আমরা একটা ইংরেজী মুভি দেখছিলাম। বাইবেল। ঈসা মসীহর উপর নাজেলকৃত আসমানী কিতাব ঈঞ্জিল শরীফের কাহিনী নিয়ে বাইবেল মুভিটি তৈরি। আদম ও ঈভের র্স্বগমর্ত্যরে কাহিনী নিয়ে মুভিটি শুরু হলেও মুভিটি খোলস ছেড়েছে নূহ'র জীবনীকালে এসে। নূহ'র প্লাবনের কথা আমাদের মোটামুটি সবারই জানা। কয়েক হাজার বছর ধরে চলে আসা এই গল্প এখন কেচ্ছায় পরিণত হয়েছে। চল্লিশ দিন ধরে অবিরাম বৃষ্টিপাত! আর সে কী প্লাবন! সমস্ত পৃথিবী যেন পানিতে ভাসছে। তার মাঝে বিচিত্র প্রাণীসব নিয়ে নূহের নৌকা। অর্পূব! আমরা তন্ময় হয়ে দেখছিলাম।
আমি আর আমার সঙ্গিনী। আমরা দুই বছর ধরে একসঙ্গে আছি। আমদের চারপাশে এতবেশি দেয়াল, লোকনিন্দা, ভয়, সমাজ- ক্রমশ আমাদের সংকোচিত করে ফেললে আমরা রিফ্রেশমেন্ট-এর জন্য এখানে চলে আসি। বেশ নিরিবিলি একটা বাড়ি। আসলে এটা কোন বাড়ি নয়। এটা একটা স্কুল ঘর। চারতলা বিল্ডিং-এর এই নিচতলাটা বাচ্চাদের স্কুল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। উপরের ফ্যাটে স্কুলের পরিচালক থাকেন। বছর তিনেক ধরে আমি তার আশ্রিত। এই শহরেই আমার বাবা মা থাকলেও আমি তার আশ্রয়ে থাকতেই বেশি স্বছন্দ্য বোধ করি। দুপুরের পর স্কুল ছুটি হয়ে যায়। আর এই সময়েই আমি আমার সঙ্গিনীকে নিয়ে এখানে আসি। প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন মুভি আমরা দেখি। মুভি দেখতে দেখতেই আমরা স্বপ্ন বিনিময় করি।
বেশ লম্বা সময় নিয়ে তৈরি মুভিটি। নূহ’র ভূমিকায় অভিনয় করেছেন যিনি (নামটা অবশ্য জানা হয়নি)- চাপ দাড়ি সমেত, মোটা বস্ত্র পরিহিত- তিনি অনবদ্য ফুটিয়ে তুলেছেন চরিত্রটি। তো প্লাবনের পর হঠাৎ আমরা খেয়াল করলাম মুভিতে একটা অদৃশ্য আওয়াজ হচ্ছে- নোয়া! নোয়া! অপূর্ব মায়াবী সে আওয়াজ! আর নূহকে দেখলাম কেমন ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বাতাসে কান পাতছে। মনে পড়লো প্লাবনের আগেও এরকম একবার হয়েছিল। তখনও আমরা জানি না নূহকেই ডাকা হচ্ছে নোয়া বলে। এইবার বুঝতে পারলাম ঈশ্বর নূহকে ডাকছে নোয়া বলে। ঈশ্বর যখন নূহকে ডাকে তখন নূহ'র মুখটা কেমন বোকা বোকা শিশু শিশু হয়ে যায়। দেখতে আমার খুবই ভালো লাগে। দেখলাম আমার সঙ্গিনীর ও ঐ মুর্হূতটা খুব পছন্দ। আমি সঙ্গিনীর দিকে তাকালাম। তোমাকেও আমি এখন থেকে 'নোয়া' বলে ডাকবো। সে তৎক্ষনাত রাজি এবং কয়েকটা আনন্দের অভিব্যক্তি ঘটালো।
