৪
পরদিন সকালে স্বয়ং মিসেস বিশপ জাগাতে এলো এলেনরকে। হু হু করে কাঁদছে সে।
‘মিস এলেনর, উনি আর নেই...’
“কী!’ ধড়মড় করে উঠে বসলো এলেনর।
‘আপনার ফুপু ঘুমের মধ্যে মারা গেছেন...’
‘ফুপু মারা গেছেন? বোবার মত চেয়ে রইলো এলেনর। বিশ্বাস করতে পারছে না সে।
‘আঠারো বছর আমি এখানে ছিলাম’, কাঁদতে কাঁদতে বলছে মিসেস বিশপ। ‘মনেই হয় না। দিনগুলো কীভাবে চলে গেলো...’
‘ফুপু মারা গেছেন ঘুমের মাঝে—তার মানে শান্তিতেই। ওনার জন্য আশীর্বাদই হলো।’
‘একদম হঠাৎ করে হলো ঘটনাটা। কেউ ভাবতেও পারেনি।’
‘ঠিক হঠাৎ করে বলা যায় না। উনি বহুদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। একদিক দিয়ে বরং ভালোই হয়েছে। আর যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে না।’
কান্না জড়ানো কণ্ঠে একমত হলো মিসেস বিশপ। ‘মি. রডরিককে খবরটা দেবেন কে?’
‘আমিই দেবো’, বলে ড্রেসিং গাউন চাপিয়ে রডির ঘরে গিয়ে খবরটা দিলো এলেনর।
‘বেচারি চাচী! আমি অবশ্য কৃতজ্ঞ। গতকাল যে অবস্থা দেখলাম, তাতে ভালোই হয়েছে। ওভাবে আর বেশিদিন সহ্য করতে হয়নি।’
‘তুমি কখন দেখলে তাকে?’ এলেনর জিজ্ঞেস করলো।
লজ্জিত কণ্ঠে উত্তর দিলো রডি, ‘আমার খুব খারাপ লাগছিলো, এলেনর। তাই তারে যখন ওই মোটামত নার্সটা গরম পানির বোতল নিয়ে কীসের জন্য যেন রুম থেকে বেরিয়ে গেলো, তখন আমি রুমে গিয়েছিলাম চাচীকে দেখতে। চাচী অবশ্য বুঝতে পারেনি। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পেয়ে আমি বেরিয়ে গেছি তারপর। যা দেখলাম—ভয়াবহ!’
মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো এলেনর।
-
‘কী খুঁজছো, নার্স?’ জিজ্ঞেস করলো নার্স ও’ব্রায়েন।
গতকাল সন্ধ্যায় হলঘরে রেখে যাওয়া নিজের অ্যাটাচি-কেসটা তন্নতন্ন করে খুঁজছে নার্স হপকিন্স। ‘বিরক্তিকর! কোথায় গেলো ওটা?’
‘কী হারিয়েছো?’
‘এলাইজা রাইকিন্স মহিলাকে তো চেনো। তার দিনে-রাতে দুইবার মরফিন ইনজেকশন লাগে। কালকে এখানে আসার আগে তাকে পুরনো বোতলের শেষ ট্যাবলেটটা দিয়ে এসেছিলাম। কসম, নতুন বোতলটা এখানেই ছিলো।’
‘খুঁজে দেখো আরেকবার। বোতলগুলো তো ছোট।’
কেসের সব জিনিস আরেকবার হাতড়ে দেখলো নার্স হপকিন্স। ‘না। নেই এখানে! আমার কাবার্ডেই ফেলে এসেছি নির্ঘাত। মাথা আমার একদম গেছে! আমি নিশ্চিত ওটা এখানেই দেখেছিলাম।’
‘আসার সময় কেসটা কি কোথাও রেখেছিলে?’
‘অবশ্যই না! কেসটা শুধু রেখেছিলাম এই হলেই। এখানের তো কারো কিছু সরানোর কথা না। মনে হয় আমিই ভুলে গেছি। কী যন্ত্রণা, দেখো তো! আবার গ্রামের ওই মাথায় গিয়ে বোতলটা আনা লাগবে!’
‘আশা করি গতকালের পর আজকের দিনটা বেশি ক্লান্তিকর যাবে না তোমার। বেচারি মহিলা। বোঝাই গিয়েছিলো আর বেশিদিন বাঁচবে না। ডাক্তার তো আরও কত আশায় ছিলো!’
‘ডাক্তারের বয়স কম। আমাদের মত অভিজ্ঞতা নেই তার’, বলে বেরিয়ে গেলো নার্স হপকিন্স। ।
-
খবরটা শুনে সোজা উঠে দাঁড়ালো ডা. লর্ড। ভুরু কপালে উঠে প্রায় চুলে গিয়ে মিশেছে তার। অবাক হয়ে বললো, ‘উনি মারাই গেলেন তাহলে?’
