.
--আচ্ছা জল ভাই,এই দিঘীটা আপনার এত
প্রিয় কেন?
কথাটা জিগ্গাস জলের চাচাতো ভাই
নীলয়।
জল কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে
থাকে।কারন এই প্রশ্নের উত্তর তার
জানা নেই।
প্রায় দশ বছর পর আজ জল এই দিঘীর পাড়ে
আসলো।দিঘীর শান বাধানো ঘাটটা
এখন সেই রকমই আছে।তবে শ্যাওলা পড়ে
কিছুটা পিছলা হয়ে গেছে।নীল
পানিটা এখন কালো আকার ধারন
করছে।দিঘীর পাড়ের ইয়া বড় পাকড়
গাছটাও দাড়িয়ে আছে।তবে বয়সের
ভাড়ে কিছুটা দাড়ি গোফ
গজিয়েছে।ঘাটের পারে বেন্ঞ্বটা
একটু ভেঙ্গে গেছে।এই বেন্ঞ্ব,এই
দিঘী,দিঘীর জল,পাকড় গাছটা একসময়
ছিলো প্রানউচ্ছল।এখানেই সে প্রথম
রাত্রিকে দেখে।
.
আজ দশ বছর পর সে গ্রামে এসে সে
প্রথমেই এই দিঘীর পাড়ে চলে এসেছে।
রাত্রি আর কেউ না।একসময় এই
মেয়েটাকে জল খুব ভালবাসতো।এখন মন
প্রান দিয়ে ভালবাসে।মেয়েটা ওকে
ভালবাসে নাকি ও জানে না।তবুও
দশবছর আগেকার সেই স্মৃতিটুকু জল পরম
যত্নে তুলে রেখেছে মনের মনি
কোঠায়।আচ্ছা ওর কি বিয়ে হয়ে
গেছে।ভুলে গেছে জলকে।জল ভাবতে
থাকে।চলে যায় দশ বছর অতীতে......
(1)
জলের বাবারা দুই ভাই।জলের আব্বু বড়।
জলের আব্বু থাকে ঢাকায় আর জলের
ছোট চাচা থাকে গ্রামে।ছোট
চাচার বিয়ে উপলক্ষে জল গ্রামে
আসে।ওর চাচাতো বোনের নাম
সিনথিয়া।গ্রাম বরাবরই জলকে
টানতো।তাই একটু আগেই চলে আসে
গ্রামে।ছোট থেকেই ওর ছবি তোলা
আর ছবি আকার উপর দারুন ঝোক।অবশর
সময়ে ছবি একে আর বাইরে বের হলে
ছবি তুলেই সময় পার করে দেই।কোন সুন্দর
দৃশ্য পেলেই ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দি
করে নেই।
.
গ্রামে এসে দিনে ছবি তুলে আর
রাতে আড্ডা দিয়েই চলে যাচ্ছিলো।
একদিন ছবি তুলতে তুলতে ও এটা দিঘীর
পারে চলে আসে।সাথে সাথেই সে
মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শান
বাধানো দিঘীটার দিকে।দিঘী আর
তার চারপাশের পরিবেশ একদম
পরিষ্কার আর সৌন্দর্যে পরিপূর্ন।তাই
জল গ্যাট গ্যাট করে ছবি তুলে
নিচ্ছিলো।হঠাৎ ক্যামেরার লেন্সে
একটা মেয়ের ছবি ভেসে উঠলো।
দিঘীর শান্ত জলে হাটু ডুবিয়ে বসে
আছে।ক্যামেরা থেকে চোখ তুলে সে
মেয়েটার দিকে ভাল করে তাকাল।
জল তার ক্যানভাসে যে ছবিটা তার
কল্পনা দিয়ে একে ছিলো এই
মেয়েটার সাথে তার হুবহু মিল।এত মিল
দেখে ও একটু আবাকই হলো।জল দেখলো
পাশে কিছু কাপড়।হয়ত গোসল করতে
এসেছে।মেয়েটা জলকে দেখেই
দৌড়ে কোথায় যেন চলে যায়।জল আর
খুজে পায় না।ভেবেছে এটা মনে হয়
মনের ভুল।
(2)
রাতে সবার সাথে জল গল্প করছিলো।
হঠাৎ দেখে সেই মেয়েটা সিনথিয়ার
সাথে গল্প করছে একটু দুরে বসে।জল উঠে
সেখানে গেলো।গিয়ে সরাসরি বলল,
--আপনি কি তখন আমাকে দেখে ভয়
পেয়েছিলেন?