এরপর যখনই আমি তাকে 'নোয়া' বলে ডাকি সে ঠিক নূহর মতো শূন্যে কান পাতে। শিশুর মতো ভাব করে। আমার ভারি আনন্দ হয়। একদিন আমরা দু’জনে মিলে ঠিক করি- আমাদের কন্যার নাম হবে নোয়া। সেই থেকে আমি নোয়ার বাবা। ওকে ডাকি নোয়ার মা বলে। প্রতিদিন একটু একটু করে বড় হয় আমাদের নোয়া। আমরা কোথাও বাইরে বেড়াতে গেলে ও আমাকে তাগাদা দেয় তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে কিন্তু, বাসায় নোয়া একা। আমি হাসি। হাসতে হাসতেই নোয়া বড় হয়। আমার প্রথম কন্যার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা স্বপ্নের ভিতর।
নোয়া একটু একটু করে বড় হয়ে উঠতে লাগলো। ওর শরীরের গঠন কাঠামোর সাথে চেতন কাঠামোও স্পষ্ট হতে লাগলো। নোয়া মুখের আদল পেয়েছে ওর মা’র। নাকটা একটু চ্যাপ্টা। গোলগাল মুখ। ছোট ছোট হাতের আঙুল। আবার আমার মতো অল্পতেই রেগে যায়। কোন ব্যাপারে আনন্দিত হলে তার প্রকাশ ঘটে একটু বাড়াবাড়ি রকমের উল্লাসের ভেতর দিয়ে। ওর মা প্রতিদিন দুপুরে ওকে সময় করে গোসল করায়, খেতে দেয়, ঘুম পাড়িয়ে আমার জন্য অপো করে। আমি একটু জোরে শব্দ করলেই ও আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়- নোয়া ঘুমুচ্ছে, আস্তে কথা বলো, জেগে যাবে তো। ওর জন্য আমি নানা রকম খেলনা নিয়ে আসি। আমার সঙ্গিনী সেগুলো ঘরময় ছড়িয়ে রাখে, নোয়াকে নিয়ে নিজেই খেলতে বসে। নোয়া একটু একটু দুষ্টুমি করতে শিখেছে। ওর মা’র কাজের সময় সে পিছন থেকে মা’র গলায় ঝুলে পড়ে। বেশি দুষ্টুমি করলে সঙ্গিনী ওকে শাসায় - নোয়া, এরকম করতে হয়না। পরণেই আবার মোলায়েম গলায় বলে- এই সমাজে মেয়েদের একটু সাবধানে চলতে হয়রে, মা ; নোয়া ফোকলা দাঁতে হাসে। ওকি আর এত কিছু বোঝে? হামাগুড়ি দিয়ে আমার বুকে এসে ঝাপিয়ে পড়ে। কারন নোয়া জানে শত ঝামেলা করলেও বাপি ওকে কিছু বলবে না। পরণই আমার সঙ্গিনী নোয়ার পাশে এসে বলে, এখন যদি নোয়ার কিছু হয়ে যায় তাহলে আমি বাঁচবো না। বিশ্বাস করো, নোয়াকে ছাড়া এখন আমার রাতে ঘুমই হয় না।
দিনে দিনে নোয়ার বয়স তিন হলো। ততদিনে আমাদের পারস্পরিক আদরে অনেকটাই ভাগ বসিয়েছে নোয়া। একদিন আমার সঙ্গিনী বললো-'এই শোন, এবার কিন্তু নোয়াকে স্কুলে ভর্তি করে দিতে হবে'। আমি হেসে ফেললাম, 'এতটুকুন মেয়ে! এখনি কী স্কুলে দেবে?' ওর জোর আব্দারে বললাম, ' ঠিক আছে, আগামী বছরেই ওকে স্কুলে ভর্তি করে দেব। দিন যায়। নোয়া ক্রমেই আমাদের মাঝে রক্ত মাংসময় হয়ে ওঠে। নোয়ার মা'র সাথে আমার কখনো মনোমালিন্য হলে, সে নোয়ার উপর রাগ ঝাড়ে। কখনো বা আমিই সঙ্গিনীর প্রতি অভিমানবশত নোয়াকে নিয়ে একাই বেড়াতে