‘জ্বি, ডাক্তার সাহেব’। ও’ব্রায়েনের মুখ নিশপিশ করছিলো সব খুলে বলার জন্য, কিন্তু নিজেকে সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো সে।’
এক মুহূর্ত কী যেন ভাবলো ডাক্তার। তারপর বললো, ‘আমাকে একটু ফুটন্ত পানি দাও।’
হাসপাতালের ট্রেনিং আছে নার্সের। তাই নির্দেশ শুনে অবাক হলেও উচ্চবাচ্য না করে ও’ব্রায়েন ছুটে গেলো পানি আনতে।
-
‘আপনি বলতে চাইছেন, চাচী উইল করেনইনি কখনও?’
চশমার কাচ পরিষ্কার করলেন মি. সেডন। ‘তাই তো দেখা যাচ্ছে।’
‘ব্যাপারটা তো অস্বাভাবিক!’
মি. সেডন গলা খাকাড়ি দিলেন। ‘যতটা অস্বাভাবিক ভাবছেন, ততটা না। এমনটা প্রায়ই ঘটে। মানুষ মনে করে তাদের হাতে সময় আছে। তাদের কাছে মনে হয় উইল করা মানে মৃত্যুকে এগিয়ে আনা। অদ্ভুত চিন্তা, কিন্তু এই ব্যাপারটা হয়।’
‘এটা নিয়ে ওনার সাথে কথা বলেননি কখনো?’
‘অনেকবারই বলেছি।’
‘উনি কী বলেছেন?’
‘ওসব কথাই। হাতে সময় আছে... ওনার এখনই মরার ইচ্ছা নেই... কীভাবে সম্পত্তি ভাগ করবেন, সেটা এখনও স্থির করেননি—এসবই।’
‘কিন্তু প্রথম স্ট্রোকের পর তো নিশ্চয়ই—?’ প্রশ্ন করলো এলেনর।
মাথা ঝাঁকিয়ে না বললেন মি. সেডন। ‘তখন তো আরো না। উনি তখন ‘উইল’ শব্দটা শুনতেই নারাজ।’
‘আজব’, বললো রডি।
‘না। অসুস্থতা ওনাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলো।’
বিভ্রান্ত কণ্ঠে বললো এলেনর, ‘কিন্তু উনি তো মরতেই চাইতেন...’
‘মানুষের মন বড়ই বিচিত্র, মিস এলেনর। মিসেস ওয়েলম্যান হয়তো ভেবেছিলেন উনি আর বাঁচতে চান না, কিন্তু একই সাথে নিজের অজান্তেই উনি আশায় বুক বেঁধেছিলেন যে হয়তো সেরে উঠবেন একদিন। প্রতিদিন ভেবেছেন, কালকেই করা যাবে।’
‘এজন্যই রাতে উনি এত অশান্তিতে ছিলেন। এজন্যই তাহলে আপনাকে আসতে জোর করেছিলেন...’ ধীরে ধীরে এলেনর বললো।
‘সেজন্যই’, বললেন মি. সেডন।
‘এখন তাহলে কী হবে?’ রডি জানতে চাইলো।
‘মিসেস ওয়েলম্যানের সম্পত্তির কথা বলছেন?’ বলে কাশি দিলেন উকিল ভদ্রলোক। ‘যেহেতু উনি উইল না করেই মারা গেছেন, কাজেই তার সব সম্পত্তি পাবেন তার সবচেয়ে কাছের আত্মীয়- মিস কার্লাইল।’
‘সব—আমার?’
‘সরকার একটা নির্দিষ্ট অংশ পাবে।’ বিস্তারিত বোঝালেন মি. সেডন। শেষে বললেন, ‘উনি কোনো ট্রাস্ট বা তেমন কিছু করে যাননি যেহেতু, কাজেই সম্পত্তি সরাসরি মিস কার্লাইলের কাছে চলে আসছে। দাফন-কাফন ইত্যাদির খরচ অনেক হবে, কিন্তু সেগুলো বাদেও সম্পত্তির মূল্য মোটেও কম হবে না।’
‘কিন্তু রডরিক—’
ক্ষমা চাওয়ার কণ্ঠে বললেন মি. সেডন, ‘মি. রডরিকের সাথে ওনার রক্তের সম্পর্ক ছিলো না। উনি তো ওনার স্বামীর ভাইপো।’
‘ঠিক’, রডি বললো।
‘কিন্তু তাতে কিছু আসে-যায় না, যেহেতু আমরা দুজন বিয়ে করছি...’ বললো এলেনর। রডির দিকে তাকালো না সে।
‘ঠিক’, একটু দ্রুতই বললেন মি. সেডন।
-
‘কিছুই তো যায় আসে না, তাই না?’ প্রায় মিনতির স্বরে বললো এলেনর। মি. সেডন ততক্ষণে চলে গেছেন।
নার্ভাস স্বরে বললো রডি, ‘টাকাটা তোমারই প্লিজ ভেবো না আমি পাইনি বলে মন খারাপ করছি। টাকাটা চাই না আমি!’
