
''কাতার এয়ারওয়েজের দোহাগামী যাত্রী সাধারনের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে...'' হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পাবলিক এড্রেস সিস্টেম থেকে ভেসে এলো ঘোষিকার কন্ঠস্বর। মাশুক রহমান উঠে দাড়ালো, তারপর ডিসপ্লে মনিটরে গেট নাম্বারটা দেখে নিয়ে নিশ্চিত হয়ে এগিয়ে গেল ৭ নাম্বার ডিপারচার গেটের দিকে। ওর মনে একইসঙ্গে আনন্দ আর বিষাদ! আনন্দ এই জন্যে যে, শেষপর্যন্ত ও ওর স্বপ্নপূরণের সিড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করলো। আর বিষাদ! এয়ারপোর্টে ওর মা সিঅফ করতে এসে কেদেকেটে যা অবস্থা তৈরী করেছিল তাতে একপর্যায়ে ওর মনে হয়েছিল, কি হবে সবাইকে ছেড়ে দেশের বাইরে গিয়ে! তারচেয়ে দেশেই থাকি, সবার সাথে মিলেমিশে!
মাশুকের দেশের বাইরে পড়তে যাওয়ার পরিকল্পনা বেশ আগে থেকে শুরু হলেও সেটার বহিঃপ্রকাশ হয়েছিল মাত্র মাস দুয়েক আগে, বাসায় ডিনারের টেবিলে। সাধারনতঃ ওদের বাসায় ডিনারে সবাইকে একসাথে পাওয়া মুশকিল! সবাই বলতে মা, বাবা, ও নিজে, আর ওর ছোট বোন মৃন্ময়; এই চারজন আরকি। কিন্তু মাশুক আগেই সবাইকে জানিয়ে রেখেছিল যেন সবাই ডিনারে উপস্থিত থাকে। সেখানেই ও ঘোষণা দিল, ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অফ লেস্টার ওকে ফুল স্কলারশীপ দিয়ে আন্ডারগ্র্যাড কোর্সে এক্সেপ্ট করেছে এবং ও ঠিক করেছে, সেখানেই গ্র্যাজুয়েশান করবে। বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো এই ঘোষণায় একেকজনের প্রতিক্রিয়া হলো একেকরকমের।
ওর বাবা, আদনান রহমান, দেশের একজন বিশিষ্ট শিল্পপতি। অত্যন্ত স্বল্পকথার মানুষ। খেতে খেতেই বললেন, এতোবড় একটা সিদ্ধান্ত তুমি একা একাই নিলে? মৃন্ময় খাওয়া থামিয়ে দিয়ে চোখ বড় বড় করে বললো, বলিস কি ভাইয়া! তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে ঘোষণা করলো, বাবা, আমিও কিন্তু ভাইয়ার মতো দেশের বাইরে পড়তে যাবো। তুমি না করতে পারবে না! আর ওর মা খাওয়া পুরোপুরি থামিয়ে দিয়ে একদৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মাশুক আড়চোখে মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে খাওয়ায় মনোযোগ দিল। বাবা, মৃন্ময় কোনও সমস্যা না, কিন্তু ওর মূল ভয়টা মাকে নিয়ে। একমাত্র মা-ই পারে ওর পরিকল্পনা ভন্ডুল করতে! এরপর আর কেউ কোনও কথা বললো না। চুপচাপ খাওয়া শেষ করে বাবা চলে গেলেন স্টাডী রুমে। মৃন্ময় ওর ঘরে, মা কিচেনে কাজের লোকদেরকে পরদিনের নাস্তার নির্দেশনা দিতে আর মাশুক সিটিং রুমের লাগোয়া বিশাল বারান্দায়। বাসার পরিবেশ কেমন যেন থম ধরে গেল। অথচ এমন দিনে, অর্থাৎ যেদিন ওরা সবাই একসাথে ডিনারে উপস্থিত থাকতে পারে সেদিন বাসায় কেমন একটা উৎসব উৎসব ভাব বিরাজ করে। মাশুকের নিজেকে একটু অপরাধী মনে হলেও আসলে করার