় কোলে করে তিনি গাড়িতে তুললেন।


ফটো ক্রেডিটঃ গুগল।

ইচ্ছা পূরণের গল্পঃ তৃতীয় পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মে, ২০২০ দুপুর ১:৫৩
১৫টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×