এমন আকস্মিক প্রশ্ন শুনে মেয়েটা মনে
হলো ঘাবরে গেছে।হয়ত জলকে এভাবে
কখন প্রত্যাশা করেনি।সিনথিয়া বলে
উঠল,
--তুই কি ওকে চিনিস?
--আমি চিনবো কিভাবে?বিকেলে ওই
দিঘীর পাড়ে গেছিলাম।দেখি ইনি
বসে আছেন?আমাকে দেখে এমন দৌড়
দিল যে আমি আর খুজেই পেলাম না।
সিনথিয়া হাসতে হাসতে ফেটে
পড়তে লাগলো।বলল,আই তোদের পরিচয়
করিয়ে দেই।
জল জানতে পারলো মেয়েটার নাম
রাত্রি।সিনথিয়ার ক্লাসমেট।ও
রাত্রিকে বলল,
--আপনার নামটা কিন্তু খুব সুন্দর।ঠিক
আপনার মতোই।
রাত্রিও মিনমিন গলায় বলল,
--আপনার নামটাও অনেক সুন্দর আর অদ্ভুদ।
জল কারো নাম হয় নাকি?
জল লক্ষ্য করলো লজ্জায় ওর মুখ লাল হয়ে
গেছে।কথা বলার সময় গলাটা কাপছে।
জল ভাবলো,মেয়েটা কি এখনো
আমাকে দেখে ভয় পাচ্ছে।আমি বাঘ
না তেলাপোকা।রুমে গিয়ে আয়না
দেখে সিওর হতে হবে একটু।
(3)
রাত্রির সাথে জলের একটা ভাল সম্পর্ক
হয়ে গেলো।জল প্রথমে ভেবেছিলো
যে ও শান্ত একটা মেয়ে।কিন্তু এখন
বুঝলো কি পরিমান চন্ঞ্বল।জল রাত্রির
সাথে সারা গ্রাম ঘুরতে লাগলো।
রাত্রি নিজেই ঘুরাতে লাগলো।এটা
গ্রাম হলেও আধুনিকতার ছোয়া একটু
লেগেছিলো।তাই কেউ তেমন কিছু
মনে করতো না।জল ওর সাথে কথা
বলতো আর ছবি তুলতো।কিন্তু রাত্রির
ছবি তুলতে চাইলে তুলতে দিতনা
রাত্রি।
.
জল কখন যে রাত্রিকে ভালবেসে
ফেলেছে নিজেই বুঝতে পারে নি।
ভালবাসা গুলো খুব সহজেই তৈরি হয়ে
যায়।আবার খুব সহজেই চলে যায়।জল তার
মনের ক্যানভাসে রংতুলি দিয়ে
নিজের মত করে আকিয়ে নিয়েছে
রাত্রিকে।বসন্তের কোন এক হিমশীতল
দমকা বাতাস এসে জল কে জাগিয়ে
কানে কানে ভালবাসি বলে যায়।
শিরদ্বারা বেয়ে অনুভুতির চমক খেলে
যায়।উঠানের উপর ঘুরে বেড়ানো নাম
না জানা পাখিটা ডানা ঝাপটিয়ে
মনের পরতে পরতে জমে থাকা
ভালবাসা নিলীমার রঙ্গে মিশিয়ে
দিয়ে যায়।
(4)
সিনথিয়ার বিয়ে হয়ে শুশুর বাড়ি চলে
গেলো।জলেরও চলে যাবার সময় হয়ে
গেলো।এ কথা ভেবেই ওর মন অস্তির
হয়ে উঠে।যেভাবেই হোক রাত্রিকে
জানাতেই হবে।ঢাকা যাবার দুই দিন
আগে জল রাত্রিকে তার মনের
অব্যাক্ত কথাগুলো বলে।রাত্রিকে
কিছু বলে না।চুপ করে থাকে চলে
গেলো জলকে একলা রেখে।তারপরের
দিনও ওকে দেখা গেলো না।
নিজেকে খুব অপরাধী ভাবে জল।কি
দরকার ছিলো বলার।নিজের মধ্যে
রেখে না হয় একটু দগ্ধিত হত।তবুও রাত্রি
কষ্ট পেতো না।কিন্তু জল যে
নিরোপায়।
.
জল যেদিন চলে যাবে সেদিনও দেখা
পেল না।জল মনে মনে ভাবলো,তবে কি
রাত্রি আমাকে ভালবাসে নি?খুব
কষ্টভরা একটা চিঠি লিখে নীলয়কে
দিয়ে রাত্রির কাছে পাঠিয়ে
দিলো।তারপর ও ঢাকায় চলে আসলো।
একরাশ স্মৃতি আর এক আকাশ ভালবাসা
ফেলে আসলো।ঢাকায় আসার পর জলের
বাবা ওকে আমেরিকায় পড়ালেখার
করার জন্য পাঠিয়ে দেয়।
.