খুব বেশী কিছু ছিল না। আজ হোক, কাল হোক, এটা করতেই হতো। তারচেয়ে এই ভালো হয়েছে, হাতে অন্ততঃ বেশকিছুটা দিন পাওয়া যাবে সবকিছু ঠিকঠাক করার জন্য। বোমা ফাটানো হয়ে গেছে, এখন ও ওর মায়ের জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করার পরও যখন মায়ের দেখা মিললো না, তখন কিছুটা আশ্চর্য এবং চিন্তিত হয়েই ও ওর নিজের রুমে চলে এলো। মায়ের চিরাচরিত আচরণের সাথে আজকের প্রতিক্রিয়ার কোন মিল নাই, কোথাও যেন একটা ছন্দপতন হয়েছে।
ফাটাফাটি বড়লোকের ছেলে হলেও মাশুক ওর সমগোত্রীয় অন্যান্য ছেলেদের থেকে চিন্তা এবং ভাবনায় একেবারেই আলাদা। পড়ালেখাতে ও বরাবরই তুখোড়। অন্যান্য ছেলেরা যখন গার্লফ্রেন্ড আর ফেসবুক নিয়ে মাতামাতি করছে, ও তখন ব্লগিং আর পড়াশুনা নিয়েই ব্যস্ত থেকেছে। ওর স্বপ্নগুলোও অন্যদের থেকে আলাদা। ওর প্রধানতম স্বপ্ন হলো বিশ্বের যতো প্রাচীন সভ্যতা আছে, সেগুলো ঘুরে ঘুরে দেখা, সেগুলো সম্পর্কে আদ্যোপান্ত জানা এবং এসব নিয়ে লেখালেখি করা। বাবার সৌজন্যে অল্প কিছুটা দেখা হলেও এখনও প্রচুর বাকী। তবে সমস্যা হলো বাবা-মা’র সাথে এসব জায়গায় ঘুরে খুব একটা তৃপ্তি আসে না। বিদেশে পড়তে গেলেই শুধুমাত্র একা ঘোরাঘুরি করার একটা সুযোগ তৈরী হবে, বাইরে পড়তে যেতে চাওয়ার সেটাও একটা বড় কারন। তাছাড়া, বাবার বিশাল ব্যবসা যেহেতু ভবিষ্যতে ওকেই সামলাতে হবে, তাই পড়ালেখাটা ঠিকমতো চালিয়ে যাওয়াও জরুরী।
মাশুকের আরেকটা শখ বা ইচ্ছা হলো, ভুত, জ্বীন, প্রেতাত্মা বা অশরীরী বলে যদি কিছু থাকে তো তাদের কোন একজনের সাথে কথা বলা, সেই জীবন সম্পর্কে জানা। এ ব্যাপারে ওর কিছু পড়াশুনাও আছে। এদের সাথে সাক্ষাতের আশায় বিভিন্ন কবরস্থান, শ্মশানে গিয়েও রাতের পর রাত একা একা বসে থেকেছে। কিন্তু কপাল মন্দ, এখনও সেরকম কোন কিছুর সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি!
ওর এইসব ইচ্ছা বা পরিকল্পনা, ব্লগিং জগত এবং এ সম্পর্কিত সবকিছু ও শুধুমাত্র একজনের সাথেই শেয়ার করে, ওর এক এবং অদ্বিতীয় বন্ধু সজীব, সজীব রায়হান। ও লেভেল পাশ করার আগে থেকেই ওদের দু’জনের প্ল্যান, ইংল্যান্ডে পড়তে যাওয়া। যদিও টাকা কোন সমস্যা না, তবুও মাশুক মনেপ্রানেই চেয়েছিল একটা ফুলব্রাইট স্কলারশীপ যোগাড় করার। ও লেভেলে চমৎকার রেজাল্টের পর ইংল্যান্ডের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে এপ্লাই করে ও, তারমধ্যে একমাত্র ইউনিভার্সিটি অফ লেস্টারই ওকে ফুল স্কলারশীপ অফার করেছে। ফুল স্কলারশীপ না পেলেও সজীবও একই ইউনিভার্সিটিতেই ভর্তি হচ্ছে।
পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে আদনান সাহেব ছেলেকে জানিয়ে দিলেন, একটার সময় অফিসে চলে আসবে। আমরা একসাথে লান্চ করবো। মায়ের ভাবগতিক আজও সুবিধার ঠেকলো না মাশুকের কাছে। কেমন যেন একটু বেশীই স্বাভাবিক!
