-বাবা ওঠো, সকাল হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে অফিসে যাও। দেরী হয়ে যাবে তাছাড়া।
-আরেকটু ঘুমাই মামনি? আর মাত্র ৫ মিনিট।
-একদম না। ৭ টা বেজে গেছে। এখনই না উঠলে গরম চা মাথায় ঢেলে দেবো।…
অগত্যা ভয় পেয়ে এক প্রকার বাধ্য হয়েই ঘুম থেকে উঠতে হয়। এমনকি এটাই আমার প্রতিদিনের অভ্যাস। সকালবেলাই ওর উষ্ণ হাতের ছোয়ায় ঘুমটা ভাঙ্গে। ৪ বছর বয়সী মেয়েটা আমার খুবই চঞ্চল। আধোবোলে পাকা পাকা কথা বলে। মায়ের কাছ থেকেই শিখেছে কথাগুলো। বিয়ের আগে ওর মাকে নিয়ে যখন ঘুরতে যেতাম, আজব আজব কথা বলে আমাকে নাজেহাল করে ফেলতো।
আমাদের ভালোবাসার ফসল আমাদের ছোট্ট লেডি কুইন। আমার সমস্ত চিন্তা-চেতনা, স্বপ্ন, কাজ, ভালোবাসা আমার মেয়েটিকে ঘিরে। ওর মুখের পাড়ায় তাকালে সমস্ত ক্লান্তি, দুঃখ, কষ্ট ভষ্মিভূত হয়ে যায়। সকালে ওর ডাকে ঘুম থেকে ওঠা, অফিসে গিয়ে ক্ষণ ক্ষণে ওর ফোন রিসিভ করা, মায়ের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ শোনা, এটা এনো সেটা এনো বলে নানান আবদার, কিটক্যাট চকলেট ওর খুবই প্রিয়, এটা আনার জন্য বারে বারে মনে করিয়ে দেয়া... অফিস থেকে ফেরার সাথে সাথে গলাটা জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়া- এগুলো অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে। যতক্ষণ জেগে থাকে ততক্ষণই বাসাটাকে মাতিয়ে তোলে। তার একমাত্র খেলার বস্তু তার বাবা। আমি হয়তো বসে বসে বই পড়ছি, এর মাঝে ও আমার মাথায় ঝুটি করে দেবে.. মুখে মেকাপ লাগিয়ে দেবে…. পায়ের আঙ্গুলে নেইল পালিশ করে দেবে। আর আামার শরীর তো তার কাছে পেইন্টের খাতা বলেই মনে হয়, আমার সারা গায়ে রং ছিটিয়ে আঁকাআঁকি করবে। ওর ব্যস্ততা আমাকে মুগ্ধ করে তোলে। একজন বাবার কাছে সন্তানের কার্যকলাপগুলোর চেয়ে মধুর দৃশ্য আর কী-ই বা হতে পারে। ছুটির দিনে সারাদিন কার্টুন দেখা বা তাকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়া চাই-ই চাই। ঘুরতে যাওয়ার দিন দুপুরে খাওয়ার পর থেকে সাজতে শুরু করে। কী যে সুন্দর লাগে তার আগ্রহ ভরে সাজতে দেখলে..!!! তাকিয়ে থেকে দেখি আর ভাবি, “এই মেয়েটি আমার স্বর্গ, জীবনে অনেক পুণ্য করেছিলাম বলেই এমন একটি মেয়েকে পেয়েছি। মেয়ের খুশিতেই আমার সুখ, মেয়ের চোখের জল আমার সারা দুনিয়ার কষ্ট।
আজ সেই প্রাণচঞ্চল মেয়েটি আমার চোখের সামনে শান্তির ঘুম দিচ্ছে। রাক্ষসী ট্রাক ওকে চিরদিনের জন্য ঘুম পাড়িয়ে দিলো। মেয়ের শরীরে কোনদিন ফুলোর টোকা লাগতে দেই নি, সেই শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো চাকার ঘর্ষণে। যেই বুকে বাবাকে আলিঙ্গন করে শুয়ে থাকার কথা সেই বুকের উপর দিয়ে চলে গেছে সর্বনাশা ট্রাকের চাকা। কত নিষ্ঠুর সেই চাকাগুলো। ও আর জাগবে না কখনো…. সকালে ছোট্ট হাতের ছোয়ায় আমার ঘুম ভাঙ্গবে না আর। আমার পকেটে এখনো কিটক্যাটের প্যাকেটটা শব্দ করে তার অস্তিত্ব বোঝাচ্ছে কিন্তু যার জন্য কেনা সে আর কখনো পকেট হাতড়ে বলবে না, “বাবা, আমার কিটট্যাট এনেছো?” অফিস থেকে ফিরেই আর সেই ক্লান্তি দূর করা শ্রীমুখটি দেখতে পাবো না….. ভুল করে হয়তো মাঝে মাঝে খেলনা কিনে নিয়ে আসবো, কিন্তু খেলার মানুষটা কই??? মামুনী বলে ডাক দিলে সাড়া দেবে না কেউ.. আর কখনো 'বাবা' ডাক শুনতে পাবো না… ছুটির দিনটি কাটবে কীভাবে…..উফফ! আমি আর ভাবতে পারছি না। বেঁচে থাকার সব আগ্রহ চাকার তলায় পিশে গেলো। পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বস্তু নাকি “বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ”। আমি তো সেই ভার নিতে চাই নি কখনো!!! সেই শক্তি আমার নেই.. একদমই নেই। “মামুনী ওঠো… দেখো, তোমার বাবা এতো বড় ভার নিতে পারবে না। তোমার বাবার খুব কষ্ট হবে.. খুব কষ্ট হবে…….।”
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:৫১