যাই। ডিসেম্বরের ১৩ তারিখ নোয়া চার বৎসরে পা রাখলো। জানুয়ারিতে আমরা নোয়াকে নার্সারিতে ভর্তি করে দিয়ে এলাম। নোয়ার স্কুল খরচ মেটানোর জন্য আমাকে তখন একটু বেশি পরিশ্রম করতে হয়। ফলে দিনের বেলায় সঙ্গিনীর প্রতি এতোটা মনোযোগ দেওয়া হয়না। সেও রুষ্ঠ না। সকালে আমি একটা কোচিং সেন্টারে পড়াতে যাই। ও সারাদিন নোয়াকে নিয়েই থাকে।
মে মাসের ১৩ তারিখ করে নোয়ার মা’র সাথে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। লোকচুর অন্তরালে, সমাজের শত চোখ রাঙানি উপো করে আমরা ছিলাম ছয় বছর একত্রে। এই ছয় স্বপ্নের যে বাড়ি আমরা তৈরি করেছিলাম আপাত দৃষ্টিতে তার কোন ভিটে ছিলে না। কিন্তু এই ভিটেহীন বাড়ি পরীক্ষিতভাবে সামাল দিয়েছে অনেক ঝড়। মানুষ যত রহস্যের আধার তার চেয়ে রহস্যময় মানুষের জীবন। আর মানুষের সম্পর্ক সে এক অন্তহীন রহস্যের অকূল পাথার। আমি তার কতটুকু বুঝি? তাহলে কোন সাহসে আজ বলি তার চলে যাওয়ার কারণ? সুখ? না! আমিতো জানি চরম অসুখেও সে আমার পাশে ছিলো। যে ঝগড়া থেকে সে চলে যায় এরকম ঝগড়া আমরা প্রতিদিনই করতাম। অনেক সময় আমরা ইচ্ছে করেই করতাম। কোনদিন কোন কারণে ঝগড়া নাহলে সন্ধ্যায় আমরা একজন আরেকজনকে বলতাম, আজ আমাদের কী কাজটা যেন করা হয় নি? তারপরও খুব সামান্য একটা বিষয় নিয়ে অভিমান, রাগ তারপর খুব দ্রুতই ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। জীবনে কতকিছুই না হয়! নোয়া রইল আমার কাছে। কে জানে আমাদের এই স্বপ্নের কন্যাটিকে সাথে করে সেও নিয়ে গিয়েছিলো কি না? সঙ্গিনী চলে যাওয়াতে আমি কতটা বিরহে, কতকটা অপমানে অনেকটাই কাতর হয়ে পড়েছিলাম। সেই কাতর দিনগুলোতে আমাকে অনেকটাই নির্ভার করেছিলো পুরনো দিনের এক বান্ধবী। আমাদের পাড়াতেই থাকত সে, ফলে আমার র্সাবণিক দেখ ভাল করতে শুরু করলো। কাতরতা কেটে গেলে একদিন আমি তাকে সময় করে নোয়ার কথাটা বলি। ও তো হেসেই উড়িয়ে দিলো ব্যাপারটা। আমি তাকে সিরিয়াসলি বুঝাতে চেষ্টা করলাম যে, ব্যাপারটা শুধুই কল্পনার নয়, স্বপ্নের নয়। নোয়া এখন রক্ত মাংসময় মানুষ, তার বয়স সাড়ে চার, সে নার্সারীতে পড়ে এবং প্রতিতিরাতে মাকে কাছে পাওয়ার জন্য আমার কাছে মিনতি করে। এখন আমি ওকে মা এনে দেই কোত্থেকে? আমার গলা ধরে এলো। সম্ভবত চোখে পানিও এসে পড়ছিলো। আমার চোখের পানি ওকে প্রভাবিত করে। ও নোয়ার দায়িত্ব নিতে রাজি হয়। নোয়ারও দেখলাম আমার বান্ধবীকে বেশ পছন্দ। আন্টিকে কাছে পেলে ও মা'র কথা ভুলে যায়। সেদিন থেকে নোয়া আন্টির বাড়িতে থাকে। পরদিন সকাল হতেই আমি বান্ধবীর বাড়ীতে যাই। গিয়ে দেখি ওদের দু'জনের বেশ ভাব হয়েছে। রাতে একটুও কাঁদে নি । আগে যাকে আন্টি ডাকতো এখন তাকে দিব্যি 'ছোট মা' বলে ডাকতে শুরু করেছে।