‘লন্ডনে আমরা কী বলেছিলাম, মনে নেই? টাকাটা যে-ই পাক না কেন, ব্যাপার না, কারণ আমরা দুজন বিয়ে করছি...?’
রডি কিছু বললো না।
‘মনে নেই তোমার, রডি?’
‘আচ্ছা’, নিচে তাকিয়ে বললো রডি। তার মুখ সাদা হয়ে আছে। সেখানে বেদনার ছাপ স্পষ্ট।
আচমকা মাথা তুললো এলেনর।
‘এটা কোনো ব্যাপার না, যদি আমরা বিয়ে করি...। সেটা কি হচ্ছে, রডি?
‘কী হচ্ছে?’
‘আমরা দুজন কি বিয়ে করছি?’
‘সেটাই তো জানি।’
রডির কণ্ঠ ভাবলেশহীন। ‘অবশ্যই আমরা বিয়ে করছি। তুমি যদি এখন অন্য কিছু ভেবে থাকো...’
‘সত্যি করে বলো, রডি!’ প্রায় চেঁচিয়ে বললো এলেনর।
রডি শিউরে উঠলো। ‘জানি না আমার কী হয়েছে’, নিচু গলায় বললো সে।
ধরা কণ্ঠে উত্তর দিলো এলেনর, ‘আমি জানি...’
দ্রুত বলে উঠলো রডি, ‘আসলে ভেতরে ভেতরে আমি হয়তো চাই না বউয়ের পয়সা ভেঙে খেতে...’
সাদা হয়ে গেছে এলেনরের মুখ। ‘ব্যাপারটা তা না... ব্যাপারটা আসলে অন্য...’ একটু থামলো সে। ‘মেরি, তাই না?’
দুঃখী গলায় বিড়বিড় করে বললো রডি, ‘মনে হয় সেটাই। তুমি কীভাবে জানলে?’
বাঁকা হাসি দেখা দিলো এলেনরের ঠোঁটের কোণে। ‘একদম সহজ। তুমি যেভাবে ওর দিকে তাকিয়ে থাকো... যে কেউই বুঝে ফেলবে।’
হঠাৎ ভেঙে পড়লো রডি।
‘ওহ, এলেনর— আমি জানি না আমার কী হয়েছে! আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি! ওকে যখন জঙ্গলে প্রথম দেখলাম, তখন থেকেই আমার সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গেছে। তুমি বুঝবে না...’
‘বুঝবো। বলে যাও।’
অসহায় কণ্ঠে বলতে লাগলো রডি, ‘আমি ওর প্রেমে পড়তে চাইনি... তোমার সাথে আমি ভালোই ছিলাম। ওহ, এলেনর! তোমার সাথে আমি কেমন হারামির মত কথা বলছি... তুমি অসাধারণ! তোমাকে আমার খুব ভালো লাগে, এলেনর! বিশ্বাস করো... কিন্তু ও কেমন যেন মায়াজালের মত! আমার জীবনদর্শন— ভালোলাগা-মন্দলাগা— গোছানো জীবন— সবকিছু হযবরল হয়ে গেছে...’
‘ওকে কিছু বলেছো?’ গলাটা একটু কাঁপলো এলেনরের।
‘সকালে আমি— বেকুবের মত—’
‘তারপর?’
‘অবশ্যই ও... আমাকে সাথে সাথে ফিরিয়ে দিয়েছে। ও চমকে গিয়েছিলো। ফুপু— তারপর তোমার কথা ভেবে—’
আঙ্গুল থেকে হীরার আংটিটা খুলে ফেললো এলেনর। ‘তুমি বরং এটা ফেরত নাও।’
আংটিটা নিলো রডি। এলেনরের দিকে না তাকিয়ে সে বললো,
‘নিজের প্রতি আমার কত ঘৃণা হচ্ছে, জানো না তুমি।’
শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো এলেনর, ‘আচ্ছা, ও কি তোমাকে বিয়ে করবে মনে হয়?’
‘জানি না। অনেকদিন পর্যন্ত তো প্রশ্নই আসে না। এখন হয়তো ও আমাকে ভালোবাসে না, কিন্তু একদিন হয়তো...’
‘ঠিক। তোমার উচিত ওকে সময় দেয়া। কিছুদিন ওর সাথে দেখা কোরো না, তারপর... সব নতুন করে শুরু কোরো।’
‘তোমার মত বন্ধু দুনিয়ায় আর একটাও নেই, এলেনর!’ আবেগ উপচে পড়লো রডির কন্ঠে। ‘আমি তোমাকে এখনও আগের মতই ভালোবাসি। মেরিকে কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগে। মনে হয় যেন জেগে উঠে দেখবো ও নেই... ও যদি না থাকতো...’
মনে মনে ভাবলো এলেনর,
‘মেরি যদি না থাকতো...’
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৪:১২