তারপর দীর্ঘ দশটি বছর কেটে যায়।
ভাবতে ভাবতে কখন যে চোঁখ দিয়ে
পানি বের হয়ে গেছে জল নিজেয়
বুঝতে পারে নি।
(5)
--কি জল ভাই বললে না?
নীলয়ের কথায় বাস্তবে ফিরে আসে।
অস্ফুট গলায় বলে,কিছু না।এমনিতেই
ভাল লাগে।
দিঘীর পাড় থেকে উঠে জল নীলয়ের
সাথে রাত্রিদের বাড়িতে যায়।জল
বাড়ি চিনে না।তাই নীলয়ের সাথে
যায়।ওর কাছ থেকে জানতে পারে;
রাত্রির বিয়ে হয়েছিলো।দুইবছর আগে
স্বামী মারা যায়।এই খবরে রাত্রির
বাবাও নাকি হার্ট এটার্কে মারা
যায়।রাত্রি শুশুর বাড়ি থেকে চলে
এসে মায়ের সাথে থাকে।রাত্রির
একটা ছোট মেয়ে আছে।নাম নীলা।
.
রাত্রির মায়ের সাথে কথা বলে জল
রাত্রির রুমে যায়।দেখে রাত্রি
ঘুমুচ্ছে তার মেয়েটাকে নিয়ে।জল
মনে মনে ভাবলো,রাত্রি কি আমাকে
চিনতে পারবে?নাকি ভুলে গেছে?
না ও আমাকে ঠিকই পারবে।
জলের ঘরে ঢোকার শব্দে রাত্রি
তাকাতেই জলকে দেখতে পেল।
জলের দিকে অনেকক্ষন তাকিয়ে
থেকে অবাক আর বিষ্ময়ের সুরে
বলল,জল!!
--চিনতে পারছো তাইলে?
--কি মনে করে এসেছো?
--এমনি।কেমন আছো?
রাত্রি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
--ভালই আছি।এত দিন কোথায় ছিলে?
--সে অনেক কথা।পরে একসময়
শোনাবো।
হঠাৎ রাত্রি রেগে বলল,
--তো কি জন্য এসেছো?কেমন আছা
সেটা দেখতে।অনেক ভাল আছি।খুব
সুখে আছি।চারদেয়ালের মাঝে
খাচায় বন্দি পাখির মত ডানা
ঝাপটিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে মিথ্যা
মুক্তির আশ্বাস নিয়ে সুখেই আছি।
জল নরম গলায় বলল,
--এসেছি তোমায় নিতে।তোমার
মেয়ের পিতা হতে।
--দয়া,করুনা দেখাতে চাও?
--না।ভালবাসা দেখাতে চাই।
এই বলে জল রুম থেকে বের হয়ে আসলো।
পিছনে রাত্রি অবাক হয়ে বসে
থাকে।
.
জল বাসায় এসে ছোট চাচাকে বলে
যে সে রাত্রিকে বিয়ে করবে।একটু
ইতস্ত করলেও জলের জেদের কাছে সে
হার মেনে রাজি হয়ে যায়।ওর ছোট
চাচা সেই দিনই প্রস্তাব নিয়ে যায়।
জল মনে মনে ভাবে,ভালবাসা কত
বিচিত্র।মানে না কোন হার,পরাজয়
অথবা দুঃখ।সবকিছু ছাপিয়ে সে একসময়
জেগে উঠে।ভালবাসা আসে মনের
গভির হ্রদ থেকে।আর মন তো অবিনশ্বর।
ক্ষনে ক্ষনে নিজের রং পাল্টালেও
কিছু কিছু মানুষের জন্য এটা নিদিষ্ট
রং ঠিকই থেকে যায়।যে রঙ্গের তুলি
দিয়ে মনের পাতলা ক্যানভাসে একে
রাখে তার ছবি।
(6)
তার দুইদিন পরে।জল সকালে শুয়ে পড়ে
একটা বই নিয়ে পড়ছিলো।হঠাৎ নীলয়
দৌড়ে এসে হাপাতে লাগলো।
--কিরে কি হয়ছে?এমন হাপাচ্ছির
কেন?
--জল ভাই সর্বনাশ হয়ে গেছে।
--কি সর্বনাশ হয়ছে?
--রাত্রি ভাবি গলায় দড়ি দিয়ে
আত্তহত্যা করেছে...................
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে আগস্ট, ২০১৫ সকাল ১০:০৩