বান্ধবীর স্বামী আবার থাকতো অন্য শহরে। খুব ঘন ঘন আসা হতো না তার। মাঝে মাঝে আসতো। আমার অবশ্য জানা ছিলো না ওর স্বামী বেচারা আমার প্রতি কিছুটা জেলাস ফিল করে। বেচারার আর দোষ কী? নিজের স্ত্রীকে এভাবে অন্যের সেবায় পড়ে থাকতে দেখলে কার না রাগ হয়? বেচারা স্ত্রী-অন্ত প্রাণ, স্ত্রীকে কষ্ট দিতে চায়নি, ফলে সমস্ত রাগ গিয়ে পড়েছে আমার উপর। ভদ্রলোক অবশ্য আমাকে কিছু বলে নি। আমার সাথে বেশ হাসি খুশি আন্তরিক ব্যবহারই করেন। তার রাগের গল্পটি আমাকে বলেছে বান্ধবী।
একদিন নোয়া আমাকে বলে, 'জানো বাবা, ছোট মা না আমাকে বলেছে আঙ্কেলকে বাবা ডাকতে। তুমি ছোট মাকে বলে দিয়ো আমি আঙ্কেলকে বাবা ডাকতে পারবো না। ' শুনে তো আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। বান্ধবীকে জিজ্ঞেস করতেই বললো, 'এটা আমি নোয়ার নিরাপত্তার জন্য করেছি। তা নাহলে তো ও নোয়াকে আমার কাছে রাখতে দেবে না।''তাই বলে ও আরেকজনকে বাবা ডাকবে?'' আমি নোয়াকে নিজের কাছে নিয়ে এলাম। সেই রাতে আমি অনেকক্ষণ ভেবেছি। নিজেকে বারবার বুঝিয়েছি, নোয়া আমার মনের একটা অসুখ মাত্র। নোয়া বলে আসলে কিছু নেই। একটা স্বপ্ন, একটা ব্যার্থ কল্পনা। একে বয়ে বেড়ানোর কিছু নেই।
সকাল হতেই মনে হলো আমি কি গত রাতে একটা খুন করে ফেলেছি? আমি একটা খুনি- এই বোধ আমার ভেতরে ক্রমশ ডালপালা ছড়াতে লাগলো। একটা খুনীর অবয়ব নিয়ে আমি উদভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। ভয়ংকর রকমের একটা তাড়না আমাকে তাড়িয়ে ফিরতে লাগল। আমি একটা খুনী। আমি একটা রক্ত মাংসময় জ্যান্ত মানুষকে খুন করে ফেলেছি, যে কিনা- আমারই সন্তান। তারও পূর্বে আমরা দু’জনে মিলে আরো একবার খুন করেছিলাম নোয়াকে। নোয়া, মা আমার, আমাদের মা করো। বেঁচে থাকলে তুমি আজ কত বড় হতে ?
এই ঘোর, এই মায়া কাটতে আমার অনেকদিন লেগেছিলো। তবুও মাঝে মাঝেই এখনও আমার সেই অনাগত কন্যাটি আমাকে আক্রমন করে, স্মৃতিভারাতুর করে তোলে। যখন বিছানায় আমার দু'টি ফুটফুটে কন্যা হাসে, লুটোপুটি খায়, মেঝেতে আমার সাথে ছোড়াছুড়ি খেলে আমি তখন হঠাৎ আনমনা হয়ে যাই। এদের মুখের ভিতর নোয়ার মুখ খুঁজি। এদের কোনটা নোয়ার মতো দেখতে? একটা অতৃপ্তি ভর করে না।
না। এদের ভেতর কোনটাই নোয়ার মত নয়।