ঠিক একটার সময় বাবার রুমের দরজায় তিনবার নক করে ঢুকে পড়লো মাশুক। আদনান সাহেব ছেলের জন্যেই অপেক্ষায় ছিলেন। পাশের ছোট্ট ডাইনিং রুমে খাবার টেবিলে দেয়াই ছিল, ছেলেকে নিয়ে সরাসরি সেখানে চলে গেলেন। ছেলের প্লেটে খাবার তুলে দিতে দিতে বললেন,
- তোমার মায়ের সাথে কোন কথা হয়েছে?
- না বাবা, মা তো এই ব্যাপারে কোন কথাই বলছে না! একটু হতাশ হয়েই মাশুক বললো।
- বলবে। এখন প্রস্তুতিপর্ব চলছে। শোন, তুমি এখন বড় হয়েছো। তোমার সিদ্ধান্ত তুমি নিজেই নেয়ার যে সাহস দেখিয়েছো, সেজন্যে আমি খুশী, খুবই খুশী। তুমি আর দশটা ছেলের মতো নও। পড়াশুনা নিয়ে আমি তোমাকে কখনওই চাপ দেইনি। তারপরও তোমার রেজাল্ট গর্ব করার মতো। আমি নিশ্চিত যে, তুমি ভেবে-চিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছ। আমি কি ঠিক বলছি?
- তুমি ঠিকই বলছো, বাবা। মাশুক বললো।
- আমারও তাই ধারনা। তিল তিল করে গড়ে তোলা আমার এই ব্যবসা আমি নিশ্চিন্তে তোমার হাতে তুলে দিতে চাই। তার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে তোমার এই সিদ্ধান্ত ঠিক আছে, আমার পছন্দ হয়েছে। তবে তোমার মাকে ম্যানেজ করার দায়িত্ব তোমার। এই ব্যাপারে আমি কোন সাহায্য করতে পারবো না। আরেকটা কথা, বলে একটু থামলেন আদনান সাহেব।
- বলো বাবা।
- তোমার সিদ্ধান্ত আমি যেভাবে সহজেই মেনে নিয়েছি, আমারও কিছু সিদ্ধান্ত তোমাকে মেনে নিতে হবে। তেমন বড় কোন ব্যাপার না, ছোটখাটো বিষয়। তারপরও তোমাকে জানিয়ে রাখছি। সময় মতো জানাবো। তবে, সবার আগে তোমার মায়ের সাথে কথা বলো। তার গ্রীন সিগন্যালের পরই এসব ব্যাপারে কথা বলবো। ঠিক আছে?
- ঠিক আছে বাবা।
- আরেকটা কথা তোমাকে বলা হয়নি। আই এ্যাম প্রাউড অফ ইউ, মাই সান!
- থ্যাংক ইউ, বাবা। মাশুকের চোখ একটু ভিজে উঠলো। ও জানে এরচেয়ে বেশী আবেগ দেখানো ওর বাবার পক্ষে সম্ভব না। তবে, যেটুকু দেখান, একেবারে অন্তর থেকেই দেখান। বাবা বাইরে যতোই কাঠিন্যতা দেখান না কেন, ভিতরটা তার একেবারে ফুলের মতোই কোমল, স্পর্শকাতর।
বাবার অফিস থেকে বের হয়েই সজীবকে ফোন করলো মাশুক। খুশীর খবরটা ওকে দিতে তর সইছে না ওর!
ফটো ক্রেডিটঃ গুগল।
ইচ্ছা পূরণের গল্পঃ দ্বিতীয় পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মে, ২০২০ দুপুর ১:৫১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




